জোরকদমে পূর্বে চলার তাগিদ-নয়াদিলি্লর চিটি by গৌতম লাহিড়ী

য়েকদিন আগে দিলি্লতে ভারতের দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরির জন্য দেশের সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভারতের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য যে নীতি গৃহীত হলো তার তাৎপর্য বাংলাদেশের জন্য অপরিসীম।


আগামী দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ভারতের বিকাশ দর যদি ৯ শতাংশের ঊধর্ে্ব পেঁৗছতে হয়, তাহলে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে আর্থিক সমঝোতা অত্যন্ত জরুরি_ একথা ভারত সরকারের পেশ করা খসড়া 'আলোচনা-দলিল' তো বটেই এমনকি পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের বক্তব্যে ফুটে ওঠে। এ কথাই এবারের চিঠিতে আলোচনা করব।
ভারতের যোজনা কমিশন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। কমিশনের চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। দেশের সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত জাতীয় উন্নয়ন পর্ষদ নীতি নিয়ে আলোচনা করে। এ সম্মেলনের জন্য যোজনা কমিশন একটি খসড়ানীতি পেশ করে। তাতে বলা হয়, 'ভারতের পূর্বে চলো নীতির সার্থক রূপায়ণ তখনই সম্ভব যদি থাইল্যান্ড-মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়।' এই যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে সীমান্ত বাণিজ্যের বিকাশ ঘটবে এবং তাতে আর্থিক উন্নতির প্রভূত সুযোগ বাড়বে। মুখ্যমন্ত্রীদের উদ্দেশে যোজনা কমিশনের আর্জি পূর্বোত্তর রাজ্যগুলোর বার্ষিক আর্থিক নীতি এমনভাবেই রচনা করতে হবে যাতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা বৃদ্ধি পায় এবং শক্তিশালী হয়। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্য প্রতিবেশীর তুলনায় বাংলাদেশকেই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একাদশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দলিলে এভাবে বাংলাদেশ এতটা গুরুত্ব পায়নি। এ উন্নয়ন নীতি একেবারেই একতরফা নয়, ভারতের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও পরিকল্পনানীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। খসড়ানীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, 'যদি উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয় তাহলে আমরা বাংলাদেশকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ রফতানি করতে পারি।' এতে রাজ্যগুলোর যেমন আর্থিক উন্নয়ন ঘটবে তেমনি বাংলাদেশের শিল্প বিকাশের পথ খুলে যাবে।
খসড়ানীতিতে এও বলা হয়েছে, উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর যদি পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করা যায় তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভারতের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে। গোটা দক্ষিণ এশিয়া এভাবে 'এক পরিবার'রূপে গণ্য হতে পারে। গোটা উত্তর-পূর্বের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক বিপ্লব সৃষ্টি হতে পারে। পরিকল্পনার খসড়ায় সরাসরি তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত না হওয়ার কথা উল্লেখ না হলেও একথা পরোক্ষে মেনে নেওয়া হয়েছে, ওই চুক্তি না হওয়ায় ভারতের সার্বিক উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। নীতিতে লেখা হয়েছে, 'এসব রাজ্যের বেশকিছু স্পর্শকাতর ইস্যু রয়েছে। যার সমাধান এ পরিকল্পনা চলাকালীন খুঁজে নিতে হবে। প্রয়োজনে সৃষ্টিমূলক সমাধানের পথ বের করা জরুরি।'
পশ্চিমবঙ্গসহ উত্তর-পূর্বের আসাম-মণিপুর-নাগাল্যান্ড-মিজোরাম-ত্রিপুরা-মেঘালয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ভারত সরকারের খসড়ায় সম্মতি দিয়েছেন তাই নয়, তারা প্রত্যেকে এক বাক্যে বাংলাদেশের সঙ্গে আর্থিক সমঝোতায় আরও গতি আনা দরকার বলে বিশেষ আবেদন করেন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সম্মেলনের সমাপ্তি ভাষণে ঘোষণাও করতে পেরেছেন মুখ্যমন্ত্রীদের মতামতের ভিত্তিতেই তিনি ভবিষ্যতে পদক্ষেপ নেবেন। আশা করা যায়, আগামী দিনে বাংলাদেশের সঙ্গে আরও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারত সরকার সক্রিয় ভূমিকা নেবে। দুই দেশের সম্পর্ক এক নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করতে পারে, যা অন্য প্রতিবেশীদের কাছে এক আদর্শ উদাহরণ বলে গণ্য হবে। সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রীরা শুধু যোজনা কমিশনের খসড়ানীতি নিয়েই আলোচনা করেছেন তাই নয়, নিজেরাও নতুন নতুন প্রস্তাব পেশ করেছেন, যা বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের বিবেচনার বিষয় হতে পারে। এরকম কয়েকটি প্রস্তাব এখানে উল্লেখ করতে চাই। যেমন_ নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেইফুইয়া রিও বলেছেন, বাংলাদেশকে যদি অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হয় তাহলে ভারত সরকারকেই বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বণ্টনের জন্য লাইন পাতার দায়িত্ব নিতে হবে। তা না হলে ওই প্রস্তাব ঘোষণাই থেকে যাবে। তার অন্য প্রস্তাব পূর্ব-পশ্চিম সড়ক করিডোরের পরিকল্পনা সংশোধন করে মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত করতে হবে। আসামের নওগাঁও পর্যন্ত নির্মাণ না করে বিস্তার করতে হবে নুমালিগড় পর্যন্ত, তারপর ডিমাপুর-ইম্ফল হয়ে মিয়ানমারের মোড় পর্যন্ত তৈরি করা প্রয়োজন। তিনি এও মনে করেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ বিস্তৃত হলে বেআইনি অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য চোরাচালান বন্ধ হবে। কেননা সীমান্ত বাণিজ্য চালু হলে পণ্য চলাচল আইনি হয়ে যাবে। তিনি ট্রান্স-অরুণাচল হাইওয়ের মতো নাগাল্যান্ডব্যাপী ট্রান্স-ইস্টার্ন হাইওয়ে গড়ার প্রস্তাব দেন। যা তাং জংশন থেকে পুঙ্গরো পর্যন্ত বিস্তৃত। মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমাও মনে করেন, প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে আর্থিক ও স্ট্র্যাটেজিক সহযোগিতা গুরুত্ব পাওয়া উচিত পরিকল্পনা নীতি চূড়ান্ত করার সময়। তার ভাষণের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বিকাশের বিষয়। তিনি তিস্তা চুক্তির নাম না করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর উভয় দেশের সম্পর্ক এক নতুন স্তরে উন্নীত হয়েছে। আশা করব, বকেয়া ইস্যু রাষ্ট্রনেতাসুলভ আচরণ দেখিয়ে সমাধান করবেন। কেননা বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য যোগাযোগ রাজ্যের পক্ষে মঙ্গলময়। উত্তর-পূর্ব রাজ্যের বাজার মূলত বাংলাদেশেই। এখানে মৌলিক পরিকাঠামো, স্থল ও শুল্কের বন্দর অবিলম্বে গড়ে তুলতে পারলে ভারতের সঙ্গে ভুটান-বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য প্রভূত পরিমাণে বেড়ে যাবে। তার প্রস্তাব, গারো পাহাড় ও আসামের ধুবড়ী দিয়ে ভুটান থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এক বিশেষ বাণিজ্য করিডোর গড়ে তোলা। এর সঙ্গে ধুবড়ী ও ফুলবাড়ীর মধ্যে যোগাযোগকারী ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সেতু দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্যের জন্য খুলে দেওয়া। তার একথা বলার কারণ, বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্প্রতি দুই দেশের সরকার মেঘালয়ে পশ্চিম গারো জেলার কালাইচরে সীমান্ত হাট খুলে দেওয়ায় ব্যাপক সাফল্য এসেছে। এতে দুই দেশের সাধারণ মানুষ উপকৃত। সেই অভিজ্ঞতার নিরিখেই তার এ প্রস্তাব। কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ব খাসি জেলার বালাটে আরেকটি হাট চালু হয়ে যাবে বলে মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনে ঘোষণা দেন। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী ওত্রাম ইবোবি সিং কিঞ্চিৎ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গত ১০ বছর আগে 'পূর্বে চলো' নীতি ঘোষিত হলেও তার রূপায়ণের গতি অত্যন্ত শ্লথ। তিনি এর জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আর্জি জানান। আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যোগাযোগ গড়ে তোলার আর্জি জানান। একই ধরনের মন্তব্য শুনেছি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের মুখে। অর্থাৎ ভারতের নিজের আর্থিক বিকাশের জন্যই বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক জরুরি। এ তাগিদ রয়েছে বলেই বাংলাদেশের যেসব ন্যায্য দাবি রয়েছে ভারতের কাছে তা অচিরেই পূরণ হতে পারে। এমন ঘটনা আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবে রূপায়ণের পথেই চলেছে।
 

No comments

Powered by Blogger.