ইউরোশিয়া, না সোভিয়েত ইউনিয়ন?-ইউরোপের চিঠি by দাউদ হায়দার
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে; কিন্তু রাশিয়া কিছুতেই বরদাশত করেনি ন্যাটোর কসোভো-বসনিয়া যুদ্ধ। তীব্র প্রতিবাদ করেছে বটে, তবে ওই প্রতিবাদ আদৌ পাত্তা দেয়নি আমেরিকাসহ নাটোভুক্ত দেশগুলো। কেন দেবে? বরিস ইয়েলৎসিনের মেরুদণ্ড বলে কিছু নেই, জানে আমেরিকা। ইয়েলৎসিন নির্ভরশীল আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেনের দয়াদাক্ষিণ্যে।
এক সময় মহাপরাক্রমশালী সোভিয়েত রাশিয়ার পতনে মিখায়েল গর্বাচেভ যে খুব ব্যথিত তা কখনোই মনে হয়নি আমার। অন্তত ১০ বার তার সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিয়েছি। এক সংবাদ সম্মেলনে (১৯৯২) প্রশ্ন করি, 'প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (সিনিয়র) সিআইএ'র কর্তা ছিলেন। নিজে দেখভাল করতেন পূর্ব ইউরোপ, রাশিয়াসহ সব কমিউনিস্ট দেশ। আপনি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট হয়ে তথাকথিত গ্গ্নাসনস্ত, পেরেস্ত্রোইকার নামে, শান্তির অছিলায়, চারবার কী গোপন আলোচনা করেছেন বুশের সঙ্গে? আলোচনার মূল বিষয় কেন খোলাসা করেননি?
_এই প্রশ্নে এতটাই ক্ষিপ্ত হন, উত্তর না দিয়ে সংবাদ সম্মেলন থেকে বেরিয়ে যান। প্রশ্নেই যিনি রেগে যান, তার কাছে গণতন্ত্র দুরাশা। ঠিক এই কথাই লিখেছিল সাপ্তাহিক ড্যের স্পিগেল।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ড্যের স্পিগেল জরিপ চালিয়েছিল গর্বাচেভকে নিয়ে। ৮০ ভাগ রুশির কাছে তিনি ঘৃণ্য। ১৭ ভাগের কাছে আবর্জনা। তিন ভাগের কাছে মহান। ৫৯.০৪ ভাগ মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস, আমেরিকান ডলার খেয়ে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙেছেন গ্গ্নাসনস্ত, পেরেস্ত্রোইকার নামে। ইউরোপ-আমেরিকায় মিখায়েল গর্বাচেভ এখনও তুমুল জনপ্রিয়। কিন্তু নিজ দেশে পরবাসী। একঘরে।
এতটাই একঘরে যে, চিকিৎসার জন্য বার্লিনে আসেন। যেমন আসতেন বরিস ইয়েলৎসিন। তিনিও রুশ চিকিৎসকদের বিশ্বাস করতেন না। বার্লিনের হাসপাতালে ট্যাবলেট গিলে গর্বাচেভ বলেন, 'আহ! মার্কিন গণতান্ত্রিক ট্যাবলেট। কী আনন্দ।' যেহেতু রসিকতা, ধর্তব্য নয়। কিন্তু রস এক লহমায় তৈরি হয় না এবং রসের উৎপত্তি শিকড় থেকেই। এই শিকড়ের অনুসন্ধান করেছেন ট্যুবিঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব ইউরোপের সোশ্যাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল বিভাগের অধ্যাপিকা ক্লাউডিয়া হোলৎসবার্গার। বলছেন, তার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থে ('কুয়ানটিটিয়াট ফর কুয়ালিটিয়্যাট। পৃষ্ঠা :১০২)। মিখায়েল গর্বাচেভ পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্গ্নাসনস্ত, পেরেস্ত্রোইকা তত্ত্ব আবিষ্কার করে কমিউনিজম ধ্বংসের পথে এগিয়েছেন।' এ গ্রন্থে কমিউনিজমের পক্ষে যত গুণগান, গর্বাচেভের বিরুদ্ধে ষোলআনা বিষ-উদ্গিরণ। আশ্চর্য ঘটনা বৈকি। লেখিকা মার্ক্স, কমিউনিস্টের নাম শুনলেই জ্বলেপুড়ে জামাকাপড় খোলেন, বাপ-মা তুলে গালাগাল দেন (তার বহু লেখায়), তিনিই কি-না এখন গর্বাচেভের মার্কিনপ্রেম, গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন? এ কী কথা মন্থরার মুখে!
