সমকালীন প্রসঙ্গ-শিক্ষা ব্যবস্থার ভাঙন :কোচিং সেন্টারের উদ্ভব ও বিস্তার by বদরুদ্দীন উমর
মানুষ যা কিছু কারবার করে, রাজনীতি, সংস্কৃতি থেকে নিয়ে শিক্ষা পর্যন্ত সবকিছুই গড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যবসাতেই পরিণত হয়। ব্যবসার মধ্যেই সবকিছু লয়প্রাপ্ত হয়। বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে এবং বিশেষত স্কুল পর্যায়ে এখন যা ঘটছে তার মধ্যেও এটাই দেখা যাচ্ছে। শিক্ষা এখন ব্যবসায় পরিণত হওয়ায় শিক্ষার মান শোচনীয়ভাবে কমে আসায় অনেক জৌলুস সত্ত্বেও সংস্কৃতি এখন ব্যবসার অধীন হয়েছে এবং সাধারণভাবে নৈতিকতার মান ভয়ঙ্করভাবে
নিচে নেমেছে বাংলাদেশে এখন শিক্ষা ব্যবস্থার করুণ অবস্থা। বলা চলে, এই ব্যবস্থা এখন ভেঙে পড়েছে। উচ্চশিক্ষার অবস্থা খারাপ, কিন্তু স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার অবনতি এখন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে এটা এক আতঙ্কজনক ব্যাপার। এই আতঙ্কের কারণ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঠিকমতো কাজ করছে না এবং এভাবে চলতে থাকলে এগুলো অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ অকেজো প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। এটা গ্রামাঞ্চলে ও মফস্বল শহরগুলোর স্কুলের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, রাজধানী ঢাকা শহরের স্কুলগুলো সম্পর্কেও প্রযোজ্য। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর ঢাকার কয়েকটি বাছাই করা স্কুলের ভালো ফল এবং এই ভালো ফল করা উচ্ছ্বসিত ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজি 'ভি' চিহ্ন প্রদর্শন সত্ত্বেও এ কথা সত্য, এই ভালো ফল করা ছাত্রছাত্রীরা এসব স্কুলের ছাত্রী হলেও পরীক্ষায় ভালো ফলের কৃতিত্ব প্রকৃতপক্ষে স্কুলগুলোর নয়। এ কৃতিত্ব হচ্ছে এই স্কুলগুলোর কিছুসংখ্যক শিক্ষকের দ্বারা পরিচালিত কোচিং সেন্টারগুলোর। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামসহ অন্য কয়েকটি বড় শহরের কিছু স্কুলের অবস্থাও একই রকম।
পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যায়, কিছুসংখ্যক স্কুলের সব ছাত্রই ফেল করেছে। অনেক স্কুলে সব ছাত্র ফেল না করলেও পাসের হার নগণ্য। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, এই স্কুলগুলো সব গ্রামাঞ্চলে এবং আর্থিক দুরবস্থার কারণে এগুলোতে শিক্ষকদের নিম্নমান থেকে নিয়ে শিক্ষা প্রদানের অন্যান্য উপকরণের অবস্থাও শোচনীয়। এই স্কুলগুলোতে গরিব ও নিম্নবিত্তদের ছেলেমেয়েরাই পড়াশোনা করে থাকে। অন্যদিকে ঢাকাসহ কয়েকটি বড় মফস্বল শহরের কিছু স্কুল যে ভালো করে সেগুলোর অর্থাভাব নেই। উপযুক্ত শিক্ষা থেকে নিয়ে শিক্ষার যাবতীয় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবও এগুলোতে নেই। কাজেই এগুলোতে ছাত্রছাত্রীরা গ্রামাঞ্চলের অর্থাভাবগ্রস্ত স্কুলগুলো থেকে শিক্ষার সুযোগ অনেক বেশি পেয়ে থাকে।