মুক্তিযুদ্ধ-একাত্তরের স্বপ্ন ও আমাদের নেতৃত্ব by আনোয়ার উল আলম শহীদ
১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন বাতিলের আন্দোলনে অংশ নিয়েই বুঝেছিলাম, পাকিস্তানে আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ১৫ বছর বয়সে করাচি গিয়ে দেখেছি, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কী তফাত। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পাঠান ও বেলুচদের সঙ্গে আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি-কৃষ্টি—কোনোটির মিল ছিল না।
মনের গহিনে প্রশ্ন জেগেছে, আমাদের কেন একটা আলাদা রাষ্ট্র থাকবে না? একটি রাষ্ট্র গঠনের যে কটি উপাদান থাকা দরকার অর্থাৎ আলাদা জাতিসত্তা, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, আলাদা ভাষা ও সংস্কৃতি—সবই আমাদের আছে, নেই শুধু সার্বভৌমত্ব।
১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে যে বিদেশি আগ্রাসন থেকে আমাদের রক্ষার কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি পেশ করার পর পাকিস্তান সরকার বলতে শুরু করল, এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতার বীজ রোপিত হয়েছে। আমরাও ভাবলাম, আমাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠন করা দরকার। আমাদের সত্তার মধ্যে নিহিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ জেগে উঠল। এই সময় স্লোগান উঠল, ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’। পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করার ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত করলে আমরা পেয়ে যাই আমাদের মুক্তিদাতার সন্ধান। স্বপ্ন দেখতে থাকি কবে হবে বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। তখন আমরা স্লোগান তুলি, ‘তোমার দেশ আমার দেশ—বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’।
আমাদের চাওয়ার স্বপ্নের এই বাংলাদেশ ছিল একটা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। সেখানে বাংলা ভাষা, বাঙালি শিল্প-সংস্কৃতি-কৃষ্টি বিকশিত হবে, বাঙালি অর্থনৈতিকভাবে মুক্তি লাভ করবে, ধর্মের নামে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না এবং বিশ্বে বাঙালি জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আর ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের বুকটা স্ফীত হয়ে উঠেছিল। ভেবেছিলাম, স্বপ্নের সোনালি দিনগুলো আমাদের হাতের মুঠোয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ করেছি সহযোদ্ধাদের মধ্যে কী আত্মত্যাগী মনোভাব আর অসাধারণ দেশপ্রেম!
মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর ভেবেছিলাম, বাংলার মাটিতে দেশদ্রোহী, বর্বর, সাম্প্রদায়িক শক্তির কবর রচিত হয়েছে, বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে কী যেন হয়ে গেল, সবাই কিছু পাওয়ার জন্য উতলা-অধৈর্য হয়ে উঠলেন। অন্যদিকে যাদের অন্তরে সুপ্ত ছিল পাকিস্তানপ্রেম, তারা তো দেশপ্রেমিকদের বদনাম ছড়াতে উঠেপড়ে লাগল। দেশবাসীও কত সহজে একাত্তরের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা, আত্মত্যাগের কথা, বাঙালির গৌরবগাথা ভুলে যেতে লাগল।
তারপরও বলব, আমি একজন আশাবাদী মানুষ। সব সময়ই স্বপ্ন দেখি বাঙালির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। অনেককে বলতে শুনি, বাংলাদেশের কিছু হয়নি। কিন্তু আমি জানি, আমরা যা চেয়েছিলাম তার অনেক কিছুই পেয়েছি। তবে আরও পেতে পারতাম যদি সঠিক নেতৃত্ব থাকত, পুরোপুরি গণতন্ত্রের চর্চা হতো, রাজনীতিবিদেরা সৎ ও জনদরদি থাকতেন এবং পরবর্তী প্রজন্ম তাঁদের দেখে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতো। আমাদের কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ তো উৎপাদন বাড়িয়ে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছেন। শিল্প-কারখানা স্থাপন করে ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কম অবদান রাখেননি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্রঋণ প্রদান ও শিক্ষা বিস্তার করে গ্রামগঞ্জের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে, অর্থনীতিকে রেখেছে চলমান। পাকিস্তান আমলে খাদ্যের, পোশাকের ও বাসস্থানের যে অভাব ছিল তা এখন অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।
সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশবাসী এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারছে না। জনগণ যানবাহন ক্রয় করছেন, সড়ক-কর দিচ্ছেন কিন্তু সরকার নতুন রাস্তাঘাট, রেলপথ তৈরি করছে না, যা আছে তাও চলাচলের উপযোগী রাখতে পারছে না। বেসরকারি উদ্যোক্তারা কলকারখানা স্থাপন করতে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না, গ্যাস পাচ্ছেন না, পানি পাচ্ছেন না, পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থাও ভঙ্গুর। তারপরও উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে চাইছেন, করছেন। কিন্তু এদিকেও সরকার তাঁদের থেকে অনেক পিছিয়ে। অন্যদিকে দুর্নীতিতে সরকারের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই এগিয়ে আছে। দুর্নীতির কবলে জাতি আজ বিপর্যস্ত। জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক ও লজ্জাকর।
বাংলাদেশের আরও দুর্ভাগ্য যে ১৯৭১ সালে লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের যেসব সমস্যা নিষ্পত্তি হয়েছে, বারবার অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক সেনাশাসনে তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এই অসাম্প্রদায়িক দেশটাকে পেছনে ঠেলেছে। একাত্তরের ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে একটি রাজনৈতিক দল অবস্থান নিয়েছে, শুধুই ক্ষমতার লোভে, যা দেশের জন্য মোটেই মঙ্গলকর নয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত দেশটিতে মূঢ় সেনাশাসকেরা নাগরিকত্বের আড়ালে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে এক সাংঘর্ষিক ও বিভক্তির রাজনীতির সূচনা করেছে। সৎ, যোগ্য ও আদর্শবান রাজনীতিবিদদের পেছনে ফেলে দুর্নীতিবাজ, সুযোগসন্ধানী ও ব্যবসাকেন্দ্রিক রাজনীতি আমাদের ওপর চেপে বসেছে।
এসব সত্ত্বেও আমি আশাবাদী। কারণ, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে, যা এখন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। মানুষকে, বিশেষ করে যুবসমাজকে একাত্তরের মতো আবারও স্বপ্ন দেখাতে হবে। একাত্তরে যেমন বাঙালি প্রমাণ করেছে তারা যুদ্ধ করতে জানে, তেমনি আরও প্রমাণ করবে তারা সর্বক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করতে পারে। কৃষিনির্ভর বাঙালি এখন ব্যবসা করতে শিখেছে, নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে শিখেছে এবং সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক যে একটা মেধাবী যুবসমাজ আত্মপ্রকাশ করছে, যারা সমাজ পরিবর্তনে সক্ষম হবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।
এখন আমাদের যা করতে হবে তা হলো, ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিকতা থেকে রাজনীতিকে উদ্ধার করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে গড়ে তুলতে হবে সত্যিকার গণতন্ত্র চর্চার সংস্কৃতি। যাঁর যা দায়িত্ব তা নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে পালন করতে হবে। রাজনীতিবিদকে রাজনীতি, সশস্ত্র বাহিনীকে প্রতিরক্ষা, ব্যবসায়ীকে ব্যবসা, শিক্ষককে জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষাদান, চিকিৎসককে চিকিৎসা, ছাত্রদের লেখাপড়া, সাংবাদিকদের সাংবাদিকতা, সরকারি চাকরিজীবীদের সততা, নিষ্ঠা ও যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন, কৃষক-শ্রমিককে উৎপাদনের কাজে, অর্থাৎ যাঁর যে পেশা, তাঁকে সেই পেশায় একাগ্রভাবে কাজ করতে হবে। তাহলেই দেশের সমস্যা সমাধান সহজ হবে। ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। আমাদের সবার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।