'গর্বাচেভের দূরদৃষ্টি ও বিশ্ব রাজনীতি' শিরোনামে একটি উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয় লন্ডনের দ্য টাইমসে, বার্লিন দেয়াল ধসের চার দিন পরই (১৩.১১.১৯৮৯)। গর্বাচেভের রাজনৈতিক 'ভিশন' কতটা সফল এবং শুরু পূর্ব জার্মানি দিয়ে, কমিউনিজম ধ্বংসের মাধ্যমে_ লিখেছেন মার্টিন ওয়াকার।
গর্বাচেভের দূরদৃষ্টি ছিল বৈকি! না থাকলে ভ্লাদিমির পুতিনকে কী করে আবিষ্কার করলেন? ১৯৮৫ সালে মিখায়েল গর্বাচেভ ২৩ জন হাই র্যাংকিং জেবি অফিসারকে ডিঙিয়ে বত্রিশ-উত্তীর্ণ-যুবা পুতিনকে পূর্ব জার্মানির ড্রেসডেনে পাঠান পূর্ব জার্মানিসহ পূর্ব ইউরোপের কেজিবি প্রধান করে। স্মরণ রাখছি, তখন ড্রেসডেন ছিল পূর্ব ইউরোপের কেজিবির প্রধান কার্যালয় তথা হেডকোয়ার্টার। ফরাসি, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ এবং পূর্ব ইউরোপের তিনটি দেশের ভাষা জানেন। চমৎকার ইংরেজি বলেন। আর জার্মান তো প্রায় মাতৃভাষা।
ভাষা শেখার কারণও একাধিক। যেহেতু পূর্ব ইউরোপে কেজিবি প্রধান, তাই কেবল চোখ-কান খোলা রাখাই পহেলা শর্ত নয়, ভাষা জানাও অত্যন্ত জরুরি। সাধারণ মানুষের কথা, রাজনীতিকদের কথা, রাজনীতির হালহকিকত জানতেই হবে। পুতিন যেহেতু অতিশয় ধুরন্ধর, পূর্ব জার্মানিতে থাকাকালে চটপট বুঝে যান, পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম ইউরোপের সদর ও অন্দরমহলের চেহারা এবং মুখোশ কীভাবে, কখন পাল্টায়।
বলা হয়, ভ্লাদিমির পুতিন গণতন্ত্রী নন, মার্কিনঘেঁষা তো ননই, বরং হাড়েমজ্জায় কমিউনিস্ট। বহিরঙ্গে গণতন্ত্রের মুখোশধারী, অন্তরঙ্গে কমিউনিস্ট। জর্জ বুশ (জুনিয়র) একবার বলেছিলেন, 'গর্বাচেভ, ইয়েলৎসিনকে যতটা বিশ্বাস করা যেত, পুতিনকে নয়।' পুতিনের উত্তর ছিল চমৎকার :'ওই বিশ্বাসের মাশুল দিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন।' ওই যে বলা হচ্ছে_ 'হাড়েমজ্জায় কমিউনিস্ট', কারণও আছে।
ভ্লাদিমির (ভ্লাদিমিরোভিচ) পুতিন লিখছেন তার আত্মজীবনীতে : 'ওট পারভোগো লিস্তা' (ইন দ্য ফার্স্ট পারসন) :'আমার ঠাকুরদা স্পিরিডোন ইভানোভিচ পুতিন (১৮৭৯-১৯৬৫) ছিলেন মহামতি লেনিনের পাচক। লেনিনের মৃত্যুর পর তার (লেনিন) স্ত্রী মেডেজদা ত্রুক্রপস্কায়া আমার ঠাকুরদাকেই পাচক বহাল রাখেন। পাচক হলেও তিনি লেনিন ও ত্রুক্রপস্কায়ার কাছে কমিউনিজমের মূল মসলা কী, জেনে নেন। জোসেফ স্টালিনেরও স্পেশাল পাচক ছিলেন আমার ঠাকুরদা।'
পুতিনের জন্মদিন ৭ অক্টোবর (জন্ম :৭.১০.১৯৫২। লেনিনগ্রাদ। এখন সেন্ট পিটার্সবুর্গ)। আগামী বছর ষাট। তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী নন। তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট। খুব ধুমধাম করে হয়তো পালিত হবে জন্মদিন। ৬০ বছর হলে ইউরোপে যেমন হয়।
