ইউরোপ-ইউরোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার by দাউদ হায়দার
ইউরোপেই ইউরোর নাভিশ্বাস। ইংল্যান্ড প্রথম থেকেই ইউরোপে একক মুদ্রা ইউরোর বিরুদ্ধে ছিল, বলছে এখন 'ডিজাস্টার'। ইউরোর কারণে ইউরোপকে এক রাখা প্রশ্নবিদ্ধ। এই প্রশ্ন কেবল ইংল্যান্ডের নয়। সাধারণ মানুষেরও। জার্মানির ২৫ ভাগের বেশি মানুষ ডয়েচ মার্কের পক্ষে। ফ্রান্সের ২৭ ভাগ ফ্রাঁর পক্ষে। ইতালির ৩৯ ভাগ লিরার পক্ষে
চোখের সামনেই সব ঘটনা। প্রত্যক্ষদর্শী। কিংবা বলা ভালো, নিজেই অংশগ্রহণকারী। ইতিহাসের এ টু জেড সাক্ষী।
চোখের সামনেই সব ঘটনা। প্রত্যক্ষদর্শী। কিংবা বলা ভালো, নিজেই অংশগ্রহণকারী। ইতিহাসের এ টু জেড সাক্ষী।
বার্লিন দেয়ালধস। কমিউনিজমের ধস। সোভিয়েত রাশিয়ার পতন (রিপোর্ট করতে গিয়েছিলাম মস্কোয়)। ইয়েলৎসিনের বিপ্লব। গর্বাচেভের আস্ফালন চুরমার। দুই বার্লিনসহ দুই জার্মানির পুনর্মিলন। পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির নতুন নামকরণ। খোলনালচে পাল্টিয়ে আবার ভিন্ন নাম। বার্লিনের নতুন সাজ। বন থেকে বার্লিনের রাজধানী স্থানান্তরিত। চ্যান্সেলরের নতুন দফতর-বাড়ি নির্মাণ। 'কমিউনিস্ট সংসদ ভবন' ধূলিসাৎ। চোখ ধাঁধানো স্থাপত্যকলায় বিশাল বিশাল ভবন, বিপণি বিতান নির্মাণ। সিনেমা হলগুলো বন্ধ করে ডিপার্টমেন্ট স্টোরস। পশ্চিম বার্লিনের যে কুদাম (কুরফরস্টেনডাম) ছিল সবচেয়ে দর্শনীয় (সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় 'ইউরোপের শ্রেষ্ঠ সড়ক') বাণিজ্য এলাকা, রেস্তোরাঁয় ভরপুর, সেক্সসপ, ক্লাব, ডিস্কোয় জমজমাট, সন্ধ্যার পরে সুন্দরী কলগার্লদের মিঠে চাহনি, হাতছানি_ একলহমায় যেন উধাও। পোটসডামার প্লাৎস, পূর্ব বার্লিনের ফ্রিডরিসস্ট্রাসে, প্রেন্সলাউয়ারব্যার্গ, হাকেশে হোকে, ওরানিয়াবুগার স্ট্রাসে ট্যুরিস্টের ভিড়ভাট্টা। শহরের চেহারা-চরিত্রে আমূল পরিবর্তন। এমনকি সংসদ ভবন রাখইস্টাগও। ঐতিহাসিক ব্রান্ডেনবুর্গ গেটও। এই গেটের নোম্যানস ল্যান্ডে কত ঢিল ছুড়েছি! গেটের সামনেই বার্লিন দেয়াল। দেয়ালের গায়ে নানা গ্রাফিটি। আবিষ্কার করি, গ্রাফিটির মধ্যেই কে যেন বাংলা ভাষায় লাল কালিতে লিখেছে, 'শালা' বিশাল অক্ষরে।
ওই যে বললাম, চোখের সামনে সব ঘটনা। প্রত্যক্ষদর্শী। ১৯৮৭ সাল থেকে আমি বার্লিনে এবং পশ্চিম বার্লিনে। ইতিহাস পরিষ্কার। জীবন্ত।
খুব উত্তেজনায় আছি। গোটা ইউরোপের কারেন্সি 'ইউরো' হয়ে যাবে। বাজারে ইউরোপ ছাড়ার আগে, এক বছর ধরে কাগজে-টিভিতে ইউরো কারেন্সির কী চেহারা (নোট, সেন্ট-পয়সা) নিত্যদিনই মুদ্রিত-প্রদর্শিত। এক ডয়েচ মার্কের বিপরীতে এক ইউরোর মূল্য কত, জানানো হচ্ছে নিয়মিত (এক ডয়েচ মার্কের বিপরীতে পাওয়া যাবে ৫০ সেন্ট। দুই ডয়েচ মার্কের মূল্য হয়ে যাবে এক ইউরো। অর্থাৎ অর্ধেক। ১০ ডয়েচ মার্ক ৫ ইউরো। ডয়েচ মার্ক এবং ফেনিংস [পয়সা] থাকবে না)। পূর্ব জার্মান কমিউনিস্ট সরকারের 'ডিডিআর' ডয়েচ মার্ক তো দুই জার্মানির পুনর্মিলনের একদিন আগেই লাপাত্তা।
