সময়ের প্রতিধ্বনি-পদ্মা সেতু : অভিযুক্ত মন্ত্রীর বিদায় এখন কী করবে বিশ্বব্যাংক? by মোস্তফা কামাল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন, গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় মন্ত্রিসভার রদবদল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে আবুল হোসেনের বিদায় সরকারের দৃষ্টিতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও আমরা তা মনে করছি না। আমরা জানি, বিশ্বব্যাংক তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্নীতির অভিযোগ করেছিল। তারা বলেছিল, আবুল হোসেন দায়িত্বে থাকলে পদ্মা সেতুতে তারা কোনো সহায়তা দেবে না। এর ফলে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে


পড়তে হয়েছিল। কিন্তু তার পরও আবুল হোসেন পদত্যাগ করেননি। তিনি বললেন, পদত্যাগের বিষয়টি তাঁর হাতে নেই। এর ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে তাদের সহায়তা স্থগিত করে দিয়েছে।
এ ঘটনার অব্যবহিত পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে প্রধানমন্ত্রী বাধ্য হয়েই মন্ত্রিসভায় রদবদলের সিদ্ধান্ত নেন। অভিযুক্ত মন্ত্রী আবুল হোসেনকে সরিয়ে ওবায়দুল কাদেরকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর আগে তিনি সরকারের ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে মিডিয়ায় বেশ সরব ছিলেন। শপথ নেওয়ার পর প্রথম কর্মদিবসে নতুন যোগাযোগমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর এক নম্বর অগ্রাধিকার হচ্ছে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করা। খুব শিগগিরই এর নির্মাণকাজ শুরু হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তবে তিনি এ কাজে কতটা সফল হতে পারবেন তা সময়ই বলে দেবে।
আমরা জানি, দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গত বছর কাজও শুরু হয়েছিল। ছয় হাজার ১৫০ মিটার দীর্ঘ ও ২১.১০ মিটার প্রস্থ সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল তিন বিলিয়ন (৩০০ কোটি) মার্কিন ডলার। এর অর্ধেক অর্থাৎ ১.৫ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা বিশ্বব্যাংকের। এ ছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ৬১৫ মিলিয়ন ডলার, জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা) ৪১৫ মিলিয়ন ডলার এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ১৪০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বাকি অর্থ সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এর নির্মাণকাজ ২০১৩ সালের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। সামগ্রিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে বলে উল্লেখ করা হয়।
সব কিছুই ঠিকঠাক মতো চলছিল। কিন্তু মন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কারণে প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে। এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক চেষ্টা-তদবিরও করা হয়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা চলে। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয়নি। বিশ্বব্যাংক তাদের অবস্থানে অনড় থাকে। বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য অনুযায়ী, তারা এ বিষয়ে যে তদন্ত করেছে, তাতে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা তারা পেয়েছে। ওই তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছেও দেওয়া হয়েছে এবং সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে। অথচ সরকার কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।
এ নিয়ে গণমাধ্যম বেশ সরব ছিল। প্রতিটি টিভি ও সংবাদপত্র সরকার এবং মন্ত্রীর একগুঁয়ে মনোভাবের কঠোর সমালোচনা করেছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সরকারের উচিত ছিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা করা। আমি নিজেও লিখেছিলাম, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ যেহেতু উঠেছে, সেহেতু তাঁর সরে যাওয়াই উচিত। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করা উচিত নয়। মন্ত্রী ভাবলেন, পদত্যাগ করলে তাঁর গায়ে দুর্নীতির সিল লেগে যাবে। সেটা সরকারের জন্যও বিব্রতকর হবে। কাজেই পদত্যাগ করা যাবে না। সরকারের ভেতর থেকেও আবুল হোসেনকে সমর্থন দেওয়া হয়েছিল। আর তাতে বিশ্বব্যাংকের অসন্তুষ্টি আরো বেড়ে গেল। তারা তাদের সাহায্য স্থগিত ঘোষণা করল। এতে শুধু যে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে তা নয়, দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এই ইস্যুটি উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে একটা নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছে। দেশে যে বিনিয়োগের একটা আবহ তৈরি হচ্ছিল, সেখানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, এখন বিশ্বব্যাংককে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের বিশ্বব্যাপী ভাবমূর্তি ধরে রাখার জন্য হলেও অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে। অন্যথায় মানুষের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হবে যে সরকারকে বিপদে ফেলতেই বিশ্বব্যাংক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারকে চাপে রাখতে কিংবা বিপদে ফেলতে এ কাণ্ডটি তারা করে থাকে। আমরা এটাও জানি, আমাদের দেশে বিভিন্ন ইস্যুতে বিশ্বব্যাংক সব সময়ই সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কখনো কখনো নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। কোনো কারণে সরকারের সঙ্গে বনিবনা না হলেই তারা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকে।
