খসড়া জাতীয় কৃষিনীতি ২০১০ by এ এম এম শওকত আলী
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েই ১৯৯৯ সালে প্রথম জাতীয় কৃষিনীতি প্রণীত হয়। সময়ের প্রয়োজনে যেকোনো উন্নয়নবিষয়ক নীতি পর্যালোচনা করে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বলা যায়, বর্তমান পদক্ষেপ সময়োচিত। খসড়া নীতিতে ভূমিকা ও উপসংহারসহ সর্বমোট ১৩টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। নীতির দুই ক্রমিকে কৃষি (ফসল) খাতের শক্তিশালী বা সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রসহ দুর্বলতা, সুযোগ এবং হুমকির ক্ষেত্রও চিহ্নিত করা হয়েছে। শক্তিশালী ও দুর্বল ক্ষেত্রগুলো পর্যালোচনা করে বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করা সম্ভব।
এক. বছরব্যাপী সাধারণত অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করে। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির সঙ্গে এ বিষয়টি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। বলা যেতে পারে, এ কারণেই সাধারণত শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া হুমকির ক্ষেত্র হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণাক্ততা ইত্যাদির কথাও বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নটি হলো বৃষ্টির পরিমাণসহ সব অঞ্চলে এর প্রাপ্তি কি একই ধরনের হচ্ছে না এখন কিছু পরিবর্তন হয়েছে। উল্লেখ্য, সব অঞ্চলে ফসলের প্রয়োজন অনুসারে বৃষ্টি না হলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হবে।
দুই. শক্তিশালী ক্ষেত্রের মধ্যে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বলা হয়েছে যে সেচের জন্য পানি রয়েছে। কথাটা আংশিক সত্যি। নীতিতে বিস্তারিত বিবরণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শতকরা ৯০-৯৫ শতাংশ ফসলি জমির সেচ পরিচালিত হয় ক্ষুদ্র সেচের মাধ্যমে। কথাটি সঠিক হলেও এর মধ্যে যে একটি বিরাট হুমকি বিদ্যমান সে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। হুমকি হলো অত্যধিক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার, যা পরিবেশ সুরক্ষার অন্তরায়।
উল্লেখ্য, আশির দশক থেকেই কৃষি ও পানিবিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে সাবধানবাণী ক্রমাগত উচ্চারণ করছেন। শুকনো মৌসুমে ভূ-উপরস্থ পানির স্বল্পতার জন্যই ভূগর্ভস্থ পানির উৎস অধিক মাত্রায় ব্যবহৃত। এ ক্ষেত্রে বৃষ্টিনির্ভর চাষ করার জন্য কী কৌশল অবলম্বন করা যায় সে বিষয়ে নীতি কোনো দিকনির্দেশনা দেয়নি। তবে বিস্তারিত বিবরণে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। নীতির এ অংশের শিরোনাম হলো সেচযোগ্য পানির উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা। একই সঙ্গে দুটি সেচযন্ত্রের মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব নির্ধারণের বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়টির ইতিহাস আশির দশকের। ওই সময় কৃষি মন্ত্রণালয় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার সুষম করার লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন ও জারি করে, যা কিছু দাতা গোষ্ঠীর চাপে কার্যকর হয়নি। কারণ ওই সময় তাদের উন্নয়ন দর্শনে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ অবাধ করাই ছিল অন্ধ কৌশল। পরবর্তী পর্যায়ে কৃষি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে দূরত্বের বিষয়টি নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছিল। এ চেষ্টা কতদূর সফল হয়েছে তা অনুসন্ধানযোগ্য। এ বিষয়টি নিয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বিএডিসির মধ্যে মতবিরোধ এখনো রয়েছে। এ ছাড়া একটি বড় প্রশ্ন হলো সেচযন্ত্রের অবাধ বেসরকারিকরণের ফলে এ চেষ্টা আদৌ সফল হবে কি না। এ প্রসঙ্গে নীতিতে এ কথাও বলা হয়েছে যে বিএডিসি, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য সংস্থা ভূগর্ভস্থ পানির জোনিং ম্যাপ হালনাগাদ করবে। এ কাজটির বর্তমান অবস্থা কী?