পুতিনের উত্থান চমকপ্রদ। সংক্ষিপ্ত এই : বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেই কেজিবিতে যোগদান (১৯৭৫)। ১০ বছরের মধ্যেই সরকারের উঁচু মহলের নজর কেড়ে জার্মানির ডেসডেনে পূর্ব ইউরোপের কেজিবিপ্রধান। ২৬ মার্চ, ১৯৯৭ সালে ইয়েলৎসিন তাকে ডেপুটি চিফ অব প্রেসিডেন্টসিয়াল স্টাফের দায়িত্ব দেন। দুই বছর পর (৯ আগস্ট, ১৯৯৯) তিনজন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর একজন। বরিস ইয়েলৎসিন তাকেই উত্তরাধিকার হিসেবে পছন্দ করতেন, বলেওছেন বারবার। ইয়েলৎসিন অকস্মাৎ পদত্যাগ করেন ৩১ ডিসেম্বর (১৯৯৯)। ওইদিন অ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিন দায়িত্ব নেন। তিন মাস পর নির্বাচন (২৬ মার্চ, ২০০০)। প্রথম রাউন্ডে জয়ী। দ্বিতীয় রাউন্ডেও। ৭ মে, ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ।
দ্বিতীয়বারও (২০০৪-২০০৮) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী। রাশিয়ার সংশোধিত সংবিধান (১৯৯২) অনুযায়ী একটানা দুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিধান নেই। প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় বাধা নেই। প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পুতিন বেছে নেন কে তার কথায় ওঠবস করবে। কে বশংবদ। পেয়ে যান দিমিত্রি (আনাতোলেয়েভিচ) মেদভেদেভকে (জন্ম ১৪.৯.১৯৬৫)। মেদভেদেভ আইনের ছাত্র। আইনের অধ্যাপক এবং বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র ক্ষমতার অন্দরমহলে ঢুকে অভিজ্ঞ। প্রশাসনেও বিজ্ঞ। পুতিনই তাকে প্রশ্রয় দিয়ে গড়েপিটে তৈরি করেছেন। মেদভেদেভও লেনিনগ্রাদের। অতএব ঘরের মানুষ। বিশ্বাসযোগ্য। পুতিনই তাকে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেন। শর্ত এই, এক টার্ম পর পদত্যাগ করতে হবে। মেনে নেন। আগামী বছর মার্চে রুশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। পুতিন প্রতিদ্বন্দ্বী। ত্যাগ করবেন প্রধানমন্ত্রীর পদ। রাশিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর কোনো পাওয়ার নেই। যেমন নেই বাংলাদেশ ও ভারতের রাষ্ট্রপতির। এই পোস্ট আলঙ্কারিক। বাংলাদেশ-ভারতের রাষ্ট্রপতির কথায় প্রধানমন্ত্রী চলেন না। রাশিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর কথায় প্রেসিডেন্টের চলার কথা নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পুতিনের পরামর্শ, নির্দেশ ছাড়া দিমিত্রি (আনাতোলেয়েভিচ) মেদভেদেভ একচুল নড়েন না।
পুতিনের আমলে যতবারই মস্কোয় গেছি, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, পুতিনকে খুব পছন্দ করেন। জানিয়ে রাখা ভালো, রাশিয়ার ৩৩.০২ ভাগ মানুষ এখনও কমিউনিজমের পক্ষে। কমিউনিজমের জন্য আন্দোলনও দানা বাঁধছে ক্রমে। বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার কারণেই।
