মন্ত্রিসভা-রদবদলের প্রক্রিয়া কতটা গণতান্ত্রিক? by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভায় সাম্প্রতিক সামান্য রদবদল নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা ও কিছু সমালোচনারও জন্ম হয়েছে। এসব আলোচনা-সমালোচনার সূত্র ধরেই এই লেখা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সামান্য রদবদল করে প্রকারান্তরে সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সমালোচনাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। স্বাধীন সংবাদমাধ্যম (দলীয় বা বশংবদ নয়) যে উচিত কথা বলতে কখনো পিছপা হয় না, এটা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে।
অবশ্য এর সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের আপত্তি, সমালোচনাও অনেকটা কাজ করেছে। প্রধানমন্ত্রী এই ইস্যুতে নানা রকম কথা বললেও মন্ত্রিসভায় এই সামান্য রদবদল করে তাঁর গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। জেদ বা একগুঁয়েমি গণতন্ত্রে মানায় না। বেশির ভাগ মানুষের মতকে শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সঙ্গে মেনে নেওয়াই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। আমি আশা করি, ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিভক্তি নিয়েও প্রধানমন্ত্রী একদিন জনমতের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন।
সৈয়দ আবুল হোসেন একজন সফল ব্যবসায়ী। নানা কারণে তাঁর মন্ত্রিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু দেশেই নয়, বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানও তাঁর ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছে। দেশের স্বার্থে, সরকারের ভাবমূর্তির স্বার্থে সৈয়দ আবুল হোসেন নিজে মন্ত্রিত্ব থেকে সরে দাঁড়ালে সবচেয়ে ভালো হতো। তিনি যে মাপের ব্যবসায়ী, মন্ত্রিত্ব তাঁর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদিও এ কথা আমি মানি, মন্ত্রিত্ব ব্যবসার বিকল্প নয়। তবু অনেক ব্যক্তি আছেন, মন্ত্রী ছাড়া তাঁদের আর কোনো পরিচয় হয় না। কোনো পদ অলংকৃত করতে না পারলে তাঁদের দিকে কেউ মনোযোগও দেবে না। আবার সমাজে এমন ব্যক্তিও রয়েছেন, যাঁরা কোন পদে আছেন, তা জানতে কেউ আদৌ আগ্রহী নয়। ব্যক্তিসত্তাই তাঁর প্রধান পরিচয়। কাজই তাঁর প্রধান পরিচয়। সৈয়দ আবুল হোসেন খুব খ্যাতিমান মানুষ না হলেও ব্যবসায়ী হিসেবে অনেক সফল। সেটা কম গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য নয়। কাজেই তাঁর পরিচয়সংকট হওয়ার কথা নয়। তিনি নিজের ইচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে সরে দাঁড়ালে ভালো করতেন। রদবদলের পর তাঁকে এমন এক বিষয়ে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়েছে, সেখানেও নানা সন্দেহ জনমনে উঁকি দিচ্ছে। টেলিযোগাযোগ খাতে কিছুদিন আগেও যেসব নাটক হয়েছে, তা দেশবাসী দেখেছেন। যা দেখেননি, তা নিয়ে নানা গুজব বা গল্প ডালপালা বিস্তার করেছে। সেই টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সৈয়দ আবুল হোসেনকে দেওয়াটা কি ঠিক হয়েছে?
বাজারে তাঁর সম্পর্কে নানা কথা চালু রয়েছে। অনেকে মনে করেন, তিনি খুবই সৎ ব্যক্তি। তিনি তাঁর নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্য কমিশন সংগ্রহ করেন। তাঁকে মন্ত্রী পদে রেখে দেওয়া ও আরেকটি টসটসে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়াতে এসব গুজব বা সন্দেহ যদি পাকাপোক্ত হয়, তাহলে খুব কি দোষ দেওয়া যাবে?
আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। ত্যাগী রাজনৈতিক নেতা, বড় মাপের ব্যবসায়ী, তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতি অঙ্গনের তারকা, দুঁদে আইনজীবী—কে নেই এই দলে? আমাদের তো মনে হয়, যদি অভ্যন্তরীণ দলীয় ভোটের মাধ্যমে দক্ষ মন্ত্রিসভা গঠন করার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে আওয়ামী লীগ দু-তিনটি দক্ষ মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারত। এখন আওয়ামী লীগে সেই সুযোগ আর নেই। এখন নাকি শুধু দলীয় সমর্থক বা নেতা হলে কাজ হয় না, এখন শেখ হাসিনার প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্যের বিষয়টা বিবেচনা করা হয় বেশি। কোনো আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন, মেধাবী, যোগ্য, দক্ষ ব্যক্তি শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার মতো নেত্রীর প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য স্বীকার করবেন বলে মনে হয় না। নেত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা বা নেত্রীর সুরে কথা বলা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। সে জন্য অনেক মেধাবী ও দক্ষ ব্যক্তি আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে থাকতে পারেননি। অনেকে আদর্শগত সহমর্মিতা সত্ত্বেও এই দুই দলে যোগ দিতে পারেননি। কাজেই এসব নানা কারণে যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিরা মন্ত্রিসভায় স্থান পান না। দুই বড় দল সম্পর্কেই এ কথা প্রযোজ্য। আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।
মন্ত্রিসভায় সামান্য রদবদল নিয়ে সংবাদমাধ্যমের বহু আলোচনা হয়েছে। দুজন ত্যাগী নেতাকে মন্ত্রিত্ব দেওয়ায় অনেকে খুশি হয়েছেন। অনেকে তাঁদের অভিনন্দিত করেছেন। সাধারণভাবে দেখলে খুশি হওয়ারই কথা, অভিনন্দন জানানোরই কথা। কিন্তু এই বিষয়ে আমার ভিন্ন বক্তব্য রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন এই সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করেন, তখন জনাব সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বা জনাব ওবায়দুল কাদের কি মন্ত্রী হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন? তাঁদের সম্পর্কে কি কোনো অভিযোগ ছিল? তখন কি তাঁদের মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা ছিল না? তখন তাঁদের মন্ত্রী করা হলো না কেন? এখন করা হলো কী যুক্তিতে? কী বিবেচনায়? এর সঠিক উত্তর কখনো জানা যাবে না। তবে আমরা একটা উত্তর অনুমান করতে পারি। প্রধানমন্ত্রী হয়তো তখন ভেবেছিলেন, মন্ত্রী কে হলো, তা কোনো ব্যাপারই না। সরকার চলবে আমার নির্দেশে বা আমার ক্যারিশমায়। যদু মধু একজনকে মন্ত্রী করলেই হলো। তিন বছর পর তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন সরকার চালানো অত সহজ নয়। কচিকাঁচা বা যাকে-তাকে দিয়ে সরকার চলে না। দক্ষ সরকার চালাতে হলে মাথার দরকার হয়। অনভিজ্ঞ ও নিছক অনুগত ব্যক্তিদের দিয়ে সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা এখন পড়তির দিকে বলে অনেকে প্রকাশ্যে মন্তব্য করছেন। নিরপেক্ষ রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরাও সংবাদমাধ্যমে সে রকম কথাই বলছেন। এমনকি ভারতের একজন খ্যাতনামা সাংবাদিকও প্রায় অনুরূপ মন্তব্য করেছেন।
এ ছাড়া রাস্তাঘাটে, পরিবারে, অফিস-আদালতেও যা শোনা যায়, তাতে বর্তমান সরকারের প্রতি নেতিবাচক মন্তব্যই বেশি। এ রকম একটা পড়ন্ত অবস্থায় শেখ হাসিনা দুজন প্রভাবশালী নেতাকে মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছেন। তাঁরা দুজন কি এতই শক্তিশালী যে এই খারাপ অবস্থা থেকে আওয়ামী লীগ সরকারকে উদ্ধার করতে পারবেন? তাও আগামী দুই বছরের মধ্যে? কাজটা কি এতই সহজ? নাকি শুধু তাঁদের সমালোচনার মুখ বন্ধ করার জন্যই এই মন্ত্রিত্ব?