তিন. বীজ এবং এ-সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ের জন্য কিছু ভালো কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে (ক) ব্যক্তি, কম্পানি এবং অন্যান্য সংস্থাকে উদ্ভিদ প্রজননসহ মৌল ও ভিত্তি বীজ আমদানি করার জন্য উৎসাহিত করা হবে। এ সুযোগ ঘোষিত বীজ যথা ধান, গম ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ অংশের প্রথমেই বলা হয়েছে, উচ্চ মানসম্পন্ন বিভিন্ন ফসলের বীজের অধিকাংশই সরকারি খাত সরবরাহ করে থাকে। এ দাবি সঠিক নয়। ১৯৯৩ সালের বীজনীতিতে প্রথমবারের মতো সরকারি পর্যায়ে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট খাতে মৌল বীজ বেসরকারি খাতসহ এনজিওদের ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ নীতি কার্যকর হয় ১৯৯৬-২০০১ সময়ে। এ নীতি কার্যকর করার ফলে বীজ সরবরাহের দৃশ্যপট এখন ভিন্নতর। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০৩টি বেসরকারি সংস্থা বোরো বীজের শতকরা ৬৬ ভাগ বিপণন করেছে। অর্থাৎ তাদের অংশই অধিকতর। বিএডিসির অংশ ১০ শতাংশ। আটটি এনজিওর অংশ মাত্র আট শতাংশ। আমনের ক্ষেত্রে বিএডিসির অংশ সর্বাধিক। ৪৬ শতাংশ। বেসরকারি খাতের অংশ ১০ শতাংশ এবং এনজিওদের ১ শতাংশ। আমনের ক্ষেত্রে বেসরকারিসহ এনজিও খাত কেন পিছিয়ে রয়েছে, সে বিষয়টি অনুসন্ধানযোগ্য। এদের অংশগ্রহণ সম্প্রসারণ করতে পারলে আমনের উৎপাদনের জন্য কৃষকদের অধিকতর সুযোগ হবে। ফসল উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে।
চার. নীতির এক অংশে কৃষি সম্প্রসারণ সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণমাধ্যম ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সনাতনীসহ উন্নত মাধ্যম যথা টিভি ও ডিজিটাল পদ্ধতির তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার হবে। বাস্তবতা হলো, কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি তথ্য সরবরাহ সংস্থা ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে। এসব কাজের জন্য বেসরকারি খাতসহ এনজিওদের সম্পৃক্ততার বিষয় কিছু বলা হয়নি। অথচ এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে সার ও বীজ ডিলারদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসব উপকরণ-সংক্রান্ত সম্প্রসারণ করা সম্ভব।
পাঁচ. কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে এক অংশে তিনটি বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে যেমন_(ক) জাতীয় গবেষণা সংস্থা সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে অংশীদারিত্বের সুযোগ সৃষ্টি করবে, (খ) বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল অন্যান্য গবেষণা সংস্থার পরিপূরক ভূমিকা পালন করবে। এ কাউন্সিলের আইনি ভূমিকা সমন্বয় সাধন পরিপূরক ভূমিকা নয়, (গ) কৃষি মন্ত্রণালয় গবেষণা ও সম্প্রসারণ ব্যবস্থার যোগসূত্র শক্তিশালী করবে। এ সবই সঠিক নীতি। তবে কার্যকর করার ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন করা যায়। কারণ, অতীতেও এসব বিষয়ের উল্লেখ ছিল। বিশেষ করে গবেষণা ও সম্প্রসারণ যোগসূত্র শক্তিশালী করার জন্য অতীতে একাধিক বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়িত করা হয়। এ সত্ত্বেও সমস্যার পূর্ণ সমাধান হয়নি। তবে এ কথা বলা যায়, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্প বর্তমানে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর আগে এ লক্ষ্য অর্জনে একটি জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি কমিটি গঠন করা হয়। এর বিস্তৃতি মাঠপর্যায়েও ছিল। এখন এ কাঠামো আংশিকভাবে বিদ্যমান। এর কারণ বিশ্বব্যাংক সমর্থিত প্রকল্প এলাকার বাইরেই এ কাঠামোর অধিক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে মুখ্য বিষয়টি