পুতিন কেন জনপ্রিয়, সহজেই বোধগম্য। নিজেকে গণতন্ত্রী বলে জাহির করেন না। কমিউনিস্ট বলেও চিৎকার করেন না। এই মৌন অবলম্বনে আমেরিকা-ইউরোপ হদিস পাচ্ছে না পুতিনের মতলব কী। সোভিয়েত রাশিয়া ধসের পর ২০০০ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার অবস্থা এতটাই খারাপ, প্রায় দারিদ্র্যসীমায় পেঁৗছে যায়। ওই সময় বছর চারেক রাশিয়ায় গিয়ে নিজেকে কুবের মনে হয়। একশ' ডয়েচ মার্কে ১০ হাজার রুবল! ভাবা যায়? পুতিন ক্ষমতাসীন হয়েই আমূল পরিবর্তন। দুই বছরের মধ্যেই ইনফ্লেশন রোধ, তাই নয় শুধু, মাসিক আয় ৮০ থেকে ৬০০ ডলার। ইনকাম ট্যাক্স ১৩ পার্সেন্টের বেশি নয়।
আগামী বছর মার্চে পুতিন প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে প্রার্থী। জয় নিশ্চিত। পুতিন জানিয়েছেন, "আমেরিকা-ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাতব্বরি অসহ্য। আমরা পূর্ব ইউরোপ, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশ নিয়ে 'ইউরোশিয়া' তৈরি করব। যারা যোগ দিতে চান স্বাগতম। ইউরোশিয়া হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়ে শক্তিশালী।" কীভাবে শক্তিশালী, আর্থিক বলয়ে কতটা শক্তিশালী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক রাখা হবে তা খোলাসা করেননি। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে ইতিমধ্যেই, পুতিন কি আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে 'নতুন সোভিয়েত ইউনিয়ন' তৈরি করবেন? পুতিন বলেছেন, 'নতুন সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়, নতুন ইউরোশিয়া। কমিউনিজম এখনও কবরস্থ হয়নি।
বার্লিন, জার্মানি
_এই প্রশ্নে এতটাই ক্ষিপ্ত হন, উত্তর না দিয়ে সংবাদ সম্মেলন থেকে বেরিয়ে যান। প্রশ্নেই যিনি রেগে যান, তার কাছে গণতন্ত্র দুরাশা। ঠিক এই কথাই লিখেছিল সাপ্তাহিক ড্যের স্পিগেল।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ড্যের স্পিগেল জরিপ চালিয়েছিল গর্বাচেভকে নিয়ে। ৮০ ভাগ রুশির কাছে তিনি ঘৃণ্য। ১৭ ভাগের কাছে আবর্জনা। তিন ভাগের কাছে মহান। ৫৯.০৪ ভাগ মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস, আমেরিকান ডলার খেয়ে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙেছেন গ্গ্নাসনস্ত, পেরেস্ত্রোইকার নামে। ইউরোপ-আমেরিকায় মিখায়েল গর্বাচেভ এখনও তুমুল জনপ্রিয়। কিন্তু নিজ দেশে পরবাসী। একঘরে।
