ফলোআপ : বন্দিদশায় মা ও দুই ছেলে-জমিজমার বিরোধ থেকে শুরু এখন সবাই মানসিক রোগী by জে এম রউফ

গুড়ায় এক মা ও তাঁর দুই ছেলেকে প্রায় এক যুগ বন্দিদশায় রাখার নেপথ্যে রয়েছে মাত্র চার শতক জমি নিয়ে বিরোধ। চিকিৎসকরা বলছেন, পরিবারের এই সদস্যরা বংশপরম্পরায় সিজোফ্রেনিয়া রোগের জিন বহন করে আসছিলেন। বিশেষ পারিপাশ্বর্িক অবস্থায় রোগটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা. পরিতোষ কুমার ঘোষ বলেন, ফাতেমা খাতুন, এস


এম ফজলুল করিম মানিক ও এস এম নূরুন্নবী রতন দীর্ঘদিন চলফেরা করেননি। ফলে তাঁদের হাত-পায়ের হাড়ের জোড়া শক্ত হয়ে গেছে। মানসিক চিকিৎসার পর তাঁদের থেরাপি দিয়ে শারীরিকভাবে সুস্থ করতে হবে।
ডা. পরিতোষ আরো বলেন, 'রোগীদের পর্যবেক্ষণ ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, চিন্তার সমস্যা এবং ভ্রান্ত ধারণা থেকে তাঁরা ক্রমান্বয়ে চরম পর্যায়ে পেঁৗছে গেছেন। রোগের এটি একটি ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া। তাঁদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসার মধ্যে রাখতে হবে। কারণ তাঁরা নিজেদের অসুস্থ মনে করেন না। সে কারণে ওষুধও খেতে চান না। দীর্ঘদিন একাকী থাকার কারণে তাঁরা ঘরকুণো স্বভাবের হয়ে গেছেন। ফলে অন্য কাউকে যেমন সহ্য করতে পারেন না, তেমনি কেউ তাঁদের কাছে গেলে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। সামাজিকভাবে তাঁদের সহায়তা না করা হলে এই রোগ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না।'
পরিতোষ কুমার বলেন, এখন তাঁরা যে অবস্থায় পেঁৗছেছেন তাতে মাসাধিককাল হাসপাতালে রেখে ওষুধসহ মানসিক সহায়তা দিতে হবে। তিনি জানান, ফাতেমা খাতুন সোমবার সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে গেলেও গতকাল তাঁকে আবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
গতকাল এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্ট পরিবারের আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবদুল লতিফ ও তাঁর শ্বশুর মালতিনগর চানমারি ঘাট এলাকায় আশির দশকে একই দাগে আট শতক জমি কেনেন। এরপর তোলা হয় টিনের চালা। ১৯৯৯ সালে শ্বশুর মারা গেলে নিজের চার শতক জায়গায় পাকা ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেন খাদ্য বিভাগের সাবেক অফিস সহকারী আবদুল লতিফ। কিন্তু তাঁর শাশুড়ি ও চার শ্যালিকা জমির সম্মুখভাগে বাড়ি করতে নিষেধ করেন। স্ত্রী ফাতেমা খাতুনও বোনদের পক্ষ নেন। এতে করে ক্ষিপ্ত লতিফ স্ত্রীকে মারধর করেন। সেই সময় তাঁর বড় ছেলে মানিক বগুড়া শাহ সুলতান কলেজের একাদশ শ্রেণীতে পড়তেন এবং রতন প্রি-ক্যাডেট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হয়েছিলেন। ছেলেদের সামনে মাকে নির্যাতন করায় তাঁরা ক্ষুব্ধ হলেও ভয়ে ও লজ্জায় বাবাকে কিছু বলতে পারেননি। চাপা ক্ষোভ এবং সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়ে তাঁরা বাইরের পরিবেশে মেলামেশা বন্ধ করে দেন। স্বামীর নির্যাতনে স্ত্রীও অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে কিছুদিন চিকিৎসা করানো হলেও ছেলেদের চিকিৎসার কোনো উদ্যোগই নেননি লতিফ। এ কারণে দীর্ঘদিন চিকিৎসাবঞ্চিত স্ত্রী ও দুই ছেলে স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে পড়েন বাড়িতে। অভিযুক্ত আবদুল লতিফ, তাঁর ছোট ভাই বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার মথুরাপাড়া এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী আবদুর রশিদ, লতিফের শ্যালিকা রাবেয়া বেগম এবং প্রতিবেশী বাসন্তীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
রাবেয়া বেগম লাকি অভিযোগ করেন, বোনের বিয়ের পর একই বাড়িতে দীর্ঘদিন তাঁরা থেকেছেন। সে সময় শ্বশুর-শাশুড়ি ও শ্যালিকাদের সামনেই তাঁর বোনকে মারধর করা হতো। এসব কারণে লজ্জা ও অভিমানে তাঁর বোন মানসিক ভারসাম্য হারান। তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়ে বলে তিনি দাবি করেন।
লতিফ দাবি করেন, তাঁর শ্বশুরের পরিবারের লোকজন বাড়ি নির্মাণের সময় দিয়েছিল। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে দুই পরিবারের মধ্যে আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর শ্বশুরের মৃত্যুর কিছুদিন পর হঠাৎ তাঁর স্ত্রী মনোরোগে আক্রান্ত হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, 'আমি কোনো নির্যাতন করিনি।' তাঁর ছোট ভাই আবদুর রশিদ বলেন, হয়তো পারিবারিক কারণে তাঁর ভাই স্ত্রীকে চড়-থাপ্পড় মেরে থাকতে পারেন, কিন্তু তেমন নির্যাতন করেননি। মায়ের অসুস্থতার পর ক্রমান্বয়ে তাঁর ছেলেরাও অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে তিনি উল্লেখ করেন। প্রতিবেশী বাসন্তী রানী বলেন, বাড়ির ভেতরে মাঝেমধ্যেই চিৎকার-চেঁচামেচি হতো। কিন্তু এর কারণ তাঁরা বলতে পারবেন না। কারণ ওই বাড়িতে কেউ প্রবেশ করতে পারত না।

No comments

Powered by Blogger.