হলো, নানা প্রকল্পের আওতায় সময়ে সময়ে ভিন্ন কাঠামো সৃষ্টি করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিশ্বব্যাংক সমর্থিত বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের নিয়ে দল গঠন করা হয়েছে। এর নাম সমমনা দল যা ইংরেজিতে ঈড়সসড়হ ওহঃবৎবংঃ ৎেড়ঁঢ়। অতীতে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা বা আইপিএমের আওতায় আইপিএম ক্লাব গঠন করা হয়। পরে এর কার্যপরিধি সম্প্রসারণ করে সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা দল বা ওহঃবমৎধঃবফ ঈৎড়ঢ় গধহধমবসবহঃ ৎেড়ঁঢ় করা হয়। সারা দেশে বর্তমানে ১৮০০০ আইসিএম ক্লাব নামে কৃষক সংগঠন বিদ্যমান। অথচ এদের দিকে কোনো নজর নেই। কৃষি সম্প্রসারণ ব্যবস্থাপনায় কৃষি তথ্য সংস্থা এ দলকে ব্যবহার করছে। বিভিন্ন নামের দল গঠন করা হলে বিভ্রান্তিরই সৃষ্টি হবে। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ছয়. নীতির এক অংশে বলা হয়েছে, সরকার প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ও মানবসম্পদ-সংক্রান্ত বিষয়ে অসমতা দূরীভূত করার প্রচেষ্টা চালাবে। এর প্রয়োজন রয়েছে। তবে অগ্রাধিকার ক্ষেত্র হবে ভিন্নতর। যেসব অঞ্চল কৃষি উৎপাদনে অনগ্রসর সেদিকে আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন উপকূলীয় জেলা। লবণাক্ততার হুমকিসহ সেচের অভাব এখানে প্রকট। এ ধরনের অসমতা অগ্রাধিকার পাওয়া যুক্তিযুক্ত।
সবশেষে বলা যায়, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বিষয়টি হলো খাদ্য পুষ্টি উন্নয়ন। অর্থাৎ কোন ফলমূল শাকসবজিসহ কোন কৃষিজাত পণ্যে সহজে পুষ্টি লাভ করা যায় সে বিষয়টি। ১৯৯৯ সালের কৃষিনীতিতে এর উল্লেখ ছিল। 'পুষ্টি' বিষয় হিসেবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধিক্ষেত্রভুক্ত। কিন্তু ওই মন্ত্রণালয়ে ওষুধ সেবনের মাধ্যমকেই গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন দর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য অঙ্গ হলো কৃষি, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির মাধ্যমে মানব উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এ তিনটি বিষয়ের যোগসূত্র শক্তিশালী করার বিষয়টি উপেক্ষা করা সঠিক নয়। এ ছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে 'ফলিত গবেষণা সংস্থা' নামে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পত্রিকান্তরে দেখা যায়, সম্প্রতি এ সংস্থাকে স্থায়িত্ব প্রদানের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
দুই. শক্তিশালী ক্ষেত্রের মধ্যে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বলা হয়েছে যে সেচের জন্য পানি রয়েছে। কথাটা আংশিক সত্যি। নীতিতে বিস্তারিত বিবরণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শতকরা ৯০-৯৫ শতাংশ ফসলি জমির সেচ পরিচালিত হয় ক্ষুদ্র সেচের মাধ্যমে। কথাটি সঠিক হলেও এর মধ্যে যে একটি বিরাট হুমকি বিদ্যমান সে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। হুমকি হলো অত্যধিক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার, যা পরিবেশ সুরক্ষার অন্তরায়।
উল্লেখ্য, আশির দশক থেকেই কৃষি ও পানিবিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে সাবধানবাণী ক্রমাগত উচ্চারণ করছেন। শুকনো মৌসুমে ভূ-উপরস্থ পানির স্বল্পতার জন্যই ভূগর্ভস্থ পানির উৎস অধিক মাত্রায় ব্যবহৃত। এ ক্ষেত্রে বৃষ্টিনির্ভর চাষ করার জন্য কী কৌশল অবলম্বন করা যায় সে বিষয়ে নীতি কোনো দিকনির্দেশনা দেয়নি। তবে বিস্তারিত বিবরণে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। নীতির এ অংশের শিরোনাম হলো সেচযোগ্য পানির উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা। একই সঙ্গে দুটি সেচযন্ত্রের মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব নির্ধারণের বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়টির ইতিহাস আশির দশকের। ওই সময় কৃষি মন্ত্রণালয় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার সুষম করার লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন ও জারি করে, যা কিছু দাতা গোষ্ঠীর চাপে কার্যকর হয়নি। কারণ ওই সময় তাদের উন্নয়ন দর্শনে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ অবাধ করাই ছিল অন্ধ কৌশল। পরবর্তী পর্যায়ে কৃষি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে দূরত্বের বিষয়টি নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছিল। এ চেষ্টা কতদূর সফল হয়েছে তা অনুসন্ধানযোগ্য। এ বিষয়টি নিয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বিএডিসির মধ্যে মতবিরোধ এখনো রয়েছে। এ ছাড়া একটি বড় প্রশ্ন হলো সেচযন্ত্রের অবাধ বেসরকারিকরণের ফলে এ চেষ্টা আদৌ সফল হবে কি না। এ প্রসঙ্গে নীতিতে এ কথাও বলা হয়েছে যে বিএডিসি, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য সংস্থা ভূগর্ভস্থ পানির জোনিং ম্যাপ হালনাগাদ করবে। এ কাজটির বর্তমান অবস্থা কী?
তিন. বীজ এবং এ-সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ের জন্য কিছু ভালো কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে (ক) ব্যক্তি, কম্পানি এবং অন্যান্য সংস্থাকে উদ্ভিদ প্রজননসহ মৌল ও ভিত্তি বীজ আমদানি করার জন্য উৎসাহিত করা হবে। এ সুযোগ ঘোষিত বীজ যথা ধান, গম ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ অংশের প্রথমেই বলা হয়েছে, উচ্চ মানসম্পন্ন বিভিন্ন ফসলের বীজের অধিকাংশই সরকারি খাত সরবরাহ করে থাকে। এ দাবি সঠিক নয়। ১৯৯৩ সালের বীজনীতিতে প্রথমবারের মতো সরকারি পর্যায়ে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট খাতে মৌল বীজ বেসরকারি খাতসহ এনজিওদের ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ নীতি কার্যকর হয় ১৯৯৬-২০০১ সময়ে। এ নীতি কার্যকর করার ফলে বীজ সরবরাহের দৃশ্যপট এখন ভিন্নতর। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০৩টি বেসরকারি সংস্থা বোরো বীজের শতকরা ৬৬ ভাগ বিপণন করেছে। অর্থাৎ তাদের অংশই অধিকতর। বিএডিসির অংশ ১০ শতাংশ। আটটি এনজিওর অংশ মাত্র আট শতাংশ। আমনের ক্ষেত্রে বিএডিসির অংশ সর্বাধিক। ৪৬ শতাংশ। বেসরকারি খাতের অংশ ১০ শতাংশ এবং এনজিওদের ১ শতাংশ। আমনের ক্ষেত্রে বেসরকারিসহ এনজিও খাত কেন পিছিয়ে রয়েছে, সে বিষয়টি অনুসন্ধানযোগ্য। এদের অংশগ্রহণ সম্প্রসারণ করতে পারলে আমনের উৎপাদনের জন্য কৃষকদের অধিকতর সুযোগ হবে। ফসল উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে।
চার. নীতির এক অংশে কৃষি সম্প্রসারণ সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণমাধ্যম ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সনাতনীসহ উন্নত মাধ্যম যথা টিভি ও ডিজিটাল পদ্ধতির তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার হবে। বাস্তবতা হলো, কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি তথ্য সরবরাহ সংস্থা ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে। এসব কাজের জন্য বেসরকারি খাতসহ এনজিওদের সম্পৃক্ততার বিষয় কিছু বলা হয়নি। অথচ এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে সার ও বীজ ডিলারদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসব উপকরণ-সংক্রান্ত সম্প্রসারণ করা সম্ভব।