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, স্কুলগুলোর অবস্থা যাই হোক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুলের সিলেবাস বা পাঠ্য বিষয়ের দিকে তাকালে দেখা যাবে তার অবস্থা শোচনীয়। এই সিলেবাস অনুযায়ী পড়াশোনা করে ছাত্রছাত্রীরা খুব ভালো ফল করলেও তাদের বিশেষ শিক্ষা হয় না, অন্তত এই পর্যায়ে যে শিক্ষা হওয়া দরকার তা হয় না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, স্কুল পর্যায়ে ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেভাবে পড়া দরকার তার কিছুই হয় না। না হওয়ার কারণ, পাঠ্যসূচিতে ইতিহাস বলে কোনো বিষয় পড়ানো হয় না, যেমন আগে হতো। সমাজবিজ্ঞান নামে এক বিষয়ের মধ্যে মাত্র কয়েক পৃষ্ঠার ইতিহাসের সঙ্গে যা থাকে সেটা মোটেই ইতিহাস পদবাচ্য নয়। আগে ম্যাট্রিকুলেশন (যা বর্তমানে এসএসসির সমতুল্য) পর্যায়ে ভারতবর্ষের প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক ইতিহাসের ওপর একটা পেপার থাকত এবং সেটা পড়লে নিজেদের দেশের ইতিহাসের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের একটা পরিচয় হতো। ইন্টারমিডিয়েট (যা বর্তমানে এইচএসসির তুল্য) পর্যায়ে ভারতের ইতিহাস ছাড়াও থাকত ইংল্যান্ড ও ইউরোপের ইতিহাস। এখন তার কোনো নাম-নিশানাই এইচএসসি বা এসএসসির সিলেবাসে নেই। ইতিহাসের নামে এখানে যে স্থূল কারবার করা হয় তা হলো, যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তখন তাদের দলের নেতাদের ইতিহাসের নায়ক বানিয়ে নানা ধরনের অসত্য কাহিনী ইতিহাসের নামে পরিবেশন করা। এভাবে পরিবেশিত ইতিহাসে পাওয়া যায় কে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল তার কথা। এতে পাওয়া যায় জনগণ নয়, দেশের অন্য কেউই নয়, শুধু ক্ষমতাসীন দলের নেতাই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, দেশের পরিত্রাতা! এই 'ইতিহাস' থেকে মনে হয়, ১৯৭১ সালের আগে এ দেশের ইতিহাস বলে কিছু ছিল না। ইতিহাসের শুরু ১৯৭১ সালে!
সিলেবাসের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, স্কুল বা স্কুলের শিক্ষকরা ভালো হলেও যদি পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে জ্ঞান লাভের মতো কোনো কিছু না থাকে, তাহলে শিক্ষা পরিণত হয় এক ভুয়ো ব্যাপারে। ইতিহাসকে বিষয় হিসেবে প্রকৃতপক্ষে সিলেবাস থেকে উচ্ছেদ করে দিয়ে শিক্ষাকে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনো মহলের কোনো উদ্বেগ বা চিন্তা আছে এমন মনে হয় না। যে দেশের এই অবস্থা সে দেশের ছাত্রছাত্রীদের এর থেকে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে?