ইউরোর জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৯৯-এ। প্রচলন :১ জানুয়ারি ২০০২ সাল থেকে। প্রচলনের এক মাস আগে ইউরো নিয়ে ইউরোপের কোন দেশে কী রকম উত্তেজনা চাক্ষুষ করার, রিপোর্ট করার দায় চাপায় ডয়েচে ভেলে। তা ছুটতে হয় এথেন্সে, ভিয়েনায়, লিবসনে, প্যারিসে, ব্রাসেলসে, আমস্টারডামে, মাদ্রিদে ও রোমে।
প্রত্যেক শহর থেকে রিপোর্টে উল্লেখ করি, জনগণ খুশি এবং অখুশি। এই মানুষ নিজস্ব তথা জাতীয় মুদ্রা হারিয়ে মনমরা। কেউ বলেন, ইউরোপীয় অভিন্ন মুদ্রা দুই দশকও টিকবে না। কারোর কথা, ইউরোপীয় ইনট্রেগেটি রাখার জন্যই ইউরো মুদ্রা জরুরি। কারণ একাধিক। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে, চলাফেরায় হরেক সুবিধা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে (২৭ দেশ, ১৭ দেশে ইউরো প্রচলিত) অভিন্ন মুদ্রা তথা ইউরো (বলা হয় 'ইউরো জোন') চালুর প্রস্তাব ১৯৬৯ সাল থেকে। তখন প্রস্তাবই ছিল অবশ্য। কার্যকর হয়নি।
স্মরণ রাখা জরুরি, ৫ মে ১৯৪৯ সালে কাউন্সিল অব ইউরোপ দশটি দেশ নিয়ে গঠিত। বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেন এবং যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন করে (তখন নাম ছিল ইউরোপিয়ান কমিউনিটি)। এই কমিউনিটিতে পশ্চিম জার্মানি, গ্রিস, স্পেন ও পর্তুগাল ছিল না।
আরও স্মরণীয়, প্রথম মহাযুদ্ধের এক দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরে 'লীগ অব নেশনসের কর্তা গুস্তাফ স্ট্রেসেমান ইউরোপিয়ান কমিউনিটিস' তৈরি করে ইউরোপের 'ইকোনমিক অ্যান্ড মনিটারি ইউনিয়ন' গঠন করেন। ১৯২৯ সালে ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম এবং সুইজারল্যান্ড ছিল কমিউনিটিতে। ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতা দখল করে কমিউনিটির ঝাড়বংশ উৎখাত করেন। কারণও ছিল।
বিস্তারিত ইতিহাস লিখছি না। মোদ্দা কথা, ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সালে ম্যাসট্রিক্ট সম্মেলনে ঠিক হয় অভিন্ন ইউরো মুদ্রা চালু করা হবে। যুক্তরাজ্য এবং ডেনমার্ক তীব্র আপত্তি জানিয়ে ওই সম্মেলন বয়কট করে। করলেও ইউরো মুদ্রা চালুর পক্ষেই বাকি দেশের ভোট। 'দ্য টাইম' পত্রিকার সাংবাদিক লিখছেন তখন, যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রীর বয়ান উদ্ধৃতি করে 'মাস্ট বি ডিজাস্টার', তিনিই কী ঠিক বললেন তবে? _ মনে হচ্ছে, ভাইরেসিয়াম তিনি।
