শহীদদের রক্তস্নাত বধ্যভূমিও বেদখল-স্থবির হয়ে আছে ৭১ কোটি টাকার প্রকল্প by নওশাদ জামিল
১৯৭১ সালে জায়গাটিতে ছিল 'মুসলিম লীগ বাজার'। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করে পুঁতে রাখা হতো এখানে। স্বাধীনতার ২৮ বছর পর ১৯৯৯ সালে এখানে আবিষ্কৃত হয় বধ্যভূমি। পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ লে. সেলিমসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধার হাড়, পাঁজর, মাথার খুলি। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে এটি খনন করা হলে তখন উঠে আসে অসংখ্য মানুষের মাথার খুলি, হাড়গোড়, কঙ্কালসহ মানবদেহের নানা অংশ।
এ ঘটনা সারা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জোরালো হয়। জায়গাটির নামকরণ করা হয় মুসলিম বাজার বধ্যভূমি।
মিরপুর ১১ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ বধ্যভূমি। সরকারি নথিপত্রে বধ্যভূমিটি সংরক্ষিত। তবে কিছুদিন আগে গিয়ে দেখা গেছে, এর অধিকাংশ জায়গা দখল হয়ে গেছে। ঠিক যে জায়গায় কূপ ছিল, যেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে পুঁতে রাখা হয়েছিল, ওই জায়গা দখল করে সেখানে টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে! এভাবেই দেশের বিভিন্ন বধ্যভূমি ও গণকবর দখল হয়ে গেছে।
শহীদ লে. সেলিমের ভাই মুক্তিযোদ্ধা ডা. হাসান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মুসলিম বাজার বধ্যভূমির জায়গায় টয়লেট নির্মাণ করে পুরো জাতির প্রতি অসম্মান দেখানো হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা হয়েছে।
পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে বিস্মৃতির গহ্বরে। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা অধিকাংশ বধ্যভূমিতে স্বাধীনতার ৪০ বছরেও নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিফলক। সেগুলোর সংরক্ষণ ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণও নেই। সরকারি উদ্যোগে হাতে গোনা কয়েকটি বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হলেও অধিকাংশ এখন বেদখল। বধ্যভূমির সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ৭১ কোটি টাকার প্রকল্পটিও বন্ধ হয়ে গেছে। এ বাস্তবতায় আজ ১৪ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৭৬টি বধ্যভূমি ও গণকবর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলেও সেটি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। মাত্র ৩৩টি বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক নির্মাণ করলেও বাকিগুলো পড়ে আছে অবহেলায়। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির অভাবে ইতিমধ্যে ২৮টি বধ্যভূমি ও গণকবর দখল করে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। সেখানে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে আবাসিক ভবন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কাঁচাবাজার ও টয়লেট।
বধ্যভূমির দখলের কথা অস্বীকার করেননি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা বেশ কিছু বধ্যভূমি ও গণকবর দখলের অভিযোগ পেয়েছি। আমরা শিগগিরই বধ্যভূমি অবৈধ দখলদারমুক্ত করব। সেসব স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করব। তাতে লেখা থাকবে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা।' তিনি আরো বলেন, '১৭৬টি বধ্যভূমি ও গণকবরে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। এর জন্য কিছু সময় লাগবে। আপাতত আমাদের এ প্রকল্পটি বন্ধ রয়েছে। প্ল্যানিং কমিশনের অনুমোদন পেলেই আবার কাজ শুরু হবে।'
নিশ্চিহ্নের পথে ২৮ বধ্যভূমি : ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির মাঠপর্যায়ের গবেষণা ও জরিপ থেকে দেখা যায়, সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষিত ৩৩টি বধ্যভূমির ২৮টি ইতিমধ্যে স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে। সংগঠনটি অবৈধ দখলে থাকা বধ্যভূমিগুলো দখলদারমুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে বেশ কয়েকবার চিঠিও দিয়েছে। তবে মন্ত্রণালয় থেকে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির তথ্যানুসারে জানা যায়, ইতিমধ্যে দখলের কারণে প্রকৃত মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার হুমকিতে রয়েছে মিরপুরের শিয়ালবাড়ী, মুসলিম বাজার, শিনি্নরটেক, সারেংবাড়ী, কালাপানির ঢাল, বাঙলা কলেজের আমবাগান, কল্যাণপুর বাস ডিপো, চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর আমবাগান, ফয়'স লেক, নেত্রকোনার মগড়াবাড়ীসহ ২৮টি সংরক্ষিত বধ্যভূমি ও গণকবর। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান কালের কণ্ঠকে জানান, 'একাত্তর সালে গোটা বাংলাদেশই ছিল একটা বধ্যভূমি। অধিকাংশ এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন। কিছু টিকে থাকলেও সেগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ নেই। আমরা চাই গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও নিদর্শনগুলো অন্তত যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হোক। তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণ উদাসীন।'
