শ্রদ্ধাঞ্জলি-বিনম্র মোজাফফর স্যারের উজ্জ্বল স্মৃতি
দর্শনের অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন, যাঁকে আমরা মোজাফফর স্যার বলে ডাকতাম, তাঁর প্রধান কাজ নিয়ে এ লেখা শুরু করা যেতে পারে। জর্জ টমসনের মার্কসিজম অ্যান্ড পোয়েট্রি (Marxism and Poetry) বইটির তিনি অনুবাদক। ফরাসি চিন্তাবিদ আলফ্রেড গিয়োমের ইসলাম গ্রন্থটির অনুবাদও তিনিই বাঙালি পাঠককে উপহার দিয়েছিলেন। সবশেষে ২০০৩ সালে বেরিয়েছিল টমাস হার্ডির উপন্যাস দ্য মেয়র অব ক্যাস্টারব্রিজ-এর অনুবাদ।
ইংরেজি থেকে করা সেসব ছাড়াও তিনি জাতীয় কবির অভিভাষণগুলোর ইংরেজি অনুবাদ Kazi Nazrul Islam:Speeches এবং ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস পরবাস-এর (Parobaas) ইংরেজি ভাষার প্রধান অনুবাদক ছিলেন। ছাত্রদের উপযোগী করে দর্শনকে উপস্থাপন করতেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। লিখেছিলেন গ্রিক দর্শনের রূপরেখা। তবে তাঁর দার্শনিক কলমের গুরুত্বপূর্ণ কাজ আরও কয়েকজন সক্রেটিস। ব্রুনো, হাইপেশিয়া, স্পিনোজা, ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা প্রমুখ যুগসৃষ্টিকারী দার্শনিককে উপস্থাপনের ভেতর দিয়ে মোজাফফর হোসেনের প্র্রগতিশীল চেতনা মূর্ত হয়। মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রকাশ করেন পাতা উল্টাই। দর্শন ও বিজ্ঞান নিয়ে, সমাজ আর সাহিত্য নিয়ে তাঁর ভাবনারাশি লিখিত রূপই আত্মজীবনীমূলক এ গ্রন্থ।
লেখালেখি ছাড়াও সাংগঠনিক কাজ করেছেন নিভৃতে। বিজ্ঞানচেতনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে তরুণদের মধ্যে আধুনিক মনন তৈরি করতে কাজ করেছেন। সুরধুনীর সংগীত অঙ্গনও তাঁর স্মৃতিতে ধন্য। বানিয়েছিলেন বাংলাদেশ লিটারারি রিসোর্স সেন্টার (বিএলআরসি)। ২০০৬ সালের ৩ আগস্ট অনুষ্ঠিত লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হানে-রুথ ঠম্পসনের বক্তৃতার আয়োজক ছিলেন। ২০১০-এর ৩০ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার কোড়কদীর ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে যে আয়োজন করা হয় তার সমন্বয়ক ছিলেন তিনি।
মোজাফফর হোসেন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজে খুব বেশি পরিচিত মানুষ ছিলেন না। বলয়টা তাঁর কেন্দ্রিত ছিল চেনাচিনির ভেতরেই। মফস্বলে কর্মজীবনের সিংহভাগ কাটানোর কারণে ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর খুব বেশি যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। আর তাই, চিন্তাগত এবং আচরণগত উভয় প্রশ্নেই রীতিমতো প্রগতিশীল লেখক ও অনুবাদক মোজাফফর হোসেনকে চেনার সুযোগ ঘটে ওঠেনি অনেকেরই। তাঁর ধী-কে অগ্রভাগে রেখে অনুসরণ করার প্রয়াস নিয়েছিলেন কিছু তরুণ এবং নতুন প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মী।
মোজাফফর হোসেনের দর্শনবোধ সংস্থাপিত ছিল বিজ্ঞানের শক্ত ভিত্তির ওপর। বোধের শক্তি থেকেই তিনি দেখতেন সমাজকে, সমাজের সাহিত্যকে। অর্থাৎ, দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজ ও সাহিত্য মোজাফফর হোসেনের চেতনায় যেমন ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, তেমনি একে অন্যের ভিত্তিতে স্থাপিতও বটে। আর সে কারণেই ধর্মকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার নিরিখে, সংগীতকে তিনি ভালোবেসেছেন কালীন পরিপ্রেক্ষিতে। লক্ষ করার বিষয় এই যে, ঐতিহাসিক দর্শনের সে বিচার ও প্রয়োগে তিনি ছিলেন রসপুষ্ট, কিন্তু মর্যাদাবান। তাঁর এমন প্রয়াসগুলোই তাঁকে সর্বোপরি ‘মানুষ’ হিসেবে উপস্থাপন করেছিল বলে আমাদের বিশ্বাস।
২০১০ সালের ২০ মে আমরা ঘরোয়াভাবে স্যারের ৭৪তম জন্মদিন পালন করি। প্রত্যয় ছিল ৭৫তমটি পালন করব অনেক বেশি সুসংগঠিতভাবে, বৃহত্তর পরিসরে। কিন্তু পরের বছরের ২০ মে আসার আগে থেকেই স্যারের প্রাণ-ভঙ্গুরতা বৃদ্ধি পায়। হাজার উৎসাহ ও চিকিৎসা দিয়েও তাঁকে সজীব রাখা যায়নি। অবশেষে সে বছরের ৭ ডিসেম্বর এই লোক ছেড়ে অন্য কোনো অজানালোকে তিনি প্রস্থান করেন।
