আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

জ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের মর্মন্তুদ যন্ত্রণার দিন। ১৯৭১-এ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ যখন শেষ প্রান্তে, বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে যখন সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি, তখনই দেশকে মেধাশূন্য করার পূর্বপরিকল্পনা নিয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা হয়। পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ যখন অনিবার্য, তখনই এদেশীয় নরঘাতক রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা মেতে ওঠে দেশের


বুদ্ধিজীবীদের হত্যাযজ্ঞে। ১৬ ডিসেম্বর যখন বিজয়ের আনন্দে ভাসছে মুক্ত স্বদেশ, তখন সে আনন্দে বিষাদের কালো ছায়া ফেলে হঠাৎ রায়েরবাজার এবং মিরপুরে কয়েকশ' শিক্ষাবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকের পেছনে হাত বাঁধা মৃতদেহ আবিষ্কারের মর্মন্তুদ ঘটনা। গোটা জাতিসহ সারাবিশ্ব হতবিহ্বল হয়ে পড়ে এ মর্মস্পর্শী হত্যাকাণ্ডে। একে একে আবিষ্কৃত হতে থাকে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীসহ দেশের বড় বড় শহর-বন্দরে একই ধরনের হত্যাকাণ্ডের খবর।
এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হচ্ছে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। জাতির বহুল আকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধাপরাধীদের আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম চলতি বছরই শুরু হয়েছে। এর আগেই একাত্তরের ঘাতক-দালাল রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর রাজনৈতিক ভিত্তি জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত কয়েকজনকে বিচারের জন্য গ্রেফতার করে কারাবন্দি রাখা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে অন্য রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে থাকা কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীও। কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বিচার কাজও শুরু হয়েছে তাদের। এখন যুদ্ধাপরাধীদের চূড়ান্ত বিচার শেষ করার মাধ্যমে ৪০ বছর আগে জাতির ইতিহাসে লেপে দেওয়া এক কলঙ্ক মুক্তির অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে গোটা দেশের মানুষ।
আজকের দিনটিতে তাই বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত শেষ করার দাবিও জানাবে সোচ্চার কণ্ঠে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি হন্তারকদের প্রতিও জানাবে তীব্র ঘৃণা। দৃঢ়প্রত্যয়ে মানুষ নতুন দিনের শপথ নেবে, আবার যূথবদ্ধ হবে স্বজনহত্যার বিচারের দাবিতে। দেশীয় নরপশুদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশায় আবারও শুরু হবে নতুন করে পথচলা।
১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হলেও ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর থেকেই সমাজের প্রগতিশীল ব্যক্তিত্বদের আলবদর বাহিনী ঘরবাড়িতে হানা দিয়ে ধরপাকড় শুরু করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যেতে থাকে। হত্যাকাণ্ড চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাত্র দু'দিন আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে। ঘাতক চক্র কেবল ঢাকা শহরেই প্রায় দেড়শ' বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন পেশার কৃতী মানুষকে অপহরণ করে চোখ বেঁধে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে। সান্ধ্য আইনের মধ্যে রাতের আঁধারে তালিকা ধরে ধরে শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী এবং পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের হত্যা করে ফেলে রাখা হয় নিস্তব্ধ ভুতুড়ে অন্ধকারে।
পরদিন সকালে ঢাকার মিরপুরের ডোবা-নালা ও রায়েরবাজার ইটখোলায় বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায় হতভাগ্য এসব বুদ্ধিজীবীর নিথর দেহ। এ যেন বাঙালির সংস্কৃতি ও সভ্যতার এক নির্মম বধ্যভূমি। কারও শরীর বুলেটবিদ্ধ, কারও বা অমানুষিক নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত। হাত পেছনে বেঁধে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নাড়িভুঁড়িও বের করে ফেলা হয়েছিল অনেকের। স্বাধীনতা ছুঁইছুঁই উল্লসিত মানুষ স্বজন হারানোর সেই কালরাত্রির কথা জানতে পেরে শিউরে উঠেছিল। স্থবির হয়ে গিয়েছিল সবকিছু। শিশুরাষ্ট্র বাংলাদেশ হয়ে পড়েছিল মেধাশূন্য। তখনও স্বজনের রক্তের ওপর উল্লসিত নৃত্যরত এদেশীয় নরঘাতকরা।
বাঙালি জাতির দীর্ঘ স্বাধিকার সংগ্রামে এসব বুদ্ধিজীবী নিজ নিজ মেধা, মনন ও লেখনীর মাধ্যমে স্বাধীনতার সংগঠকদের প্রেরণা জুগিয়েছেন। দেখিয়েছেন মুক্তির পথ। গোটা জাতিকেও উদ্দীপ্ত করেছেন স্বাধিকারের সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতার পথে যেতে।
সেই প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক ভূমিকাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের জন্য। স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম কিছুতেই সহ্য হচ্ছিল না স্বাধীনতাবিরোধী এদেশীয় ঘাতকচক্রের। তাই ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য হত্যাযজ্ঞের গোপন ফন্দি আঁটে নরঘাতকের দল।
হানাদারদের হত্যার তালিকায় উঠে আসে অসংখ্য বুদ্ধিদীপ্ত সাহসী মানুষের নাম। পরে কৃতী এসব বুদ্ধিজীবীর তালিকাই তুলে দেওয়া হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র ক্যাডার গ্রুপ কুখ্যাত আলবদর ও আলশামস বাহিনীর হাতে। নেপথ্যে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলী। মূলত ১০ ডিসেম্বর রাত থেকে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি ও বেয়নেটে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা শুরু হয়। আর এ নীলনকশারই চূড়ান্ত বাস্তবায়ন ঘটে ১৪ ডিসেম্বর।
একাত্তরের ডিসেম্বরে হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা এখনও নিরূপণ করা যায়নি। তবে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাপিডিয়ায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে সংখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে, সে অনুযায়ী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ শিক্ষাবিদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিৎসক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিক-প্রকৌশলী। তাদের মধ্যে রয়েছেন ড. জিসি দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মনীরুজ্জামান, অধ্যাপক আনওয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, রাশেদুল হাসান, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজুদ্দিন হোসেন, নিজামুদ্দিন আহমদ, লাডু ভাই, খন্দকার আবু তালেব, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, ডা. যোগেশ চন্দ্র সাহা, নতুন চন্দ্র সিংহ, আরপি সাহা, আবুল খায়ের, সিরাজুল হক খান, আবুল বাশার, ড. মুক্তাদির, ফয়জুল মাহি, ড. সাদেক, ড. আমিনুদ্দিন, সায়ীদুল হাসান, হবিবুর রহমান, কবি মেহেরুন্নেসা, সেলিনা পারভীনসহ আরও অনেকে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী
দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সরকারি-বেসরকারি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন।
বাণীতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন তারা। বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের শোকাবহ দিনে শোককে শক্তিতে পরিণত করে সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সবার প্রতি আহ্বান জানান তারা।
রাষ্ট্রপতি বাণীতে বলেন, বুদ্ধিজীবীরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। জাতি হিসেবে আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কাছে কৃতজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, ১৯৭১ সালের এ দিনে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসররা পরিকল্পিতভাবে দেশকে মেধা ও নেতৃত্বশূন্য করতে শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। তাদের আত্মত্যাগ জাতি কখনোই ভুলবে না।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রায়েরবাজারের বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে শুরু হবে দিবসটির কর্মসূচি। এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া, জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট, মন্ত্রিসভার সদস্য ও সংসদ সদস্যরা। তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য স্মৃতিসৌধ উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। শোকের দিন হিসেবে সব সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোয় কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের স্মরণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। সংবাদপত্রগুলোয় প্রকাশিত হয়েছে বিশেষ নিবন্ধ। টেলিভিশন ও রেডিওতে প্রচার করা হবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।
দিবসটি উপলক্ষে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্থা নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ও বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, আলোচনা সভা, শোক র‌্যালি এবং মিলাদ মাহফিল।
বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমীসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে আলোচনা সভার আয়োজন করবে। স্যাটেলাইট টিভি 'চ্যানেল আই' ও মোবাইল অপারেটর 'রবি'র উদ্যোগে আজ থেকে শুরু হচ্ছে বিজয়মেলা। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে এ মেলা।

No comments

Powered by Blogger.