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামের আমবাগান, খুলনার চুকনগর ও সিলেট ক্যাডেট কলেজসংলগ্ন বধ্যভূমির বেশির ভাগ এলাকা অবৈধ দখলে চলে গেছে। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. শামসুজ্জোহা হলের পেছনের বধ্যভূমি, রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমী সংলগ্ন বধ্যভূমি, বরিশালের আগৈলঝাড়া থানার গৈলা ইউনিয়নের পশ্চিম কাঠিড়া বধ্যভূমিসহ মেহেরপুর, সুনামগঞ্জ, যশোর, হবিগঞ্জ, পঞ্চগড়, পাবনা, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় বধ্যভূমিগুলো রয়েছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের যশদল সুগার মিল এলাকায় নির্জন স্থানে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে একটি বধ্যভূমি। ঝোপঝাড় আর জনাকীর্ণ এ বধ্যভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা করা হয় ১৫০ স্বাধীনতাকামী মানুষকে। স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতায় এ বধ্যভূমিটি এখন অবৈধ দখলে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে ১০টি বধ্যভূমির বেশির ভাগ জায়গা দখল হয়ে গেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পল্লবীর কালাপানি, রাইনখোলা, মিরপুরের শিনি্নরটেক, সারেংবাড়ী, গোলারটেকের পালপাড়া, বাঙলা কলেজের আমবাগান. আলুদ্দি, খুনিবাড়ী আর জল্লাদখানা। শুধু রায়ের বাজার, জগন্নাথ হলের বধ্যভূমি ছাড়া অন্যগুলো প্রায় জীর্ণ। দখলের ফলে বদলে গেছে বধ্যভূমির প্রকৃত অবয়বও।
সংখ্যাও নিরূপণ করা হয়নি : স্বাধীনতার ৪০ বছরেও একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবরের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করা হয়নি। এ সম্পর্কে সরকারি উদ্যোগে জরিপ ও মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ থেমে গেছে। ফলে বেশির ভাগ বধ্যভূমি ও গণকবর আবিষ্কৃত হয়নি বলে মনে করা হয়। সরকারি হিসাবে, এ পর্যন্ত দেশে মোট ২০৯টি বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ শনাক্ত করেছে ১৯৩টি।
বেসরকারি উদ্যোগে বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান মিলেছে বেশি। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণা অনুযায়ী, একাত্তরে দেশে প্রায় পাঁচ হাজার ছোট-বড় বধ্যভূমি তৈরি হয়। এসবের মধ্যে ৯২০টি বধ্যভূমি শনাক্ত করা গেছে সারা দেশে। এ ছাড়া ৮৮টি নদী ও ৬৫টি ব্রিজ-কালভার্ট শনাক্ত করা গেছে, সেসব জায়গায় একাত্তরে নিয়মিত শত শত সাধারণ বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। তবে সরকারি ও বেসরকারি হিসাবে সমন্বয় করে এবং অধ্যাপক মওদুদ এলাহীর সহযোগিতায় একটি বধ্যভূমি মানচিত্র প্রণয়ন করেছে ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি। ওই মানচিত্রে দেশের ছয়টি বিভাগে ৮৭৪টি বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিত করা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমির সন্ধান মিলেছে ঢাকা বিভাগে, ২৭০টি। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগে ২১২, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগে ১১৬টি করে, সিলেট বিভাগে ৭৪ ও বরিশাল বিভাগে ৪১টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা গেছে। জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি রয়েছে ঢাকায়, ৭০টি।
বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ বন্ধ
স্থবির ৭১ কোটি টাকার প্রকল্প
১৭৬টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। সে হিসাবে প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৭১ কোটি টাকা। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৩৩টি স্থানে বধ্যভূমি চিহ্নিত করে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। তবে পরে সেগুলো যথাযথ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে পাওয়া তালিকা এবং অন্যান্য সুপারিশের মাধ্যমে ১৭৬টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৯টির জন্য সরকারি জমি পাওয়া গেছে। বাকি ১৪৭টির জন্য জমি কিনতে হবে, যার অর্থায়ন হবে প্রকল্প ব্যয় থেকে। গড়ে প্রতিটি বধ্যভূমির জন্য ১০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে ২০১৩ সালের মধ্যে। পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ দুই বছর চললেও এখন তা থমকে আছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ও প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ মজিবুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রয়োজনীয় অর্থ ও জমি বরাদ্দের অভাবে থেমে আছে প্রকল্পটি। তবে তা শিগগির চালু হবে বলে আশা করি।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'কয়েকটি বধ্যভূমি দখলের অভিযোগ রয়েছে আমাদের কাছে। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর আমবাগান বধ্যভূমির আংশিক দখল হলেও হাইকোর্টের রায়ে সেখানকার নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। ঢাকার মিরপুরের কয়েকটি বধ্যভূমি দখল সম্পর্কেও অভিযোগ পেয়েছি। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।'
