শ্রদ্ধাঞ্জলি-একজন মেধাবী ও সৎ শিক্ষাবিদ

ড. এ এস এম আবদুল খালেক। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, সিলেট-এর সাবেক চেয়ারম্যান। ১৩ জানুয়ারি সকালে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু সংবাদটি দৈনিক পত্রিকায় দেখে খুবই মর্মাহত হলাম। জনাব খালেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আমাদের সমসাময়িক ছিলেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের আর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের।


ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তাঁর আত্মীয় সেলিম রেজা বর্তমানে জনশক্তি রপ্তানি ব্যুরোর পরিচালক, এস এম হলে আমার কক্ষসাথি থাকার সুবাদে খালেকের সঙ্গে দু-একবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে তখন আমাদের মাঝে ঘনিষ্ঠতা ছিল—এটা দাবি করা যাবে না। তাঁর সঙ্গে আমার কর্মসূত্রে ঘনিষ্ঠতা হয় ২০০৭ সালে। ২০০৭ সালের মার্চ মাসে আমি অতিরিক্ত সচিব হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগদান করি। খালেক তখন সিলেট মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, অর্থাৎ তিনি আমার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগদানের আগে থেকেই সিলেট বোর্ডে কর্মরত ছিলেন।
শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে আমার নিবিড় কর্ম সম্পৃক্ততা ছিল। মাসিক সমন্বয় সভাসহ বিভিন্ন সভায় তাদের সঙ্গে দেখা হতো, আলোচনা ও মতবিনিময় হতো, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগে আমার দপ্তরে এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার সেন্টারে আমরা বেশ কিছু সভা করতাম। এ ছাড়া বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য, সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা আমার কাছে মাঝেমধ্যে এসেছেন। এই সময় কর্মরত শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানদের মধ্যে জনাব খালেক ছিলেন সদাহাস্যোজ্জ্বল, বিনয়ী, সদালাপী ও সজ্জন। এ মানুষটি অনায়াসে যে কারও মন জয় করতে পারতেন। আমি এক বছর তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি, পরেও আমাদের নিবিড় যোগাযোগ ছিল। সর্বশেষ তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় ২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর। ওই দিন জেএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। বিকেলের দিকে আমার অফিসে আসেন এবং আমাকেও সিলেট বোর্ডের পরীক্ষার ফলাফলের একটি কপি দিয়ে যান। সিলেটে যাওয়ার আমন্ত্রণও জানিয়ে যান। কিন্তু এটাই যে আমার সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা হবে, আমি কি তা কল্পনাও করেছি! তিনি ছিলেন স্বাস্থ্য-সচেতন একজন মানুষ। পরিমিত আহার করতেন। কখনো উত্তেজিত হতেন না। নিরহংকারী, নির্লোভ, সৎ, নৈর্ব্যক্তিক এ মানুষটি কর্মক্ষেত্রেও ছিলেন একেবারেই নির্ঝঞ্ঝাট। প্রায় সাত বছর সিলেট শিক্ষা বোর্ডে দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ বা নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমার জানামতে যে শিক্ষা বোর্ডটিতে কোনো দলাদলি ছিল না, কোনো দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ ছিল না, সেটি হলো সিলেট শিক্ষা বোর্ড। এটি সম্ভব ছিল শুধু বোর্ডের প্রধান খালেকের সততা, নিষ্ঠা, নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি, সজ্জন আচরণ এবং নেতৃত্বদানের দক্ষতার কারণে। আমার বিবেচনায় খালেক বর্তমান সময়ের একজন আদর্শ কর্মকর্তা। তিনি শুধু শিক্ষা ক্যাডারের নন, সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, এক অনন্য, অসাধারণ প্রতিভা। কিন্তু এ মানুষটি মাত্র ৫৪ বছর বয়সে হঠাৎ কেন মারা গেলেন—এটা মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর। খালেকের মৃত্যুতে তাঁর পরিবারই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সমগ্র জাতি। তাঁর সততা, নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ণতা, দেশপ্রেম, নেতৃত্বদানের গুণাবলি এবং সজ্জন আচরণ আমাদের সবার জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। আমি কায়মনোবাক্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
খালেকের অকাল মৃত্যুতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁর পরিবার। তাঁর স্ত্রী ফারহানা, কন্যা খাদিজাতুল কোবরা, যাকে তিনি কাব্যমণি বলে ডাকতেন এবং ছেলে আবদুল্লাহ আল খালেদের প্রতি জানাচ্ছি গভীর সহানুভূতি। কোবরা এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে এবং খালেদ ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। ফারহানা ভাবী, খালেদ ও কোবরাকে বলতে চাই, তাঁরা পরম আপন এ মানুষটিকে চিরতরে হারিয়েছেন। কখনো আর তাঁকে ফেরত পাবেন না। সন্তান দুটিকে নিয়ে ভাবিকে হয়তো অনেক সংগ্রাম করতে হবে। তবে তাঁদের সান্ত্বনা পাওয়ার ও গর্ব করার মতো বিষয় হচ্ছে তাঁরা একজন সৎ, দেশপ্রেমিক ও আদর্শ মানুষের স্ত্রী ও সন্তান।
জনাব খালেককে যাঁরা চেনেন, সম্ভবত এমন একজন মানুষও পাওয়া যাবে না, যিনি তাঁর সম্পর্কে কোনো কটু কথা বলতে পারেন। খালেক ছিলেন সবার প্রিয়, শ্রদ্ধা ও স্নেহের পাত্র। একজন অসাধারণ ভালো মানুষ। আমি আশা করি, এ অনুপ্রেরণা নিয়ে ভাবি, কাব্যমণি ও খালেদ বেঁচে থাকবে। এ মানুষটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে কি না এটি বিবেচনা করে দেখার জন্যও বিনীত আবেদন থাকল।
এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার
সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়

No comments

Powered by Blogger.