পরমাণু বিদ্যুৎ : সংকট নয়, সম্ভাবনা by ডা. এম এ করীম

রমাণু বিদ্যুৎ নিয়ে কালের কণ্ঠে বেশ কয়েকটা লেখা আমি লিখেছি। আবার একই বিষয়ে কলম ধরলাম এ জন্য যে গত ২০ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার কালের কণ্ঠে 'রাজনীতি' বুলেটিন প্রচ্ছদ আয়োজনে 'নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ সম্ভাবনা নাকি সংকট!' নামে মাহবুব রুবাইয়াৎ লিখেছেন, 'আমি নিউক্লিয়ার বিশেষজ্ঞ নই, বিশেষজ্ঞরা কবে লিখবেন সে আশায় বসে থাকাটাকেও আমি ঠিক মনে করি না। আর আমাদের এসব বিশেষজ্ঞও ভালো করে জানেন ঠিক কোথায়, কখন, কিভাবে বিশেষভাবে, বিশেষ বিষয়ে অজ্ঞ হয়ে যেতে হয়।' আমার মনে হয়, লেখক মাহবুব রুবাইয়াৎ অসাবধানতাবশত ভুলটি করেছেন।


পরমাণু বিদ্যুৎ নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে দুই ধরনেরই। এটা এখন থেকে নয়, এ দেশে যখন পরমাণু বিদ্যুতের চিন্তাভাবনা করা শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। লেখক পরমাণু বিদ্যুৎ নিয়ে লিখতে গিয়ে রাজনৈতিক অভিলাষের কথাও ব্যক্ত করেছেন। আমি শুধু বলতে চাই, পরমাণু বিদ্যুৎ সংকট নয়, সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। আমাদের দেশে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পরিকল্পনা করা হয় ১৯৬১ সালের দিকে। তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ সালে সর্বপ্রথম রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ওয়াদা করে সে ওয়াদা রাখেনি। ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন পাকিস্তান সফরকালে পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি স্টিল মিল এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনে সাহায্যের কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু তখন পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য তাও হয়ে ওঠেনি। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে প্রথমে সরকার একটি কার্যপত্র তৈরি করে। এই 'ওয়ার্কিং গ্রুপ' তাদের রিপোর্টে রূপপুরে ২০০ মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করে। ১৯৭৫ সালে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের ফলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এ কাজ ধীরগতিতে এগিয়ে চলে। ১৯৮৪-৮৫ সালে আবার এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। সে সময় আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার মতামত গ্রহণ করা হয়। তাদের রিপোর্টে বলা হয়, Bangladesh has a nucleus of trained manpower to work in implementation of its first nuclear program. In this respect, Bangladesh is unique as a developing country and is qualified to assume more responsibility for its nuclear power project than is expected for this type of member states. আশির দশকের প্রথমার্ধে পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প জাতীয় চাহিদা হিসেবে দেখা দেয়। পরে আবার রাশিয়ার সাহায্যের প্রস্তাব বিবেচনায় আনা হয়।
আমরা 'বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা'- এই তত্ত্ব নিয়ে চলছি। যেমন আশির দশকের প্রথমার্ধে চেরনোবিল দুর্ঘটনার সময় ঘটেছিল। জাপানে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাও কিন্তু সেকেলে ছিল। এখন পৃথিবীতে সব কিছু বিবেচনা করেই নতুনভাবে পরমাণু চুল্লি নির্মাণ করা হচ্ছে, যা তৃতীয় প্রজন্মের চেয়েও উন্নত। আমাদের দেশে যে বিশাল বিদ্যুতের ঘাটতি; এ ঘাটতি পূরণে যেসব উপাদান আছে, তার কোনটি দীর্ঘমেয়াদি হবে সে কথা আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। জ্বালানির অন্যান্য উৎস কী? বাংলাদেশে জ্বালানির অন্যতম উৎস হলো গ্যাস। ৬৬ শতাংশ জ্বালানি আসে গ্যাস থেকে। সে গ্যাসের রিজার্ভও ফুরিয়ে আসছে। তেলের ওপর নির্ভরশীলতা এখনো ৩১ শতাংশ। কয়লার সম্ভাবনা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১ শতাংশ। পৃথিবীতে যেসব 'জ্বালানির উৎস' আছে তার মধ্যে কয়লা, জলবিদ্যুৎ, গ্যাস, বায়ু, সৌরবিদ্যুৎ, তেল, বায়োগ্যাস ও পরমাণু অন্যতম। এগুলোর মধ্যে পরমাণু বিদ্যুৎ হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি। বিশ্বে বর্তমানে উৎপাদিত বিদ্যুতের ১৭ থেকে ২৪ শতাংশ পাওয়া যাচ্ছে পরমাণু শক্তি থেকে। ফ্রান্স ৭৯ শতাংশ বিদ্যুৎ পাচ্ছে পরমাণু শক্তি থেকে, বেলজিয়াম পাচ্ছে ৫৮ শতাংশ। জাপান ৫৫, সুইডেন ৪৪, কোরিয়া ৪০ ও যুক্তরাষ্ট্র ২০ শতাংশ। চীন এ খাত থেকে উৎপাদন করছে ৯ হাজার মেগাওয়াট, ভারত চার হাজার ২০ মেগাওয়াট, পাকিস্তান ৪২৫ মেগাওয়াট। যদিও ভারত ও পাকিস্তান পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে, পাকিস্তান চীনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। পৃথিবীতে যেসব জ্বালানির উৎস আছে, তার মধ্যে পরমাণু বিদ্যুৎই দীর্ঘমেয়াদি। জ্বালানির স্বল্পতা, জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া, কৃষিতে খারাপ প্রতিক্রিয়া ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ভূপৃষ্ঠে তাপ বৃদ্ধির ফলে পরিবেশগত পরিবর্তন দেখা দেয়। ফলে অল্প বৃষ্টি ও বনাঞ্চল ধ্বংস করছে এবং মৎস্য সম্পদ উজাড় হয়ে যাচ্ছে। বায়ুদূষণের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। যাঁরা বেঁচে থাকেন তাঁদের জীবনমানের ক্ষতি হচ্ছে নানাভাবে। ব্যাপক খনিজ আহরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। উল্লেখ্য, যত বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার হবে, তত বেশি কার্বনডাই-অঙ্াইড নির্গত হয়ে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে সহায়তা করবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ তারতম্য হতে পারে। কিন্তু এর ফলাফল অনিবার্য। বৈশ্বিক উষ্ণতা পরিবর্তনে কৃষি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু পরমাণু বিদ্যুৎ এসব থেকে মুক্ত। বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা প্রায় সবাই মনে করেন, এই ফসিল ফয়েল থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করতে হলে পরমাণু বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। পরমাণুবিরোধীরা পরমাণু বর্জ্যকে কঠিন সমস্যা বলে চিহ্নিত করেন না। তাঁরা মনে করেন, এসব জ্বালানির (ফসিল ফুয়েল) বর্জ্যের সঙ্গে পরমাণু বর্জ্যের (যা শক্তি উৎপাদনের জন্য সৃষ্ট) এটা শুধু পরিমাণে কমই নয়, এটা আবদ্ধ থাকে, ফলে পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। এটা প্রমাণিত যে যদি চার ধাপে পরমাণু বিদ্যুতের প্রতিটি স্তর অনুসরণ করা হয় তাতে যে বর্জ্য তৈরি হবে, তা একটি গলফ বলের চেয়ে বড় নয়। পরমাণু বর্জ্য অপসারণ বেশ সহজ। কারণ তা ভূগর্ভে 'ডাম্পিং' করা হয়, যা দীর্ঘকাল ধরে আস্তে আস্তে নিঃশেষিত হয়ে যায়। নিষ্কৃত এই বর্জ্যের ভূপ্রকৃতিতে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই। বর্জ্য 'ড্যাম্পিং' করা অতি সামান্যই ঝুঁকিপূর্ণ; যা আরো কমিয়ে আনা সম্ভব নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে। পশ্চিমা দেশগুলো এর চমৎকার উদাহরণ। তা ছাড়া রাশিয়া তো আমাদের পরমাণু বর্জ্যগুলো নিজ দেশে ফেরত নিতে চুক্তি করেছে। তেজস্ক্রিয়ার ভীতি আরো একটি অপপ্রচার। আমেরিকার স্বনামধন্য বিজ্ঞানী Donald W. Miller. Jr. MD �Advantages of Nuclear Power,, নামক প্রবন্ধে লিখেছেন �Artemus Ward, Mark Twain�s predecessor, once said : �It isn't the things we don�t know that gets us into trouble. It�s the things we know that just isn't so.