এতটাই একঘরে যে, চিকিৎসার জন্য বার্লিনে আসেন। যেমন আসতেন বরিস ইয়েলৎসিন। তিনিও রুশ চিকিৎসকদের বিশ্বাস করতেন না। বার্লিনের হাসপাতালে ট্যাবলেট গিলে গর্বাচেভ বলেন, 'আহ! মার্কিন গণতান্ত্রিক ট্যাবলেট। কী আনন্দ।' যেহেতু রসিকতা, ধর্তব্য নয়। কিন্তু রস এক লহমায় তৈরি হয় না এবং রসের উৎপত্তি শিকড় থেকেই। এই শিকড়ের অনুসন্ধান করেছেন ট্যুবিঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব ইউরোপের সোশ্যাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল বিভাগের অধ্যাপিকা ক্লাউডিয়া হোলৎসবার্গার। বলছেন, তার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থে ('কুয়ানটিটিয়াট ফর কুয়ালিটিয়্যাট। পৃষ্ঠা :১০২)। মিখায়েল গর্বাচেভ পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্গ্নাসনস্ত, পেরেস্ত্রোইকা তত্ত্ব আবিষ্কার করে কমিউনিজম ধ্বংসের পথে এগিয়েছেন।' এ গ্রন্থে কমিউনিজমের পক্ষে যত গুণগান, গর্বাচেভের বিরুদ্ধে ষোলআনা বিষ-উদ্গিরণ। আশ্চর্য ঘটনা বৈকি। লেখিকা মার্ক্স, কমিউনিস্টের নাম শুনলেই জ্বলেপুড়ে জামাকাপড় খোলেন, বাপ-মা তুলে গালাগাল দেন (তার বহু লেখায়), তিনিই কি-না এখন গর্বাচেভের মার্কিনপ্রেম, গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন? এ কী কথা মন্থরার মুখে!
'গর্বাচেভের দূরদৃষ্টি ও বিশ্ব রাজনীতি' শিরোনামে একটি উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয় লন্ডনের দ্য টাইমসে, বার্লিন দেয়াল ধসের চার দিন পরই (১৩.১১.১৯৮৯)। গর্বাচেভের রাজনৈতিক 'ভিশন' কতটা সফল এবং শুরু পূর্ব জার্মানি দিয়ে, কমিউনিজম ধ্বংসের মাধ্যমে_ লিখেছেন মার্টিন ওয়াকার।
গর্বাচেভের দূরদৃষ্টি ছিল বৈকি! না থাকলে ভ্লাদিমির পুতিনকে কী করে আবিষ্কার করলেন? ১৯৮৫ সালে মিখায়েল গর্বাচেভ ২৩ জন হাই র্যাংকিং জেবি অফিসারকে ডিঙিয়ে বত্রিশ-উত্তীর্ণ-যুবা পুতিনকে পূর্ব জার্মানির ড্রেসডেনে পাঠান পূর্ব জার্মানিসহ পূর্ব ইউরোপের কেজিবি প্রধান করে। স্মরণ রাখছি, তখন ড্রেসডেন ছিল পূর্ব ইউরোপের কেজিবির প্রধান কার্যালয় তথা হেডকোয়ার্টার। ফরাসি, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ এবং পূর্ব ইউরোপের তিনটি দেশের ভাষা জানেন। চমৎকার ইংরেজি বলেন। আর জার্মান তো প্রায় মাতৃভাষা।
ভাষা শেখার কারণও একাধিক। যেহেতু পূর্ব ইউরোপে কেজিবি প্রধান, তাই কেবল চোখ-কান খোলা রাখাই পহেলা শর্ত নয়, ভাষা জানাও অত্যন্ত জরুরি। সাধারণ মানুষের কথা, রাজনীতিকদের কথা, রাজনীতির হালহকিকত জানতেই হবে। পুতিন যেহেতু অতিশয় ধুরন্ধর, পূর্ব জার্মানিতে থাকাকালে চটপট বুঝে যান, পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম ইউরোপের সদর ও অন্দরমহলের চেহারা এবং মুখোশ কীভাবে, কখন পাল্টায়।
বলা হয়, ভ্লাদিমির পুতিন গণতন্ত্রী নন, মার্কিনঘেঁষা তো ননই, বরং হাড়েমজ্জায় কমিউনিস্ট। বহিরঙ্গে গণতন্ত্রের মুখোশধারী, অন্তরঙ্গে কমিউনিস্ট। জর্জ বুশ (জুনিয়র) একবার বলেছিলেন, 'গর্বাচেভ, ইয়েলৎসিনকে যতটা বিশ্বাস করা যেত, পুতিনকে নয়।' পুতিনের উত্তর ছিল চমৎকার :'ওই বিশ্বাসের মাশুল দিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন।' ওই যে বলা হচ্ছে_ 'হাড়েমজ্জায় কমিউনিস্ট', কারণও আছে।
