সাক্ষাৎকার-‘কোনো সাংবাদিকের জেল হতে পারে না’ by উলা সিগভার্ডসন

ত ১৮ নভেম্বর স্টকহোমে সুইডেনের সংবাদপত্র ন্যায়পাল (প্রেস ওম্বুডসম্যান) উলা সিগভার্ডসন তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে সাক্ষাৎকার দেন। সুইডেনের দক্ষিণাঞ্চলে এক ছোট গ্রামে তাঁর জন্ম। বয়স ৫৭। মা-বাবা ছিলেন গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা অধ্যয়নের পর দীর্ঘ ২৩ বছর বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদক ছিলেন।


পরে তিনি সুইডেনের দৈনিক পত্রিকা ডাগানস নিহিয়াটের-এর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একটি পত্রিকার সম্পাদক এবং অপর একটি পত্রিকার প্রধান সম্পাদকও ছিলেন। এ বছরের ১ এপ্রিল থেকে তিনি সুইডেনের প্রেস ওম্বুডসম্যান পদে নিয়োগ লাভ করেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল কাইয়ুম

প্রথম আলো  সুইডেনে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান হিসেবে ন্যায়পাল প্রধানত কী ধরনের ভূমিকা পালন করে?
উলা সিগভার্ডসন  প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা মতামতে যদি নীতি-নৈতিকতা বা আচরণবিধি লংঘিত হয়, সংক্ষুব্ধ কারো আপত্তি থাকে, তাহলে সেখানে ন্যায়পাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সংবাদপত্র-সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ মিলে ন্যায়পাল নিয়োগ করেন বলে সেটা কারও কোনো অভিযোগ জানানোর একটা একক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতে পারে। পাঠকদের সুবিধা।
প্রথম আলো  সুইডেনে তো সংবাদপত্র অনেক স্বাধীন।
সিগভার্ডসন  দেখুন, স্বাধীনতার পরিসীমা আমরা সংবাদপত্রের জন্য কিছুটা কমিয়ে এনেছি। দেশের আইনে যে কাজটা বিধিসম্মত, সংবাদপত্রের জন্য সব সময় তা ছাপানো হয়তো বিধিসম্মত নয়। এখানে কিছু আচরণবিধি (কোড অব এথিকস) রয়েছে, যা মেনে চলতে হয়।
প্রথম আলো  যেমন?
সিগভার্ডসন  ধরুন, কোনো স্পর্শকাতর সংবাদে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির নাম উল্লেখ বা তাঁর ছবি ছাপাতে চান, এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষে ওই ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া সেটা করা যাবে না। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কখনো কেউ সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার নির্মম শিকারে পরিণত হলেন, তাঁর বিকৃত দেহের ছবি ছাপানোর ব্যাপারে বিধিনিষেধ আছে। পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতি হতে হবে সত্যিকার অর্থে দলনিরপেক্ষ। কোনো দলীয় পক্ষপাতিত্ব না করা। পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো খবরের প্রতিবাদ ছাপানোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। প্রকাশিত সংবাদ যেন সঠিক হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো আচরণবিধির অন্তর্ভুক্ত।
প্রথম আলো  সবাই এসব মেনে চলে?
সিগভার্ডসন  আসলে পত্রিকাগুলো সব সময় তাদের স্বাধীনতার পরিধি বাড়াতে চাপ দেয়। কিন্তু মিডিয়া কো-অপারেশন কমিটির (গণমাধ্যম সহযোগিতা কমিটি) অনুমোদন ছাড়া আচরণবিধি পরিবর্তন করা যায় না। এ বছর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিসীমা আরও কমানোর দাবি উঠেছে।
