বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের পরই অস্ট্রেলিয়া!

সূর্য ডুবেছে অস্ট্রেলিয়ান সাম্রাজ্যের! অতি সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সে এ সংশয়কে কারো কারো কাছে অমূলক মনে হতে পারে। তবে ব্র্যাডম্যানের দেশের ক্রিকেটে এখন আর রোদেলা দিন নেই_এটুকু বলা যেতেই পারে। মাইকেল ক্লার্কের দল এই সেদিনও হোঁচট খেল হোবার্ট টেস্টে নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে। ৭ রানের নাটকীয় হারের পর অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া তুলোধুনো করে চলেছে ক্লার্কদের। জয়ের জন্য ২৪১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে একটা সময়


২ উইকেটে ১৫৯ করে ফেলেছিল তারা। জয়টা যখন মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার তখনই ক্লার্করা ঝলসে গেলেন ডগ ব্রেসওয়েলের আগুনে। ৬ উইকেট নিয়ে ২৬ বছর পর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে নিউজিল্যান্ডকে টেস্ট জয়ের স্বাদ পাইয়ে দিয়েছেন এ তরুণ।
অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে এটা কিন্তু এখন আর একেবারে বিচ্ছিন্ন বা অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। গত চার বছর ধরেই টালমাটাল তাদের হার-না-মানা ক্রিকেটের ঐতিহ্য। তাই ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১১-এর ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৭ টেস্ট খেলে ১৬টিতে হেরেছে অস্ট্রেলিয়া। এ সময়ে অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে বেশি হেরেছে কেবল বাংলাদেশ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ! গত চার বছরে বাংলাদেশ ২৩ টেস্টে সর্বোচ্চ ১৯টি আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩৭ টেস্টে হেরেছে ১৭ ম্যাচ। ২৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া বঙ্ংি ডে টেস্টে ভারতের কাছে হারলে অস্ট্রেলিয়ার হারও হবে ক্যারিবীয়দের সমান, ১৭টি!
একটা সময় বিশ্বক্রিকেটের মুকুট ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের। পরপর দুটি বিশ্বকাপ জেতার পাশাপাশি ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডস, ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিংদের রাজত্ব ছিল টেস্টেও। এসব এখন রূপকথা মনে হয়। রূপকথার মতো পারফরম্যান্স ছিল অস্ট্রেলিয়ারও। টানা তিনটি বিশ্বকাপ জয়। স্টিভ ওয়াহর পর রিকি পন্টিংয়ের দলেরও টানা ১৬টি টেস্ট জেতা, অ্যাশেজে ইংল্যান্ডকে পাড়ার দল বানিয়ে হোয়াইটওয়াশ করা। অনবদ্য সব পারফরম্যান্স। ১৯৯৭ থেকে ২০০৭ সাল_এই ১০ বছরে ১১৮ টেস্টে তারা জয় পেয়েছিল ৮৩টিতে আর হেরেছিল মাত্র ১৬ ম্যাচে। অথচ গত চার বছরেই পন্টিং-ক্লার্কের দল হারল ১৬ টেস্ট। শেন ওয়ার্ন, ম্যাথু হেইডেন, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, জাস্টিন ল্যাঙ্গার, গ্লেন ম্যাকগ্রার মতো তারকারা একে একে অবসর নেওয়ায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল তা এখনো পূরণ করতে পারেনি তারা। ব্যর্থতার আসল কারণ এটাই।
পতনের শুরুটা ভারতের বিপক্ষে ২০০৮ সালের ১৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া পার্থ টেস্টে। ২০০০-২০০১ মৌসুমে স্টিভ ওয়াহর দলের টানা ১৬ জয়ের রেকর্ড মেলবোর্নে ৩৩৭ রানে ভারতকে হারিয়ে স্পর্শ করেছিল রিকি পন্টিংয়ের দল। প্রিয় ভেন্যু পার্থে ভারতকে হারাতে পারলে তারা গড়ত নতুন রেকর্ড। অথচ স্টিভ ওয়াহর দলের জয়রথ যেমন ইডেনে ফলো অনে পড়েও থামিয়েছিল সৌরভের ভারত তেমনি পন্টিংদের জয়যাত্রা সেবার রুখে দেয় অনিল কুম্বলের দল। অস্ট্রেলিয়াকে তারা হারায় ৭২ রানে। সেটা ছিল আবার ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমের পর পার্থে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম হার। এই পরাজয়ের পর তারা অ্যাডিলেডে সিরিজের শেষ টেস্টটাও জিততে পারেনি, ড্র হয়েছিল সেই ম্যাচ।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে পরের সিরিজটা পন্টিংয়ের দল জিতেছিল ২-০ ব্যবধানে। কিংস্টনে ৯৫ রান আর ব্রিজটাউনে ৮৭ রানে জিতলেও ড্র করেছিল অ্যান্টিগায়। এরপর অক্টোবরে ভারত সফরে তো সিরিজই হেরে বসে ০-২ ব্যবধানে। ভারত সফরটা বরাবরই কঠিন ছিল অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট ইতিহাসে। স্টিভ ওয়াহ তো এই সফরটাকে বলতেন, 'লাস্ট ফ্রন্টিয়ার'। টানা ১৫ জয় নিয়ে ২০০১ সালে ভারতে এসে ১-২ ব্যবধানে হেরে গিয়েছিল তার সেই অজেয় দলও। তবে ২০০৪ সালে পরের সফরে সেই 'লাস্ট ফ্রন্টিয়ার' জয় করেছিলেন রিকি পন্টিংরা। সিরিজ জিতেছিলেন ২-১ ব্যবধানে। ২০০৮ সালে সেই দাপটটা থাকেনি আর। বেঙ্গালুরু আর দিলি্লতে ড্র করলেও মোহালিতে ৩২০ ও নাগপুরে তারা হেরে যায় ১৭২ রানে।
এই ক্ষতে মলমের কাজ করে নভেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জয়টা। কিন্তু জ্বালাটা বেড়ে যায় নিজেদেরই মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ১-২ ব্যবধানে সিরিজ হেরে বসায়। পার্থে ৬ উইকেটের পর মেলবোর্নে আরো একতরফাভাবে পন্টিংরা হেরে বসেন ৯ উইকেটে। পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ২-১-এ সিরিজ জিতে অবশ্য প্রতিশোধ নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া।
এ উৎসবটা মাটি হয়ে যায় অ্যাশেজে। এ সিরিজে বরাবরই উত্তেজনা থাকে চরমে। আর সেখানেই কিনা পন্টিংরা হেরে বসেন ১-২ ব্যবধানে। কার্ডিফ ও বার্মিংহামে ড্র হলেও লর্ডসে ১১৫ ও ওভালে তারা হারে ১৯৭ রানের বড় ব্যবধানে। দুঃস্বপ্নের সেই সফরে ইনিংস ও ৮০ রানের একমাত্র সান্ত্বনার জয়টা পেয়েছিল কেবল লিডসে। হারতে হয়েছিল গত বছর ভারত সফরে খেলা দুটি টেস্টেই। মোহালিতে ১ উইকেট ও বেঙ্গালুরুতে ৯ উইকেটে হারের চেয়েও বড় ব্যর্থতা নিজেদের মাঠের অ্যাশেজে ইংল্যান্ডের কাছে ৩-১ ব্যবধানের হারটা। সেটা ছিল ২৪ বছর পর নিজেদের মাঠে তাদের প্রথম অ্যাশেজ হার। তিনটি হারের প্রতিটিই ছিল আবার ইনিংস ব্যবধানে!
২০১১ বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর শেষ হয় পন্টিং যুগ। নতুন অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্কের নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কা সফরে ১-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতে শুভ সূচনাও করে একঝাঁক তরুণ নিয়ে নতুনভাবে শুরু করা দলটি। শ্রীলঙ্কা সফর শেষে দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া টেস্ট সিরিজ ড্র করে ১-১-এ। কেপটাউনে তো আরেকটু হলে টেস্টেরই সবচেয়ে কম রানে অল আউট হওয়ার লজ্জায় ডুবতে হতো মাইকেল ক্লার্কের দলকে। দ্বিতীয় ইনিংসে তারা একপর্যায়ে ৯ উইকেট হারিয়ে বসেছিল ২১ রানে! তবে লিওঁ ও সিডলের কল্যাণে শেষ পর্যন্ত অল আউট হয় ৪৭ রানে। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের কালো দিন হিসেবেই সেই দিনটিকে মনে রাখতে চায় সে দেশের মিডিয়া।
অ্যাশেজে মেলবোর্নে ৯৮ রানে গুটিয়ে যাওয়া, কেপটাউনের ৪৭ কিংবা হোবার্টে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ১৩৬ রানে অল আউট হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংয়ের সামর্থ্য নিয়ে। ২০০৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত যে দল কখনোই ১৫০ রানের নিচে গুটিয়ে যায়নি তারাই গত দুই বছরে ১৫০-এর কম রানে অল আউট হয়েছে ছয়বার! এমন দুরবস্থা থেকে অস্ট্রেলিয়া কবে বেরিয়ে আসে সেটাই এখন দেখার।
২০০৮ থেকে টেস্টে বেশি হার

No comments

Powered by Blogger.