শুধু পাঠ্য বিষয় হিসেবে ইতিহাস উচ্ছেদ করাই নয়, এই দুই পর্যায়ের সমগ্র সিলেবাসের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে শিক্ষাক্ষেত্রে শুধু সিলেবাসের দারিদ্র্যের কারণেই যে অবস্থা তৈরি করে রাখা হয়েছে তাকে ভয়াবহ ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। কাজেই এই সিলেবাস অনুযায়ী পরীক্ষা দিয়ে কোনো ছাত্র যদি সোনার মেডেল পায় তা হলেও তার বিশেষ কিছু শিক্ষা অর্জিত হয়েছে এমন বলার উপায় নেই।
এ তো গেল শিক্ষা ব্যবস্থার একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর অন্য দিক হলো, স্কুল পর্যায়ে শিক্ষাদানের পদ্ধতি। যেসব স্কুলে এইচএসসি পরীক্ষায় সব ছেলে ফেল করে অথবা হাতেগোনা কয়েকজন পাস করে সেগুলোতে এটা ঘটার প্রধান কারণ শিক্ষকদের অতি নিম্নমান ও শিক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব। ঢাকা, চট্টগ্রাম ইত্যাদি বড় শহরের কয়েকটি স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত ভালো ফল করার কারণ এই স্কুলগুলোতে শিক্ষকদের মান ভালো এবং শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণের লভ্যতা। কিন্তু যে বিষয়টি এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার তা হলো, এই স্কুলগুলোতে শিক্ষকদের মান ভালো হলেও স্কুলে যেটুকু শিক্ষা দেওয়া হয় তার জন্যই এগুলোর ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ফল ভালো হয় না। এখন এই ভালো ফল নির্ভর করে ছাত্রছাত্রীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের স্কুলের শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত কোচিং সেন্টারগুলোতে হাজার হাজার টাকা মাসে ব্যয় করে পড়ছে কি-না তার ওপর। এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে এসব স্কুলের নিচু ক্লাসগুলোতে শিক্ষকরা মোটামুটি ঠিকমতো পাঠদান করলেও ওপরের ক্লাসগুলোতে শিক্ষকরা পাঠদান করেন না বললেই চলে। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোতে এইচএসসি, এসএসসি এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে ও-লেভেল এ-লেভেল পরীক্ষা সামনে রেখে উঁচু ক্লাসের শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের স্কুলের ক্লাসে বাস্তবত কিছুই পড়ান না। এই স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের মাসে অনেক বেতন দিতে হয়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে মাসে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দিতে হয়! অথচ এগুলোতে উঁচু ক্লাসে কোনো শিক্ষা দেওয়া হয় না। শিক্ষকরা ক্লাসে কোনো পাঠদান না করে ছাত্রছাত্রীদের বাধ্য করেন তাদের কোচিং সেন্টারে গিয়ে পাঠ গ্রহণ করতে! এই কোচিং সেন্টারগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের মাসিক বেতন দিতে হয় হাজার হাজার টাকা। শুধু যে তাদের এই উঁচু বেতন দিতে হয় তাই নয়, তারা ও তাদের অভিভাবকরা নিজেদের কাজের সঙ্গে এই কোচিং সেন্টারগুলোতে যাওয়া-আসার দৌড়াদৌড়িতে এমন হয়রান হন, যা তাদের সকলের স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ। কোনো সভ্য দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা নিজেদের দায়িত্ব সম্পূর্ণ অবহেলা করে এভাবে ব্যবসাদারে পরিণত হতে পারেন না। কিন্তু বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে এখন এই অবস্থাই চলছে। শিক্ষকরা আজ তাদের পেশাগত দায়িত্ববোধ সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে ষোলোআনা ব্যবসাদারে পরিণত হয়ে কোচিং ব্যবসা যেভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন এটা যে কোনো দেশের পক্ষেই এক কলঙ্কজনক ব্যাপার। বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন থেকে এই কলঙ্কজনক ব্যাপারই পরিণত হয়েছে স্বাভাবিক ব্যাপারে! পাঁচ-দশ হাজার টাকা মাসিক বেতন নেওয়া স্কুলগুলোতে উঁচু বেতন নেওয়া শিক্ষকরা ঠিকমতো নিজেদের দায়িত্ব পালন করছেন কি-না তা তাদের দেখার কেউ নেই! শুধু স্কুল কর্তৃপক্ষই নয়, সরকারি কর্তৃপক্ষও বিষয়টি সম্পর্কে ভালোমতো অবহিত থাকলেও তারা কিছুই করে না।
