সহজ-সরল-হুমায়ূন আহমেদের পাগল পাঠকরা ভেবে দেখুন by কনকচাঁপা

হুমায়ূন আহমেদ। একটি নাম। একটি ফলক। একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর লেখার মান, বিশেষত্ব, গুণাবলি নিয়ে মন্তব্য করার মতো স্পর্ধা আমার নেই। প্রয়োজনও নেই। বইয়ের পোকার মতো পাঠকদের বাদ দিয়েও যত মানুষ আছে, যারা পাঠ্য বইয়ের প্রয়োজনীয়তা ছাড়া কখনো অন্য বইয়ের প্রচ্ছদে চোখ রাখতে অনিচ্ছুক, তাদের চকোলেট বা আচারের মতো প্রলোভন দেখিয়ে বইয়ের পাতায় আঠা লাগিয়ে বছর বছর (পাঠকদের) বেঁধে রেখেছেন, সেই ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ! যাঁরা


ভালো ও উচ্চমানের পাঠক তাঁরা তো আছেনই। তাঁরা ছাড়াও স্কুল পালানো ও নোটবই পড়া পাঠকও বই কিনতে বাধ্য হয়েছেন। আমাদের হুমায়ূন আহমেদ এই অসম্ভব কাজটি করেছেন জলবৎ তরলভাবে। বইয়ে তাঁর চরিত্ররা কঠিন চোখ-মুখে হাস্যকর কথা বলে ঘুরে বেড়ায়; কিন্তু সবশেষে তা আমাদের অব্যক্ত অনুভূতির পঙ্ক্তিমালা হয়ে দাঁড়ায়। হাস্যরসের মাঝে কঠিন জীবন দর্শন বলা এত সহজ নয়; কিন্তু আমাদের হুমায়ূন আহমেদ? তা সত্যিই সহজে বলে বা লিখে দেন। তিনি যেখানে হাত দেন তা সোনা হয়ে যায়। তা প্রবন্ধ, গল্প, ইতিহাস, ছায়াছবি, গান রচনা, নাটক পরিচালনা, শিল্পী তৈরি-ঘন নিবিড় ভেষজ গ্রাম তৈরি, মানুষকে চমকে দেওয়া যা কিছুই হোক না কেন, সব কিছুতেই তিনি সমান পারদর্শী। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এই সব্যসাচী মানুষটি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রচনা করেছেন তাতে তাঁর মা-বাবা-দাদার নাম দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্যটা শিলালিপিতে বাঁধিয়ে সব কর্মকাণ্ডকে সীমিত করেননি। সব শহীদের তিনি এমনভাব শ্রদ্ধা জানিয়েছেন যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শ্রদ্ধার উষ্ণতা পলে পলে বিকিরণ করে সমগ্র বাংলাদেশের মাটিতে ঘুমিয়ে থাকা শহীদদের ছুঁয়ে দিচ্ছে। উচ্চ শিক্ষার্থে পৃথিবীর সর্বোচ্চ আরামদায়ক (কথিত) দেশে গিয়েও এই বাংলায় ফিরে এসেছেন এবং বিরামহীনভাবে আমাদের সাহিত্য-শিল্পসংলগ্ন অনেক কিছু উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের সেই ভালোবাসার-শ্রদ্ধার মানুষটি আজ কর্কট আক্রোশে আক্রান্ত। তাতে কি কলমযোদ্ধা মোটেও ভীত নন! মৃত্যু নিয়ে তাঁর অনেক ভাবনা_কিন্তু তার জন্য তিনি ভেঙে পড়েননি। তাঁর চিন্তা চিকিৎসা শেষে তিনি যখন দেশে ফিরে আসবেন, তখন তিনি আপামর জনতা অথবা বিত্তশালীদের কাছে অর্থের আহ্বান করবেন একটি ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি করার লক্ষ্যে। আমাদের এই লেখক নিউ ইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোন-ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসা নিচ্ছেন_এটা আমরা কমবেশি সবাই জানি। আমরা সব বাংলা ভাষাভাষী ও বাংলাদেশিরা কায়মনোবাক্যে শ্রষ্টার কাছে তাঁর রোগমুক্তি কামনা করছি। কিন্তু এটা ছাড়াও আরেকটি কথা আমি বলতে চাইছি। স্বভাবতই আমেরিকায় এই হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা হচ্ছে ব্যয়বহুলভাবে। যাতায়াত ভাড়া, থাকা-খাওয়া এই ব্যয়কে আরো বড় করে তুলছে। যা বহন করা সাধারণ মানুষের কাছে তো বটেই, তাঁর কাছেই ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু নিজের জন্য তিনি ভাবছেন না। তিনি ভাবছেন এমন একটি হাসপাতাল কি আমাদের দেশে তৈরি করা যায় না? অবশ্যই যায়। খোদ আমেরিকায়ও এমন হাসপাতাল ১৯৮৪ সালের আগে ছিল না। এই চিন্তা থেকেই সস্ত্রীক জন এস্টর এই হাসপাতালটি নির্মাণ করেন এবং এর উন্নতিকল্পে পরবর্তী সময় একটি গাড়ি নির্মাণ সংস্থার কর্মকর্তা আলফ্রেড প্রিটচার্ড ক্লোনন ও চার্লস ফ্রাংকলিন ক্যাটারিং যৌথভাবে এই হাসপাতালের পূর্ণরূপ দান করেন। আমাদের দেশে অনেক বিত্তশালীর এত টাকা আছে যা থেকে কিছুটা দিলে এমন হাসপাতাল তৈরি করার কথা ভাবা যায় অবশ্যই। এমন হতে পারে ১০ জন বিত্তবান মানুষ অর্থ দান করলেন_হাসপাতালটির ১০টি কক্ষ তাঁদের নামে হলো। আবার এমনও হতে পারে শুধু বিত্তশালী না সাধারণ জনগণও (যে যা পারে) পয়সা দিতে থাকল। হাসপাতালের কোথাও ডিসপ্লে সেন্টারে তাঁদের নাম অনবরত উঠতেই থাকল। আসুন না আমাদের হুমায়ূন আহমেদ আমাদের কাছে ফিরে আসার আগেই হাসপাতালটি তৈরির জন্য একটা তহবিল গঠন করে ফেলি। তিনি তো আমাদের অনেক দিয়েছেন, তিনি কেন হাত পাতবেন_তাঁর আসার আগেই এ কাজটি একটু গুছিয়ে রাখি। এটুকু অন্তত তাঁর জন্য আমরা করতেই পারি। আর শুধু তাঁর জন্য হবে কেন, সেটা তৈরি হলে আমরাই তো চিকিৎসাসেবা পাব। যে হারে ভেজাল খাচ্ছি_সবাইকেই তো ওই পথেই পৃথিবী ছাড়তে হবে বলে মনে হচ্ছে। আসুন পাঠক তাঁকে আমরা হাত পাতার আগেই প্রাপ্য সম্মানটুকু ফেরত দিয়ে তাঁর আশা পূরণে সহায়তা করি। যদিও শিল্পীদের ঋণ কখনো শোধ হয় না_তবুও। তিনি যদি এসে দেখেন তাঁর স্বপ্ন পূরণের সিংহভাগ কাজ জনগণ এগিয়ে দিয়েছে তখন তাঁর কেমন লাগবে ভেবে দেখুন হুমায়ূন আহমেদের পাগল পাঠকরা!

লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.