আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৪০)-দিদি আমাকে ঋণী করে গেছেন by আলী যাকের

মা চলে যাওয়ার পর দিদি সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি বাচ্চাদের নিয়ে আমাদের সঙ্গে থাকবেন। অন্তত কিছুদিন। তাঁর স্বামী এটা মেনে নিলেন। তিনি তখন ময়মনসিংহে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মাসখানেকের মধ্যে দিদি অতি স্বচ্ছন্দে এবং আমাদের কাউকে বুঝতে না দিয়ে আমাদের জীবনে মায়ের জায়গায় নিজের আসন করে নিলেন।


দিদিকে আমাদের সবার মাঝখানে রেখে সন্ধ্যাবেলায় আড্ডা মারতে এত ভালো লাগত যে কী বলব! আর দিদিও হৈহৈ করে আমাদের সদ্য মাতৃবিয়োগের দুঃখ তাড়াতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু দুঃখের একটা ব্যাপার আছে। অনেকটা জীবনানন্দের ভাষায়, অনেকটা অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে। দিনের সব জাগতিক কাজের শেষে যখন বিছানায় আশ্রয় নিই, তখন যেন এক বিষণ্নতার চাদর পা থেকে মাথা অবধি ঢেকে দেয়। বুকের ভেতরে অস্থির ভাব, যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কেবলই মায়ের ছবি ভাসে করোটির ভেতরে। এ রকম এক রাতে বিছানায় শুইতে গেছি। হঠাৎ মনে হলো, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিছুতেই নিশ্বাস নিতে পারছি না। চিৎকার করার চেষ্টা করলাম, কণ্ঠ দিয়ে গোঙানির মতো কিছু একটা বেরোল। সেটাই বাড়ির সবার কানে পেঁৗছেছিল এবং তারা দৌড়ে এল। আমাদের পাড়ায় থাকতেন ডা. ওয়াহিদ। তাঁকে খবর দেওয়া হলো। তিনি এসে আমার রক্তচাপ পরীক্ষা করে দেখলেন তা অত্যন্ত চড়া। তখন আমার বয়স কুড়ি। ওই বয়সে উচ্চ রক্তচাপ অত্যন্ত ভয়াবহ ব্যাপার। পরদিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ডা. রবকে নিয়ে আসা হলো। তিনি বললেন, নার্ভাস ব্রেকডাউন থেকে এ রকম হয়েছে। তিনি আরো বললেন, আমার ওজন কমাতে হবে। এখন এ কথাটি আর আমার কাছে নতুন কিছু নয়। সেই সময় থেকে শুরু করে জীবনের বর্তমান সময় পর্যন্ত ডাক্তারদের এই পরামর্শ শুনতে শুনতে জীবন তো প্রায় শেষই করে আনলাম। অতঃপর কুড়ি বছর বয়সেই মোটামুটি একটা নিয়ন্ত্রিত জীবনের মধ্যে প্রবেশ করতে হলো। খাওয়াদাওয়া কমাতে হলো এবং নিয়মিত ওষুধপত্র খাওয়া শুরু হয়ে গেল। সেই থেকে ওষুধ আমার পেছন ছাড়েনি। দিদি সে সময় আমাকে মায়ের মতো আগলে রেখেছিলেন। এই অসুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরীক্ষাও আমার দেওয়া হলো না।
যাহোক, দিদি আমাদের মন ভালো করার জন্য নানা রকম মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করতেন। বাসায় বিশেষ খাবারদাবার ছাড়াও তখনকার ঢাকার বিভিন্ন বিখ্যাত রেস্টুরেন্টে যাওয়া হতো। কোথায় ভালো কাবাব পাওয়া যায় কিংবা কোথায় চিংড়ি কাটলেট_এ সবই ছিল দিদির নখদর্পণে। তাঁরই অনুপ্রেরণায় আমরা নারায়ণগঞ্জে নদীর ধারে 'বোস কেবিন' বলে একটা বাঙালি মধ্যবিত্ত রেস্তোরাঁ আবিষ্কার করি। এই বোস কেবিনে অতি উপাদেয় চিকেন কাটলেট তৈরি হতো। এটিকে কোনো এক অদৃশ্য কারণে তাঁরা বলতেন 'ফাউল কাটলেট'। এই শব্দটির আভিধানিক অর্থ এমতো///// ইঙ্গিত করে যে হয়তো বা এই নামটি