এর মূল কারণ, ১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের হঠাৎ উত্থান ঘটে। তারা এ দেশে সবরকম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে অবশেষে শাসকের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ীদের শাসন এখন বাংলাদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। মানুষ যা কিছু কারবার করে, রাজনীতি, সংস্কৃতি থেকে নিয়ে শিক্ষা পর্যন্ত সবকিছুই গড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যবসাতেই পরিণত হয়। ব্যবসার মধ্যেই সবকিছু লয়প্রাপ্ত হয়। বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে এবং বিশেষত স্কুল পর্যায়ে এখন যা ঘটছে তার মধ্যেও এটাই দেখা যাচ্ছে। শিক্ষা এখন ব্যবসায় পরিণত হওয়ায় শিক্ষার মান শোচনীয়ভাবে কমে আসায় অনেক জৌলুস সত্ত্বেও সংস্কৃতি এখন ব্যবসার অধীন হয়েছে এবং সাধারণভাবে নৈতিকতার মান ভয়ঙ্করভাবে নিচে নেমেছে। চতুর্দিকে দুর্নীতির জয়জয়কারের মধ্যে এর প্রমাণ দাঁড়িয়ে আছে। শিক্ষকদের ব্যবসাদারে পরিণত হওয়া এই দুর্নীতিরই এক প্রামাণ্য দৃষ্টান্ত।
৩.১০.২০১১
পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যায়, কিছুসংখ্যক স্কুলের সব ছাত্রই ফেল করেছে। অনেক স্কুলে সব ছাত্র ফেল না করলেও পাসের হার নগণ্য। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, এই স্কুলগুলো সব গ্রামাঞ্চলে এবং আর্থিক দুরবস্থার কারণে এগুলোতে শিক্ষকদের নিম্নমান থেকে নিয়ে শিক্ষা প্রদানের অন্যান্য উপকরণের অবস্থাও শোচনীয়। এই স্কুলগুলোতে গরিব ও নিম্নবিত্তদের ছেলেমেয়েরাই পড়াশোনা করে থাকে। অন্যদিকে ঢাকাসহ কয়েকটি বড় মফস্বল শহরের কিছু স্কুল যে ভালো করে সেগুলোর অর্থাভাব নেই। উপযুক্ত শিক্ষা থেকে নিয়ে শিক্ষার যাবতীয় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবও এগুলোতে নেই। কাজেই এগুলোতে ছাত্রছাত্রীরা গ্রামাঞ্চলের অর্থাভাবগ্রস্ত স্কুলগুলো থেকে শিক্ষার সুযোগ অনেক বেশি পেয়ে থাকে।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, স্কুলগুলোর অবস্থা যাই হোক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুলের সিলেবাস বা পাঠ্য বিষয়ের দিকে তাকালে দেখা যাবে তার অবস্থা শোচনীয়। এই সিলেবাস অনুযায়ী পড়াশোনা করে ছাত্রছাত্রীরা খুব ভালো ফল করলেও তাদের বিশেষ শিক্ষা হয় না, অন্তত এই পর্যায়ে যে শিক্ষা হওয়া দরকার তা হয় না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, স্কুল পর্যায়ে ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেভাবে পড়া দরকার তার কিছুই হয় না। না হওয়ার কারণ, পাঠ্যসূচিতে ইতিহাস বলে কোনো বিষয় পড়ানো হয় না, যেমন আগে হতো। সমাজবিজ্ঞান নামে এক বিষয়ের মধ্যে মাত্র কয়েক পৃষ্ঠার ইতিহাসের সঙ্গে যা থাকে সেটা মোটেই ইতিহাস পদবাচ্য নয়। আগে ম্যাট্রিকুলেশন (যা বর্তমানে এসএসসির সমতুল্য) পর্যায়ে ভারতবর্ষের প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক ইতিহাসের ওপর একটা পেপার থাকত এবং সেটা পড়লে নিজেদের দেশের ইতিহাসের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের একটা পরিচয় হতো। ইন্টারমিডিয়েট (যা বর্তমানে এইচএসসির তুল্য) পর্যায়ে ভারতের ইতিহাস ছাড়াও থাকত ইংল্যান্ড ও ইউরোপের ইতিহাস। এখন তার কোনো নাম-নিশানাই এইচএসসি বা এসএসসির সিলেবাসে নেই। ইতিহাসের নামে এখানে যে স্থূল কারবার করা হয় তা হলো, যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তখন তাদের দলের নেতাদের ইতিহাসের নায়ক বানিয়ে নানা ধরনের অসত্য কাহিনী ইতিহাসের নামে পরিবেশন করা। এভাবে পরিবেশিত ইতিহাসে পাওয়া যায় কে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল তার কথা। এতে পাওয়া যায় জনগণ নয়, দেশের অন্য কেউই নয়, শুধু ক্ষমতাসীন দলের নেতাই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, দেশের পরিত্রাতা! এই 'ইতিহাস' থেকে মনে হয়, ১৯৭১ সালের আগে এ দেশের ইতিহাস বলে কিছু ছিল না। ইতিহাসের শুরু ১৯৭১ সালে!
