কমনওয়েলথ-দারিদ্র্য নিরসনে কার্যকর জোট হোক
অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে সমাপ্ত কমনওয়েলথ রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সম্মেলন থেকে বিশ্ব এবং আঞ্চলিক খাদ্য নিরাপত্তা জোরদারের যে ঘোষণা এসেছে তা বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। সমুদ্রে অবৈধ মাছ ধরা নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য রফতানি ও এর প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে ট্যারিফ, নন-ট্যারিফ প্রতিবন্ধক উঠিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য একক এজেন্ডা হতে পারত।
এটা ঠিক, ঔপনিবেশিক অতীত ভিত্তি হিসেবে থাকলেও পূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশের সময় কমনওয়েলথের লক্ষ্য ও আদর্শ রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন জাতিগুলোকে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তির স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিল। প্রত্যাশা ছিল, সদস্য দেশগুলো গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার ও সমতা সমুন্নত রাখা, আইনের শাসন এবং টেকসই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখবে। বাস্তবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে কমনওয়েলথ কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারেনি বলে সমালোচনা রয়েছে। তবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অনুপ্রেরণা হিসেবে সংস্থাটির অবদান অস্বীকার করা যাবে না। এটাও ঠিক যে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো রাজনৈতিক ইস্যুতে জাতিসংঘের ভূমিকাও সমালোচনার ঊধর্ে্ব নয়। কমনওয়েলথভুক্ত বেশিরভাগ দেশের স্থানীয় বাস্তবতাও মনে রাখতে হবে। একই সংস্থার সদস্য হলেও যুক্তরাজ্য, কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে গাম্বিয়া, ঘানা বা কেনিয়ার মধ্যে যে আর্থ-সামাজিক পার্থক্য, রাজনৈতিক মানদণ্ড নির্ধারণে তা বিবেচনায় রাখতে হবে বৈকি। প্রধানতম বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘের সঙ্গে কমনওয়েলথের বিশিষ্টতা রক্ষার প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মনে করি, সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশভুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের এ জোট বরং আগে অরাজনৈতিক লক্ষ্যগুলো অর্জনেই মনোযোগী হোক। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের ফলে এশিয়া ও আফ্রিকার যেসব দেশ অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে ইউরোপ, আমেরিকার তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে, তাদের সঙ্গে ব্যবধান কমানোই হতে হবে কমনওয়েলথে প্রভাবশালী এবং উন্নত রাষ্ট্রগুলোর প্রধান লক্ষ্য। আমরা জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে যেসব দেশ ঝুঁকির শীর্ষ সারিতে রয়েছে, তার প্রায় সবই বিলেতভিত্তিক আন্তর্জাতিক জোটটির সদস্য। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি গবেষণায় বাংলাদেশ এরই মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বৈশ্বিক এ বিপদ যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে কমনওয়েলথভুক্ত উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের ব্যবধান আরও বাড়বে। পার্থ শীর্ষ সম্মেলনে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণেও সে সত্য প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা আশা করি, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে প্রধানমন্ত্রী যে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, উন্নত বিশ্ব তাতে সাড়া দেবে। ওই সম্মেলনে দেওয়া তার এ বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য যে, অর্থ ও সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এখন প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সহায়তা ও সমর্থন। কমনওয়েলথ ঘোষণায় খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি এবং কৌশল নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে, আগামী দিনগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যু তার কেন্দ্রস্থলে থাকতে বাধ্য। এটা আশাব্যঞ্জক যে, সবার জন্য নিরাপদ, পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কমনওয়েলথ নেতারা তাদের ঘোষণায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন। এখন নজর দিতে হবে তা বাস্তবায়নে। এর আগে বিভিন্ন সম্মেলনে ঘোষণা বাস্তবায়ন না করার যে সমালোচনা রয়েছে, পার্থ ঘোষণা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে তা কাটিয়ে উঠতে পারে কমনওয়েলথ। একুশ শতকের উপযোগী বিশ্ব সংস্থা হয়ে উঠতে চাইলে বিশ্ববাসীর আস্থা ফিরিয়ে আনার বিকল্প নেই।
No comments