শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস-বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির জয় হোক

'আধিপত্যের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম আদতে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মনে রাখার সংগ্রাম।' চেক ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা 'দি বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং' উপন্যাসে অবিস্মরণীয় এই বাক্যটি লিখেছিলেন।স্মরণাতীতকাল থেকে আজ অবধি পৃথিবীর যেখানেই গণহত্যা, গুপ্তহত্যা হয়েছে সেখানেই সাধারণ মানুষকে নিজের প্রয়োজনে মনে রাখতে হয়েছে দুঃসহ স্মৃতিলিপি। প্রজন্মের পর প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে হয়েছে প্রকৃত ইতিহাস।


এভাবেই আধিপত্যবাদী ক্ষমতার বিরুদ্ধে সক্রিয়তা জারি থেকেছে এবং শেষ পর্যন্ত একটি প্রজন্ম সত্যিকার অর্থে আধিপত্যবাদী মতাদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্য উচ্চারণের সাহস দেখিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ইতিহাসের ব্যত্যয় ঘটেনি। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করলেও বহুকাল এ দেশে এমন একটি প্রক্রিয়া সক্রিয় ছিল, যাতে লোকে যুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি ভুলে যায়, যাতে মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণী বিস্মৃত হয়ে এটি স্রেফ ইতিহাসের একটি অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। বলতে গেলে, এ প্রক্রিয়াটি সফল হতে চলেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালের কিছু ঘটনা বলছে_ আধিপত্যের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়নি। কেননা মানুষ মনে রেখেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে রাখার এই নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ইতিহাসকে আবার জাগ্রত করতে পেরেছে। আজ যখন এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, তখন তারা ইতিহাসের ঘুমন্ত কোনো পর্বের কথা নয়, জাগ্রত ও জীবন্ত একটি প্রক্রিয়ার কথা বলে। ফলে এখন মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলিকে স্মরণ করার তাৎপর্য বিশাল। আর এ ঘটনাবলির মধ্যে ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ মনে রাখার মতো একটি দিন। যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, আন্তর্জাতিক মহলে নানা প্রক্রিয়া চলছে; যখন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী ঢাকা দখলের কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছে; যখন সমস্বরে 'জয় বাংলা' উচ্চারণে ফেটে পড়ার জন্য অস্থির হয়ে আছে বাংলাদেশ, তখনই ঘটেছে ১৪ ডিসেম্বর। ঠাণ্ডা মাথার খুনিরা এ দিনের আগে-পরে বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে বের করে এনেছে। শুধু চিন্তা করার অপরাধে; শুধু স্বাধীনতা, মুক্তি ও মতপ্রকাশের কারণে তাদের হত্যা করেছে। আর হত্যা করার পর মরদেহগুলো অযত্নে-অবহেলায় ফেলে রেখেছে রায়েরবাজারের নিচু ভূমিতে। ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যার নজির অনেক আছে। যখন শাসকরা তাদের নিশ্চিত পরাজয়ের দিকে এগিয়ে যায় তখন তারা বিজয়ীদের চিন্তাকে খুন করে চলে যেতে চায়। বাংলাদেশেও পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা চিন্তাকে খুন করতে চেয়েছিল। অবশ্য শুধু ১৪ ডিসেম্বরই নয়, ২৫ মার্চের রাতের মৃত্যুর মিছিলেও অনেক বুদ্ধিজীবীকে দেখেছি আমরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযানের মধ্য দিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার যে অভিযান শুরু হয়, সে অভিযান শেষ হলো আরও পরিকল্পিত আরও নিষ্ঠুর ১৪ ডিসেম্বর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য এ হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি মনে রাখা যেমন জরুরি, তেমনি এ হত্যাকাণ্ডের তাৎপর্যও মনে রাখা জরুরি। এসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিবিধান দরকার। আশার কথা, খুনিদের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তা শুরু হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিজীবী দিবসের চেতনাকে আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ দিনটি হতে পারে স্বাধীন চিন্তা, মুক্ত মতপ্রকাশের স্মারক। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা, মতপ্রকাশের অধিকারকে মান্য ও চিন্তার স্বাধীনতাকে স্বীকার করার মধ্য দিয়ে এ দিনটির প্রকৃত স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব। যেদিন শুধু শব্দ নয়, আমাদের জীবনযাপনের মধ্যে আমরা মুক্তি ও স্বাধীনতা শব্দের অর্থ অনুভব করতে পারব, লাখো শহীদের প্রাণদানের অর্থ সেদিনই আমরা উপলব্ধি করতে পারব।

No comments

Powered by Blogger.