যাঁরা সরকার ও দেশ পরিচালনা করছেন, যাঁরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের আসনে রয়েছেন, তাঁদের সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে চাই, দেশ তোমাকে কী দিয়েছে সেটি বড় কথা নয়, দেশকে তুমি কী দিতে পার, সেটাই বড় কথা। একাত্তরের শহীদেরা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, তাঁরা দেশ ও দেশের মানুষের কাছে কিছুই প্রত্যাশা করেননি। আমাদের রাজনীতিকেরাও যদি সেবা ও ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করতেন, তাহলে এই দেশটির চেহারাই বদলে যেত।
আনোয়ার উল আলম শহীদ: মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক রাষ্ট্রদূত।
১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে যে বিদেশি আগ্রাসন থেকে আমাদের রক্ষার কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি পেশ করার পর পাকিস্তান সরকার বলতে শুরু করল, এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতার বীজ রোপিত হয়েছে। আমরাও ভাবলাম, আমাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠন করা দরকার। আমাদের সত্তার মধ্যে নিহিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ জেগে উঠল। এই সময় স্লোগান উঠল, ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’। পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করার ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত করলে আমরা পেয়ে যাই আমাদের মুক্তিদাতার সন্ধান। স্বপ্ন দেখতে থাকি কবে হবে বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। তখন আমরা স্লোগান তুলি, ‘তোমার দেশ আমার দেশ—বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’।
আমাদের চাওয়ার স্বপ্নের এই বাংলাদেশ ছিল একটা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। সেখানে বাংলা ভাষা, বাঙালি শিল্প-সংস্কৃতি-কৃষ্টি বিকশিত হবে, বাঙালি অর্থনৈতিকভাবে মুক্তি লাভ করবে, ধর্মের নামে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না এবং বিশ্বে বাঙালি জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আর ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের বুকটা স্ফীত হয়ে উঠেছিল। ভেবেছিলাম, স্বপ্নের সোনালি দিনগুলো আমাদের হাতের মুঠোয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ করেছি সহযোদ্ধাদের মধ্যে কী আত্মত্যাগী মনোভাব আর অসাধারণ দেশপ্রেম!
মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর ভেবেছিলাম, বাংলার মাটিতে দেশদ্রোহী, বর্বর, সাম্প্রদায়িক শক্তির কবর রচিত হয়েছে, বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে কী যেন হয়ে গেল, সবাই কিছু পাওয়ার জন্য উতলা-অধৈর্য হয়ে উঠলেন। অন্যদিকে যাদের অন্তরে সুপ্ত ছিল পাকিস্তানপ্রেম, তারা তো দেশপ্রেমিকদের বদনাম ছড়াতে উঠেপড়ে লাগল। দেশবাসীও কত সহজে একাত্তরের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা, আত্মত্যাগের কথা, বাঙালির গৌরবগাথা ভুলে যেতে লাগল।
তারপরও বলব, আমি একজন আশাবাদী মানুষ। সব সময়ই স্বপ্ন দেখি বাঙালির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। অনেককে বলতে শুনি, বাংলাদেশের কিছু হয়নি। কিন্তু আমি জানি, আমরা যা চেয়েছিলাম তার অনেক কিছুই পেয়েছি। তবে আরও পেতে পারতাম যদি সঠিক নেতৃত্ব থাকত, পুরোপুরি গণতন্ত্রের চর্চা হতো, রাজনীতিবিদেরা সৎ ও জনদরদি থাকতেন এবং পরবর্তী প্রজন্ম তাঁদের দেখে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতো। আমাদের কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ তো উৎপাদন বাড়িয়ে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছেন। শিল্প-কারখানা স্থাপন করে ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কম অবদান রাখেননি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্রঋণ প্রদান ও শিক্ষা বিস্তার করে গ্রামগঞ্জের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে, অর্থনীতিকে রেখেছে চলমান। পাকিস্তান আমলে খাদ্যের, পোশাকের ও বাসস্থানের যে অভাব ছিল তা এখন অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।
সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশবাসী এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারছে না। জনগণ যানবাহন ক্রয় করছেন, সড়ক-কর দিচ্ছেন কিন্তু সরকার নতুন রাস্তাঘাট, রেলপথ তৈরি করছে না, যা আছে তাও চলাচলের উপযোগী রাখতে পারছে না। বেসরকারি উদ্যোক্তারা কলকারখানা স্থাপন করতে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না, গ্যাস পাচ্ছেন না, পানি পাচ্ছেন না, পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থাও ভঙ্গুর। তারপরও উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে চাইছেন, করছেন। কিন্তু এদিকেও সরকার তাঁদের থেকে অনেক পিছিয়ে। অন্যদিকে দুর্নীতিতে সরকারের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই এগিয়ে আছে। দুর্নীতির কবলে জাতি আজ বিপর্যস্ত। জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক ও লজ্জাকর।
বাংলাদেশের আরও দুর্ভাগ্য যে ১৯৭১ সালে লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের যেসব সমস্যা নিষ্পত্তি হয়েছে, বারবার অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক সেনাশাসনে তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এই অসাম্প্রদায়িক দেশটাকে পেছনে ঠেলেছে। একাত্তরের ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে একটি রাজনৈতিক দল অবস্থান নিয়েছে, শুধুই ক্ষমতার লোভে, যা দেশের জন্য মোটেই মঙ্গলকর নয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত দেশটিতে মূঢ় সেনাশাসকেরা নাগরিকত্বের আড়ালে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে এক সাংঘর্ষিক ও বিভক্তির রাজনীতির সূচনা করেছে। সৎ, যোগ্য ও আদর্শবান রাজনীতিবিদদের পেছনে ফেলে দুর্নীতিবাজ, সুযোগসন্ধানী ও ব্যবসাকেন্দ্রিক রাজনীতি আমাদের ওপর চেপে বসেছে।
এসব সত্ত্বেও আমি আশাবাদী। কারণ, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে, যা এখন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। মানুষকে, বিশেষ করে যুবসমাজকে একাত্তরের মতো আবারও স্বপ্ন দেখাতে হবে। একাত্তরে যেমন বাঙালি প্রমাণ করেছে তারা যুদ্ধ করতে জানে, তেমনি আরও প্রমাণ করবে তারা সর্বক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করতে পারে। কৃষিনির্ভর বাঙালি এখন ব্যবসা করতে শিখেছে, নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে শিখেছে এবং সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক যে একটা মেধাবী যুবসমাজ আত্মপ্রকাশ করছে, যারা সমাজ পরিবর্তনে সক্ষম হবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।
এখন আমাদের যা করতে হবে তা হলো, ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিকতা থেকে রাজনীতিকে উদ্ধার করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে গড়ে তুলতে হবে সত্যিকার গণতন্ত্র চর্চার সংস্কৃতি। যাঁর যা দায়িত্ব তা নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে পালন করতে হবে। রাজনীতিবিদকে রাজনীতি, সশস্ত্র বাহিনীকে প্রতিরক্ষা, ব্যবসায়ীকে ব্যবসা, শিক্ষককে জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষাদান, চিকিৎসককে চিকিৎসা, ছাত্রদের লেখাপড়া, সাংবাদিকদের সাংবাদিকতা, সরকারি চাকরিজীবীদের সততা, নিষ্ঠা ও যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন, কৃষক-শ্রমিককে উৎপাদনের কাজে, অর্থাৎ যাঁর যে পেশা, তাঁকে সেই পেশায় একাগ্রভাবে কাজ করতে হবে। তাহলেই দেশের সমস্যা সমাধান সহজ হবে। ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। আমাদের সবার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।
যাঁরা সরকার ও দেশ পরিচালনা করছেন, যাঁরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের আসনে রয়েছেন, তাঁদের সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে চাই, দেশ তোমাকে কী দিয়েছে সেটি বড় কথা নয়, দেশকে তুমি কী দিতে পার, সেটাই বড় কথা। একাত্তরের শহীদেরা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, তাঁরা দেশ ও দেশের মানুষের কাছে কিছুই প্রত্যাশা করেননি। আমাদের রাজনীতিকেরাও যদি সেবা ও ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করতেন, তাহলে এই দেশটির চেহারাই বদলে যেত।
আনোয়ার উল আলম শহীদ: মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক রাষ্ট্রদূত।
No comments