সিলেবাসের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, স্কুল বা স্কুলের শিক্ষকরা ভালো হলেও যদি পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে জ্ঞান লাভের মতো কোনো কিছু না থাকে, তাহলে শিক্ষা পরিণত হয় এক ভুয়ো ব্যাপারে। ইতিহাসকে বিষয় হিসেবে প্রকৃতপক্ষে সিলেবাস থেকে উচ্ছেদ করে দিয়ে শিক্ষাকে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনো মহলের কোনো উদ্বেগ বা চিন্তা আছে এমন মনে হয় না। যে দেশের এই অবস্থা সে দেশের ছাত্রছাত্রীদের এর থেকে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে?
শুধু পাঠ্য বিষয় হিসেবে ইতিহাস উচ্ছেদ করাই নয়, এই দুই পর্যায়ের সমগ্র সিলেবাসের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে শিক্ষাক্ষেত্রে শুধু সিলেবাসের দারিদ্র্যের কারণেই যে অবস্থা তৈরি করে রাখা হয়েছে তাকে ভয়াবহ ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। কাজেই এই সিলেবাস অনুযায়ী পরীক্ষা দিয়ে কোনো ছাত্র যদি সোনার মেডেল পায় তা হলেও তার বিশেষ কিছু শিক্ষা অর্জিত হয়েছে এমন বলার উপায় নেই।
এ তো গেল শিক্ষা ব্যবস্থার একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর অন্য দিক হলো, স্কুল পর্যায়ে শিক্ষাদানের পদ্ধতি। যেসব স্কুলে এইচএসসি পরীক্ষায় সব ছেলে ফেল করে অথবা হাতেগোনা কয়েকজন পাস করে সেগুলোতে এটা ঘটার প্রধান কারণ শিক্ষকদের অতি নিম্নমান ও শিক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব। ঢাকা, চট্টগ্রাম ইত্যাদি বড় শহরের কয়েকটি স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত ভালো ফল করার কারণ এই স্কুলগুলোতে শিক্ষকদের মান ভালো এবং শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণের লভ্যতা। কিন্তু যে বিষয়টি এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার তা হলো, এই স্কুলগুলোতে শিক্ষকদের মান ভালো হলেও স্কুলে যেটুকু শিক্ষা দেওয়া হয় তার জন্যই এগুলোর ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ফল ভালো হয় না। এখন এই ভালো ফল নির্ভর করে ছাত্রছাত্রীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের স্কুলের শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত কোচিং সেন্টারগুলোতে হাজার হাজার টাকা মাসে ব্যয় করে পড়ছে কি-না তার ওপর। এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে এসব স্কুলের নিচু ক্লাসগুলোতে শিক্ষকরা মোটামুটি ঠিকমতো পাঠদান করলেও ওপরের ক্লাসগুলোতে শিক্ষকরা পাঠদান করেন না বললেই চলে। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোতে এইচএসসি, এসএসসি এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে ও-লেভেল এ-লেভেল পরীক্ষা সামনে রেখে উঁচু ক্লাসের শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের স্কুলের ক্লাসে বাস্তবত কিছুই পড়ান না। এই স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের মাসে অনেক বেতন দিতে হয়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে মাসে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দিতে হয়! অথচ এগুলোতে উঁচু ক্লাসে কোনো শিক্ষা দেওয়া হয় না। শিক্ষকরা ক্লাসে কোনো পাঠদান না করে ছাত্রছাত্রীদের বাধ্য করেন তাদের কোচিং সেন্টারে গিয়ে পাঠ গ্রহণ করতে! এই কোচিং সেন্টারগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের মাসিক বেতন দিতে হয় হাজার হাজার টাকা। শুধু যে তাদের এই উঁচু বেতন দিতে হয় তাই নয়, তারা ও তাদের অভিভাবকরা নিজেদের কাজের সঙ্গে এই কোচিং সেন্টারগুলোতে যাওয়া-আসার দৌড়াদৌড়িতে এমন হয়রান হন, যা তাদের সকলের স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ। কোনো সভ্য দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা নিজেদের দায়িত্ব সম্পূর্ণ অবহেলা করে এভাবে ব্যবসাদারে পরিণত হতে পারেন না। কিন্তু বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে এখন এই অবস্থাই চলছে। শিক্ষকরা আজ তাদের পেশাগত দায়িত্ববোধ সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে ষোলোআনা ব্যবসাদারে পরিণত হয়ে কোচিং ব্যবসা যেভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন এটা যে কোনো দেশের পক্ষেই এক কলঙ্কজনক ব্যাপার। বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন থেকে এই কলঙ্কজনক ব্যাপারই পরিণত হয়েছে স্বাভাবিক ব্যাপারে! পাঁচ-দশ হাজার টাকা মাসিক বেতন নেওয়া স্কুলগুলোতে উঁচু বেতন নেওয়া শিক্ষকরা ঠিকমতো নিজেদের দায়িত্ব পালন করছেন কি-না তা তাদের দেখার কেউ নেই! শুধু স্কুল কর্তৃপক্ষই নয়, সরকারি কর্তৃপক্ষও বিষয়টি সম্পর্কে ভালোমতো অবহিত থাকলেও তারা কিছুই করে না।
এর মূল কারণ, ১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের হঠাৎ উত্থান ঘটে। তারা এ দেশে সবরকম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে অবশেষে শাসকের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ীদের শাসন এখন বাংলাদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। মানুষ যা কিছু কারবার করে, রাজনীতি, সংস্কৃতি থেকে নিয়ে শিক্ষা পর্যন্ত সবকিছুই গড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যবসাতেই পরিণত হয়। ব্যবসার মধ্যেই সবকিছু লয়প্রাপ্ত হয়। বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে এবং বিশেষত স্কুল পর্যায়ে এখন যা ঘটছে তার মধ্যেও এটাই দেখা যাচ্ছে। শিক্ষা এখন ব্যবসায় পরিণত হওয়ায় শিক্ষার মান শোচনীয়ভাবে কমে আসায় অনেক জৌলুস সত্ত্বেও সংস্কৃতি এখন ব্যবসার অধীন হয়েছে এবং সাধারণভাবে নৈতিকতার মান ভয়ঙ্করভাবে নিচে নেমেছে। চতুর্দিকে দুর্নীতির জয়জয়কারের মধ্যে এর প্রমাণ দাঁড়িয়ে আছে। শিক্ষকদের ব্যবসাদারে পরিণত হওয়া এই দুর্নীতিরই এক প্রামাণ্য দৃষ্টান্ত।
৩.১০.২০১১
No comments