জনাব সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও জনাব ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই ইতিবাচক। এই পড়ন্ত বেলায় মন্ত্রিত্বটা না নিলেই হয়তো তাঁরা ভালো করতেন। তাঁদের প্রতি যে অবিচার শুরুতে করা হয়েছিল, তার প্রতিবাদে এবারের মন্ত্রিত্বটা সবিনয়ে ফিরিয়ে দিলেই শোভন হতো। প্রধানমন্ত্রী কচিকাঁচা ও তাঁর অনুগত বাহিনী দিয়ে তিন বছর যেভাবে চালিয়েছিলেন, পরের দুই বছরও সেভাবে চালাতেন। এখন কেন সুরঞ্জিত বা ওবায়দুল কাদেরের প্রয়োজন হচ্ছে? বাজারে শোনা যাচ্ছে, জনাব তোফায়েল আহমদকেও নাকি মন্ত্রী করা হবে। আশা করি, ৬৯-এর অন্যতম নায়ক জনাব তোফায়েল আহমদ শেষের খারাপ দুই বছর মন্ত্রিত্ব করে হাত ময়লা করবেন না।
মন্ত্রিসভা গঠনে প্রথমে শেখ হাসিনা যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে পারেননি, তা যদি তিনি স্বীকার করেন ও দলের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন, কেবল তাহলেই প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতাদের উচিত প্রধানমন্ত্রীকে সহযোগিতা করা। ভুল মানুষের হতেই পারে। ভুল স্বীকার করাই মহত্ত্ব।
জনকণ্ঠ পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে (৮ ডিসেম্বর): ‘আগামী জানুয়ারিতে মন্ত্রিসভায় আরও বদল আসছে। এতে নাকি নানা চমকও থাকতে পারে।’ এ রকম খবর অবশ্য প্রায়ই ছাপা হয়। এসবের কোনো মূল্য নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের নানা ব্যর্থতা দেখে মন্ত্রিসভায় বড় পরিবর্তন আনতেই পারেন। এটা তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতা। আর সে জন্য দলের বড় বড় নেতা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতারা প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তিনি কাকে মন্ত্রী করবেন, এটা একান্তই তাঁর ইচ্ছা।
কোনো দল যখন নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তখন তা পায় দল, কোনো নেতা বা নেত্রী পান না। দলের পার্লামেন্টারি গ্রুপ একজনকে দলনেতা নির্বাচন করে। দলনেতা নির্বাচিত হওয়ার পর সংবিধানের একটি ধারার জোরে তিনি মহা ক্ষমতাশালী এক ব্যক্তিতে পরিণত হন। যে দল সরকার গঠন করবে, সেই দলকে তিনি তখন আর তোয়াক্কা করেন না। তখন তিনি অনুগত খুঁজে বেড়ান। ত্যাগী বা দক্ষ নেতাদের তিনি খোঁজেন না। না খুঁজলেও দলনেতাকে কেউ দোষ দিতে পারে না। কারণ, তিনি সংবিধানের জোরেই কাজটা করছেন।
আমরা মনে করি, এটা সংবিধানের ও সংসদীয় পদ্ধতির একটা বড় দুর্বলতা। কোনো একজন হঠাৎ মহা ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। তাঁর একক ইচ্ছাতেই মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। সে মন্ত্রিসভা ব্যর্থ বা অদক্ষ হলে সরকারের পতন হতে পারে। পরের নির্বাচনে দল পরাজিত হতে পারে। কত বড় ঝুঁকি! আর সেই মন্ত্রিসভা গঠনের একক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে একজন সংসদ নেতাকে।
সংবিধানের এই ধারা পরিবর্তন করা যায় কি না, তা বিশেষজ্ঞরা ভেবে দেখতে পারেন। অন্তত এ রকম কথা রাখা যায় কি না: ‘দলনেতা দলীয় সাংসদ ও দলের সঙ্গে পরামর্শ করে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন।’ যদি কোনো কারণে এ রকম একটা বাক্য যোগ করা সম্ভব না হয়, তাহলে এটা দলের গঠনতন্ত্রে সংযুক্ত করার একটা উদ্যোগ নিতে পারেন দলের নেতা ও কর্মীরা। ‘সংসদ নেতা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে পরামর্শক্রমে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন ও রদবদল করবেন।’ মনে রাখতে হবে, দলের চেয়ে সংসদ নেতা বড় নয়। সংসদ নেতা একজন ব্যক্তি। দল বহু ব্যক্তির সমষ্টি। বহু মেধা ও অভিজ্ঞতার সম্মিলন।