ভ্লাদিমির (ভ্লাদিমিরোভিচ) পুতিন লিখছেন তার আত্মজীবনীতে : 'ওট পারভোগো লিস্তা' (ইন দ্য ফার্স্ট পারসন) :'আমার ঠাকুরদা স্পিরিডোন ইভানোভিচ পুতিন (১৮৭৯-১৯৬৫) ছিলেন মহামতি লেনিনের পাচক। লেনিনের মৃত্যুর পর তার (লেনিন) স্ত্রী মেডেজদা ত্রুক্রপস্কায়া আমার ঠাকুরদাকেই পাচক বহাল রাখেন। পাচক হলেও তিনি লেনিন ও ত্রুক্রপস্কায়ার কাছে কমিউনিজমের মূল মসলা কী, জেনে নেন। জোসেফ স্টালিনেরও স্পেশাল পাচক ছিলেন আমার ঠাকুরদা।'
পুতিনের জন্মদিন ৭ অক্টোবর (জন্ম :৭.১০.১৯৫২। লেনিনগ্রাদ। এখন সেন্ট পিটার্সবুর্গ)। আগামী বছর ষাট। তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী নন। তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট। খুব ধুমধাম করে হয়তো পালিত হবে জন্মদিন। ৬০ বছর হলে ইউরোপে যেমন হয়।
পুতিনের উত্থান চমকপ্রদ। সংক্ষিপ্ত এই : বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেই কেজিবিতে যোগদান (১৯৭৫)। ১০ বছরের মধ্যেই সরকারের উঁচু মহলের নজর কেড়ে জার্মানির ডেসডেনে পূর্ব ইউরোপের কেজিবিপ্রধান। ২৬ মার্চ, ১৯৯৭ সালে ইয়েলৎসিন তাকে ডেপুটি চিফ অব প্রেসিডেন্টসিয়াল স্টাফের দায়িত্ব দেন। দুই বছর পর (৯ আগস্ট, ১৯৯৯) তিনজন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর একজন। বরিস ইয়েলৎসিন তাকেই উত্তরাধিকার হিসেবে পছন্দ করতেন, বলেওছেন বারবার। ইয়েলৎসিন অকস্মাৎ পদত্যাগ করেন ৩১ ডিসেম্বর (১৯৯৯)। ওইদিন অ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিন দায়িত্ব নেন। তিন মাস পর নির্বাচন (২৬ মার্চ, ২০০০)। প্রথম রাউন্ডে জয়ী। দ্বিতীয় রাউন্ডেও। ৭ মে, ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ।
দ্বিতীয়বারও (২০০৪-২০০৮) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী। রাশিয়ার সংশোধিত সংবিধান (১৯৯২) অনুযায়ী একটানা দুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিধান নেই। প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় বাধা নেই। প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পুতিন বেছে নেন কে তার কথায় ওঠবস করবে। কে বশংবদ। পেয়ে যান দিমিত্রি (আনাতোলেয়েভিচ) মেদভেদেভকে (জন্ম ১৪.৯.