প্রথম আলো  গণমাধ্যম কমিটি কে গঠন করে?
সিগভার্ডসন  এখানে রয়েছে সংবাদপত্র প্রকাশক সমিতি, সাংবাদিক ইউনিয়ন, সাময়িকী প্রকাশক সমিতি ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রতিনিধি। এই কমিটির অনুমোদন ছাড়া আচরণবিধি পরিবর্তন করা যায় না। ন্যায়পাল ও প্রেস কাউন্সিলের কাছে নির্দেশনা পাঠানোর দায়িত্বও এই কমিটির।
প্রথম আলো  তার মানে সংবাদপত্র কঠোর দায়িত্বশীলতার মধ্য দিয়ে তার স্বাধীনতা ভোগ করে?
সিগভার্ডসন  হ্যাঁ, ঠিক তাই। এর এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার আইন ঘোষিত হয় সেই ১৭৬৬ সালে। সুইডেনেই বিশ্বের প্রথম এ ধরনের আইন হয়। তখন সংবাদপত্র অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করত। এরপর আইন পরিষদ কিছু আচরণবিধি তৈরি করে। ১৮৭৪ সালে গঠিত হয় জাতীয় প্রেস ক্লাব। এরপর কোর্ট অব অনার হিসেবে গঠিত হয় প্রেস কাউন্সিল, ১৯১৬ সালে। ১৯২৩ সালে প্রথম লিখিত আচরণবিধি তৈরি হয়। আর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালে। এইভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ধাপে ধাপে বিকশিত হয়েছে তার পূর্ণ দায়িত্বশীলতা নিয়ে।
প্রথম আলো  ন্যায়পাল ও তাঁর কার্যালয় পরিচালনায় সরকারের কোনো ভূমিকা আছে কি? সরকার কি হস্তক্ষেপ করতে পারে?
সিগভার্ডসন  না না, ন্যায়পালের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রেস কাউন্সিল ও ন্যায়পাল গণমাধ্যম দ্বারা পরিচালিত। প্রকাশক সমিতি, সাংবাদিক ইউনিয়ন, জাতীয় প্রেসক্লাব—এরাই আমাদের বেতন-ভাতা দেয়, অফিস পরিচালনার ব্যয় চালায়। বছরে আমাদের বাজেট প্রায় পাঁচ লাখ ইওরো (পাঁচ কোটি টাকারও বেশি)। এটা আসে ওদের কাছ থেকেই। সরকারের কোনো ব্যাপার নেই।
প্রথম আলো  প্রেস কাউন্সিলই তো আছে, তারপর আবার জাতীয় পর্যায়ে ন্যায়পালের দরকার কী?
সিগভার্ডসন  ধরুন, কোনো সংবাদ সম্পর্কে কারও একটা আপত্তি আছে। তিনি ন্যায়পালের কাছে লিখতে পারেন। তবে সেটা তাঁর নিজের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট হতে হবে। আমরা প্রাথমিক অনুসন্ধানে যদি দেখি অভিযোগের ভিত্তি নেই, তাহলে বাদ। কিন্তু যদি ভিত্তি থাকে, তাহলে সেই পত্রিকার সম্পাদকের কাছে পাঠিয়ে দিই। সম্পাদক যদি মেনে নেন ভালো। না মানলে, এবং সেটা যুক্তিসংগত হলে, আমরা তা পাঠিয়ে দিই অভিযোগকারীর কাছে। কিন্তু যদি মনে করি, সম্পাদকের দাবি যুক্তিসংগত নয়, তাহলে সেটা পাঠাই প্রেস কাউন্সিলে। তারা যদি মনে করে অভিযোগ সত্য, তাহলে সেই পত্রিকাকে ভুল স্বীকার করে ছাপাতে হবে।
প্রথম আলো  ভুলের শাস্তি কী?
সিগভার্ডসন  ওই ছাপানোটাই শাস্তি। এটা পত্রিকার জন্য বিরাট ব্যাপার। তবে এই পুরো প্রক্রিয়ার প্রশাসনিক ব্যয় হিসেবে অভিযুক্ত পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তিন হাজার ইওরো (তিন লাখ টাকারও বেশি) আদায় করা হয়।
প্রথম আলো  একটা অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে কত সময় লাগে? মানে, বিচার প্রত্যাশীকে কত দিন অপেক্ষা করতে হয়?
