স্মৃতিচিহ্নে শহীদের কথা
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের 'শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা'। এখানে শহীদদের নানা দুর্লভ স্মৃতিচিহ্ন থাকলেও ক্যাম্পাসের বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীই জানেন না গুরুত্বপূর্ণ এ সংগ্রহশালাটি কিভাবে গড়ে উঠেছে, কী কী আছে এখানে! এবারের আয়োজনে এই সংগ্রহশালা ঘুরে
জানাচ্ছেন আসাদুর রহমান ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ছিল একই সঙ্গে আনন্দ এবং বিষাদে ভরা একটি দিন। কারণ এই দিনই সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দেশের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগ্রহশালা_'শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা'। প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলোর স্থানীয় সংগ্রহ হিসেবেই গড়ে উঠেছিল এ সংগ্রহশালা। পরে এখানে যুক্ত হয় '৫২-এর ভাষা আন্দোলনের নানা স্মৃতিচিহ্ন এবং দেশের নানা প্রান্তের স্মৃতিচিহ্নগুলো।
শিল্পী ফণীন্দ্রনাথ রায়ের ডিজাইনে তৈরি সংগ্রহশালাটি গড়ে উঠেছে শহীদ মিনারের মুক্তমঞ্চের গ্রিনরুমে। এটি উদ্বোধন করেন তিন শহীদ শিক্ষকপত্নী_ওয়াহিদা রহমান, মাস্তুরা খানম এবং চম্পা সমাদ্দার। এদিন থেকেই দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হয় সংগ্রহশালা। শুরুর দিকে নির্ধারিত স্থান না থাকায় বছরের বিশেষ দিনগুলোতেই কেবল দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হতো এটি। পরে ২২ মার্চ, ১৯৮৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আমানুল্লাহ আহমদ সংগ্রহশালার মূল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এখন ছয় হাজার ৬০০ বর্গফুটের বিশাল এ সংগ্রহশালায় গ্যালারি রয়েছে তিনটি। সংরক্ষিত রয়েছে '৫২, '৬৬, '৬৯ ও '৭১ সালের গণআন্দোলনের স্মৃতিচিহ্ন।
যা আছে প্রথম গ্যালারিতে
এই গ্যালারিতে রয়েছে ৫৯টি আলোকচিত্র, ছয়টি প্রতিকৃতি, দুইটি কোলাজ, আটটি শিল্পকর্ম, একটি ভাস্কর্য, চারটি ডায়েরি ও পাণ্ডুলিপি এবং বাঁধাইকৃত দুটি আলোকচিত্র, সাতটি পোশাক ও অন্যান্য বস্তু। এখানে আরো রয়েছে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী কলেজ হোস্টেল গেটে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারের বাঁধাইকৃত আলোকচিত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার ঐতিহাসিক সভাসহ ওই দিন ঘটা নানা ঘটনার আলোকচিত্র_১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি, নগ্নপদ মিছিলের ছবি আছে এখানে। রয়েছে ১৯৫৩ সালের শহীদ মিনারের তোলা ছবিও। এ ছাড়া '৬৯-এর গণবিক্ষোভের মুখে পিছু হটে যাওয়া পুলিশ বাহিনী, বিক্ষুব্ধ জনতার ব্যারিকেড দেওয়ার ছবি ছাড়াও রয়েছে শহীদ_আসাদ, মতিউর, রফিক, বরকত, সালামের প্রতিকৃতি। আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষক শামসুজ্জোহার নানা সময়ের আলোকচিত্র_১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিলের শুরুতে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মিছিলে, ১৯৬৯ সালে মিছিলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায়, মৃতাবস্থায়, কবরে শায়িত ও '৭০-এ তাঁর স্মরণে অনুষ্ঠিত প্রার্থনাসভার। মোস্তফা মনোয়ারের শিল্পকর্ম ছাড়াও রয়েছে ভাস্কর্য, সুজা হায়দারের 'বর্ণমালা', আবু তাহেরের 'অসহায় আত্মা', প্রণব দাসের 'আর্তনাদ'।
দ্বিতীয় গ্যালারির এ টু জেড