খাদ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো সংস্কার থেকে উঠে এসেছিল। সে যা-ই হোক, বোস কেবিনের ফাউল কাটলেট ছিল অতি উপাদেয় খাবার। এই দোকানে তখন চিংড়ি কাটলেটও তৈরি হতো। এখন নারায়ণগঞ্জবাসীর আর সেই কথা মনে নেই। এখন গোব্দাগাব্দা আলুর চপই হয়ে গেছে বোস কেবিনের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের স্টিমার ঘাটে যাওয়ার পথে একটা রেলক্রসিং পড়ে। সেই ক্রসিংয়ের গেটে একটা মিষ্টির দোকান ছিল। নাম 'মিষ্টিমুখ'। দোকানটি নাকি এখনো আছে। সেখানকার নিখুতির লাড্ডুর স্বাদ আমি এখনো ভুলতে পারিনি। নারায়ণগঞ্জের আরো একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল আমাদের কাছে। ছোটবেলায় ঢাকায় আসার পর থেকেই যতবার কলকাতায় যাওয়া হয়েছে, গোয়ালন্দের স্টিমারে, যাত্রা শুরু হয়েছে নারায়ণগঞ্জ থেকে। অতএব আমাদের কাছে নারায়ণগঞ্জের অর্থই হলো, কলকাতায় যাওয়ার প্রথম ধাপ। ওখানে গিয়ে একবার স্টিমারে গোছগাছ করে বসতে পারলে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদী দিয়ে সেই স্টিমার ধীরে ধীরে গোয়ালন্দের দিকে এগিয়ে যায়। গোয়ালন্দ থেকে ঢাকা মেইল নামের একটি ট্রেনে চড়ে কুষ্টিয়া এবং দর্শনা হয়ে কলকাতা।
দিদি অত্যন্ত স্নেহশীল ও মৃদুভাষী মানুষ ছিলেন। কোনো ব্যাপারেই শক্তভাবে আমাদের 'না' বলতে পারতেন না। অনেক আগের একটা ঘটনা প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল। আমার মেট্রিক পরীক্ষার পর দীর্ঘ আড়াই মাস সময় হাতে ছিল। সেই সময়টায় আমি ফরিদপুরে দিদির সঙ্গে থাকতে গিয়েছিলাম। দুলাভাই তখন ফরিদপুরের জেলা কৃষি অফিসার। তখনকার সরকারি নির্বাহীদের বৈষয়িক অবস্থা খুব একটা ভালো হতো না। তবুও দিদি এবং দুলাভাই যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন আমাকে আনন্দ দিতে। অনেক মধুর স্মৃতি আছে আমার ফরিদপুরকে ঘিরে। প্রায় দুই মাস ছিলাম ফরিদপুরে। তার পর যেদিন চলে আসব, বিকেল সাড়ে ৩টায় ফরিদপুরের টেপাখোলা থেকে সদরঘাটের লঞ্চ। রুটি আর আলুভাজা দিয়ে সকালে নাশ্তা করছি। হঠাৎ দিদি জিজ্ঞেস করলেন, 'আজ তো চলে যাচ্ছ। দুপুরে কী খাবে?' হঠাৎ মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এল। বললাম, 'বিরিয়ানি খাব।' দিদি যে কথাটা কত সিরিয়াসলি নিয়েছেন, তা আমি বুঝতেই পারিনি। বেলা ১টায় দিদির ডাক এল, 'খেতে এসো।' টেবিলে গিয়ে দেখি, ডিশে বিরিয়ানি জাতীয় কিছু একটা পরিবেশন করা হয়েছে। আমি দিদিকে জিজ্ঞেস করলাম, 'এটা কী?' তিনি বললেন, 'রাতের গরুর মাংস আর ভাত একটু ঘি দিয়ে ভেজে দিলাম।' বিরিয়ানি তো এত অল্প সময়ে রান্না করা সম্ভব না, তা ছাড়া বাড়িতে বিরিয়ানি রান্না করার মতো রসদও নেই। অতএব, এর চেয়ে ভালো কিছু করা সম্ভব ছিল না। ভাই বিরিয়ানি খেতে চেয়েছে, এটাকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিয়েছিলেন দিদি সেদিন। আমার জন্য এ এক স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা। এই ধরনের নানাবিধ স্নেহময় আপাত নগণ্য কাজের দ্বারা আমার দিদি আমাকে ঋণী করে গেছেন আমৃত্যু। (চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.