সিগভার্ডসন  সাধারণত কম সময়েই হয়ে যায়, যদি দেখা যায় অভিযোগ পরিষ্কার। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছয় মাস বা এক বছর পর্যন্ত সময় লাগে।
প্রথম আলো  কেউ যদি মনে করেন, তাঁর ব্যাপারে ভীষণ ক্ষতিকর খবর বেরিয়েছে, সে ক্ষেত্রে তিনি কি সরাসরি আদালতে মামলা করতে পারেন?
সিগভার্ডসন  সরাসরি আদালতে যাওয়া কঠিন। এ রকম খুব কমই হয়। বছরে একটাও হয় কি না সন্দেহ। কারণ ন্যায়পাল যেখানে আছেন, দরকার কি আদালতে যাওয়ার। তা ছাড়া কেউ চাইলে সরাসরি প্রেস কাউন্সিলেও যেতে পারেন। ছোটখাটো আপত্তি জানাতে সরাসরি সম্পাদকের কাছেও লিখতে পারেন। আপত্তির ভিত্তি থাকলে তা গুরুত্ব দিয়ে ছাপানোর দায়িত্ব সংবাদপত্রের। এটা আচরণবিধিতে আছে।
প্রথম আলো  ধরুন, কোনো সংবাদে গুরুতর ভুল কিছু ছাপা হলো, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি দারুণ ক্ষুণ্ন হলো। দোষী সাব্যস্ত হলে ওই সাংবাদিকের কি জেল হতে পারে?
সিগভার্ডসন  না, আইনত কোনো সাংবাদিকের জেল হতে পারে না। সবকিছুর জন্য দায়ী সম্পাদক। যা শাস্তি, সব হবে সম্পাদকের।
প্রথম আলো  কোনো সংবাদের সূত্র প্রকাশ করতে কি সাংবাদিককে বাধ্য করা যায়?
সিগভার্ডসন  যদি জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক কিছু হয়, তাহলে আদালত সূত্র জানতে চাইতে পারেন। এ রকম সাধারণত হয় না। একবার হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ওলফ পাম আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে পত্রপত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়। সে সময় একজন সাংবাদিক তদন্ত বিষয়ে একটি গোপন খবর ফাঁস করে দেন। বিষয়টা আদালতে ওঠে। সংবাদের সূত্র ছিল তদন্তের দায়িত্বে নিয়োজিত একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে ওই সাংবাদিক গোপন বৈঠক করেছিলেন। আদালতে তিনি সেই সূত্র প্রকাশ করেন।
প্রথম আলো  ন্যায়পাল হিসেবে আপনার দায়িত্বের পরিধি কতটা? শুধু ছাপানো পত্রপত্রিকার বিষয়, নাকি পুরো গণমাধ্যম?
সিগভার্ডসন  সব ছাপানো পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিন এবং তাদের ওয়েবসাইট আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তা ছাড়া যেসব স্বাধীন ওয়েবসাইট আমাদের আচরণবিধিমালা ব্যবস্থার মধ্যে থাকতে চান, তারাও আমার দায়িত্বের আওতায়। এই স্বাধীন ওয়েবসাইট বলতে বোঝাচ্ছি সেই সব সাইট, যেগুলো পত্রিকার সঙ্গে তুলনীয়, যাদের আছে পেশাদার সম্পাদক, কিন্তু তাদের ছাপানো পত্রিকা নেই।
প্রথম আলো  তাহলে রেডিও-টিভি, অর্থাৎ ইলেকট্রনিক মিডিয়া কার দায়িত্বে?
সিগভার্ডসন  সরকারি রেডিও-টেলিভিশনের আচরণবিধি তদারক করে সরকারি কর্তৃপক্ষ। আর যারা স্বতন্ত্র (সরকারি নয়), তাদের আচরণবিধি তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা নেই।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ।
সিগভার্ডসন  প্রথম আলো ও তার অগণিত পাঠককে ধন্যবাদ। আমার সাক্ষাৎকার ছাপা হলে আমি ইন্টারনেটে আগ্রহ নিয়ে দেখব, যদিও পড়তে পারব না।

No comments

Powered by Blogger.