এই গ্যালারিতে রয়েছে ৩৫টি, শিল্পকর্ম আছে ৯টি, বাঁধাইকৃত আলোকচিত্রের সংখ্যা ১৯টি, ভাস্কর্য রয়েছে তিনটি। পোশাক ও অন্যান্য বস্তু আছে ৯৯টি। ডায়েরি সংরক্ষিত রয়েছে পাঁচটি। এখানে আরো স্বাধীনতা যুদ্ধের ১১ সেক্টর কমান্ডার, সাত বীরশ্রেষ্ঠ ও জাতীয় চার নেতার প্রতিকৃতি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ শিক্ষকদের প্রতিকৃতি ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণাবাণীর প্রতিলিপি, মুজিবনগরে ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র, ১৯৭১ সালে মিছিলে উত্তাল ঢাকার রাজপথ, গণ-বিক্ষোভ, সংগ্রামী জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষ, ছাত্রীনিগ্রহ, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিলের চুক্তিপত্র, গণহত্যার স্থিরচিত্র রয়েছে। এই গ্যালারিতে বাঁধাই করে রাখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক বিখ্যাত পোস্টার_'আমরা সবাই বাঙালি', 'বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা', 'সদাজাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী'।
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি_রণবীর 'একাত্তর ফেরা', হাসেম খানের 'বাংলাদেশ ডিসেম্বর', মাহমুদুল হকের '৭১ দুর্ভিক্ষ' এবং আবদুর রাজ্জাকের ভাস্কর্য_'একজন মুক্তিযোদ্ধা' সংরক্ষিত রয়েছে এই গ্যালারিতে। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পোশাক ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র ছাড়াও এখানেই পাবেন শহীদ বুদ্ধিজীবী_মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশিদুল হাসান চৌধুরী এবং সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের ডায়েরি ও পাণ্ডুলিপি।
তৃতীয় গ্যালারির নানা কিছু
তৃতীয় গ্যালারিতেও আছে অন্যান্য গ্যালারির মতো আলোকচিত্রসহ নানা কিছু। এখানে সংরক্ষিত আলোকচিত্রের সংখ্যা ১১২টি, প্রতিকৃতি রয়েছে একটি, শিল্পীকর্ম আছে ১১টি, ভাস্কর্য রয়েছে ছয়টি, ডায়েরি ও পাণ্ডুলিপি আছে ৪০টি, পোশাক ও অন্যান্য বস্তু রয়েছে ৫৬টি। এখানে আরো পাবেন_মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবির, রণাঙ্গনে গেরিলা যোদ্ধা, বিজয়ী মুক্তিসেনা, হানাদারমুক্ত ঢাকা, গণকবর, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড, রায়েরবাজার বধ্যভূমি, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রের ছবি, বুদ্ধিজীবী ও শহীদ সাংবাদিকদের ছবি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি আলাদা বোর্ডও আছে এই গ্যালারিতে। রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গণকবর থেকে পাওয়া নাম না জানা শহীদদের মাথার খুলি-হাঁড়গোড় ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, শিল্পী কামরুল হাসানের বিখ্যাত পোস্টার_'এই জানোয়ারকে ধরিয়ে দিন' এবং আমিনুল ইসলামের_'শ্বেতপত্র ৭১'।
গবেষণা পাঠাগার এবং...
সাধারণ মানুষ এবং গবেষকদের জন্য 'শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা'য় রয়েছে 'মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা পাঠাগার'। যেখানে রয়েছে ১৯৪৭-'৭১ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা এবং এই বিষয়ের ওপর লেখা প্রায় হাজার তিনেক গ্রন্থ, পুস্তিকা, ইশতেহার ও সংকলন। এ ছাড়া সে সময়ের নানা পত্রিকাও রয়েছে এখানে বাঁধানো আকারে। সংগ্রহশালা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সিনিয়র প্রদর্শন কর্মকর্তা দিলরুবা খানম বলেন, 'সবার সামনে এই সংগ্রহশালা তুলে ধরতে আমরা সবসময় সচেষ্ট।'
No comments