ফিরে যাচ্ছি অতীতে। ইউরো মুদ্রা যেদিন চালু, রিপোর্ট করতে ফ্রাঙ্কফুর্টে। ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের চত্বরে বিশাল জাঁকজমক অনুষ্ঠানাদি। সারারাত হৈ-হুল্লোড়। হঠাৎই মনে হলো, সংসারের কেউ গোসা করলে আনন্দে সুর কাটে। যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রীকে ইন্টারভিউ করলাম : 'ইউরোর ভবিষ্যৎ কী?' উত্তর :'নিজস্ব গরিমা ব্যতিরেকে নানা প্রেমের ঢলঢলানি বেশিদিন টেকে না।'_ তার মন্তব্য হুবহু প্রচারিত করি। ডয়েচে ভেলের কর্তা এই মন্তব্য বাদ দেননি, কাটছাঁটও করেননি, কিন্তু টেলিফোনে জানান, 'লাইক হিম, য়্যু আর অলসো অ্যান্টি ইউরো।'
আজকে ভবিষ্যৎ কী ইউরোর? ইউরোপেই ইউরোর নাভিশ্বাস। ইংল্যান্ড প্রথম থেকেই ইউরোপে একক মুদ্রা ইউরোর বিরুদ্ধে ছিল, বলছে এখন 'ডিজাস্টার'। ইউরোর কারণে ইউরোপকে এক রাখা প্রশ্নবিদ্ধ। এই প্রশ্ন কেবল ইংল্যান্ডের নয়। সাধারণ মানুষেরও। জার্মানির ২৫ ভাগের বেশি মানুষ ডয়েচ মার্কের পক্ষে। ফ্রান্সের ২৭ ভাগ ফ্রাঁর পক্ষে। ইতালির ৩৯ ভাগ লিরার পক্ষে। চিত্রটা তাহলে ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে। ইউরো নিয়ে যত সমস্যা। কারণ ইউরো আর একক ইউরোপকে (ইউরোপীয় ইউনিয়নকে) ধরে রাখতে পারছে না। ইউরোপের প্রত্যেক দেশ (ইউরো জোনের ১৭ দেশ) বলছে, জাতীয় মুদ্রায় ফিরলে সমস্যার সমাধান হবে। বেশিরভাগ লোকের কথা, ইউরোর শক্তিশালী ও দুর্বল দেশের মধ্যে ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে। 'দুর্বলরা ইউরো থেকে বেরিয়ে যাক।' দুর্বলদের যুক্তি, 'শক্তিশালীরা আমাদের ঘাড়ে ইউরো চাপিয়ে অর্থনীতি (আমাদের) ধ্বংস করেছে।' ঘটনা এখন এমনই 'ইউরো নিয়ে দেশের অর্থনীতি চলতে পারে না।' বলছে সাধারণ মানুষ এবং রাজনীতিকরাও। ইউরো জোনের কয়েকটি দেশ ইউরো নিয়ে বেসামাল এখন। না পারছে গিলতে, না পারছে উগরাতে। প্যাকেজ ভর্তুকি ও ঋণ দিয়ে কতদিন চালাবে? 'ইউরো বন্ড' যদি চালু করে (প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ব্রাসেলস মিটিংয়ে), তাও সমস্যার সুরাহা হবে না। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, 'ইউরোর ভারে গরিব দেশগুলোর ত্রাহি মধুসূদন। ইউরো বাদ দিয়ে যদি আর্থিক স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় ইউরোপের জন্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য লাভবান। ইউরো মুদ্রার ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনই ভাবনা পোক্ত হওয়া জরুরি।' 'ইউরো জোনে যে আর্থিক টালমাটাল এর পেছনে মার্কিন এবং ইংল্যান্ডের গোপন মদদ স্পষ্ট'_ বলছেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ইয়র্গ সোলিংগার। তিনি বলছেন, 'আমেরিকা বরদাশত করছে না ইউরো। ছলেবলে ইউরো ধ্বংস করবেই। আজ হোক। কাল হোক। ইউরোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার।'
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১১, বার্লিন, জার্মানি
No comments