ভুয়া লাইসেন্স ও ‘ঐকমত্যের প্রস্তাব’

দেশে ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। তাঁদের এ লাইসেন্স জমা নিয়ে ১৫ দিন থেকে এক মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে বৈধ লাইসেন্স দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ সংগঠনের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন।


পরিবহনখাতের সব নেতাই ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রস্তাবের প্রতি ঐকমত্য প্রকাশ করেন। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তা বিবেচনার আশ্বাস দেন। গতকাল সোমবার এলেনবাড়ীতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) প্রধান কার্যালয়ে যানজট নিরসন ও পরিবহন খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, নৌপরিবহনমন্ত্রী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান, মালিক-শ্রমিক নেতা, পুলিশের প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ ও সড়ক দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারের প্রতিনিধিরা ছিলেন। বৈঠকটি সাংবাদিকদের জন্য উন্মুক্ত ছিল।
প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি হিসেবে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, পরিবহন সেক্টরে নতুন চালক তৈরি করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই অবৈধ লাইসেন্সধারী চালকদের সহজ প্রশিক্ষণ দিয়ে বৈধ লাইসেন্সধারাী চালকে পরিণত করা সম্ভব।
গতকালের বৈঠকে যানজট নিরসন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ, পরিবহন খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু সুপারিশ আসে। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কেবল চালকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে লাইসেন্স দেওয়ার প্রস্তাবটিই যোগাযোগমন্ত্রী বিবেচনায় নেওয়ার আশ্বাস দেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় ছেলে হারানো সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এনাম আহমেদ ১৫ দিন থেকে এক মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকদের বৈধ করে দেওয়ার বিরোধিতা করেন। বৈঠকে তিনি বলেন, ‘যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, সন্তান হারানোর ব্যথা আমি বুঝি। আমার মতো অনেক বাবা-মায়ের বুক খালি হয়ে গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়।’ তিনি দাবি করেন, লাইসেন্স দেওয়ার পরীক্ষা যেন পরীক্ষা মনে করে নেওয়া হয়। লাইসেন্স দিতে হবে, দিয়ে দিলাম—সেভাবে যেন না নেওয়া হয়।
বৈঠকে প্রথমে যোগাযোগমন্ত্রী বক্তব্য দেন। তাঁর বক্তব্যের বেশির ভাগজুড়েই ছিল ঢাকার যানজট এবং এ বিষয়ে কার্যকর কিছু করতে না পারার হতাশা। এরপর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন শাজাহান খান। নৌমন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার পর ইলিয়াস কাঞ্চনকে বক্তব্য দেওয়ার অনুরোধ করেন যোগাযোগমন্ত্রী।
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সারা দেশে পাঁচ লাখ ভুয়া লাইসেন্সধারী চালক আছেন। তাঁদের লাইসেন্সগুলো বিআরটিএতে জমা নিয়ে ১৫ দিন থেকে এক মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে বৈধ লাইসেন্স দেওয়া হোক।
ইলিয়াস কাঞ্চনের বক্তব্যের পর বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী ও ফেডারেশনের অন্যতম নেতা কে এম মোতাহার হোসেন এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব ওসমান আলী তাঁদের বক্তব্যে প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নেন।
এরপর বিআরটিএর চেয়ারম্যান আয়ুবুর রহমান বলেন, পাঁচ লাখ চালককে ট্র্যাকের (মূলধারা) বাইরে রেখে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা যাবে না। তবে তাঁদের কীভাবে ট্র্যাকে আনা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করেই ঠিক করতে হবে।
এ পর্যায়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে থামিয়ে দিয়ে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এ প্রস্তাবের বিষয়ে সবার ঐকমত্য আছে। এটা বিবেচনা করা যেতে পারে।’
এর পরও বিআরটিএর চেয়ারম্যান ও ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক সালেহউদ্দিন প্রস্তাব করেন, একটি কমিটি করে এ বিষয়ে বিধিমালা তৈরি করা যেতে পারে।
যোগাযোগমন্ত্রী তাঁদের থামিয়ে দিয়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি এত ভয় পান কেন? আমাদের কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপাতত অপ্রিয় মনে হতে পারে। ভবিষ্যতের জন্য স্থায়ী স্বস্তি হবে। আমি দুরূহ দায়িত্ব নিয়েছি।’
এ পর্যায়ে শাজাহান খান যোগাযোগমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি দুরূহ নয়, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনার পাশে অনেক শক্তিশালী হাত আছে। আপনি পারবেন।’
এর আগে শাজাহান খান চালকদের সহজ শর্তে পেশাদার লাইসেন্স দেওয়ার দাবি করে ব্যাপক বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন।
উল্লেখ্য, লিখিতসহ যোগ্যতার সব পরীক্ষা ছাড়াই ২৮ হাজার চালককে পেশাদার লাইসেন্স দেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছিল নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। এ নিয়ে নাগরিক আন্দোলন শুরু হয় এবং গত বছরের একটা উল্লেখযোগ্য সময় পর্যন্ত এ নিয়ে বিতর্ক চলে। সর্বশেষ হাইকোর্টে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রক্রিয়ায় লাইসেন্স দেওয়া বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এর মধ্যে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বদল হয়েছে। এ ইস্যুটিও অনেকটা চাপা পড়ে ছিল।
গতকালের বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক, ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) মাহবুবুর রহমান, বিআরটিএর পরিচালক (প্রশাসন) তপন কুমার সরকার প্রমুখ।
অধিকাংশ বক্তা ঢাকার যানজট কমাতে সড়ক থেকে অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ, সংকেতবাতি অনুযায়ী যানবাহন চালানো, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং বন্ধের পরামর্শ দেন।

No comments

Powered by Blogger.