ধর্ম-অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কারবালার চেতনা by ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
হিজরি সালের মর্যাদাপূর্ণ মহররম মাসের ১০ তারিখ পবিত্র আশুরা ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল ও ব্যাপক তাৎপর্যময় দিবস। প্রাচীনকাল থেকে যুগে যুগে আশুরা দিবসে বহু গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিবহ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আসমান-জমিন সৃষ্টির কাজ এই দিনেই সম্পন্ন করেন। হজরত আদম (আ.) খলিফা হিসেবে পৃথিবীতে আগমন করেন এবং তাঁর তওবা কবুল হয়। হজরত নূহ (আ.)-এর কিশতি মহাপ্লাবনের কবল থেকে রক্ষা পায়। হজরত দাউদ (আ.)-এর তওবা কবুল হয়।
হজরত মূসা (আ.) ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পান এবং তারা সদলবলে নীলনদে নিমজ্জিত হয়। হজরত ইবরাহিম (আ.) নমরুদের আগুন থেকে নাজাত লাভ করেন। হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। হজরত আইয়ুব (আ.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে সেরে ওঠেন। হজরত ঈসা (আ.)-কে ঊর্ধ্বাকাশে উত্তোলন করার ঘটনাও আশুরার দিনে ঘটেছিল। আশুরা দিবসে কিয়ামত সংঘটিত হবে বলেও বর্ণিত আছে।
ইসলামের ইতিহাসে আশুরা বিভিন্ন ঘটনাপুঞ্জে সমৃদ্ধ থাকলেও সর্বশেষে সংঘটিত কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতই এ দিবসের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য শোকাবহ, মর্মস্পর্শী, হূদয়বিদারক ও বিষাদময় ঘটনা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ/৬১ হিজরি সালে আশুরার দিনেই ইরাকের কুফা নগরের অদূরে ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে মহানবী (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন বিন আলী (রা.) বিশ্বাসঘাতক অত্যাচারী শাসক ইয়াজিদের নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ ও পরিবেষ্টিত হয়ে পরিবার-পরিজন এবং ৭২ জন সঙ্গীসহ নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন। আধিপত্যবাদ, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর সুমহান আদর্শের জন্য আত্মত্যাগের বেদনাবিধুর ও শোকবিহ্বল ঘটনার স্মরণে মুসলমানরা প্রধানত আশুরা পালন করে থাকেন।
আশুরা দিবসে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালায় অন্যায়, অবিচার, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের জন্য রণাঙ্গনে অকুতোভয় লড়াই করে শাহাদত বরণ করেছিলেন। তিনি অসত্য, অধর্ম ও অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বাজি রেখে সপরিবারে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। ইসলামের সুমহান আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য তাঁর এ বিশাল আত্মত্যাগ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তাই সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এবং সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আশুরার মহান শিক্ষা জাতীয় জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে হবে। কারবালার ঘটনা থেকে মানবগোষ্ঠীর জন্য যে শিক্ষা রয়েছে, তন্মধ্যে প্রধান হচ্ছে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) জীবন উৎসর্গ করেছেন, তবু ন্যায়নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। খিলাফতকে রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরে ইয়াজিদের ক্ষমতা দখলের চক্রান্তের প্রতি আনুগত্য স্বীকার না করে তিনি প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হন। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে প্রতিবাদের এক জ্বলন্ত শিক্ষা রেখে গেছেন। কারবালা প্রান্তরে সত্য ও ন্যায়কে চির উন্নত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি সর্বোচ্চ ত্যাগের অতুলনীয় আদর্শ স্থাপন করে গেছেন।
মুসলিম জাহানের কাছে ঐতিহ্যমণ্ডিত আশুরার দিবসকে অত্যাচারী ইয়াজিদ মানুষের জীবনের আনন্দকে হত্যা করে পবিত্রতাকে কলুষিত করতে চেয়েছে। কিন্তু পাষাণ হূদয় সীমারের খঞ্জর হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শিরশ্ছেদ করলেও মানুষের মহত্ত্ব, উদারতা, মহানুভবতা এবং পবিত্র ধ্যান-ধারণাকে হত্যা করতে পারেনি। কারবালার নৃশংস বর্বরতম হত্যাকাণ্ড ক্ষমতালোভী ইয়াজিদের উন্মত্ততার পর শত শত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু এ বিয়োগ বেদনা মুসলমানদের শুধুই শোকে মুহ্যমান করে না বরং সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে, অন্যায়কারীর প্রতি তীব্রতম ধিক্কার বহন করে আত্মত্যাগে সাহসী হতে শাণিত করে। ন্যায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ, এমনকি সত্যের পথে লড়াই করে শাহাদতবরণ বা জীবন উৎসর্গ করে দেওয়ার অপূর্ব দৃষ্টান্তরূপে আশুরা অনাগত যুগ যুগান্তর ধরে সব মানুষের কাছে অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে গণ্য হবে। মাতৃভূমির জন্য যাঁরা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করেন, সে সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বোলো না, বরং তারা জীবিত কিন্তু তোমরা তা বুঝতে পারো না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৫৪)
ঐতিহাসিক ১০ মহররম চিরকাল বিশ্বের নির্যাতিত, অবহেলিত এবং বঞ্চিত মানুষের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ও সোচ্চার হওয়ার দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাবে। এভাবে পৃথিবীতে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে আশুরার দিবসে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদত এক অনন্য, অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। কারবালা ট্র্যাজেডির বদৌলতেই ইসলাম স্বমহিমায় পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। তাই যথার্থই বলা হয়, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর কারবালা কী বাদ’—ইসলাম জীবিত হয় প্রতি কারবালার পর।
প্রকৃতপক্ষে মানবজাতির জন্য অন্যায়কারীর সাময়িক বিজয় ইতিহাসে কোনো দিনই মর্যাদা পায়নি। জালিমের প্রতি মানুষের তীব্র ঘৃণা প্রবল এবং শাহাদতবরণকারী শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও ইতিপূর্বে বিষ প্রয়োগে নিহত হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর প্রতি অপার শ্রদ্ধা-ভক্তি এ দিন পরিলক্ষিত হয়। সত্যের জন্য শাহাদতবরণের এ অনন্য দৃষ্টান্ত সব আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে এর অন্তর্গত ত্যাগ-তিতিক্ষার মাহাত্ম্য তুলে ধরার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ১০ মহররমের ঐতিহাসিক তাৎপর্য। আশুরা শিক্ষা দিয়েছে যে সত্য কখনো অবনত শির হতে জানে না। কারবালা ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণতন্ত্রের সংগ্রাম। ইসলামি আদর্শকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন হজরত ইমাম হোসাইন (রা.); কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে আপস করেননি। জীবনের চেয়ে সত্যের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্য নবী-দৌহিত্রের অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ জগতের ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল ঘটনা। কারবালায় চিরন্তন সত্যের মহাবিজয় হয়েছিল এবং বাতিলের পরাজয় ঘটেছিল। সুতরাং আশুরার দিনে শুধু শোক বা মাতম নয়, প্রতিবাদের সংগ্রামী চেতনা নিয়ে হোক চির সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন লড়াই, প্রয়োজনে আত্মত্যাগ—এটাই মহররমের অন্তর্নিহিত শিক্ষা। কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করাই হোক কারবালার মূলমন্ত্র। আশুরা দিবসে কারবালার ত্যাগের শিক্ষা, অন্যায়ের কাছে মাথানত না করার শিক্ষা আমাদের চিরন্তন আদর্শ ও অনুপ্রেরণা হওয়া উচিত। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা/ ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’
আসুন, জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে আমরা সবাই মিলে কারবালার সুমহান নীতি ও আদর্শের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সব অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, নিপীড়ন ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে দুর্লঙ্ঘ প্রতিরোধ গড়ে তুলি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
ইসলামের ইতিহাসে আশুরা বিভিন্ন ঘটনাপুঞ্জে সমৃদ্ধ থাকলেও সর্বশেষে সংঘটিত কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতই এ দিবসের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য শোকাবহ, মর্মস্পর্শী, হূদয়বিদারক ও বিষাদময় ঘটনা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ/৬১ হিজরি সালে আশুরার দিনেই ইরাকের কুফা নগরের অদূরে ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে মহানবী (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন বিন আলী (রা.) বিশ্বাসঘাতক অত্যাচারী শাসক ইয়াজিদের নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ ও পরিবেষ্টিত হয়ে পরিবার-পরিজন এবং ৭২ জন সঙ্গীসহ নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন। আধিপত্যবাদ, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর সুমহান আদর্শের জন্য আত্মত্যাগের বেদনাবিধুর ও শোকবিহ্বল ঘটনার স্মরণে মুসলমানরা প্রধানত আশুরা পালন করে থাকেন।
আশুরা দিবসে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালায় অন্যায়, অবিচার, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের জন্য রণাঙ্গনে অকুতোভয় লড়াই করে শাহাদত বরণ করেছিলেন। তিনি অসত্য, অধর্ম ও অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বাজি রেখে সপরিবারে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। ইসলামের সুমহান আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য তাঁর এ বিশাল আত্মত্যাগ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তাই সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এবং সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আশুরার মহান শিক্ষা জাতীয় জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে হবে। কারবালার ঘটনা থেকে মানবগোষ্ঠীর জন্য যে শিক্ষা রয়েছে, তন্মধ্যে প্রধান হচ্ছে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) জীবন উৎসর্গ করেছেন, তবু ন্যায়নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। খিলাফতকে রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরে ইয়াজিদের ক্ষমতা দখলের চক্রান্তের প্রতি আনুগত্য স্বীকার না করে তিনি প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হন। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে প্রতিবাদের এক জ্বলন্ত শিক্ষা রেখে গেছেন। কারবালা প্রান্তরে সত্য ও ন্যায়কে চির উন্নত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি সর্বোচ্চ ত্যাগের অতুলনীয় আদর্শ স্থাপন করে গেছেন।
মুসলিম জাহানের কাছে ঐতিহ্যমণ্ডিত আশুরার দিবসকে অত্যাচারী ইয়াজিদ মানুষের জীবনের আনন্দকে হত্যা করে পবিত্রতাকে কলুষিত করতে চেয়েছে। কিন্তু পাষাণ হূদয় সীমারের খঞ্জর হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শিরশ্ছেদ করলেও মানুষের মহত্ত্ব, উদারতা, মহানুভবতা এবং পবিত্র ধ্যান-ধারণাকে হত্যা করতে পারেনি। কারবালার নৃশংস বর্বরতম হত্যাকাণ্ড ক্ষমতালোভী ইয়াজিদের উন্মত্ততার পর শত শত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু এ বিয়োগ বেদনা মুসলমানদের শুধুই শোকে মুহ্যমান করে না বরং সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে, অন্যায়কারীর প্রতি তীব্রতম ধিক্কার বহন করে আত্মত্যাগে সাহসী হতে শাণিত করে। ন্যায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ, এমনকি সত্যের পথে লড়াই করে শাহাদতবরণ বা জীবন উৎসর্গ করে দেওয়ার অপূর্ব দৃষ্টান্তরূপে আশুরা অনাগত যুগ যুগান্তর ধরে সব মানুষের কাছে অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে গণ্য হবে। মাতৃভূমির জন্য যাঁরা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করেন, সে সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বোলো না, বরং তারা জীবিত কিন্তু তোমরা তা বুঝতে পারো না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৫৪)
ঐতিহাসিক ১০ মহররম চিরকাল বিশ্বের নির্যাতিত, অবহেলিত এবং বঞ্চিত মানুষের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ও সোচ্চার হওয়ার দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাবে। এভাবে পৃথিবীতে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে আশুরার দিবসে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদত এক অনন্য, অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। কারবালা ট্র্যাজেডির বদৌলতেই ইসলাম স্বমহিমায় পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। তাই যথার্থই বলা হয়, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর কারবালা কী বাদ’—ইসলাম জীবিত হয় প্রতি কারবালার পর।
প্রকৃতপক্ষে মানবজাতির জন্য অন্যায়কারীর সাময়িক বিজয় ইতিহাসে কোনো দিনই মর্যাদা পায়নি। জালিমের প্রতি মানুষের তীব্র ঘৃণা প্রবল এবং শাহাদতবরণকারী শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও ইতিপূর্বে বিষ প্রয়োগে নিহত হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর প্রতি অপার শ্রদ্ধা-ভক্তি এ দিন পরিলক্ষিত হয়। সত্যের জন্য শাহাদতবরণের এ অনন্য দৃষ্টান্ত সব আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে এর অন্তর্গত ত্যাগ-তিতিক্ষার মাহাত্ম্য তুলে ধরার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ১০ মহররমের ঐতিহাসিক তাৎপর্য। আশুরা শিক্ষা দিয়েছে যে সত্য কখনো অবনত শির হতে জানে না। কারবালা ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণতন্ত্রের সংগ্রাম। ইসলামি আদর্শকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন হজরত ইমাম হোসাইন (রা.); কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে আপস করেননি। জীবনের চেয়ে সত্যের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্য নবী-দৌহিত্রের অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ জগতের ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল ঘটনা। কারবালায় চিরন্তন সত্যের মহাবিজয় হয়েছিল এবং বাতিলের পরাজয় ঘটেছিল। সুতরাং আশুরার দিনে শুধু শোক বা মাতম নয়, প্রতিবাদের সংগ্রামী চেতনা নিয়ে হোক চির সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন লড়াই, প্রয়োজনে আত্মত্যাগ—এটাই মহররমের অন্তর্নিহিত শিক্ষা। কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করাই হোক কারবালার মূলমন্ত্র। আশুরা দিবসে কারবালার ত্যাগের শিক্ষা, অন্যায়ের কাছে মাথানত না করার শিক্ষা আমাদের চিরন্তন আদর্শ ও অনুপ্রেরণা হওয়া উচিত। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা/ ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’
আসুন, জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে আমরা সবাই মিলে কারবালার সুমহান নীতি ও আদর্শের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সব অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, নিপীড়ন ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে দুর্লঙ্ঘ প্রতিরোধ গড়ে তুলি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
No comments