� Regulators know that exposure to ionizing radiation, even in very low doses, is harmful. They say that no amount of radiation can be proclaimed safe. There is no threshold below which the deleterious effects of radiation cease to appear. This 'knowledge' has, indeed, caused us a lot of trouble and it turns out not to be true. The actual truth is this: Not only are low to moderate doses of ionizing radiation not harmful, low doses of radiation are good for you. It stimulates the immune system and checks oxidation of DNA through a process known as 'radiation hormesis' � and thereby prevents cancer. And irradiated mothers bear children that have a reduced incidence of congenital deformities.� পরমাণু বিদ্যুৎবিরোধীরা 'থ্রি মাইল আইল্যান্ড', 'চেরনোবিল' ও সর্বশেষ 'ফুকুশিমা' দুর্ঘটনার কথা বলেন। কিন্তু বাস্তব কী? সত্যিই ভয়াবহ। 'চেরনোবিল' দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল সম্ভবত ৩১ জনের। 'তেজস্ক্রিয় সিকনেস'-এ আক্রান্ত হয়েছিল সেখানকার মাত্র ১৩৪ জন চাকরিজীবী। মাত্র ৭০ জন থাইরয়েড ক্যান্সারে পরবর্তী সময়ে মারা গেছে (বিশেষ করে শিশুরা); যা সহজেই প্রতিহত করা যেত, সময়মতো যদি তাদের পটাশিয়াম আয়োডাইড খাওয়ানো যেত। অনেকে মনে করেছিল, চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর সারা ইউরোপে ক্যান্সার রোগের বিস্তার ঘটবে মারাত্মকভাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি এবং কতখানি বৃদ্ধি পেয়েছিল, তা নিয়েও মতবিরোধ আছে। ভারতের ভূপালে রাসায়নিক প্লান্টে যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল অথবা টেকসাস সিটি এঙ্প্লোশনে (অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট) অথবা প্রথম মহাযুদ্ধের সময় হালিফ্যাকস দুর্ঘটনার চেয়ে চেরনোবিল দুর্ঘটনায় তেমন কিছু ঘটেনি। পরমাণু বিদ্যুতের সঙ্গে অন্যান্য বিকল্প জ্বালানির বিভিন্ন ক্ষতির তুলনা, বিশেষ করে গড় আয়ুর একটি চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে। তাতে দেখা যায়, দারিদ্র্যের মধ্যে যাঁরা জীবন যাপন করেন, তাঁদের গড় আয়ু হ্রাস পায় তিন হাজার ৫০০ দিন, ধূমপায়ীদের (প্রতিদিন যাঁরা এক প্যাকেট ধূমপান করেন) দুই হাজার ৩০০ দিন, হৃদরোগীদের দুই হাজার ১০০ দিন, অবিবাহিতদের দুই হাজার দিন, খনিশ্রমিকদের এক হাজার ১০০ দিন, ক্যান্সার রোগীদের ৯৮০ দিন, ৩০ পাউন্ড বেশি ওজনওয়ালাদের ৯০০ দিন, মোটরগাড়ি দুর্ঘটনায় পতিতদের ১৫০ দিন, আত্মহত্যাকারীদের ৯৫ দিন, হোমোসাইডদের ৯০ দিন, বায়ুদূষণে আক্রান্তদের ৮০ দিন; যাঁরা পরমাণু বিদ্যুতের কাছে বসবাস করেন তাঁদের ০.৪ দিন। এটা অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তথ্য। এ তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে যাঁরা ভাবছেন, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে জনবসতি থাকতে পারবে না, তাঁদের এ যুক্তির যথার্থতা নেই। আর ভীতি নয়। সাম্রাজ্যবাদের ভয় নয়। সাম্রাজ্যবাদ এখন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে বিপদে আছে। বাইরে শুধু হুংকার ছাড়ছে। স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান পরিবেশ উপদেষ্টা প্রফেসর রস গ্লর্নিট বলেন, 'গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসে বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টায় পরমাণু বিদ্যুৎ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।' তিনি আরো বলেন, 'উন্নয়নশীল দেশগুলোর গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধে পরমাণু বিদ্যুতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জাপানে দুর্ঘটনা সত্ত্ব্বেও বিশ্বের ভবিষ্যৎ জ্বালানি ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তির এক বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। পরমাণু বিদ্যুৎ ছাড়া পরিবেশগত পরিবর্তন মোকাবিলা করা খুবই অর্থবহুল ও কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির জন্য পরমাণু বিদ্যুতের বিকল্প নেই, তাই বাংলাদেশে পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে।
লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট পরমাণু চিকিৎসাবিজ্ঞানী
ও মুক্তিযোদ্ধা

No comments

Powered by Blogger.