স্যারের অনেক কলাম ছাপা হয়েছে কম-চেনা, কম-দামি পত্রিকায়। সেসব খুচরো লেখাতে দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজ, সাহিত্য, ধর্ম বিষয়ে তাঁর ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। বহুল-চেনা, মূল্যবান জায়গাগুলোতে কখনো তিনি ডাক পেয়েছিলেন বলে শুনিনি। সেই ডাক না-পাওয়া লেখকের ওইসব খুচরো কিন্তু মূল্যবান ভাবনাগুলোকে দুই মলাটে বেঁধে তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিএলআরসি অগ্রন্থিত মোজাফফর হোসেন শিরোনামে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রয়াত লেখকের জীবনভাবনাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এ বই খানিকটা হলেও ভূমিকা রাখবে।
সুব্রত কুমার দাস
নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ লিটারারি রিসোর্স সেন্টার (বিএলআরসি)।
লেখালেখি ছাড়াও সাংগঠনিক কাজ করেছেন নিভৃতে। বিজ্ঞানচেতনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে তরুণদের মধ্যে আধুনিক মনন তৈরি করতে কাজ করেছেন। সুরধুনীর সংগীত অঙ্গনও তাঁর স্মৃতিতে ধন্য। বানিয়েছিলেন বাংলাদেশ লিটারারি রিসোর্স সেন্টার (বিএলআরসি)। ২০০৬ সালের ৩ আগস্ট অনুষ্ঠিত লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হানে-রুথ ঠম্পসনের বক্তৃতার আয়োজক ছিলেন। ২০১০-এর ৩০ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার কোড়কদীর ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে যে আয়োজন করা হয় তার সমন্বয়ক ছিলেন তিনি।
মোজাফফর হোসেন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজে খুব বেশি পরিচিত মানুষ ছিলেন না। বলয়টা তাঁর কেন্দ্রিত ছিল চেনাচিনির ভেতরেই। মফস্বলে কর্মজীবনের সিংহভাগ কাটানোর কারণে ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর খুব বেশি যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। আর তাই, চিন্তাগত এবং আচরণগত উভয় প্রশ্নেই রীতিমতো প্রগতিশীল লেখক ও অনুবাদক মোজাফফর হোসেনকে চেনার সুযোগ ঘটে ওঠেনি অনেকেরই। তাঁর ধী-কে অগ্রভাগে রেখে অনুসরণ করার প্রয়াস নিয়েছিলেন কিছু তরুণ এবং নতুন প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মী।
মোজাফফর হোসেনের দর্শনবোধ সংস্থাপিত ছিল বিজ্ঞানের শক্ত ভিত্তির ওপর। বোধের শক্তি থেকেই তিনি দেখতেন সমাজকে, সমাজের সাহিত্যকে। অর্থাৎ, দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজ ও সাহিত্য মোজাফফর হোসেনের চেতনায় যেমন ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, তেমনি একে অন্যের ভিত্তিতে স্থাপিতও বটে। আর সে কারণেই ধর্মকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার নিরিখে, সংগীতকে তিনি ভালোবেসেছেন কালীন পরিপ্রেক্ষিতে। লক্ষ করার বিষয় এই যে, ঐতিহাসিক দর্শনের সে বিচার ও প্রয়োগে তিনি ছিলেন রসপুষ্ট, কিন্তু মর্যাদাবান। তাঁর এমন প্রয়াসগুলোই তাঁকে সর্বোপরি ‘মানুষ’ হিসেবে উপস্থাপন করেছিল বলে আমাদের বিশ্বাস।
২০১০ সালের ২০ মে আমরা ঘরোয়াভাবে স্যারের ৭৪তম জন্মদিন পালন করি। প্রত্যয় ছিল ৭৫তমটি পালন করব অনেক বেশি সুসংগঠিতভাবে, বৃহত্তর পরিসরে। কিন্তু পরের বছরের ২০ মে আসার আগে থেকেই স্যারের প্রাণ-ভঙ্গুরতা বৃদ্ধি পায়। হাজার উৎসাহ ও চিকিৎসা দিয়েও তাঁকে সজীব রাখা যায়নি। অবশেষে সে বছরের ৭ ডিসেম্বর এই লোক ছেড়ে অন্য কোনো অজানালোকে তিনি প্রস্থান করেন।
স্যারের অনেক কলাম ছাপা হয়েছে কম-চেনা, কম-দামি পত্রিকায়। সেসব খুচরো লেখাতে দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজ, সাহিত্য, ধর্ম বিষয়ে তাঁর ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। বহুল-চেনা, মূল্যবান জায়গাগুলোতে কখনো তিনি ডাক পেয়েছিলেন বলে শুনিনি। সেই ডাক না-পাওয়া লেখকের ওইসব খুচরো কিন্তু মূল্যবান ভাবনাগুলোকে দুই মলাটে বেঁধে তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিএলআরসি অগ্রন্থিত মোজাফফর হোসেন শিরোনামে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রয়াত লেখকের জীবনভাবনাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এ বই খানিকটা হলেও ভূমিকা রাখবে।
সুব্রত কুমার দাস
নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ লিটারারি রিসোর্স সেন্টার (বিএলআরসি)।
No comments