বাংলাদেশ কী পেল? by তারেক শামসুর রেহমান
বহুল আলোচিত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে, এই সফর থেকে বাংলাদেশ কী পেল? বাংলাদেশের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হয়েছে? যে উচ্ছ্বাস মনমোহনের সফরকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল, তা এখন মিইয়ে গেছে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। বাংলাদেশি পণ্যের (৪৮০টি) যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার আমরা চেয়েছিলাম, সেখানে আমরা পেয়েছি ৪৬টি পণ্যের, যার সবই গার্মেন্ট পণ্য।
অথচ বাংলাদেশি পণ্য, বিশেষ করে সিমেন্ট, মেলামাইন, গাড়ির ব্যাটারি_এসবের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নেই। সাফটা চুক্তিতে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে সুবিধা পাওয়ার কথা, বাংলাদেশ তা পাচ্ছে না। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আমাদের শঙ্কা অনেক দিনের। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তবে মনমোহন সিংয়ের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি আবারও বলেছেন, ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। এ ধরনের আশ্বাস তিনি আমাদের ২০১০ সালেও দিয়েছিলেন। কিন্তু নর্থ ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশনের চেয়ারম্যান, প্রেমচান্দ পংকজ যখন অতিসম্প্রতি মণিপুরের সাংবাদিকদের কাছে বাঁধ নির্মাণের কথা স্বীকার করেন তখন আমরা এক ধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে থাকি। আসামের মুখ্যমন্ত্রী গগৈ নিজেও স্বীকার করেছিলেন বাঁধ নির্মাণের কথা। তাহলে কার বক্তব্য সত্য? অবশ্যই আমরা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সত্য বলে ধরে নেব। আগামী দিনগুলোই প্রমাণ করবে বাঁধটি আদৌ নির্মিত হবে, কী হবে না। টিপাইমুখ বাঁধ (কিংবা ফুলেরতল ব্যারাজ) যদি নির্মিত হয়, তাহলে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল পানিশূন্য হবে। গ্রীষ্মকালে ৯৪৬ কিলোমিটার এলাকা মরুভূমির মতো শুকনো থাকবে। বাংলাদেশের শঙ্কা এখানেই। এটা আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
আমাদের প্রত্যাশা ছিল, বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁদের একটি উদ্যোগের কথা আমাদের জানাবেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগের কথা আমরা শুনলাম না। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভারতের অনুকূলে। এই ঘাটতি দিন দিন বাড়ছেই, যা আমাদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করেছে। যেখানে ২০০৯-১০ সালে ঘাটতির পরিমাণ ছিল দুই দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার, ২০১০-১১ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে তিন দশমিক ৫০ মিলিয়ন ডলারে। সুতরাং এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তের প্রয়োজন ছিল। তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকার ব্যাপারে একটি সমঝোতা হলেও পত্রপত্রিকায়ই ছাপা হয়েছে ভারতের বিজেপির বিরোধিতার কথা। এখন এ সিদ্ধান্ত কতটুকু কার্যকর হয়, সেটাই দেখার বিষয়।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় যে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা অত্যন্ত সাদামাটা ধরনের। এ জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বাংলাদেশ সফরের প্রয়োজন ছিল না। যেমন বলা যেতে পারে, বাঘ রক্ষার প্রটোকল, সুন্দরবন সুরক্ষা, টেলিভিশন সম্প্রচার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ফ্যাশন টেকনোলজি, মৎস্য খাতে সহযোগিতা, দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি ও জেএনইউ) মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক। এসব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীই যথেষ্ট। মনমোহন সিংয়ের মতো একজন প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসার প্রয়োজন ছিল না। উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তি কিংবা নেপালকে ট্রানজিট দিতে যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, সে ব্যাপারেও কথা রয়েছে। নেপালকে ট্রানজিট দেওয়া সম্পর্কিত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এখন আবার একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলো। এটি কতটুকু কার্যকর হবে, তা রীতিমতো এক প্রশ্ন বটে।
উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ট্রানজিট-সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেনি এবং এতে আমাদের কেউ কেউ উৎসাহিত হতে পারে বটে, কিন্তু উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তিটি যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, পরোক্ষভাবে এতে ট্রানজিটের কথাই বলা হয়েছে। চুক্তিতে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা প্রকারান্তরে ট্রানজিটেরই নামান্তর। উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তিতে বলা হয়েছে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা। বলা হয়েছে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করার কথা, বিশেষ করে সমুদ্রবন্দর। এই চুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। এতে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা-সংক্রান্ত উদ্বেগ দূর করার ব্যাপারে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। প্রয়োজনে ভূখণ্ড ব্যবহার করার সম্ভাবনাও এতে তৈরি হলো। এই চুক্তিকে ভারত অদূর-ভবিষ্যতে তাঁর