শ্রদ্ধাঞ্জলি-প্রাণ করে হায় হায় by করুণাময় গোস্বামী

জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর দেহাবসান হলো। এ ঘটনা যে আমাদের জন্য কতটা শোকাবহ সে বলে বোঝাবার মতো নয়। সকালবেলা খানিক হেঁটে বাসায় ফিরে এ খবর শোনামাত্রই বুকটা যে ভার হয়ে এসেছে, এ ভার নামছে না কোনোমতেই। তাঁর সম্পর্কে এক্ষণে কিছু লেখাও নিতান্ত কষ্টকর। ভাষা জোগাতে চায় না। ছাতা সরে যাওয়া বলে একটা আলংকারিক কথা আছে। ছাতা শব্দটি এখানে আশ্রয় অর্থে ব্যবহৃত হয়। কবীর চৌধুরীর মহাপ্রস্থানের সঙ্গে


আমাদের মাথার ওপর থেকে যেন একটি ছাতা সরে গেল। আমরা আশ্রয়হীন হয়ে গেলাম। বাংলাদেশের বিবেকবান মানুষ দীর্ঘকাল ধরে এই পরম আশ্বাসের আশ্রয়টি অবলম্বন করে আসছিলেন। আজ সেই আশ্রয়ের সূত্রটি ছিন্ন হয়ে গেল। তাঁর সঙ্গে প্রতিনিয়তই যে আমাদের দেখা হতো বা কথা হতো তা নয়, আমরা জানতাম তিনি আছেন। আছেন যে সেটাই যথেষ্ট। সংকটে-সংশয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলা যাবে, করণীয় স্থির করা যাবে, আজ তিনি নেই, ফোন করে হোক, সাক্ষাৎ কথা বলে হোক করণীয় স্থির করার সুযোগ আর রইল না। এ যে জাতীয়ভাবে কত বড় শূন্যতা, এর স্বরূপ শুধু অনুধাবন করা চলে, বোঝানো যায় না। দীর্ঘকাল ধরে তিনি অগণিত মানুষের হৃদয়জুড়ে ছিলেন। কবীর চৌধুরীর প্রয়াণ সংবাদ অগণিত মানুষের হৃদয়কে ফাঁকা করে দিল। কবীর চৌধুরী শিক্ষক ছিলেন, লেখক ছিলেন, প্রশাসক ছিলেন। এমন লোক অনেক আছেন আমাদের সমাজে। কবীর চৌধুরী সব কিছুকে ছাপিয়ে উঠেছিলেন।
ঋষি যাজ্ঞবল্কের কিছু শিষ্যের পাঠ সমাপন হয়। তাঁরা স্নান করে পবিত্র বস্ত্র পরিধান করে গুরুর কাছে এসে দাঁড়ান আশীর্বচন লাভের জন্য। যাজ্ঞবল্ক বলেন, দেখো, একটা বিষয় সব সময় তোমাদের মনে রাখতে হবে, সংসারে এমন একটা স্থান আছে যেখানে শুধু বিদ্যা মানুষকে পেঁৗছাতে পারে না, পুরস্কার দিয়ে মানুষ সেখানে পেঁৗছতে পারে না, তবে বিদ্যা ও পুরস্কার উভয়ই সাহায্য করে সেখানে পেঁৗছাতে। ওই জায়গায় পেঁৗছানোই মানুষের জীবনের পরম আদর্শ। আমি নিজেও সঠিক জানি না, সেখানে কিসের বলে মানুষ যেতে পারে, তবে শোনো তোমরা, আমি যেটুকু জানি সে হচ্ছে কায়মনোবাক্যে সত্যকে অবলম্বন করা এবং সর্বজনীন প্রেম দিয়ে সত্যনিষ্ঠাকে অপরের পাত্রে জাগ্রত করবার শক্তি দিয়েই মানুষ সেখানে যেতে পারে। আমরা যে জায়গায় কবীর স্যারকে তাঁর আসন রচনা করতে দেখেছি সে শক্তি তিনি অর্জন করেছিলেন তাঁর বিদ্যা ও তাঁর সৃজনশীলবৃত্তিকে সত্য ও প্রেমের সঙ্গে যুক্ত করে। অপার্থিব বলে একটি শব্দ আমরা ব্যবহার করি। পৃথিবীর বাইরে বলে নয়, পৃথিবীর ভেতরেই পৃথিবীর বাইরের ঘটনা ঘটে, সেটাই অপার্থিব। আমরা সদাসর্বদা এত বেশি নিজেকে নিয়ে থাকি, এত বেশি ক্ষুদ্রের সঙ্গে মেশামেশি করি, আমরা ভুলতেই বসি জগতে আপনার বাইরেও কিছু আছে, আপনাকে অতিক্রম করে বাইরে গিয়ে দাঁড়ানো যায়। এর জন্য বিদ্যার বাইরে কিছু ব্যবহার করতে হয়, শারীরিক শক্তির বাইরে কিছু ব্যবহার করতে হয়। এর জন্য এমন কিছু বোধশক্তিকে অবলম্বন করতে হয়, যা ঋষি যেমন বলেন, সত্যান্বেষণ ও প্রেমান্বেষণের সঙ্গে যুক্ত। কবীর স্যারের কথা যখন ভাবি, তখন মনে হয় তিনি বিদ্যাকে, সৃজনশীল বৃত্তিকে সত্যবোধের সঙ্গে, সর্বজনীন প্রেমের সঙ্গে যুক্ত করে এমন এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, যেখানে পেঁৗছানো একটা পরম ব্যাপার, পৃথিবীর মধ্যে থেকেও সে অপার্থিব ঘটনা। সে জন্যই তাঁর প্রয়াণ এত বড় বিয়োগযন্ত্রণা সৃষ্টি করেছে। সমগ্র জাতির চিত্তকে সে যন্ত্রণা দীর্ঘ করছে।
