রাজনীতি-গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হবে by আবদুল মান্নান

রিকল্পিত এবং আপাতত ব্যর্থ একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকার উৎখাতের চেষ্টা নিয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে তুলকালাম হচ্ছে। আপাতত শব্দটি এ কারণেই ব্যবহার করতে হলো, এই হীন চেষ্টার এখানেই যে সমাপ্তি হবে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই এবং সব সময় সব হীন চেষ্টা ব্যর্থ না-ও হতে পারে।


একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে দেশে একজন সামরিক শাসক জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসলে দেশ দ্রুতগতিতে পেছনের দিকে যেতে থাকে এবং অচিরেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। ইতিপূর্বে বাংলাদেশ ১৫ বছর সামরিক শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। সেই পাকিস্তানের আইয়ুব খানের সময় থেকে দেখে আসছি, কোনো সামরিক জেনারেল নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করলে রেডিও বা টেলিভিশনের মাধ্যমেই তা দেশের মানুষকে জানানো হয়। আর কোনো অভ্যুত্থানচেষ্টা যদি ব্যর্থ হয়, তা হলে সে সম্পর্কে জনগণ তেমন কিছু জানতে পারে না। তবে এবারের পরিস্থিতি অনেকটা ভিন্ন। খোদ সেনাবাহিনীর শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তারাই অনেকটা নজিরবিহীনভাবে সাংবাদিকদের সেনা সদর দপ্তরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ব্যর্থ অভ্যুত্থান সম্পর্কে জানিয়েছেন। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সেনাবাহিনীর সব সংবাদ বা তথ্য আইএসপিআরের মাধ্যমেই জনগণ জানতে পারে।
একটি গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয় ছাড়া স্বচ্ছতার স্বার্থে সব তথ্য জনগণের সামনে সব সময় উন্মুক্ত থাকা উচিত। সরকার এবং সেনাবাহিনী এবার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাতে হয় এবং আশা করব, এমন পরিবেশ যেন ভবিষ্যতেও বজায় থাকে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এটি মনে করা হয়েছিল, পাকিস্তানি আমলের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে আর কখনো সামরিক অভ্যুত্থান হবে না। যে সেনাবাহিনী একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে গড়ে উঠেছে আর যা-ই হোক, তা কখনো দেশে বৈধ সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করবে না। কিন্তু সেই ভুল ভাঙল তখন, যখন স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছুসংখ্যক চাকরিচ্যুত মাঝারি পর্যায়ের আর কিছুসংখ্যক কর্মরত কর্মকর্তা মিলে বাকি কিছু সেনাকে বিভ্রান্ত করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে খন্দকার মোশতাকের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করল। পাকিস্তানে ইতিপূর্বে একাধিকবার সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে, কিন্তু সব সময় ছিল তা রক্তপাতহীন। বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং সেনা অভ্যুত্থানের তাৎক্ষণিক বেনিফিশিয়ারি মোশতাক হলেও শেষ পর্যন্ত নভেম্বর মাসে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেন জিয়াউর রহমান নিজে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, জিয়াকেও মর্মান্তিকভাবে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে আরেক দল সেনাসদস্যের হাতে প্রাণ হারাতে হয়। এরপর উপরাষ্ট্রপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব বুঝে নেন এবং সময়মতো নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। একদিন তাঁকেও বন্দুকের নলের জোরে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করে রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশবাসীকে সালাম জানান। এরশাদ দীর্ঘ নয় বছর দেশ শাসন ও শোষণ করেন এবং শেষ পর্যন্ত এক দুর্বার গণ-আন্দোলনের মুখে নব্বইয়ের ডিসেম্বর মাসে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করার পর এটি ধারণা করা হয়েছিল, দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার এক নতুন যুগের সূচনা হবে কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য থেকে এখনো অনেক দূরে রয়েছে। এই গন্তব্যে যাওয়ার অনাগ্রহের আলামত দেখা গেল যখন খালেদা জিয়া তাঁর প্রথম শাসনামলে যেকোনো মূল্যে মাগুরা উপনির্বাচনে বিজয়ী হতে চাইলেন। এর ফলে যেটি হলো, নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনের ওপর আস্থা উঠে গেল এবং সেই আস্থা ফিরিয়ে আনার এখনো চেষ্টা চলছে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে আবার সেনাবাহিনী অনভিপ্রেতভাবে সংবাদপত্রের শিরোনাম হলো। শেষতক বিষয়টির একটি সুরাহা হলো সে সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমানের অত্যন্ত সুচিন্তিত হস্তক্ষেপের কারণে। ২০০৭-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে তৎকালীন চারদলীয় সরকারের অপরিণামদর্শী সব পদক্ষেপের ফলে যখন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনই অনিশ্চিত হয়ে গেল এবং দেশ অনেকটা গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছিল, ঠিক তখন আবার সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলে পরিস্থিতির কিছুটা সামাল দেওয়া হয়। এবার সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করলেও বেসামরিক প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করেনি, অনেকটা পর্দার অন্তরালে থেকে হয়তো কিছু কলকাঠি নেড়েছে। জেনারেল মইন যে দেশবাসীকে সালাম দিয়ে একজন জিয়া বা এরশাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি, অন্তত তার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দিতে হয়।
২০০৭-২০০৮, এই দুই বছরের সেনাসমর্থিত উপদেষ্টা সরকার অনেক বিতর্কের মাঝেও একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত মহাজোট সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। ধারণা করা হয়েছিল, এবার বুঝি দেশের রাজনীতিতে কূটচাল, ষড়যন্ত্র আর জোর জবরদস্তিমূলক সব কার্যকলাপের অবসান হবে। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার এখনো অনেক বাকি। দলের ছত্রভঙ্গ অবস্থা থেকে কিছুটা গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার পর বিরোধী দল বিএনপি এখন সরকারের সব ছোট-বড় ব্যর্থতা অথবা কল্পিত ব্যর্থতাকে পুঁজি করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে নানা ধরনের কর্মসূচি দিয়ে ব্যস্ত রেখেছে। তাদের নতুন মিত্র কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেছিলেন, বর্তমান সরকার জুন মাসের (২০১১) আগেই ক্ষমতাচ্যুত হবেন। খালেদা জিয়া বললেন, ‘এই সরকারের মেয়াদ ডিসেম্বর মাসে (২০১১) শেষ।
বর্তমান সরকারের একটি বড় নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল, ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে। বিগত নির্বাচনে প্রায় দেড় কোটি নতুন ভোটার তাদের এই অঙ্গীকারের ওপর আস্থা রেখে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটকে নিরঙ্কুশ সমর্থন জুগিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই বিচারকাজ শুরু হলে তখন বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল থেকে সরকার উৎখাতের নতুন নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়। জামায়াত আন্তর্জাতিক মহলে কোটি কোটি ডলার অর্থ ব্যয়ে একটি লবিস্ট গ্রুপ তৈরি করে, যার বিবরণ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বাংলাদেশ এবং অনেক দেশে নিষিদ্ধ জঙ্গিবাদী সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর এবং এক শ্রেণীর বিতর্কিত বুদ্ধিজীবী। তাদের একটাই উদ্দেশ্য, কীভাবে এই বিচারকাজকে বিতর্কিত করা যায়। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, বিএনপি ও তাদের মিত্ররা সরাসরি যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা না করে বলে, ‘আমরাও বিচার চাই, তবে তা প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের’। তাদের মতে, এখন যাদের বিচার হচ্ছে, তারা প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী নয়। প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের শেখ মুজিব ছেড়ে দিয়েছেন (পাকিস্তানের ১৯৫ জন) যদিও তাদের পুরো ব্যাখ্যাই ভুল।