স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। চুক্তিতে যে ভাষা ও বক্তব্য রয়েছে, তার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আমার ধারণা, ভারতের আমলারা অত্যন্ত সুকৌশলে এ ধরনের 'শব্দ' ও 'বক্তব্য' ব্যবহার করে পরোক্ষভাবে ট্রানজিট আদায় করে নিলেন। কেননা তাঁরা ভালো করে জানেন, সরাসরি ট্রানজিট-সংক্রান্ত কোনো চুক্তি এ দেশের জনগণ মানবে না। বিরোধী দলের প্রচণ্ড আপত্তি রয়েছে ট্রানজিটের ব্যাপারে। উপরন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে ট্রানজিট-সংক্রান্ত একটি চুক্তি করে আওয়ামী লীগকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে চায় না নয়াদিলি্ল। তাই পরোক্ষভাবে তারা ওটা আদায় করে নিল। এ জন্য উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তিটি পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। সংসদে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়াও জরুরি। বিএনপি এখন সংসদে গিয়ে এই চুক্তির ব্যাখ্যা দাবি করতে পারে। এখানে বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কোনো নিরাপত্তা চুক্তি নেই। ১৯৭২ সালের মার্চে স্বাক্ষরিত মৈত্রী চুক্তির (যার ধরন ছিল অনেকটা সামরিক ও চুক্তির ৮, ৯ ও ১০ নম্বর ধারা স্পর্শকাতর) মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর (১৯৯৭) কোনো পক্ষই আর চুক্তির মেয়াদ বাড়ায়নি।
এই চুক্তিতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা এবং ভারত এটিই চায়। ট্রানজিট বা করিডরের যে কথা বলা হয়েছে, সেটা বাহ্যত উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্যই চাওয়া হচ্ছে। ভারত কিন্তু আজই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা চাইছে না। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া বাংলাদেশ সফরের সময় (জানুয়ারি, ১৯৯৭) এটা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয় যে ভারত ও বাংলাদেশ চারটি দেশ নিয়ে (বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপাল) একটি উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনে রাজি হয়েছে। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতাকে তখন বলা হয়েছিল উন্নয়নের চতুর্ভুজ বা ঝড়ঁঃয অংরধহ ৎেড়ঃিয ছঁধফৎধহমষব (ঝঅছে)। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে কাঠমাণ্ডুতে অনুষ্ঠিত চার দেশীয় পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে ঝঅছে গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। ঝঅছে-এ সমগ্র ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যকে। দীর্ঘদিন উন্নয়নের চতুর্ভুজ নিয়ে তেমন কিছু শোনা না গেলেও মনমোহনের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে এ ধারণা আবার সামনে চলে এল।
ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের একটি দিক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য তা একটি শিক্ষাও বটে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণেই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হয়নি। কেননা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে মনে হয়েছে, যে সমঝোতা হয়েছিল (অর্থাৎ পানির ভাগাভাগিতে ভারত পাবে ৫২ শতাংশ, বাংলাদেশ ৪৮ শতাংশ), তাতে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ রক্ষিত হবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরো বেশি পানি চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের জন্য। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে মনমোহন সিং কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করলেন না। ভারতে কেন্দ্রে মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস ইউপিএ সরকারের অন্যতম শরিক। সাতজন মন্ত্রী রয়েছেন কেন্দ্রে তাঁদের। অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা বারবার 'বন্ধু' মনে করেছি। মমতা যখন কেন্দ্রে রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন আমাদের দীপু মনি মমতার জন্য পদ্মার ইলিশ নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ফোন পর্যন্ত করেছিলেন। মমতার বাবা-দাদারা যশোরের সন্তান। কিন্তু মমতা বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ালেন না। দাঁড়ালেন পশ্চিমবঙ্গের জনগণের পক্ষে। কেননা তাঁর কাছে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থটাই বড়। অথচ জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আমাদের মাঝে বিভক্তি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, মনমোহন সিং ঢাকা আসার আগে নয়াদিলি্লতে বিরোধী দলের সিনিয়র নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি, অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এটাই নিয়ম ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। বাংলাদেশের সঙ্গে যেকোনো চুক্তি বা সহযোগিতার ব্যাপারে তাঁর বিরোধী দলের সম্মতি প্রয়োজন। বিরোধী দলের মতামত নিয়েই মনমোহন সিং এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই কাজ আমরা করিনি। ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ব্যাপারে সরকার বিরোধী দলের কোনো মতামত নেয়নি। গঙ্গার পানি চুক্তির সময়ও (১৯৯৬) নেওয়া হয়নি। এখন তিস্তার পানি চুক্তির ব্যাপারেও বিরোধী দলের মতামত নেওয়া হয়নি। তবু বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে দেখা করে যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তা ইতিবাচক। তিনি সরাসরি ভারতবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি। এটি একটি 'পজিটিভ' দিক।
বহুল আলোচিত মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর শেষ হয়েছে। কিন্তু এর রেশ থেকে যাবে। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেটা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মমতার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ককে এ কাজে ব্যবহার করতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গে সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। এ কারণে মমতা তিস্তার ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্ত দিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর তাঁকে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। আমরা ভারতের বন্ধুত্ব চাই। ভারত আমাদের উন্নয়নে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। এ জন্য চাই ভারতীয় নেতাদের উদার মনোভাব। কর্তৃত্ববাদী আচরণ 'ভালো বন্ধুত্বের' পরিচয় দেয় না।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
আমাদের প্রত্যাশা ছিল, বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁদের একটি উদ্যোগের কথা আমাদের জানাবেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগের কথা আমরা শুনলাম না। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভারতের অনুকূলে। এই ঘাটতি দিন দিন বাড়ছেই, যা আমাদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করেছে। যেখানে ২০০৯-১০ সালে ঘাটতির পরিমাণ ছিল দুই দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার, ২০১০-১১ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে তিন দশমিক ৫০ মিলিয়ন ডলারে। সুতরাং এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তের প্রয়োজন ছিল। তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকার ব্যাপারে একটি সমঝোতা হলেও পত্রপত্রিকায়ই ছাপা হয়েছে ভারতের বিজেপির বিরোধিতার কথা। এখন এ সিদ্ধান্ত কতটুকু কার্যকর হয়, সেটাই দেখার বিষয়।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় যে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা অত্যন্ত সাদামাটা ধরনের। এ জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বাংলাদেশ সফরের প্রয়োজন ছিল না। যেমন বলা যেতে পারে, বাঘ রক্ষার প্রটোকল, সুন্দরবন সুরক্ষা, টেলিভিশন সম্প্রচার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ফ্যাশন টেকনোলজি, মৎস্য খাতে সহযোগিতা, দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি ও জেএনইউ) মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক। এসব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীই যথেষ্ট। মনমোহন সিংয়ের মতো একজন প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসার প্রয়োজন ছিল না। উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তি কিংবা নেপালকে ট্রানজিট দিতে যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, সে ব্যাপারেও কথা রয়েছে। নেপালকে ট্রানজিট দেওয়া সম্পর্কিত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এখন আবার একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলো। এটি কতটুকু কার্যকর হবে, তা রীতিমতো এক প্রশ্ন বটে।
উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ট্রানজিট-সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেনি এবং এতে আমাদের কেউ কেউ উৎসাহিত হতে পারে বটে, কিন্তু উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তিটি যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, পরোক্ষভাবে এতে ট্রানজিটের কথাই বলা হয়েছে। চুক্তিতে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা প্রকারান্তরে ট্রানজিটেরই নামান্তর। উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তিতে বলা হয়েছে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা। বলা হয়েছে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করার কথা, বিশেষ করে সমুদ্রবন্দর। এই চুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। এতে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা-সংক্রান্ত উদ্বেগ দূর করার ব্যাপারে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। প্রয়োজনে ভূখণ্ড ব্যবহার করার সম্ভাবনাও এতে তৈরি হলো। এই চুক্তিকে ভারত অদূর-ভবিষ্যতে তাঁর স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। চুক্তিতে যে ভাষা ও বক্তব্য রয়েছে, তার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আমার ধারণা, ভারতের আমলারা অত্যন্ত সুকৌশলে এ ধরনের 'শব্দ' ও 'বক্তব্য' ব্যবহার করে পরোক্ষভাবে ট্রানজিট আদায় করে নিলেন। কেননা তাঁরা ভালো করে জানেন, সরাসরি ট্রানজিট-সংক্রান্ত কোনো চুক্তি এ দেশের জনগণ মানবে না। বিরোধী দলের প্রচণ্ড আপত্তি রয়েছে ট্রানজিটের ব্যাপারে। উপরন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে ট্রানজিট-সংক্রান্ত একটি চুক্তি করে আওয়ামী লীগকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে চায় না নয়াদিলি্ল। তাই পরোক্ষভাবে তারা ওটা আদায় করে নিল। এ জন্য উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তিটি পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। সংসদে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়াও জরুরি। বিএনপি এখন সংসদে গিয়ে এই চুক্তির ব্যাখ্যা দাবি করতে পারে। এখানে বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কোনো নিরাপত্তা চুক্তি নেই। ১৯৭২ সালের মার্চে স্বাক্ষরিত মৈত্রী চুক্তির (যার ধরন ছিল অনেকটা সামরিক ও চুক্তির ৮, ৯ ও ১০ নম্বর ধারা স্পর্শকাতর) মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর (১৯৯৭) কোনো পক্ষই আর চুক্তির মেয়াদ বাড়ায়নি।
এই চুক্তিতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা এবং ভারত এটিই চায়। ট্রানজিট বা করিডরের যে কথা বলা হয়েছে, সেটা বাহ্যত উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্যই চাওয়া হচ্ছে। ভারত কিন্তু আজই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা চাইছে না। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া বাংলাদেশ সফরের সময় (জানুয়ারি, ১৯৯৭) এটা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয় যে ভারত ও বাংলাদেশ চারটি দেশ নিয়ে (বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপাল) একটি উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনে রাজি হয়েছে। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতাকে তখন বলা হয়েছিল উন্নয়নের চতুর্ভুজ বা ঝড়ঁঃয অংরধহ ৎেড়ঃিয ছঁধফৎধহমষব (ঝঅছে)। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে কাঠমাণ্ডুতে অনুষ্ঠিত চার দেশীয় পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে ঝঅছে গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। ঝঅছে-এ সমগ্র ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যকে। দীর্ঘদিন উন্নয়নের চতুর্ভুজ নিয়ে তেমন কিছু শোনা না গেলেও মনমোহনের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে এ ধারণা আবার সামনে চলে এল।
ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের একটি দিক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য তা একটি শিক্ষাও বটে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণেই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হয়নি। কেননা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে মনে হয়েছে, যে সমঝোতা হয়েছিল (অর্থাৎ পানির ভাগাভাগিতে ভারত পাবে ৫২ শতাংশ, বাংলাদেশ ৪৮ শতাংশ), তাতে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ রক্ষিত হবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরো বেশি পানি চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের জন্য। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে মনমোহন সিং কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করলেন না। ভারতে কেন্দ্রে মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস ইউপিএ সরকারের অন্যতম শরিক। সাতজন মন্ত্রী রয়েছেন কেন্দ্রে তাঁদের। অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা বারবার 'বন্ধু' মনে করেছি। মমতা যখন কেন্দ্রে রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন আমাদের দীপু মনি মমতার জন্য পদ্মার ইলিশ নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ফোন পর্যন্ত করেছিলেন। মমতার বাবা-দাদারা যশোরের সন্তান। কিন্তু মমতা বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ালেন না। দাঁড়ালেন পশ্চিমবঙ্গের জনগণের পক্ষে। কেননা তাঁর কাছে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থটাই বড়। অথচ জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আমাদের মাঝে বিভক্তি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, মনমোহন সিং ঢাকা আসার আগে নয়াদিলি্লতে বিরোধী দলের সিনিয়র নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি, অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এটাই নিয়ম ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। বাংলাদেশের সঙ্গে যেকোনো চুক্তি বা সহযোগিতার ব্যাপারে তাঁর বিরোধী দলের সম্মতি প্রয়োজন। বিরোধী দলের মতামত নিয়েই মনমোহন সিং এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই কাজ আমরা করিনি। ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ব্যাপারে সরকার বিরোধী দলের কোনো মতামত নেয়নি। গঙ্গার পানি চুক্তির সময়ও (১৯৯৬) নেওয়া হয়নি। এখন তিস্তার পানি চুক্তির ব্যাপারেও বিরোধী দলের মতামত নেওয়া হয়নি। তবু বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে দেখা করে যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তা ইতিবাচক। তিনি সরাসরি ভারতবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি। এটি একটি 'পজিটিভ' দিক।
বহুল আলোচিত মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর শেষ হয়েছে। কিন্তু এর রেশ থেকে যাবে। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেটা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মমতার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ককে এ কাজে ব্যবহার করতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গে সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। এ কারণে মমতা তিস্তার ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্ত দিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর তাঁকে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। আমরা ভারতের বন্ধুত্ব চাই। ভারত আমাদের উন্নয়নে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। এ জন্য চাই ভারতীয় নেতাদের উদার মনোভাব। কর্তৃত্ববাদী আচরণ 'ভালো বন্ধুত্বের' পরিচয় দেয় না।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments