শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশা by রণেশ মৈত্র
অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, আমরা সবাই জানি, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম। তাঁকেও বিজয় দিবসের মাত্র কয়েক দিন আগে তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বরাদ্দকৃত বাসভবন থেকে আলবদররা মুখোশ পরে অস্ত্র হাতে এসে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। তাঁর লাশটিও ফেরত পাওয়া যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অন্যতম শিক্ষক ছিলেন তিনি। জীবনে কোনো দিন রাজনীতি করেননি_কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যও হননি।
তবে রাজনীতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল_তিনি অসাম্প্রদায়িক বা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। তাঁর জন্মভূমি পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান ছিল না। তাঁর পৈতৃক বসতভিটা ছিল পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদে। সেখানেই তাঁর জন্ম; সেখানেই তিনি মানুষ হন। লেখাপড়া সম্ভবত তিনি বহরমপুর কলেজে করেন। বহরমপুর কলেজ থেকেই সম্ভবত পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে বাংলা সাহিত্যে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। নিজ সাধনা ও অধ্যবসায়ের গুণে আনোয়ার পাশা বাংলা সাহিত্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। অতঃপর ঘুরেফিরে বহরমপুর কলেজেই এসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনা শুরু করেন। তাঁর বিশেষ আকর্ষণ বা শ্রদ্ধা ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রতি, তাঁর অমর সাহিত্যকর্মের প্রতি। রবীন্দ্রভক্ত হিসেবেই তিনি পরিচিতি অর্জন করেন। প্রচুর পড়াশোনা করেছেন তাঁকে নিয়ে, করেছেন গবেষণাও। তাঁর স্বাক্ষর হিসেবে তিনি রেখে গেছেন রবীন্দ্রসাহিত্যের নানা দিক নিয়ে লেখা তাঁর কয়েকটি অমূল্য গ্রন্থ। বহরমপুর কলেজে অধ্যাপনাকালে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতায় নিমজ্জিত হয়। মুসলিম লীগ আগে থেকেই মুসলিমপ্রধান অঞ্চলগুলো নিয়ে পাকিস্তান গঠনের দাবি ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে উত্থাপন করে। চারদিকে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। অজস্র রক্তপাত; নিরপরাধ হাজার হাজার নর-নারীর অকালমৃত্যু।
হঠাৎ একদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপনের প্রতি অধ্যাপক আনোয়ার পাশার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের পদ খালি হওয়ায় সেখানে একজনকে নিয়োগ করা হবে। বিজ্ঞাপনে বর্ণিত অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ও চাকরিগত যোগ্যতার প্রমাণাদিসহ দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছে। অধ্যাপক আনোয়ার পাশারও প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার। ভাবলেন, সুযোগটা অবশেষে পাওয়াই গেল সম্ভবত। যাবতীয় প্রমাণ ও কাগজপত্রসহ দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। যথাসময়ে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের হাতে তা পেঁৗছেও গেল। কিছুকাল পর তিনি ইন্টারভিউ কার্ড পেলেন। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে অধ্যাপক আনোয়ার পাশা জানতে পারলেন, ওই পদে একজনকে ইতিমধ্যেই নিয়োগ দেওয়া হয়ে গেছে। সর্বোচ্চ জ্ঞানপীঠ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িক শিক্ষক! অবাক হলেও ক্ষোভে-দুঃখে-অপমানে আনোয়ার পাশা ফিরে আসেন বহরমপুরে। চাকরি করতে থাকেন সেখানেই। কিন্তু মন থেকে অপমানবোধ-অভিমান তো সহজে যাওয়ার নয়। যে পাকিস্তানকে তিনি দুই চোখে দেখতে পারতেন না, যার উগ্র বিরোধী ছিলেন তিনি; স্বাধীন অখণ্ড ভারত ছিল যাঁর স্বপ্নের প্রতিটি পরতে গাঁথা, সেই আনোয়ার পাশা সুযোগ খুঁজতে থাকলেন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসার।
সুযোগটা অবশ্য শেষ পর্যন্ত পেয়েও গেলেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে বাংলা সাহিত্যের প্রভাষক পদ শূন্য হওয়ায় সেখানে উপযুক্ত প্রার্থী পেলে নিয়োগ দেওয়া হবে মর্মে পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন তাঁর চোখে পড়ল। তিনি বিজ্ঞাপনটি পুনরায় দেখে দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ বরাবর। দরখাস্তটি পাওয়ার পর পরই গভর্নিং বডির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অধ্যাপক আনোয়ার পাশাকে নিয়োগপত্র পাঠানো হলো। বলা হলো, নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে এসে জয়েনিং রিপোর্ট পেশ করতে। গভীর ক্ষোভ ও বেদনার্ত মন নিয়ে, অশ্রু সজল চোখে বহরমপুরকে ভালো করে দেখে অধ্যাপক আনোয়ার পাশা অবশেষে সত্যই দেশত্যাগী হলেন; পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে এসে যোগ দিলেন। জ্ঞানের গভীরতা, ছাত্রছাত্রীদের প্রতি স্নেহ-মমতায় শিগগিরই পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে একজন অতিশয় জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেলেন অধ্যাপক আনোয়ার পাশা।
১৯৬৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ছিল আইয়ুব খান গঠিত মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটে পাকিস্তানব্যাপী গণপরিষদের নির্বাচন। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অমান্য করে, অর্থাৎ দলের সিদ্ধান্তকে ভুল বলে জানিয়ে পাবনা জেলা ন্যাপ ও আওয়ামী লীগ তাঁকে প্রার্থী দাঁড় করায়। দিনমান তাই আমরা নির্বাচনী কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। পোলিং শেষ হওয়ার পর আমরা সন্ধ্যায় ডা. দাক্ষীর চেম্বারে আসি চা খেতে। জেলা ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদক মীজানুর রহমানের দায়িত্ব পড়েছিল চাটমোহর কেন্দ্রে। তিনি ফিরে এসে স্নান করে ঠিক সন্ধ্যায় ভাত খেতে বসেছেন। কাজের মেয়ে খেতে দিচ্ছিল। ভাতের প্রথম গ্রাস মুখে দিতেই কাজের মেয়েটি মীজানুর রহমানকে বলল, 'ভাই, তাড়াতাড়ি খেয়ে ওঠেন, এখনই গণ্ডগোল-কাটাকাটি শুরু হবে।' 'কিসের গণ্ডগোল? জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি জানাল, হিন্দুদের কাটবে; অস্ত্র শান দিচ্ছে, আমার পাড়ায় দেখে এলাম। তার পাড়াটি ছিল কৃষ্ণপুর। সবাই আজও পাকিস্তান বলে ডাকে। মীজানুর তৎক্ষণাৎ উঠে হাত-মুখ ধুয়ে লুঙ্গি পরা, গেঞ্জি গায়ে ছুটে আসেন ডা. দাক্ষীর চেম্বারে।
এডওয়ার্ড কলেজের হিন্দু হোস্টেলের ছেলেরা ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করছিল। আনোয়ার পাশা দাঙ্গার খবর পেয়ে সেখানে এসে হিন্দু ছাত্রদের খোঁজ নেন। ওরা বলে, স্যার, বাঁচান। আনোয়ার পাশা বললেন, তোমরা কি প্রিন্সিপ্যাল সাহেবকে বলেছ? ওরা বলল, দু-তিনবার গিয়ে বহুক্ষণ তাঁর বন্ধ করে রাখা দরজায় কড়া নেড়েছি। কিছুতেই কেউ খোলেন না, সাড়াও দেন না। একপর্যায় স্যার এলে সামান্য এক মিনিটের জন্য খুললে আমরা নিরাপত্তা চাইলাম। তিনি বললেন, তোমরা হোস্টেলে গিয়ে থাক। আমার কিছু করার নেই। বলে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
আনোয়ার পাশা তখন নাইট গার্ডকে বললেন, 'টিচার্স ওয়েটিং রুমটা খোলো।' খোলা হলে ছাত্রদের সবাইকে বললেন, 'তোমরা এই রুমে ঢুকে পড়ো।' ওরা তা করলে আনোয়ার পাশা বললেন, 'তোমরা কেউ ডাকলে সাড়া দিয়ো না। ভেতরে সবাই থাকো। গার্ড তালা বন্ধ করে দেবে। আমি বাসায় যাচ্ছি; ঘণ্টা দুয়েক পর তোমাদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসছি। সাবধানে থেকো।' এই কথা বলে গার্ডকে তালা বন্ধ করে দূরে গিয়ে থাকতে বললেন এবং কোনো কারণেই ওই রুমটা রাতের মধ্যে না খোলার নির্দেশ দিলেন। অধ্যাপক আনোয়ার পাশা বাসায় গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে ভাত, ডাল, ভর্তা, সবজি রান্না করতে বললেন। রান্না হয়ে গেলে দু-তিনটি রিকশা ডেকে তাতে খাবার, পানি, থালা, গ্লাস নিয়ে নিজেই আবার ছুটলেন কলেজ মাঠে। রিকশাওয়ালারা যাতে বুঝতে না পারে, তাই তাদের বিদায় করে দিলেন। সতর্কতার সঙ্গে খাবারগুলো টিচার্স কমনরুমে ঢুকিয়ে দিতে বললেন গার্ডকে। গার্ড তা করে দরজা আটকে দিল। গার্ডকে আনোয়ার পাশা বললেন, রাতটুকুর মধ্যে কিছুতেই যেন দরজা খোলা না হয়। পরদিন ভোরে তিনি আবার এসে ওই রুমের দরজা খুলে দিয়ে ছেলেদের দ্রুত তাদের হোস্টেলে সব জিনিসপত্রসহ যেতে বললেন এবং থালাবাটিগুলো বিকেলে তাঁর বাসায় পেঁৗছে দিতে বললেন। রুমটা গার্ড নিজেই পরিষ্কার করল। এভাবেই সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়ে দেশত্যাগী অধ্যাপক আনোয়ার পাশা বহু ছেলেকে সাম্প্রদায়িক শক্তির আক্রোশ থেকে ১৯৬৪ সালে বাঁচালেন। কিন্তু ১৯৭১-এ ওই সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতেই তাঁর জীবন গেল।
লেখক : সাংবাদিক ও আইনজীবী
হঠাৎ একদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপনের প্রতি অধ্যাপক আনোয়ার পাশার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের পদ খালি হওয়ায় সেখানে একজনকে নিয়োগ করা হবে। বিজ্ঞাপনে বর্ণিত অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ও চাকরিগত যোগ্যতার প্রমাণাদিসহ দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছে। অধ্যাপক আনোয়ার পাশারও প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার। ভাবলেন, সুযোগটা অবশেষে পাওয়াই গেল সম্ভবত। যাবতীয় প্রমাণ ও কাগজপত্রসহ দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। যথাসময়ে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের হাতে তা পেঁৗছেও গেল। কিছুকাল পর তিনি ইন্টারভিউ কার্ড পেলেন। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে অধ্যাপক আনোয়ার পাশা জানতে পারলেন, ওই পদে একজনকে ইতিমধ্যেই নিয়োগ দেওয়া হয়ে গেছে। সর্বোচ্চ জ্ঞানপীঠ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িক শিক্ষক! অবাক হলেও ক্ষোভে-দুঃখে-অপমানে আনোয়ার পাশা ফিরে আসেন বহরমপুরে। চাকরি করতে থাকেন সেখানেই। কিন্তু মন থেকে অপমানবোধ-অভিমান তো সহজে যাওয়ার নয়। যে পাকিস্তানকে তিনি দুই চোখে দেখতে পারতেন না, যার উগ্র বিরোধী ছিলেন তিনি; স্বাধীন অখণ্ড ভারত ছিল যাঁর স্বপ্নের প্রতিটি পরতে গাঁথা, সেই আনোয়ার পাশা সুযোগ খুঁজতে থাকলেন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসার।
সুযোগটা অবশ্য শেষ পর্যন্ত পেয়েও গেলেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে বাংলা সাহিত্যের প্রভাষক পদ শূন্য হওয়ায় সেখানে উপযুক্ত প্রার্থী পেলে নিয়োগ দেওয়া হবে মর্মে পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন তাঁর চোখে পড়ল। তিনি বিজ্ঞাপনটি পুনরায় দেখে দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ বরাবর। দরখাস্তটি পাওয়ার পর পরই গভর্নিং বডির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অধ্যাপক আনোয়ার পাশাকে নিয়োগপত্র পাঠানো হলো। বলা হলো, নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে এসে জয়েনিং রিপোর্ট পেশ করতে। গভীর ক্ষোভ ও বেদনার্ত মন নিয়ে, অশ্রু সজল চোখে বহরমপুরকে ভালো করে দেখে অধ্যাপক আনোয়ার পাশা অবশেষে সত্যই দেশত্যাগী হলেন; পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে এসে যোগ দিলেন। জ্ঞানের গভীরতা, ছাত্রছাত্রীদের প্রতি স্নেহ-মমতায় শিগগিরই পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে একজন অতিশয় জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেলেন অধ্যাপক আনোয়ার পাশা।
১৯৬৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ছিল আইয়ুব খান গঠিত মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটে পাকিস্তানব্যাপী গণপরিষদের নির্বাচন। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অমান্য করে, অর্থাৎ দলের সিদ্ধান্তকে ভুল বলে জানিয়ে পাবনা জেলা ন্যাপ ও আওয়ামী লীগ তাঁকে প্রার্থী দাঁড় করায়। দিনমান তাই আমরা নির্বাচনী কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। পোলিং শেষ হওয়ার পর আমরা সন্ধ্যায় ডা. দাক্ষীর চেম্বারে আসি চা খেতে। জেলা ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদক মীজানুর রহমানের দায়িত্ব পড়েছিল চাটমোহর কেন্দ্রে। তিনি ফিরে এসে স্নান করে ঠিক সন্ধ্যায় ভাত খেতে বসেছেন। কাজের মেয়ে খেতে দিচ্ছিল। ভাতের প্রথম গ্রাস মুখে দিতেই কাজের মেয়েটি মীজানুর রহমানকে বলল, 'ভাই, তাড়াতাড়ি খেয়ে ওঠেন, এখনই গণ্ডগোল-কাটাকাটি শুরু হবে।' 'কিসের গণ্ডগোল? জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি জানাল, হিন্দুদের কাটবে; অস্ত্র শান দিচ্ছে, আমার পাড়ায় দেখে এলাম। তার পাড়াটি ছিল কৃষ্ণপুর। সবাই আজও পাকিস্তান বলে ডাকে। মীজানুর তৎক্ষণাৎ উঠে হাত-মুখ ধুয়ে লুঙ্গি পরা, গেঞ্জি গায়ে ছুটে আসেন ডা. দাক্ষীর চেম্বারে।
এডওয়ার্ড কলেজের হিন্দু হোস্টেলের ছেলেরা ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করছিল। আনোয়ার পাশা দাঙ্গার খবর পেয়ে সেখানে এসে হিন্দু ছাত্রদের খোঁজ নেন। ওরা বলে, স্যার, বাঁচান। আনোয়ার পাশা বললেন, তোমরা কি প্রিন্সিপ্যাল সাহেবকে বলেছ? ওরা বলল, দু-তিনবার গিয়ে বহুক্ষণ তাঁর বন্ধ করে রাখা দরজায় কড়া নেড়েছি। কিছুতেই কেউ খোলেন না, সাড়াও দেন না। একপর্যায় স্যার এলে সামান্য এক মিনিটের জন্য খুললে আমরা নিরাপত্তা চাইলাম। তিনি বললেন, তোমরা হোস্টেলে গিয়ে থাক। আমার কিছু করার নেই। বলে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
আনোয়ার পাশা তখন নাইট গার্ডকে বললেন, 'টিচার্স ওয়েটিং রুমটা খোলো।' খোলা হলে ছাত্রদের সবাইকে বললেন, 'তোমরা এই রুমে ঢুকে পড়ো।' ওরা তা করলে আনোয়ার পাশা বললেন, 'তোমরা কেউ ডাকলে সাড়া দিয়ো না। ভেতরে সবাই থাকো। গার্ড তালা বন্ধ করে দেবে। আমি বাসায় যাচ্ছি; ঘণ্টা দুয়েক পর তোমাদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসছি। সাবধানে থেকো।' এই কথা বলে গার্ডকে তালা বন্ধ করে দূরে গিয়ে থাকতে বললেন এবং কোনো কারণেই ওই রুমটা রাতের মধ্যে না খোলার নির্দেশ দিলেন। অধ্যাপক আনোয়ার পাশা বাসায় গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে ভাত, ডাল, ভর্তা, সবজি রান্না করতে বললেন। রান্না হয়ে গেলে দু-তিনটি রিকশা ডেকে তাতে খাবার, পানি, থালা, গ্লাস নিয়ে নিজেই আবার ছুটলেন কলেজ মাঠে। রিকশাওয়ালারা যাতে বুঝতে না পারে, তাই তাদের বিদায় করে দিলেন। সতর্কতার সঙ্গে খাবারগুলো টিচার্স কমনরুমে ঢুকিয়ে দিতে বললেন গার্ডকে। গার্ড তা করে দরজা আটকে দিল। গার্ডকে আনোয়ার পাশা বললেন, রাতটুকুর মধ্যে কিছুতেই যেন দরজা খোলা না হয়। পরদিন ভোরে তিনি আবার এসে ওই রুমের দরজা খুলে দিয়ে ছেলেদের দ্রুত তাদের হোস্টেলে সব জিনিসপত্রসহ যেতে বললেন এবং থালাবাটিগুলো বিকেলে তাঁর বাসায় পেঁৗছে দিতে বললেন। রুমটা গার্ড নিজেই পরিষ্কার করল। এভাবেই সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়ে দেশত্যাগী অধ্যাপক আনোয়ার পাশা বহু ছেলেকে সাম্প্রদায়িক শক্তির আক্রোশ থেকে ১৯৬৪ সালে বাঁচালেন। কিন্তু ১৯৭১-এ ওই সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতেই তাঁর জীবন গেল।
লেখক : সাংবাদিক ও আইনজীবী
No comments