মন্ত্রিসভার রদবদল প্রশ্নে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন পড়ে মনে হয়, আওয়ামী লীগের প্রবীণ ও ত্যাগী নেতাদের কী দুর্ভাগ্য, শেখ হাসিনার করুণার ওপর তাঁদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নির্ভর করছে। কারণ, মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়া নির্ভর করে সংসদ নেতা বা প্রধানমন্ত্রীর একক মর্জির ওপর। সেখানে প্রবীণ নেতাদের মতামত দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই, যদি না প্রধানমন্ত্রী মতামত জানতে চান।
অনেক সরল পাঠক আমার এই বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বা সংসদ নেতা পদের সঙ্গে শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়াকে একাত্ম মনে করতে পারেন। আমার এই বক্তব্য কোনো ব্যক্তি প্রসঙ্গে নয়, পদ প্রসঙ্গে। ধরা যাক, বেগম সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগের সংসদ নেতা বা জনাব মওদুদ আহমদ বিএনপির সংসদ নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। দুই দল কি এই দুই নেতার হাতে মন্ত্রিসভা গঠনের পুরো দায়িত্ব ছেড়ে দিতে রাজি হবে?
একটা সরকারের প্রধান উপাদান একটি মন্ত্রিসভা। সেই মন্ত্রিসভার গঠনপদ্ধতি যতটা সম্ভব গণতান্ত্রিক ও ত্রুটিমুক্ত হওয়া উচিত।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
সৈয়দ আবুল হোসেন একজন সফল ব্যবসায়ী। নানা কারণে তাঁর মন্ত্রিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু দেশেই নয়, বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানও তাঁর ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছে। দেশের স্বার্থে, সরকারের ভাবমূর্তির স্বার্থে সৈয়দ আবুল হোসেন নিজে মন্ত্রিত্ব থেকে সরে দাঁড়ালে সবচেয়ে ভালো হতো। তিনি যে মাপের ব্যবসায়ী, মন্ত্রিত্ব তাঁর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদিও এ কথা আমি মানি, মন্ত্রিত্ব ব্যবসার বিকল্প নয়। তবু অনেক ব্যক্তি আছেন, মন্ত্রী ছাড়া তাঁদের আর কোনো পরিচয় হয় না। কোনো পদ অলংকৃত করতে না পারলে তাঁদের দিকে কেউ মনোযোগও দেবে না। আবার সমাজে এমন ব্যক্তিও রয়েছেন, যাঁরা কোন পদে আছেন, তা জানতে কেউ আদৌ আগ্রহী নয়। ব্যক্তিসত্তাই তাঁর প্রধান পরিচয়। কাজই তাঁর প্রধান পরিচয়। সৈয়দ আবুল হোসেন খুব খ্যাতিমান মানুষ না হলেও ব্যবসায়ী হিসেবে অনেক সফল। সেটা কম গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য নয়। কাজেই তাঁর পরিচয়সংকট হওয়ার কথা নয়। তিনি নিজের ইচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে সরে দাঁড়ালে ভালো করতেন। রদবদলের পর তাঁকে এমন এক বিষয়ে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়েছে, সেখানেও নানা সন্দেহ জনমনে উঁকি দিচ্ছে। টেলিযোগাযোগ খাতে কিছুদিন আগেও যেসব নাটক হয়েছে, তা দেশবাসী দেখেছেন। যা দেখেননি, তা নিয়ে নানা গুজব বা গল্প ডালপালা বিস্তার করেছে। সেই টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সৈয়দ আবুল হোসেনকে দেওয়াটা কি ঠিক হয়েছে?
বাজারে তাঁর সম্পর্কে নানা কথা চালু রয়েছে। অনেকে মনে করেন, তিনি খুবই সৎ ব্যক্তি। তিনি তাঁর নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্য কমিশন সংগ্রহ করেন। তাঁকে মন্ত্রী পদে রেখে দেওয়া ও আরেকটি টসটসে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়াতে এসব গুজব বা সন্দেহ যদি পাকাপোক্ত হয়, তাহলে খুব কি দোষ দেওয়া যাবে?
আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। ত্যাগী রাজনৈতিক নেতা, বড় মাপের ব্যবসায়ী, তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতি অঙ্গনের তারকা, দুঁদে আইনজীবী—কে নেই এই দলে? আমাদের তো মনে হয়, যদি অভ্যন্তরীণ দলীয় ভোটের মাধ্যমে দক্ষ মন্ত্রিসভা গঠন করার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে আওয়ামী লীগ দু-তিনটি দক্ষ মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারত। এখন আওয়ামী লীগে সেই সুযোগ আর নেই। এখন নাকি শুধু দলীয় সমর্থক বা নেতা হলে কাজ হয় না, এখন শেখ হাসিনার প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্যের বিষয়টা বিবেচনা করা হয় বেশি। কোনো আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন, মেধাবী, যোগ্য, দক্ষ ব্যক্তি শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার মতো নেত্রীর প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য স্বীকার করবেন বলে মনে হয় না। নেত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা বা নেত্রীর সুরে কথা বলা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। সে জন্য অনেক মেধাবী ও দক্ষ ব্যক্তি আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে থাকতে পারেননি। অনেকে আদর্শগত সহমর্মিতা সত্ত্বেও এই দুই দলে যোগ দিতে পারেননি। কাজেই এসব নানা কারণে যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিরা মন্ত্রিসভায় স্থান পান না। দুই বড় দল সম্পর্কেই এ কথা প্রযোজ্য। আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।
মন্ত্রিসভায় সামান্য রদবদল নিয়ে সংবাদমাধ্যমের বহু আলোচনা হয়েছে। দুজন ত্যাগী নেতাকে মন্ত্রিত্ব দেওয়ায় অনেকে খুশি হয়েছেন। অনেকে তাঁদের অভিনন্দিত করেছেন। সাধারণভাবে দেখলে খুশি হওয়ারই কথা, অভিনন্দন জানানোরই কথা। কিন্তু এই বিষয়ে আমার ভিন্ন বক্তব্য রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন এই সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করেন, তখন জনাব সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বা জনাব ওবায়দুল কাদের কি মন্ত্রী হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন? তাঁদের সম্পর্কে কি কোনো অভিযোগ ছিল? তখন কি তাঁদের মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা ছিল না? তখন তাঁদের মন্ত্রী করা হলো না কেন? এখন করা হলো কী যুক্তিতে? কী বিবেচনায়? এর সঠিক উত্তর কখনো জানা যাবে না। তবে আমরা একটা উত্তর অনুমান করতে পারি। প্রধানমন্ত্রী হয়তো তখন ভেবেছিলেন, মন্ত্রী কে হলো, তা কোনো ব্যাপারই না। সরকার চলবে আমার নির্দেশে বা আমার ক্যারিশমায়। যদু মধু একজনকে মন্ত্রী করলেই হলো। তিন বছর পর তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন সরকার চালানো অত সহজ নয়। কচিকাঁচা বা যাকে-তাকে দিয়ে সরকার চলে না। দক্ষ সরকার চালাতে হলে মাথার দরকার হয়। অনভিজ্ঞ ও নিছক অনুগত ব্যক্তিদের দিয়ে সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা এখন পড়তির দিকে বলে অনেকে প্রকাশ্যে মন্তব্য করছেন। নিরপেক্ষ রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরাও সংবাদমাধ্যমে সে রকম কথাই বলছেন। এমনকি ভারতের একজন খ্যাতনামা সাংবাদিকও প্রায় অনুরূপ মন্তব্য করেছেন।
এ ছাড়া রাস্তাঘাটে, পরিবারে, অফিস-আদালতেও যা শোনা যায়, তাতে বর্তমান সরকারের প্রতি নেতিবাচক মন্তব্যই বেশি। এ রকম একটা পড়ন্ত অবস্থায় শেখ হাসিনা দুজন প্রভাবশালী নেতাকে মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছেন। তাঁরা দুজন কি এতই শক্তিশালী যে এই খারাপ অবস্থা থেকে আওয়ামী লীগ সরকারকে উদ্ধার করতে পারবেন? তাও আগামী দুই বছরের মধ্যে? কাজটা কি এতই সহজ? নাকি শুধু তাঁদের সমালোচনার মুখ বন্ধ করার জন্যই এই মন্ত্রিত্ব?
জনাব সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও জনাব ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই ইতিবাচক। এই পড়ন্ত বেলায় মন্ত্রিত্বটা না নিলেই হয়তো তাঁরা ভালো করতেন। তাঁদের প্রতি যে অবিচার শুরুতে করা হয়েছিল, তার প্রতিবাদে এবারের মন্ত্রিত্বটা সবিনয়ে ফিরিয়ে দিলেই শোভন হতো। প্রধানমন্ত্রী কচিকাঁচা ও তাঁর অনুগত বাহিনী দিয়ে তিন বছর যেভাবে চালিয়েছিলেন, পরের দুই বছরও সেভাবে চালাতেন। এখন কেন সুরঞ্জিত বা ওবায়দুল কাদেরের প্রয়োজন হচ্ছে? বাজারে শোনা যাচ্ছে, জনাব তোফায়েল আহমদকেও নাকি মন্ত্রী করা হবে। আশা করি, ৬৯-এর অন্যতম নায়ক জনাব তোফায়েল আহমদ শেষের খারাপ দুই বছর মন্ত্রিত্ব করে হাত ময়লা করবেন না।
মন্ত্রিসভা গঠনে প্রথমে শেখ হাসিনা যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে পারেননি, তা যদি তিনি স্বীকার করেন ও দলের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন, কেবল তাহলেই প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতাদের উচিত প্রধানমন্ত্রীকে সহযোগিতা করা। ভুল মানুষের হতেই পারে। ভুল স্বীকার করাই মহত্ত্ব।
জনকণ্ঠ পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে (৮ ডিসেম্বর): ‘আগামী জানুয়ারিতে মন্ত্রিসভায় আরও বদল আসছে। এতে নাকি নানা চমকও থাকতে পারে।’ এ রকম খবর অবশ্য প্রায়ই ছাপা হয়। এসবের কোনো মূল্য নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের নানা ব্যর্থতা দেখে মন্ত্রিসভায় বড় পরিবর্তন আনতেই পারেন। এটা তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতা। আর সে জন্য দলের বড় বড় নেতা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতারা প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তিনি কাকে মন্ত্রী করবেন, এটা একান্তই তাঁর ইচ্ছা।
কোনো দল যখন নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তখন তা পায় দল, কোনো নেতা বা নেত্রী পান না। দলের পার্লামেন্টারি গ্রুপ একজনকে দলনেতা নির্বাচন করে। দলনেতা নির্বাচিত হওয়ার পর সংবিধানের একটি ধারার জোরে তিনি মহা ক্ষমতাশালী এক ব্যক্তিতে পরিণত হন। যে দল সরকার গঠন করবে, সেই দলকে তিনি তখন আর তোয়াক্কা করেন না। তখন তিনি অনুগত খুঁজে বেড়ান। ত্যাগী বা দক্ষ নেতাদের তিনি খোঁজেন না। না খুঁজলেও দলনেতাকে কেউ দোষ দিতে পারে না। কারণ, তিনি সংবিধানের জোরেই কাজটা করছেন।
আমরা মনে করি, এটা সংবিধানের ও সংসদীয় পদ্ধতির একটা বড় দুর্বলতা। কোনো একজন হঠাৎ মহা ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। তাঁর একক ইচ্ছাতেই মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। সে মন্ত্রিসভা ব্যর্থ বা অদক্ষ হলে সরকারের পতন হতে পারে। পরের নির্বাচনে দল পরাজিত হতে পারে। কত বড় ঝুঁকি! আর সেই মন্ত্রিসভা গঠনের একক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে একজন সংসদ নেতাকে।
সংবিধানের এই ধারা পরিবর্তন করা যায় কি না, তা বিশেষজ্ঞরা ভেবে দেখতে পারেন। অন্তত এ রকম কথা রাখা যায় কি না: ‘দলনেতা দলীয় সাংসদ ও দলের সঙ্গে পরামর্শ করে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন।’ যদি কোনো কারণে এ রকম একটা বাক্য যোগ করা সম্ভব না হয়, তাহলে এটা দলের গঠনতন্ত্রে সংযুক্ত করার একটা উদ্যোগ নিতে পারেন দলের নেতা ও কর্মীরা। ‘সংসদ নেতা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে পরামর্শক্রমে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন ও রদবদল করবেন।’ মনে রাখতে হবে, দলের চেয়ে সংসদ নেতা বড় নয়। সংসদ নেতা একজন ব্যক্তি। দল বহু ব্যক্তির সমষ্টি। বহু মেধা ও অভিজ্ঞতার সম্মিলন।
মন্ত্রিসভার রদবদল প্রশ্নে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন পড়ে মনে হয়, আওয়ামী লীগের প্রবীণ ও ত্যাগী নেতাদের কী দুর্ভাগ্য, শেখ হাসিনার করুণার ওপর তাঁদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নির্ভর করছে। কারণ, মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়া নির্ভর করে সংসদ নেতা বা প্রধানমন্ত্রীর একক মর্জির ওপর। সেখানে প্রবীণ নেতাদের মতামত দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই, যদি না প্রধানমন্ত্রী মতামত জানতে চান।
অনেক সরল পাঠক আমার এই বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বা সংসদ নেতা পদের সঙ্গে শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়াকে একাত্ম মনে করতে পারেন। আমার এই বক্তব্য কোনো ব্যক্তি প্রসঙ্গে নয়, পদ প্রসঙ্গে। ধরা যাক, বেগম সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগের সংসদ নেতা বা জনাব মওদুদ আহমদ বিএনপির সংসদ নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। দুই দল কি এই দুই নেতার হাতে মন্ত্রিসভা গঠনের পুরো দায়িত্ব ছেড়ে দিতে রাজি হবে?
একটা সরকারের প্রধান উপাদান একটি মন্ত্রিসভা। সেই মন্ত্রিসভার গঠনপদ্ধতি যতটা সম্ভব গণতান্ত্রিক ও ত্রুটিমুক্ত হওয়া উচিত।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
No comments