সোনার তরী কাব্যের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, এ তরী নিঃশেষে আমার ফসল তুলে নেবে। আমাকে নেবে কি! তখনো তাঁর বয়স কম, জীবনের বিচিত্র কর্মকাণ্ড সারা হয়নি। ফলে তাঁর মনে হতেই পারে, মহাকাল তাঁর কাজকে নেবে, তাঁকে হয়তো নেবে না।
এ কবিতা শেষ বয়সে লিখলে তিনি এমন সংশয় প্রকাশ করতেন না। এ সংশয় বাক্যে পেঁৗছানোর আগে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, মানুষের সংস্পর্শেই সাহিত্যের পথ ও কর্মের পথ পাশাপাশি প্রসারিত হতে আরম্ভ হলো আমার জীবনে। সারা জীবন রবীন্দ্রনাথ এই পথটির নির্মাণ করেছেন, যার প্রধান দুটি নির্মাণ উপাদান হচ্ছে সাহিত্য ও কর্ম। কর্ম বলতে রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন মানুষের জীবনকে যে জায়গায় তিনি পেয়েছিলেন, সেখান থেকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সাহিত্য ও কর্মের রজ্জু, সমানে সমান টেনে নিয়ে তিনি অগ্রসর হয়েছেন। মহাকালের জয়গান তাঁর সাহিত্যকেও বহন করছে, তাঁর কর্ম ও বেদনাকেও বহন করছে। রেনেসাঁস মানব এভাবেই জীবনকে বোঝেন, সাহিত্য ও কর্মকে এভাবেই মিলিয়ে নেন। কবীর স্যারের কথা ভাবতে গিয়ে কেন জানি সোনার তরীর ভূমিকার কথা মনে পড়ল। আমি কোনো বই হাতে নিয়ে কিছু লিখছি না, মনের তেমন অবস্থাও নয়। মুখস্থ ছিল, কেমন কেমন করে জানি কয়েকটি বাক্য উঁকি দিয়ে ধরা দিল। কবীর স্যারও সাহিত্য ও কর্মকে একসঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। তাঁর বিবেচনায়ও ছিল তেমনি কাজ, যা মানুষের জীবনকে অগ্রসর করবে। তিনিও ছিলেন এক প্রচণ্ড রেনেসাঁস মানব, আমাদের এই অপ্রচণ্ড সমাজে। কালযান তাঁর কাজের ফসলকে যেমন বহন করবে, তাঁকেও তেমনি বহন করে নেবে স্মৃতির অমর প্রদেশে।
কবীর চৌধুরী বিস্ময়কর লেখক ছিলেন। এত বিষয়ে তিনি লিখেছেন, এত অজস্রভাবে তিনি লিখেছেন যে সে এক অভাবনীয় ঘটনা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রচনাকে বাঙালির বোধগম্য করে তোলার আজীবন সাধনা ছিল তাঁর। আবার বাঙালির সুকৃতিকেও বিশ্বসভায় তুলে ধরবার কঠিন আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর মধ্যে। এমন বিপুল কর্মপ্রয়াস পৃথিবীর মাপেই এক বিরল ঘটনা। আমাদের সৌভাগ্য যে এমন এক বৈশ্বিক প্রয়াসকে আমরা খুব কাছে থেকে দেখেছি। দেখা হলেই কুশল জিজ্ঞেস করতেন অত্যন্ত প্রাণবন্ত মমতা দিয়ে। কাউকে প্রশংসা করতে কুণ্ঠিত হতেন না। ইদানীং অনেক বক্তৃতার শেষে গিয়েই বলতেন, মৃত্যুকে আমি যে পাই না। রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের মৃত্যুঞ্জয়ী চরণ উদ্ধৃত করতেন। এসবই থাকবে আমাদের স্মরণে, শুধু তিনি নেই, তিনি নেই_সেটি এ মুহূর্তে বড় কথা।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.