পাঁচ. কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে এক অংশে তিনটি বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে যেমন_(ক) জাতীয় গবেষণা সংস্থা সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে অংশীদারিত্বের সুযোগ সৃষ্টি করবে, (খ) বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল অন্যান্য গবেষণা সংস্থার পরিপূরক ভূমিকা পালন করবে। এ কাউন্সিলের আইনি ভূমিকা সমন্বয় সাধন পরিপূরক ভূমিকা নয়, (গ) কৃষি মন্ত্রণালয় গবেষণা ও সম্প্রসারণ ব্যবস্থার যোগসূত্র শক্তিশালী করবে। এ সবই সঠিক নীতি। তবে কার্যকর করার ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন করা যায়। কারণ, অতীতেও এসব বিষয়ের উল্লেখ ছিল। বিশেষ করে গবেষণা ও সম্প্রসারণ যোগসূত্র শক্তিশালী করার জন্য অতীতে একাধিক বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়িত করা হয়। এ সত্ত্বেও সমস্যার পূর্ণ সমাধান হয়নি। তবে এ কথা বলা যায়, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্প বর্তমানে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর আগে এ লক্ষ্য অর্জনে একটি জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি কমিটি গঠন করা হয়। এর বিস্তৃতি মাঠপর্যায়েও ছিল। এখন এ কাঠামো আংশিকভাবে বিদ্যমান। এর কারণ বিশ্বব্যাংক সমর্থিত প্রকল্প এলাকার বাইরেই এ কাঠামোর অধিক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে মুখ্য বিষয়টি হলো, নানা প্রকল্পের আওতায় সময়ে সময়ে ভিন্ন কাঠামো সৃষ্টি করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিশ্বব্যাংক সমর্থিত বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের নিয়ে দল গঠন করা হয়েছে। এর নাম সমমনা দল যা ইংরেজিতে ঈড়সসড়হ ওহঃবৎবংঃ ৎেড়ঁঢ়। অতীতে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা বা আইপিএমের আওতায় আইপিএম ক্লাব গঠন করা হয়। পরে এর কার্যপরিধি সম্প্রসারণ করে সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা দল বা ওহঃবমৎধঃবফ ঈৎড়ঢ় গধহধমবসবহঃ ৎেড়ঁঢ় করা হয়। সারা দেশে বর্তমানে ১৮০০০ আইসিএম ক্লাব নামে কৃষক সংগঠন বিদ্যমান। অথচ এদের দিকে কোনো নজর নেই। কৃষি সম্প্রসারণ ব্যবস্থাপনায় কৃষি তথ্য সংস্থা এ দলকে ব্যবহার করছে। বিভিন্ন নামের দল গঠন করা হলে বিভ্রান্তিরই সৃষ্টি হবে। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ছয়. নীতির এক অংশে বলা হয়েছে, সরকার প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ও মানবসম্পদ-সংক্রান্ত বিষয়ে অসমতা দূরীভূত করার প্রচেষ্টা চালাবে। এর প্রয়োজন রয়েছে। তবে অগ্রাধিকার ক্ষেত্র হবে ভিন্নতর। যেসব অঞ্চল কৃষি উৎপাদনে অনগ্রসর সেদিকে আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন উপকূলীয় জেলা। লবণাক্ততার হুমকিসহ সেচের অভাব এখানে প্রকট। এ ধরনের অসমতা অগ্রাধিকার পাওয়া যুক্তিযুক্ত।
সবশেষে বলা যায়, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বিষয়টি হলো খাদ্য পুষ্টি উন্নয়ন। অর্থাৎ কোন ফলমূল শাকসবজিসহ কোন কৃষিজাত পণ্যে সহজে পুষ্টি লাভ করা যায় সে বিষয়টি। ১৯৯৯ সালের কৃষিনীতিতে এর উল্লেখ ছিল। 'পুষ্টি' বিষয় হিসেবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধিক্ষেত্রভুক্ত। কিন্তু ওই মন্ত্রণালয়ে ওষুধ সেবনের মাধ্যমকেই গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন দর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য অঙ্গ হলো কৃষি, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির মাধ্যমে মানব উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এ তিনটি বিষয়ের যোগসূত্র শক্তিশালী করার বিষয়টি উপেক্ষা করা সঠিক নয়। এ ছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে 'ফলিত গবেষণা সংস্থা' নামে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পত্রিকান্তরে দেখা যায়, সম্প্রতি এ সংস্থাকে স্থায়িত্ব প্রদানের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments