ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং বর্তমান ছাত্র আন্দোলন-ফিরে দেখা by তোফায়েল আহমেদ
যে ছাত্রলীগ ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে '৭১-এ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিল, সেই ছাত্রলীগের আজকের এই করুণ পরিণতি দেখে আমার দুঃখ হয়, কষ্ট হয়। আমি ভাবতেও পারি না, ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে। ছাত্র নামধারী কিছু লোক ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে আজকে আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানকে যখন কলুষিত করে, দুঃখ-বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
তখন অতীতের দিনগুলোর কথাই বারবার মনে পড়ে যায়। আমি মনে করি, আমরা যারা জাতীয় রাজনীতি করি, আমাদের এখনও কর্তব্য আছে, অতীতে ছাত্রসমাজ বাংলাদেশের মানুষের মণিকোঠায় জায়গা করে যে রাজনৈতিক মূল্যবোধ, যে আদর্শ সৃষ্টি করেছিল_ আজ সেই হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা প্রয়োজন
আজ ২৪ জানুয়ারি, ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান দিবস। বাঙালি জাতির বীরত্ব আর সংগ্রামের ইতিহাসের আরেক উজ্জ্বলতম দিন। ১৯৬৯-এর এই দিনে উত্তাল সংগ্রামের যে দাবানল জ্বলে উঠেছিল তা কখনও মন থেকে মোছা যায় না। ক্ষমতার মদমত্ত অহঙ্কারের পাহাড়ে বসে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান মনে করেছিল, জনগণ বোবা দর্শক আর তার মসনদ চিরস্থায়ী। তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির মুক্তিসনদ ৬ দফা দেওয়ার কারণে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলাতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিন বাংলার বিক্ষুব্ধ মানুষ দ্রোহের আগুনে জ্বলে উঠে ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান-গণবিস্ফোরণের মুখে আইয়ুব খানকে ক্ষমতার মসনদ থেকে বিদায় জানায় এবং দীর্ঘ ৩৩ মাস কারাগারে আটক প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনে।
১৯৬৯-এর ২৪ জানুয়ারির ঝলমলে শীতের সকালটি আমাদের জীবনে অবিচল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার আগেই ক্ষুব্ধ জনতার উত্তাল সংগ্রামের মুখে গণঅভ্যুত্থান ঘটে। সেদিনের ঢাকার সংগ্রামের দৃশ্য ভাবতে কতই না ভালো লাগে। গণঅভ্যুত্থান যে বীরত্বের ইতিহাস রচনা করেছিল, তার কঠিন শিক্ষাই হলো, জনগণের সংগ্রাম দাবানলের মতো জ্বলে উঠতে সময় লাগে না। একজন স্বৈরশাসকের পতনের ইতিহাস যেমন করুণ, তেমনি জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই সত্য, চিরসুন্দর। '৬৯-এর ইতিহাসের এ পুনরাবৃত্তি এদেশে বিগত দু'দশকে তিনবার ঘটেছে। ১৯৯০, ৯৬ আর ২০০৭-এর সংগ্রামী শিক্ষা গণতন্ত্রের ইতিহাসে আপন গতিপথে জায়গা করে নিয়েছে।
১৭ জানুয়ারি দিনটি দুটি কারণে আমার জীবনে স্মরণীয়। ১৯৬৮-র এই দিনে আমি ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হই। আর সেদিনই জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু আমাকে আশীর্বাদ করে অভিনন্দনবার্তা পাঠিয়ে প্রত্যাশা করেছিলেন ডাকসু নেতৃত্বের সংগ্রামী ভবিষ্যৎ। ১৯৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুজিবের মুক্তি পর্যন্ত সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিল বাংলার ছাত্রসমাজ। আইয়ুবের লৌহ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে '৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। গৌরবময় সেই আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুর রউফ, সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, ছাত্র ইউনিয়ন একাংশের সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দোহা, অন্য অংশের সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার, সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ, এনএসএফ একাংশের সভাপতি ইব্রাহিম খলিল, সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সী ও ডাকসুর জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী। সে সময়ের জাতীয় ও তরুণ নেতারা ছিলেন কারাগারে। একজনের নাম বলতে হয় যিনি বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করেছেন। তিনি হলেন সিরাজুল আলম খান। আজ এই পরিণত বয়সে '৬৯-এর সেই অগি্নঝরা প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা কিংবা ইতিহাসের উত্তাল পল্টনের দিকে যখন ফিরে তাকাই তখন রীতিমতো অবাক হই। ১৭ জানুয়ারি পাঁচ শতাধিক ছাত্রছাত্রী নিয়ে বটতলা থেকে যে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, ১৮ জানুয়ারি সে সংগ্রামের স্রোতে সহস্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল_ 'শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই।' ১৯ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। সেদিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি বটতলায় ছাত্র সমাবেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। 'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই' অবস্থা। গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে হয় আমাদের। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া হাজার হাজার ছাত্রের মিছিলে গুলি বর্ষিত হলে আসাদ নিহত হয়। শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে তৈরি হয় পতাকা। আন্দোলন-সংগ্রাম-ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বিজয় আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। ২১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে আসাদের জানাজায় শোকে-ক্ষোভে উত্তাল জনসমুদ্র; যেন এক শহীদের রক্ত ছাত্র-জনতার চেতনায় আগুন ছড়িয়েছে। মওলানা ভাসানীসহ সব জাতীয় নেতাও এসেছেন জানাজায়। ডাকসু ভিপি ও সংগ্রাম পরিষদের মুখপাত্র হিসেবে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করি। ২২ জানুয়ারি কালো ব্যাজ ধারণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। ২৩ তারিখ মশাল মিছিল আর ২৪ তারিখ দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল। ২২ তারিখ শোক নয়, যেন প্রতিবাদে জেগে উঠল নগরী। একটি মানুষও ঢাকায় দেখা গেল না, যার বুকে শোকের চিহ্ন কালো ব্যাজ নেই। ২৪ তারিখ হরতালে সকাল থেকে ছাত্র-জনতা নেমে এলো ঢাকার রাজপথে। বিক্ষোভে উত্তাল রাজপথ। সচিবালয়ের পাশে আবদুল গনি রোডে মন্ত্রীর বাড়িতে আক্রমণ, পুলিশের গুলিতে নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিউরের সঙ্গে মকবুল, রুস্তম মিলে চারজন নিহত হয়। সর্বত্র এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তের মধ্যে ঢাকার সব মানুষ যেন বিক্ষোভে নেমে আসে রাজপথে। দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন জ্বালানো হলো। এমএনএ এনএ লস্করের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সাক্ষীদের বাড়ি খুঁজতে থাকল জনতা। বিচারপতি এসএ রহমানের বাড়িতে আক্রমণ হলে তিনি লুঙ্গি পরে পালালেন। পল্টনে তিল ধারণের জায়গা নেই। মানুষ, মানুষ আর মানুষ। তারা গভর্নর হাউস আক্রমণ করতে চায়। বিনা মাইকে সেদিন পিনপতন নীরবতায় আমাকে বক্তৃতা করতে হয়। লাশসহ সবাইকে নিয়ে মিছিল করে আমরা ইকবাল হলের মাঠে চলে আসি। বিকেল ৩টার পর সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। মানুষ তা অমান্য করে বানের স্রোতের মতো নেমে আসে রাজপথে। এদিকে ২০ তারিখ আসাদের মৃত্যুর পর সংগ্রামে আসা ছাত্ররা পকেটে ঠিকানা লিখে নিয়ে আসত। এখনও ওই সংগ্রামের সাফল্য যেমন আনন্দ দেয়, মাথা উঁচু করে পথ চলতে প্রেরণা জোগায়, তেমনি মতিউরের পকেটে পাওয়া চিরকুটের কথা মনে পড়লে বুক ভারি হয়ে আসে। মতিউরের বুকপকেটে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল_ 'মা, তুমি মনে করো তোমার মতিউর বাংলার মানুষ ও প্রিয় নেতা শেখ মুজিবের জন্য জীবন দিয়ে গেল। ইতি_ মতিউর রহমান, দশম শ্রেণী, পিতা আজহার উদ্দিন মলি্লক, নবকুমার ইনস্টিটিউট। ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনি, মতিঝিল।' সান্ধ্য আইনের মধ্যে মতিউরের লাশ তার মায়ের কাছে নিয়ে গেলে যে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় তা হৃদয় দিয়ে শুধু অনুভব করা যায়, ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। মতিউরের মা বলেছিলেন, 'সন্তানের রক্ত যেন বৃথা না যায়।' ২০ জানুয়ারি শহীদ মিনারে আসাদের রক্ত ছুঁয়ে আমরা যে শপথ নিয়েছিলাম, ২৪ জানুয়ারি মতিউরের রক্তে ওই সংগ্রাম বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করে। ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান ঘটলে ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সান্ধ্য আইন বহাল থাকে। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে জনসভা। আমার জীবনে সেটিই পল্টনের প্রথম জনসভা। জনসভা নয়, যেন জনসমুদ্র। আমরা ১০ জন ছাত্রনেতা বক্তৃতা করি। সেদিনের শপথ দিবসের সভায় একটানা ৪৫ মিনিট বক্তৃতা করে যখন ইতি টানি তখন স্লোগানে স্লোগানে জনসমুদ্রে ঢেউ উঠেছে 'শপথ নিলাম, শপথ নিলাম, মুজিব তোমায় মুক্ত করবো_ শপথ নিলাম, শপথ নিলাম, মাগো তোমায় মুক্ত করবো।' মণি সিংহ, তাজউদ্দীন আহমদ, শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেননসহ অনেকেই তখন কারাগারে। ছাত্র-জনতার বুকের আগুনে ১১ দফার আন্দোলন আর শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি এক হয়ে গেল। ছাত্র-জনতা মুজিবকে না নিয়ে ঘরে ফিরবে না। সভা শেষে সংগ্রামী জনতার ঢল ছুটল কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে। অর্ধলক্ষাধিক বিক্ষুব্ধ মানুষের মিছিলকে সেদিন কারাগারের সামনে থেকে আমরা ফিরিয়ে এনেছিলাম। ১৪ ফেব্রুয়ারি পল্টনে 'ডাক'-এর আহ্বানে জনসভা। সেদিনই বঙ্গবন্ধু আমায় দেখতে চেয়ে কারাগারে ডাকেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্যান্টনমেন্টের কারাগারে আমাকে দেখা করাতে নিয়ে যান। গাড়ি ড্রাইভ করেছিল শেখ কামাল। সেখানেই বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করেছিলেন। সেসব ভাবলে এখনও বুক ভরে যায়, দু'চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। কী উষ্ণ ভালোবাসাই না ছিল বঙ্গবন্ধুর হৃদয়পটজুড়ে। বিকেলে ডাকের জনসভায় সভাপতি পদে নূরুল আমীনের নাম প্রস্তাব হলে জনতা তা প্রত্যাখ্যান করে। তখন আমাকে মঞ্চে নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর ছবি বুকে লাগিয়ে বক্তৃতায় জনতার সমর্থন আদায় করে বলি, শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া গোলটেবিল নয়। সেদিন বেশিদূরে নয়, যেদিন আমাদের নেতা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। নেতা ফিরে আসবেন, তাকে মুক্ত না করে আমরা ঘরে ফিরব না। ওই রাতেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফজলুল হককে কারাগারে গুলি করা হয়। সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত হন। প্রতিবাদে জনতা নেমে আসে রাজপথে। ১৮ তারিখ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. শামসুজ্জোহা গুলিতে মারা যান। ২০ ফেব্রুয়ারি সান্ধ্য আইনের মধ্যে ঢাকা মশাল মিছিলের নগরী হয়ে উঠলে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টনের মহাসমুদ্র থেকে ঘোষণা করি, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে। ভাবতে দারুণ ভালো লাগে, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আমাদের আলটিমেটামের পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় বঙ্গবন্ধু ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিসহ সব রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে সরকার বাধ্য হয়। লাখো মানুষ তখন ছুটে গেল পল্টনে তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে দেখতে। কিন্তু শিক্ষা ভবনের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে আমরা ফিরিয়ে নিয়ে গেলাম ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে। পল্টনে অধীর আগ্রহে থাকা জনতাকে বললাম, ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেতার সংবর্ধনা। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেন জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার। সভাপতিত্ব করলেও রীতিভঙ্গ করে নেতার আগেই বক্তৃতায় হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত হয় সত্যবচন, 'যে নেতা তার জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে। ফাঁসির মঞ্চে বাঙালির মুক্তির কথা বলেছেন, সে নেতাকে কৃতজ্ঞচিত্তে জাতির পক্ষ থেকে একটি উপাধি দিতে চাই।' ১০ লাখ লোক ২০ লাখ হাত উঁচিয়ে সম্মতি জানিয়েছিল। কৃতজ্ঞচিত্তে শেখ মুজিবকে জাতির পক্ষ থেকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনজোয়ারই শুধু নয়, সমগ্র জাতি তখন আনন্দ আর কৃতজ্ঞতায় আবেগাপ্লুত হয়েছিল। পল্টনে শপথ গ্রহণের ১৪ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি এবং অপরাপর রাজনৈতিক নেতাকে আমরা মুক্ত করেছিলাম। দুই বছরের মাথায় প্রিয় নেতার নেতৃত্বে আমরা দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পেরিয়ে '৭০-এর নির্বাচনের ঐতিহাসিক গণরায় নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছিলাম। 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো', 'জাগো জাগো, বাঙালি জাগো', 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা'_ হৃদয় উজাড় করা স্লোগানে বাঙালি জাতি নেতার নির্দেশে এক স্রোতে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭১-এ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা ধর্মীয় উন্মাদনার তথা সাম্প্রদায়িকতার কবর রচনা করেছিলাম।
আজ যখন অতীতের সোনালি সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করি তখন কেবলই মনে পড়ে সেদিনের ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আর আজকের ছাত্রলীগের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার কথা। ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারিতে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, '৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, '৬৪-এর সমাবর্তন উৎসবকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন, '৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, '৬৯-এর যে গণআন্দোলনের কথা আমি এতক্ষণ বলেছি সেই আন্দোলন; এসব আন্দোলনের কোনো তুলনা হয় না। বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এসব আন্দোলনের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মূলত এসব আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ সমমনা ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের নিয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। আজ বারবার মনে পড়ছে সদ্য প্রয়াত আমাদের সবার প্রিয় রাজ্জাক ভাইয়ের কথা। ষাটের দশকে অনেক বড় বড় ছাত্রনেতার জন্ম দিয়েছে এই ছাত্রলীগ। জননেতা আবদুর রাজ্জাক এর মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন আমাদের সময়ের আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্র। তার কোনো তুলনা হয় না। সাংগঠনিক দক্ষতা তার এত ছিল, যে জন্য ছাত্রসমাজের তিনি প্রিয় 'রাজ্জাক ভাই' ছিলেন। ছাত্রদের তিনি বুকে টেনে নিতেন এবং ছাত্রসমাজও তাকে শ্রদ্ধায় কাছে টেনে নিত। তিনি আমাকে সঙ্গে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে ঘুরে কত শ্রম দিয়ে ছাত্রলীগকে গড়ে তুলেছেন। আমি একটি মোটরসাইকেল চালাতাম। আমার বাইকের পেছনে বসে তিনি কত জায়গায় যেতেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তিনি পরিশ্রম করতেন এই ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার জন্য। পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে তিনি অবদান রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অপরিসীম। সবার ভালোবাসার, শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন বলে মৃত্যুর পর জাতি তাকে জাতীয় বীরের মর্যাদায় সম্মানিত করে সমাহিত করেছে। ছাত্রসমাজের হৃদয়-মন জয় করে নিয়েছিল বলে বাংলার মানুষও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হৃদয় দিয়ে ভালোবাসত। গণমানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা আমরা পেয়েছি। আমরা যখন ডাকসুর ভিপি ছিলাম, ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম, গণআন্দোলন সংগঠিত করতে আমরা যখন দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে যেতাম, কী আদর-ভালোবাসা যে পেতাম মানুষের কাছ থেকে তা আমি আজ লিখে-বলে বোঝাতে পারব না। হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ আমাদের একনজর দেখতে, একটিবার বুকে টেনে নিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। যখন কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যেতাম সেখানে মানুষ ভিড় করত। আমরা যখন লঞ্চে বাড়ি যেতাম, তখন যাত্রীরা আকুল আগ্রহে বলত, আমাদের জন্য কিছু কথা বলেন, আমরা আপনার কথা শুনব। রাজনৈতিক জীবনে আমি অনেক কিছু পেয়েছি। কিন্তু রাজনীতির সূচনায় ছাত্রজীবনে আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত করতে গণমানুষের কাছ থেকে আমি যে ভালোবাসা পেয়েছি সেটি আমার জীবনের স্বর্ণযুগ। এ যুগ আর কোনোদিন ফিরে পাব না। আজ ভাবতে অবাক লাগে, যে ছাত্রলীগ ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে '৭১-এ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিল, সেই ছাত্রলীগের আজকের এই করুণ পরিণতি দেখে আমার দুঃখ হয়, কষ্ট হয়। আমি ভাবতেও পারি না, ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে। ছাত্র নামধারী কিছু লোক ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে আজকে আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানকে যখন কলুষিত করে, দুঃখ-বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তখন অতীতের দিনগুলোর কথাই বারবার মনে পড়ে যায়। আমি মনে করি, আমরা যারা জাতীয় রাজনীতি করি, আমাদের এখনও কর্তব্য আছে, অতীতে ছাত্রসমাজ বাংলাদেশের মানুষের মণিকোঠায় জায়গা করে যে রাজনৈতিক মূল্যবোধ, যে আদর্শ সৃষ্টি করেছিল_ আজ সেই হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য সভাপতি, শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
tofailahmed69@gmail.com
আজ ২৪ জানুয়ারি, ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান দিবস। বাঙালি জাতির বীরত্ব আর সংগ্রামের ইতিহাসের আরেক উজ্জ্বলতম দিন। ১৯৬৯-এর এই দিনে উত্তাল সংগ্রামের যে দাবানল জ্বলে উঠেছিল তা কখনও মন থেকে মোছা যায় না। ক্ষমতার মদমত্ত অহঙ্কারের পাহাড়ে বসে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান মনে করেছিল, জনগণ বোবা দর্শক আর তার মসনদ চিরস্থায়ী। তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির মুক্তিসনদ ৬ দফা দেওয়ার কারণে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলাতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিন বাংলার বিক্ষুব্ধ মানুষ দ্রোহের আগুনে জ্বলে উঠে ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান-গণবিস্ফোরণের মুখে আইয়ুব খানকে ক্ষমতার মসনদ থেকে বিদায় জানায় এবং দীর্ঘ ৩৩ মাস কারাগারে আটক প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনে।
১৯৬৯-এর ২৪ জানুয়ারির ঝলমলে শীতের সকালটি আমাদের জীবনে অবিচল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার আগেই ক্ষুব্ধ জনতার উত্তাল সংগ্রামের মুখে গণঅভ্যুত্থান ঘটে। সেদিনের ঢাকার সংগ্রামের দৃশ্য ভাবতে কতই না ভালো লাগে। গণঅভ্যুত্থান যে বীরত্বের ইতিহাস রচনা করেছিল, তার কঠিন শিক্ষাই হলো, জনগণের সংগ্রাম দাবানলের মতো জ্বলে উঠতে সময় লাগে না। একজন স্বৈরশাসকের পতনের ইতিহাস যেমন করুণ, তেমনি জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই সত্য, চিরসুন্দর। '৬৯-এর ইতিহাসের এ পুনরাবৃত্তি এদেশে বিগত দু'দশকে তিনবার ঘটেছে। ১৯৯০, ৯৬ আর ২০০৭-এর সংগ্রামী শিক্ষা গণতন্ত্রের ইতিহাসে আপন গতিপথে জায়গা করে নিয়েছে।
১৭ জানুয়ারি দিনটি দুটি কারণে আমার জীবনে স্মরণীয়। ১৯৬৮-র এই দিনে আমি ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হই। আর সেদিনই জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু আমাকে আশীর্বাদ করে অভিনন্দনবার্তা পাঠিয়ে প্রত্যাশা করেছিলেন ডাকসু নেতৃত্বের সংগ্রামী ভবিষ্যৎ। ১৯৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুজিবের মুক্তি পর্যন্ত সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিল বাংলার ছাত্রসমাজ। আইয়ুবের লৌহ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে '৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। গৌরবময় সেই আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুর রউফ, সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, ছাত্র ইউনিয়ন একাংশের সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দোহা, অন্য অংশের সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার, সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ, এনএসএফ একাংশের সভাপতি ইব্রাহিম খলিল, সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সী ও ডাকসুর জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী। সে সময়ের জাতীয় ও তরুণ নেতারা ছিলেন কারাগারে। একজনের নাম বলতে হয় যিনি বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করেছেন। তিনি হলেন সিরাজুল আলম খান। আজ এই পরিণত বয়সে '৬৯-এর সেই অগি্নঝরা প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা কিংবা ইতিহাসের উত্তাল পল্টনের দিকে যখন ফিরে তাকাই তখন রীতিমতো অবাক হই। ১৭ জানুয়ারি পাঁচ শতাধিক ছাত্রছাত্রী নিয়ে বটতলা থেকে যে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, ১৮ জানুয়ারি সে সংগ্রামের স্রোতে সহস্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল_ 'শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই।' ১৯ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। সেদিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি বটতলায় ছাত্র সমাবেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। 'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই' অবস্থা। গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে হয় আমাদের। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া হাজার হাজার ছাত্রের মিছিলে গুলি বর্ষিত হলে আসাদ নিহত হয়। শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে তৈরি হয় পতাকা। আন্দোলন-সংগ্রাম-ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বিজয় আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। ২১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে আসাদের জানাজায় শোকে-ক্ষোভে উত্তাল জনসমুদ্র; যেন এক শহীদের রক্ত ছাত্র-জনতার চেতনায় আগুন ছড়িয়েছে। মওলানা ভাসানীসহ সব জাতীয় নেতাও এসেছেন জানাজায়। ডাকসু ভিপি ও সংগ্রাম পরিষদের মুখপাত্র হিসেবে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করি। ২২ জানুয়ারি কালো ব্যাজ ধারণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। ২৩ তারিখ মশাল মিছিল আর ২৪ তারিখ দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল। ২২ তারিখ শোক নয়, যেন প্রতিবাদে জেগে উঠল নগরী। একটি মানুষও ঢাকায় দেখা গেল না, যার বুকে শোকের চিহ্ন কালো ব্যাজ নেই। ২৪ তারিখ হরতালে সকাল থেকে ছাত্র-জনতা নেমে এলো ঢাকার রাজপথে। বিক্ষোভে উত্তাল রাজপথ। সচিবালয়ের পাশে আবদুল গনি রোডে মন্ত্রীর বাড়িতে আক্রমণ, পুলিশের গুলিতে নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিউরের সঙ্গে মকবুল, রুস্তম মিলে চারজন নিহত হয়। সর্বত্র এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তের মধ্যে ঢাকার সব মানুষ যেন বিক্ষোভে নেমে আসে রাজপথে। দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন জ্বালানো হলো। এমএনএ এনএ লস্করের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সাক্ষীদের বাড়ি খুঁজতে থাকল জনতা। বিচারপতি এসএ রহমানের বাড়িতে আক্রমণ হলে তিনি লুঙ্গি পরে পালালেন। পল্টনে তিল ধারণের জায়গা নেই। মানুষ, মানুষ আর মানুষ। তারা গভর্নর হাউস আক্রমণ করতে চায়। বিনা মাইকে সেদিন পিনপতন নীরবতায় আমাকে বক্তৃতা করতে হয়। লাশসহ সবাইকে নিয়ে মিছিল করে আমরা ইকবাল হলের মাঠে চলে আসি। বিকেল ৩টার পর সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। মানুষ তা অমান্য করে বানের স্রোতের মতো নেমে আসে রাজপথে। এদিকে ২০ তারিখ আসাদের মৃত্যুর পর সংগ্রামে আসা ছাত্ররা পকেটে ঠিকানা লিখে নিয়ে আসত। এখনও ওই সংগ্রামের সাফল্য যেমন আনন্দ দেয়, মাথা উঁচু করে পথ চলতে প্রেরণা জোগায়, তেমনি মতিউরের পকেটে পাওয়া চিরকুটের কথা মনে পড়লে বুক ভারি হয়ে আসে। মতিউরের বুকপকেটে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল_ 'মা, তুমি মনে করো তোমার মতিউর বাংলার মানুষ ও প্রিয় নেতা শেখ মুজিবের জন্য জীবন দিয়ে গেল। ইতি_ মতিউর রহমান, দশম শ্রেণী, পিতা আজহার উদ্দিন মলি্লক, নবকুমার ইনস্টিটিউট। ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনি, মতিঝিল।' সান্ধ্য আইনের মধ্যে মতিউরের লাশ তার মায়ের কাছে নিয়ে গেলে যে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় তা হৃদয় দিয়ে শুধু অনুভব করা যায়, ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। মতিউরের মা বলেছিলেন, 'সন্তানের রক্ত যেন বৃথা না যায়।' ২০ জানুয়ারি শহীদ মিনারে আসাদের রক্ত ছুঁয়ে আমরা যে শপথ নিয়েছিলাম, ২৪ জানুয়ারি মতিউরের রক্তে ওই সংগ্রাম বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করে। ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান ঘটলে ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সান্ধ্য আইন বহাল থাকে। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে জনসভা। আমার জীবনে সেটিই পল্টনের প্রথম জনসভা। জনসভা নয়, যেন জনসমুদ্র। আমরা ১০ জন ছাত্রনেতা বক্তৃতা করি। সেদিনের শপথ দিবসের সভায় একটানা ৪৫ মিনিট বক্তৃতা করে যখন ইতি টানি তখন স্লোগানে স্লোগানে জনসমুদ্রে ঢেউ উঠেছে 'শপথ নিলাম, শপথ নিলাম, মুজিব তোমায় মুক্ত করবো_ শপথ নিলাম, শপথ নিলাম, মাগো তোমায় মুক্ত করবো।' মণি সিংহ, তাজউদ্দীন আহমদ, শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেননসহ অনেকেই তখন কারাগারে। ছাত্র-জনতার বুকের আগুনে ১১ দফার আন্দোলন আর শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি এক হয়ে গেল। ছাত্র-জনতা মুজিবকে না নিয়ে ঘরে ফিরবে না। সভা শেষে সংগ্রামী জনতার ঢল ছুটল কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে। অর্ধলক্ষাধিক বিক্ষুব্ধ মানুষের মিছিলকে সেদিন কারাগারের সামনে থেকে আমরা ফিরিয়ে এনেছিলাম। ১৪ ফেব্রুয়ারি পল্টনে 'ডাক'-এর আহ্বানে জনসভা। সেদিনই বঙ্গবন্ধু আমায় দেখতে চেয়ে কারাগারে ডাকেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্যান্টনমেন্টের কারাগারে আমাকে দেখা করাতে নিয়ে যান। গাড়ি ড্রাইভ করেছিল শেখ কামাল। সেখানেই বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করেছিলেন। সেসব ভাবলে এখনও বুক ভরে যায়, দু'চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। কী উষ্ণ ভালোবাসাই না ছিল বঙ্গবন্ধুর হৃদয়পটজুড়ে। বিকেলে ডাকের জনসভায় সভাপতি পদে নূরুল আমীনের নাম প্রস্তাব হলে জনতা তা প্রত্যাখ্যান করে। তখন আমাকে মঞ্চে নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর ছবি বুকে লাগিয়ে বক্তৃতায় জনতার সমর্থন আদায় করে বলি, শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া গোলটেবিল নয়। সেদিন বেশিদূরে নয়, যেদিন আমাদের নেতা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। নেতা ফিরে আসবেন, তাকে মুক্ত না করে আমরা ঘরে ফিরব না। ওই রাতেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফজলুল হককে কারাগারে গুলি করা হয়। সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত হন। প্রতিবাদে জনতা নেমে আসে রাজপথে। ১৮ তারিখ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. শামসুজ্জোহা গুলিতে মারা যান। ২০ ফেব্রুয়ারি সান্ধ্য আইনের মধ্যে ঢাকা মশাল মিছিলের নগরী হয়ে উঠলে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টনের মহাসমুদ্র থেকে ঘোষণা করি, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে। ভাবতে দারুণ ভালো লাগে, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আমাদের আলটিমেটামের পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় বঙ্গবন্ধু ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিসহ সব রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে সরকার বাধ্য হয়। লাখো মানুষ তখন ছুটে গেল পল্টনে তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে দেখতে। কিন্তু শিক্ষা ভবনের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে আমরা ফিরিয়ে নিয়ে গেলাম ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে। পল্টনে অধীর আগ্রহে থাকা জনতাকে বললাম, ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেতার সংবর্ধনা। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেন জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার। সভাপতিত্ব করলেও রীতিভঙ্গ করে নেতার আগেই বক্তৃতায় হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত হয় সত্যবচন, 'যে নেতা তার জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে। ফাঁসির মঞ্চে বাঙালির মুক্তির কথা বলেছেন, সে নেতাকে কৃতজ্ঞচিত্তে জাতির পক্ষ থেকে একটি উপাধি দিতে চাই।' ১০ লাখ লোক ২০ লাখ হাত উঁচিয়ে সম্মতি জানিয়েছিল। কৃতজ্ঞচিত্তে শেখ মুজিবকে জাতির পক্ষ থেকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনজোয়ারই শুধু নয়, সমগ্র জাতি তখন আনন্দ আর কৃতজ্ঞতায় আবেগাপ্লুত হয়েছিল। পল্টনে শপথ গ্রহণের ১৪ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি এবং অপরাপর রাজনৈতিক নেতাকে আমরা মুক্ত করেছিলাম। দুই বছরের মাথায় প্রিয় নেতার নেতৃত্বে আমরা দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পেরিয়ে '৭০-এর নির্বাচনের ঐতিহাসিক গণরায় নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছিলাম। 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো', 'জাগো জাগো, বাঙালি জাগো', 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা'_ হৃদয় উজাড় করা স্লোগানে বাঙালি জাতি নেতার নির্দেশে এক স্রোতে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭১-এ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা ধর্মীয় উন্মাদনার তথা সাম্প্রদায়িকতার কবর রচনা করেছিলাম।
আজ যখন অতীতের সোনালি সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করি তখন কেবলই মনে পড়ে সেদিনের ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আর আজকের ছাত্রলীগের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার কথা। ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারিতে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, '৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, '৬৪-এর সমাবর্তন উৎসবকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন, '৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, '৬৯-এর যে গণআন্দোলনের কথা আমি এতক্ষণ বলেছি সেই আন্দোলন; এসব আন্দোলনের কোনো তুলনা হয় না। বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এসব আন্দোলনের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মূলত এসব আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ সমমনা ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের নিয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। আজ বারবার মনে পড়ছে সদ্য প্রয়াত আমাদের সবার প্রিয় রাজ্জাক ভাইয়ের কথা। ষাটের দশকে অনেক বড় বড় ছাত্রনেতার জন্ম দিয়েছে এই ছাত্রলীগ। জননেতা আবদুর রাজ্জাক এর মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন আমাদের সময়ের আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্র। তার কোনো তুলনা হয় না। সাংগঠনিক দক্ষতা তার এত ছিল, যে জন্য ছাত্রসমাজের তিনি প্রিয় 'রাজ্জাক ভাই' ছিলেন। ছাত্রদের তিনি বুকে টেনে নিতেন এবং ছাত্রসমাজও তাকে শ্রদ্ধায় কাছে টেনে নিত। তিনি আমাকে সঙ্গে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে ঘুরে কত শ্রম দিয়ে ছাত্রলীগকে গড়ে তুলেছেন। আমি একটি মোটরসাইকেল চালাতাম। আমার বাইকের পেছনে বসে তিনি কত জায়গায় যেতেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তিনি পরিশ্রম করতেন এই ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার জন্য। পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে তিনি অবদান রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অপরিসীম। সবার ভালোবাসার, শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন বলে মৃত্যুর পর জাতি তাকে জাতীয় বীরের মর্যাদায় সম্মানিত করে সমাহিত করেছে। ছাত্রসমাজের হৃদয়-মন জয় করে নিয়েছিল বলে বাংলার মানুষও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হৃদয় দিয়ে ভালোবাসত। গণমানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা আমরা পেয়েছি। আমরা যখন ডাকসুর ভিপি ছিলাম, ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম, গণআন্দোলন সংগঠিত করতে আমরা যখন দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে যেতাম, কী আদর-ভালোবাসা যে পেতাম মানুষের কাছ থেকে তা আমি আজ লিখে-বলে বোঝাতে পারব না। হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ আমাদের একনজর দেখতে, একটিবার বুকে টেনে নিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। যখন কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যেতাম সেখানে মানুষ ভিড় করত। আমরা যখন লঞ্চে বাড়ি যেতাম, তখন যাত্রীরা আকুল আগ্রহে বলত, আমাদের জন্য কিছু কথা বলেন, আমরা আপনার কথা শুনব। রাজনৈতিক জীবনে আমি অনেক কিছু পেয়েছি। কিন্তু রাজনীতির সূচনায় ছাত্রজীবনে আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত করতে গণমানুষের কাছ থেকে আমি যে ভালোবাসা পেয়েছি সেটি আমার জীবনের স্বর্ণযুগ। এ যুগ আর কোনোদিন ফিরে পাব না। আজ ভাবতে অবাক লাগে, যে ছাত্রলীগ ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে '৭১-এ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিল, সেই ছাত্রলীগের আজকের এই করুণ পরিণতি দেখে আমার দুঃখ হয়, কষ্ট হয়। আমি ভাবতেও পারি না, ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে। ছাত্র নামধারী কিছু লোক ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে আজকে আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানকে যখন কলুষিত করে, দুঃখ-বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তখন অতীতের দিনগুলোর কথাই বারবার মনে পড়ে যায়। আমি মনে করি, আমরা যারা জাতীয় রাজনীতি করি, আমাদের এখনও কর্তব্য আছে, অতীতে ছাত্রসমাজ বাংলাদেশের মানুষের মণিকোঠায় জায়গা করে যে রাজনৈতিক মূল্যবোধ, যে আদর্শ সৃষ্টি করেছিল_ আজ সেই হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য সভাপতি, শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
tofailahmed69@gmail.com
No comments