মিরপুর ১১ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ বধ্যভূমি। সরকারি নথিপত্রে বধ্যভূমিটি সংরক্ষিত। তবে কিছুদিন আগে গিয়ে দেখা গেছে, এর অধিকাংশ জায়গা দখল হয়ে গেছে। ঠিক যে জায়গায় কূপ ছিল, যেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে পুঁতে রাখা হয়েছিল, ওই জায়গা দখল করে সেখানে টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে! এভাবেই দেশের বিভিন্ন বধ্যভূমি ও গণকবর দখল হয়ে গেছে।
শহীদ লে. সেলিমের ভাই মুক্তিযোদ্ধা ডা. হাসান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মুসলিম বাজার বধ্যভূমির জায়গায় টয়লেট নির্মাণ করে পুরো জাতির প্রতি অসম্মান দেখানো হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা হয়েছে।
পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে বিস্মৃতির গহ্বরে। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা অধিকাংশ বধ্যভূমিতে স্বাধীনতার ৪০ বছরেও নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিফলক। সেগুলোর সংরক্ষণ ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণও নেই। সরকারি উদ্যোগে হাতে গোনা কয়েকটি বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হলেও অধিকাংশ এখন বেদখল। বধ্যভূমির সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ৭১ কোটি টাকার প্রকল্পটিও বন্ধ হয়ে গেছে। এ বাস্তবতায় আজ ১৪ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৭৬টি বধ্যভূমি ও গণকবর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলেও সেটি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। মাত্র ৩৩টি বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক নির্মাণ করলেও বাকিগুলো পড়ে আছে অবহেলায়। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির অভাবে ইতিমধ্যে ২৮টি বধ্যভূমি ও গণকবর দখল করে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। সেখানে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে আবাসিক ভবন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কাঁচাবাজার ও টয়লেট।
বধ্যভূমির দখলের কথা অস্বীকার করেননি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা বেশ কিছু বধ্যভূমি ও গণকবর দখলের অভিযোগ পেয়েছি। আমরা শিগগিরই বধ্যভূমি অবৈধ দখলদারমুক্ত করব। সেসব স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করব। তাতে লেখা থাকবে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা।' তিনি আরো বলেন, '১৭৬টি বধ্যভূমি ও গণকবরে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। এর জন্য কিছু সময় লাগবে। আপাতত আমাদের এ প্রকল্পটি বন্ধ রয়েছে। প্ল্যানিং কমিশনের অনুমোদন পেলেই আবার কাজ শুরু হবে।'
নিশ্চিহ্নের পথে ২৮ বধ্যভূমি : ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির মাঠপর্যায়ের গবেষণা ও জরিপ থেকে দেখা যায়, সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষিত ৩৩টি বধ্যভূমির ২৮টি ইতিমধ্যে স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে। সংগঠনটি অবৈধ দখলে থাকা বধ্যভূমিগুলো দখলদারমুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে বেশ কয়েকবার চিঠিও দিয়েছে। তবে মন্ত্রণালয় থেকে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির তথ্যানুসারে জানা যায়, ইতিমধ্যে দখলের কারণে প্রকৃত মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার হুমকিতে রয়েছে মিরপুরের শিয়ালবাড়ী, মুসলিম বাজার, শিনি্নরটেক, সারেংবাড়ী, কালাপানির ঢাল, বাঙলা কলেজের আমবাগান, কল্যাণপুর বাস ডিপো, চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর আমবাগান, ফয়'স লেক, নেত্রকোনার মগড়াবাড়ীসহ ২৮টি সংরক্ষিত বধ্যভূমি ও গণকবর। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান কালের কণ্ঠকে জানান, 'একাত্তর সালে গোটা বাংলাদেশই ছিল একটা বধ্যভূমি। অধিকাংশ এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন। কিছু টিকে থাকলেও সেগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ নেই। আমরা চাই গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও নিদর্শনগুলো অন্তত যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হোক। তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণ উদাসীন।'
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামের আমবাগান, খুলনার চুকনগর ও সিলেট ক্যাডেট কলেজসংলগ্ন বধ্যভূমির বেশির ভাগ এলাকা অবৈধ দখলে চলে গেছে। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. শামসুজ্জোহা হলের পেছনের বধ্যভূমি, রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমী সংলগ্ন বধ্যভূমি, বরিশালের আগৈলঝাড়া থানার গৈলা ইউনিয়নের পশ্চিম কাঠিড়া বধ্যভূমিসহ মেহেরপুর, সুনামগঞ্জ, যশোর, হবিগঞ্জ, পঞ্চগড়, পাবনা, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় বধ্যভূমিগুলো রয়েছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের যশদল সুগার মিল এলাকায় নির্জন স্থানে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে একটি বধ্যভূমি। ঝোপঝাড় আর জনাকীর্ণ এ বধ্যভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা করা হয় ১৫০ স্বাধীনতাকামী মানুষকে। স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতায় এ বধ্যভূমিটি এখন অবৈধ দখলে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে ১০টি বধ্যভূমির বেশির ভাগ জায়গা দখল হয়ে গেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পল্লবীর কালাপানি, রাইনখোলা, মিরপুরের শিনি্নরটেক, সারেংবাড়ী, গোলারটেকের পালপাড়া, বাঙলা কলেজের আমবাগান. আলুদ্দি, খুনিবাড়ী আর জল্লাদখানা। শুধু রায়ের বাজার, জগন্নাথ হলের বধ্যভূমি ছাড়া অন্যগুলো প্রায় জীর্ণ। দখলের ফলে বদলে গেছে বধ্যভূমির প্রকৃত অবয়বও।
সংখ্যাও নিরূপণ করা হয়নি : স্বাধীনতার ৪০ বছরেও একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবরের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করা হয়নি। এ সম্পর্কে সরকারি উদ্যোগে জরিপ ও মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ থেমে গেছে। ফলে বেশির ভাগ বধ্যভূমি ও গণকবর আবিষ্কৃত হয়নি বলে মনে করা হয়। সরকারি হিসাবে, এ পর্যন্ত দেশে মোট ২০৯টি বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ শনাক্ত করেছে ১৯৩টি।
বেসরকারি উদ্যোগে বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান মিলেছে বেশি। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণা অনুযায়ী, একাত্তরে দেশে প্রায় পাঁচ হাজার ছোট-বড় বধ্যভূমি তৈরি হয়। এসবের মধ্যে ৯২০টি বধ্যভূমি শনাক্ত করা গেছে সারা দেশে। এ ছাড়া ৮৮টি নদী ও ৬৫টি ব্রিজ-কালভার্ট শনাক্ত করা গেছে, সেসব জায়গায় একাত্তরে নিয়মিত শত শত সাধারণ বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। তবে সরকারি ও বেসরকারি হিসাবে সমন্বয় করে এবং অধ্যাপক মওদুদ এলাহীর সহযোগিতায় একটি বধ্যভূমি মানচিত্র প্রণয়ন করেছে ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি। ওই মানচিত্রে দেশের ছয়টি বিভাগে ৮৭৪টি বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিত করা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমির সন্ধান মিলেছে ঢাকা বিভাগে, ২৭০টি। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগে ২১২, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগে ১১৬টি করে, সিলেট বিভাগে ৭৪ ও বরিশাল বিভাগে ৪১টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা গেছে। জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি রয়েছে ঢাকায়, ৭০টি।
বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ বন্ধ
স্থবির ৭১ কোটি টাকার প্রকল্প
১৭৬টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। সে হিসাবে প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৭১ কোটি টাকা। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৩৩টি স্থানে বধ্যভূমি চিহ্নিত করে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। তবে পরে সেগুলো যথাযথ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে পাওয়া তালিকা এবং অন্যান্য সুপারিশের মাধ্যমে ১৭৬টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৯টির জন্য সরকারি জমি পাওয়া গেছে। বাকি ১৪৭টির জন্য জমি কিনতে হবে, যার অর্থায়ন হবে প্রকল্প ব্যয় থেকে। গড়ে প্রতিটি বধ্যভূমির জন্য ১০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে ২০১৩ সালের মধ্যে। পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ দুই বছর চললেও এখন তা থমকে আছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ও প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ মজিবুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রয়োজনীয় অর্থ ও জমি বরাদ্দের অভাবে থেমে আছে প্রকল্পটি। তবে তা শিগগির চালু হবে বলে আশা করি।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'কয়েকটি বধ্যভূমি দখলের অভিযোগ রয়েছে আমাদের কাছে। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর আমবাগান বধ্যভূমির আংশিক দখল হলেও হাইকোর্টের রায়ে সেখানকার নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। ঢাকার মিরপুরের কয়েকটি বধ্যভূমি দখল সম্পর্কেও অভিযোগ পেয়েছি। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।'
No comments