১৯৬৫)। মেদভেদেভ আইনের ছাত্র। আইনের অধ্যাপক এবং বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র ক্ষমতার অন্দরমহলে ঢুকে অভিজ্ঞ। প্রশাসনেও বিজ্ঞ। পুতিনই তাকে প্রশ্রয় দিয়ে গড়েপিটে তৈরি করেছেন। মেদভেদেভও লেনিনগ্রাদের। অতএব ঘরের মানুষ। বিশ্বাসযোগ্য। পুতিনই তাকে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেন। শর্ত এই, এক টার্ম পর পদত্যাগ করতে হবে। মেনে নেন। আগামী বছর মার্চে রুশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। পুতিন প্রতিদ্বন্দ্বী। ত্যাগ করবেন প্রধানমন্ত্রীর পদ। রাশিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর কোনো পাওয়ার নেই। যেমন নেই বাংলাদেশ ও ভারতের রাষ্ট্রপতির। এই পোস্ট আলঙ্কারিক। বাংলাদেশ-ভারতের রাষ্ট্রপতির কথায় প্রধানমন্ত্রী চলেন না। রাশিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর কথায় প্রেসিডেন্টের চলার কথা নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পুতিনের পরামর্শ, নির্দেশ ছাড়া দিমিত্রি (আনাতোলেয়েভিচ) মেদভেদেভ একচুল নড়েন না।
পুতিনের আমলে যতবারই মস্কোয় গেছি, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, পুতিনকে খুব পছন্দ করেন। জানিয়ে রাখা ভালো, রাশিয়ার ৩৩.০২ ভাগ মানুষ এখনও কমিউনিজমের পক্ষে। কমিউনিজমের জন্য আন্দোলনও দানা বাঁধছে ক্রমে। বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার কারণেই।
পুতিন কেন জনপ্রিয়, সহজেই বোধগম্য। নিজেকে গণতন্ত্রী বলে জাহির করেন না। কমিউনিস্ট বলেও চিৎকার করেন না। এই মৌন অবলম্বনে আমেরিকা-ইউরোপ হদিস পাচ্ছে না পুতিনের মতলব কী। সোভিয়েত রাশিয়া ধসের পর ২০০০ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার অবস্থা এতটাই খারাপ, প্রায় দারিদ্র্যসীমায় পেঁৗছে যায়। ওই সময় বছর চারেক রাশিয়ায় গিয়ে নিজেকে কুবের মনে হয়। একশ' ডয়েচ মার্কে ১০ হাজার রুবল! ভাবা যায়? পুতিন ক্ষমতাসীন হয়েই আমূল পরিবর্তন। দুই বছরের মধ্যেই ইনফ্লেশন রোধ, তাই নয় শুধু, মাসিক আয় ৮০ থেকে ৬০০ ডলার। ইনকাম ট্যাক্স ১৩ পার্সেন্টের বেশি নয়।
আগামী বছর মার্চে পুতিন প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে প্রার্থী। জয় নিশ্চিত। পুতিন জানিয়েছেন, "আমেরিকা-ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাতব্বরি অসহ্য। আমরা পূর্ব ইউরোপ, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশ নিয়ে 'ইউরোশিয়া' তৈরি করব। যারা যোগ দিতে চান স্বাগতম। ইউরোশিয়া হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়ে শক্তিশালী।" কীভাবে শক্তিশালী, আর্থিক বলয়ে কতটা শক্তিশালী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক রাখা হবে তা খোলাসা করেননি। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে ইতিমধ্যেই, পুতিন কি আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে 'নতুন সোভিয়েত ইউনিয়ন' তৈরি করবেন? পুতিন বলেছেন, 'নতুন সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়, নতুন ইউরোশিয়া। কমিউনিজম এখনও কবরস্থ হয়নি।
বার্লিন, জার্মানি
No comments