আমার আগের লেখায় বিশ্বব্যাংকের নতুন ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছিলাম। তাতে কারো কারো আঁতে ঘা লেগেছিল। যা হোক, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ সত্যি হলে আমি না হয় আমার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেব। এখন বিশ্বব্যাংকের কাছে আমার প্রশ্ন, সরকার মন্ত্রী বদল করেছে। এখন বিশ্বব্যাংকের নীতি কি বদল হবে? না হলে কেন হবে না? বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ছিল আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে। তাঁকে না সরালে পদ্মা সেতুতে সহায়তা দেবে না। সরকার তাঁকে সরিয়েছে। এখন তো বিশ্বব্যাংকের এগিয়ে আসা উচিত! বিশ্বব্যাংকের স্বউদ্যোগেই বলা উচিত, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিশ্বব্যাংক সাহায্য অব্যাহত রাখবে।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি দারুণ ক্ষুণ্ন হয়েছে। বিশ্বব্যাংক যদি অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে সরকারের ভাবমূর্তির কী হবে! সরকার কি হৃত ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে পারবে? যদি পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক আগের মতোই সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ দ্রুত শুরু করতে পারে, তাহলে হয়তো সরকারের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হবে।
এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত, বিশ্বব্যাংকের প্রতি রাগ কিংবা অভিমান ভুলে গিয়ে একসঙ্গে কাজ করা। প্রয়োজনে সরকার আবারও বিশ্বব্যাংক প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করতে পারে। সরকার আরো নমনীয় হতে পারে। সরকারের নমনীয়তায় যদি একটি পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় তাতে ক্ষতি কী! বরং সরকারের ভাবমূর্তিই উজ্জ্বল হবে।
সরকার নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পেরেছে যে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার মাপকাঠি হবে বৃহত্তর এই প্রকল্পটি। এর সঙ্গে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায়ও বড় ধরনের গতি আসবে। উন্নয়ন সহযোগীরা বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা দিতে এগিয়ে আসবে। সম্ভবত এ কারণেই সরকার প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী এবং যোগাযোগমন্ত্রী উভয়েই গণমাধ্যমকে বলেছেন, প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপে (পিপিপি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এ প্রক্রিয়ায় এই বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না তা নিয়ে ইতিমধ্যে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।
বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়তো করা যাবে, কিন্তু তাতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে উন্নয়ন সহযোগীদের চটিয়ে কিছু করা যাবে না। ঘুরেফিরে তাদের কাছে যেতেই হবে। আমরা এখনো বাজেট ঘোষণার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই আমাদের মান-অভিমান থাকতে নেই। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা দ্রুত কমিয়ে আনা ভালো। তবে আমরা এটা বলি না যে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সরকার বিশ্বব্যাংক বা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে নত হয়ে থাকুক। সরকার কর্মদক্ষতা ও কৌশল দিয়ে তাদের হাতে রাখবে। দাতারা আস্থা হারালে বিপদটা কিন্তু শুধু সরকারের নয়, দেশেরও।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীদের আস্থা ফেরাতে প্রয়োজন হলে সরকার একটা পরামর্শক টিম গঠন করতে পারে। যে টিমটি উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে। পাশাপাশি দেশের স্বার্থও যাতে অক্ষুণ্ন থাকে তা তারা নিশ্চিত করবে।
এমনিতেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা চলছে। আগামী দিনগুলোতে দেশের বাজার অর্থনীতির চাকা সচল করতে হলে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের দ্বারস্থ হতেই হবে। সম্পর্ক ভালো রেখে তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা আদায় করতে পারাই হচ্ছে একটি সরকারের দক্ষতা। সরকারের কাজকর্মে তার প্রতিফলন আমরা দেখতে চাই। তা ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারকে আরো কৌশলী হতে হবে। তা না হলে সরকারের জন্য অত্যন্ত দুঃসময় নেমে আসবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে আমরা এখনো আশাবাদী। সরকার নিশ্চয়ই পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে। আর বিলম্ব না করে অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে বসে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করবেন। এ ক্ষেত্রে আমরা সরকারের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আশা করি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.