হিযবুত তাহ্রীর নিষিদ্ধ হলেও তাদের কর্মকাণ্ড মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকেনি। তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অত্যন্ত উসকানিমূলক পোস্টার লিফলেট দিয়ে প্রায়শ ছেয়ে ফেলে। বর্তমানে তাদের এসব পোস্টারের মূল বক্তব্যই হচ্ছে চরম উসকানিমূলক। গত ৯ জানুয়ারি বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া চট্টগ্রামে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। এই ভাষণের আগে সকালে হিযবুত তাহ্রীর তাদের লিফলেটের কপি চট্টগ্রামের সব পত্রিকা অফিসে পৌঁছে দেয়। ভাষা ও বিষয়বস্তু একই। জনসভাস্থলেও এই লিফলেট বিলি করা হয়। এই লিফলেটের অন্যতম বিষয় ছিল, বর্তমান সরকারের আমলে সেনাবাহিনীতে অনেক কর্মকর্তা রহস্যজনকভাবে গুম হচ্ছেন। সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। খালেদা জিয়া তাঁর বক্তব্যেও বিষয়টি তুলে ধরেন। এটি একটি কাকতালীয় ঘটনা হতে পারে। তবে সচেতনভাবে এমন একটি বিষয়ের উল্লেখ করা অনেকটা দায়িত্বজ্ঞানবর্জিত ছিল। এরই মধ্যে কোনো কোনো সংবাদপত্র ও ইন্টারনেট ব্লগ সেনা কর্মকর্তা গুম হওয়ার বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বসহকারে প্রচার করে। সব এক সূত্রে আনলে এটি ধারণা করা যাচ্ছিল যে সেনাবাহিনীকে নিয়ে একটি মহল দেশে একধরনের বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। অনেকগুলো ওয়েবসাইটেও এসব কাজ করা হচ্ছিল। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সরকার এসব বিষয় নিয়ে তেমন বিচলিত ছিল বলে মনে হয় না। যেকোনো ব্যক্তি ব্লগ মনিটর করলেই বলে দিতে পারেন, দেশের ভেতরে ও বাইরে বর্তমান সরকারের প্রতিপক্ষরা কতটা সক্রিয়। যেদিন সেনা সদর দপ্তর সংবাদ সম্মেলন করল, ঠিক সেদিন মধ্যরাতের টক শোতে একজন সাংবাদিক, যিনি কিনা সেই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, পুরো বিষয়টি সম্পর্কে বেশ তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য উপস্থাপন করলেন। সংবাদ সম্মেলনের রাতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন প্রবাসী সাংবাদিক, যিনি নিয়মিত জাময়িত ঘরানার দুটি সংবাদপত্রে কলাম লেখেন, রেডিও তেহরানের বাংলা অনুষ্ঠানে এক সাক্ষাৎকার দিয়ে কিছু সেনাসদস্য যে বাংলাদেশে একটা অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করছিলেন, তার পক্ষে অনেকটা সাফাই গাইলেন। তিনি আরও একটা চরম সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করেন এবং বলেন, বিডিআর ঘটনার পর যেসব সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন, তাঁদের শূন্যস্থান পূরণ করা হচ্ছে আওয়ামীপন্থী ও হিন্দু সেনা কর্মকর্তা দিয়ে। জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন অধ্যাপক যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস পত্রিকাকে বলেন, সামরিক বাহিনীতে অসন্তোষ আছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বলেন, এই ব্যর্থ অভ্যুত্থান হয়তো কোনো একটা কিছু শুরুর আলামত। শেষের জন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সুশীল সমাজের একজন বড় মুখপাত্র ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় অনেক কিছুকেই খুব হালকাভাবে নিতেন এবং তার জন্য জাতিকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। আশা করব, তাঁর কন্যা পিতার মতো তেমন ভুল করবেন না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ যতই সামনের দিকে যেতে থাকবে, ধরে নিতে হবে ততই নানা মাত্রার ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত হবে। সম্প্রতি সেনাবাহিনীতে ঘটে যাওয়া এই অনভিপ্রেত ঘটনা শেষ ঘটনা মনে করলে তা হবে মারাত্মক ভুল। আর শুধু মধ্যম সারির কিছু ব্যক্তি বড় ধরনের কোনো অঘটন ঘটাতে সক্ষম, তা-ও বাস্তবসম্মত নয়। সামরিক-বেসামরিক সবদিকে নজর দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া বাঞ্ছনীয়। অনেকে তো আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটানোর কথা প্রকাশ্যেই বলেন।
সব শেষে সেনাবাহিনী আর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আবারও ধন্যবাদ, তারা যে সময়মতো একটি অঘটন থেকে দেশকে রক্ষা করেছে এবং দেশের মানুষকে আস্থার মধ্য নিয়ে তাদের পুরো বিষয়টা অবহিত করেছে। গণতন্ত্রে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। সব ষড়যন্ত্র রুখতে হবে, গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হবে।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.