শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস-শহীদের মিছিল ও ইতিহাসের ক্ষতচিহ্ন by হারুন হাবীব
জাতীয় ইতিহাসের অমোচনীয় অনেক ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৪০তম বার্ষিকী উদ্যাপন করছে এই ডিসেম্বরে। আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধা কিংবা যাঁরা একাত্তরের মানুষ, যাঁরা পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও তাদের বঙ্গীয় দোসরদের তাণ্ডব ও নৃশংসতা ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যক্ষ করেছি, তাঁদের জন্য এ ক্ষতচিহ্ন অনেক বেশি কষ্টের, যন্ত্রণার। এর মূল কারণ, আমরা যে ৩০ লাখ শহীদের প্রতি গেল ৪০ বছর সম্মান প্রদর্শন করেছি, যাঁদের বেদিতে ফুল
দিয়েছি, শ্রদ্ধা জানিয়েছি, গত ৪০ বছরেও সেই ঘাতক-অমানুষদের বিচারের হাতে সোপর্দ করা সম্ভব হয়নি। এ ব্যর্থতা জাতি হিসেবে আমাদের সম্মানিত করেনি। হৃদয়-ছেঁড়া কষ্ট ও যন্ত্রণা আরো বহুলাংশে বেড়ে যায় যখন দেখি, এ দেশেরই কিছু রাজনৈতিক দল রাজনীতির নামে মানবতাবিরোধী এসব ঘৃণ্য অপরাধীদের চলতি বিচারকে বিতর্কিত কিংবা ভণ্ডুল করতে মাঠে নামে!
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দেশীয় অনুচরদের তাড়া করে একের পর এক গঞ্জ ও শহর মুক্ত করতে থাকে। যে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা ৯টি মাস গোটা দেশে নির্বিচার গণহত্যা-নারী ধর্ষণ ও লুণ্ঠন-রাহাজানি চালিয়েছে, তারা দিশেহারা হয়ে ঢাকায় জড়ো হয়ে পরাজয়ের দিন গুনতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষদিকে আহত হওয়ার কারণে আমি ঢাকার (সেদিনকার) রেসকোর্স ময়দানে পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্যদের ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ দেখার সুযোগ পাইনি। ব্যক্তিজীবনে এ আমার এক বড় আক্ষেপ। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে যৌথ বাহিনীর কাছে পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি তাঁর ৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। সেদিন থেকেই ঐতিহাসিক এ বিজয় দিবসের যাত্রা, যা অনাদিকাল ধরে চলবে। কিন্তু জাতীয় বিজয়ের সেই মহা-আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছিল ১৬ ডিসেম্বরের আগে কয়েকটি দিনে নিষ্ঠুর বুদ্ধিজীবী হত্যায়। পরাজয় নিশ্চিত জেনে, পাকিস্তানি সেনানায়কদের সঙ্গে পরামর্শ করে, ভয়ংকর এ হত্যাযজ্ঞের নীলনকশা তৈরি করেছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধী আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর মূল কুশীলবরা। জাতির মেধা ও মননকে ধ্বংস করার এই নীলনকশার বলি হয়েছিলেন সেদিন শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা_দার্শনিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কবি, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ বুদ্ধিবৃত্তির শ্রেষ্ঠ মানুষ। ভয়াবহ এই হত্যাযজ্ঞের হৃদয়বিদারক বর্ণনা সঙ্গে সঙ্গে জানা যায়নি। জানা গেছে, ১৬ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর। দুমড়ানো-মোচড়ানো, ক্ষত-বিক্ষত শত শত লাশ পাওয়া গেছে রায়েরবাজার, মিরপুরসহ ঢাকার নানা বধ্যভূমিতে। দেশি-বিদেশি নানা অনুসন্ধানে জানা গেছে, একমাত্র ঢাকা শহরেই ১৪ ডিসেম্বর প্রায় ২০০ বুদ্ধিজীবীকে পাকিস্তানিদের সহযোগীরা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই ঘৃণিত অপরাধীদের বিচার আজও সম্ভব হয়নি, ৪০ বছরেও নয়! আমরা প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালন করি, কিন্তু আমাদের নমস্য ব্যক্তিদের হত্যাকারীদের আইনের হাতে সোপর্দ করতে ব্যর্থ হয়েছি। বরং নানা রাজনৈতিক পালাবর্তে সেই হত্যাকারীদের অনেকেই সামরিক ও আধাসামরিক শাসকদের ছত্রচ্ছায়ায় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে। এদেরই অনেককেই আবার জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া মন্ত্রিসভার সদস্য পর্যন্ত করেছিলেন!
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে গোটা দেশ ছিল এক বিরাট বধ্যভূমি। গোটা পৃথিবীতেই নির্বিচার সে গণহত্যা ও নারী ধর্ষণের বিবরণ আছে। রবার্ট পাইন তাঁর 'ম্যাসাকার' গ্রন্থে লিখেছেন, ফেব্রুয়ারি মাসের এক সেনা-বৈঠকে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেন প্রেসিডেন্ট জে. ইয়াহিয়া খান, 'ওদের তিন মিলিয়নকে খতম করে দাও, দেখবে বাদবাকিরা আমাদের হাত থেকেই খাবার নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে।' পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যা শুরু হয় ২৫ মার্চ, ১৯৭১। রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে অভিযান চালানো হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ইপিআরের সদর দপ্তর পিলখানায়। এরপর ঘাতক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যা ছিল দেশের পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের মূল উৎস। প্রথম রাতেই হত্যা করা হয় সাত হাজার নিরীহ ছাত্র-জনতাকে। রবার্ট পাইনের বহুলালোচিত 'ম্যাসাকার' গ্রন্থে বলা হয় : 'কিন্তু এটা ছিল কেবলই শুরু। এক সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকার অর্ধেক মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়, এবং কমপক্ষে কেবল ঢাকায়ই ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রামেরও অধিকাংশ মানুষ পালিয়ে যায়। বলতে গেলে গোটা পূর্ব পাকিস্তানেই মানুষ পালাতে থাকে প্রাণভয়ে।'
নিরস্ত্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যুদ্ধটি অগ্রসর হয় মূলত লিঙ্গভিত্তিক গণহত্যার রূপ নিয়ে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ভাষ্যমতে, 'এই গণহত্যার মূল টার্গেট ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্য, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ, বাঙালি প্যারা-মিলিটারি আনসার এবং মুজাহিদ, হিন্দু, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থক, ছাত্র, বিশেষত যারা প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিতে পারে। এরপর বাঙালি বুদ্ধিজীবী, যেমন অধ্যাপক, শিক্ষক।' গবেষক আর জে রুমেল তাঁর 'ডেথ বাই গভর্নমেন্ট' বইয়ে লেখেন, 'পাকিস্তানি সৈন্যরা বেছে বেছে তরুণদের তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এসব ছেলের দেহ কখনো পাওয়া যেত মাঠে, নদীর স্রোতে অথবা কোনো আর্মি ক্যাম্পের পাশে।' নাৎসিরা যেভাবে ইহুদি পুরুষদের বর্বরভাবে হত্যা করেছে, সেই রীতির পুনরাবৃত্তির কথা উল্লেখ করেছেন রুমেল। তাঁর ভাষায়, 'গোটা প্রদেশে যেভাবে গণহত্যা চলেছিল, তাতে হিন্দুদের দেখামাত্র গুলি করা হতো। অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম পার্থক্য নির্ণয় করতে সৈন্যরা কাপড় খুলে তাদের লিঙ্গ পরীক্ষা করত। যদি লিঙ্গ 'মুসলমানি' করানো থাকত, তাহলে হয়তো বাঁচা গেলেও বাঁচা যেত। তা না হলেই অনিবার্য মৃত্যু।'
আজ সবই ইতিহাস, কিন্তু এটিই সত্য যে ঢাকার চারদিক ঘিরে মৃত্যু-উপত্যকা সৃষ্টি করা হয়েছিল। রবার্ট পাইনের ভাষায় : 'শুধু হত্যার পদ্ধতি নয়, মৃত্যুর পর এসব হতভাগ্য মানুষের লাশও গুম করা হতো, নদীতে ফেলে দেওয়া হতো।' বিদেশি সাংবাদিকদের বর্ণনা অনুযায়ী এসব মানুষের বেশির ভাগকেই একসঙ্গে দড়িতে বেঁধে গুলি করে বা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নদীতে ফেলা হতো। ঠিক একই ধরনের গণহত্যার নারকীয় পদ্ধতি জানা যায় আর্মেনিয়া এবং ১৯৩৭ সালের নানজিং গণহত্যার বিবরণে। ১৯৭১ সালে সংঘটিত নারকীয় ঘটনাবলিতে দেখা যায়, বাঙালি মেয়েদের ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার করা হয়েছে যত্রতত্র, চালানো হয়েছে অবর্ণনীয় পাশবিক এবং দলগত ধর্ষণ-পীড়ন। শুধু ধর্ষণ নয়, তাদের বহুসংখ্যককেই হত্যা করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি বেশি করে পশ্চিমা দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে পরিকল্পিত এসব হত্যাকাণ্ড এবং বাঙালি নারীদের ওপর গণহারে ধর্ষণের ঘটনাবলি প্রকাশ হয়ে পড়ার পর থেকেই। বহুলালোচিত গ্রন্থ 'অ্যাগেইনস্ট আওয়ার উইল : মেন-উইমেন অ্যান্ড রেপ'-এ সুজান ব্রাউন মিলার বাংলাদেশের নারী নির্যাতনের সঙ্গে জাপানি সৈন্যদের দ্বারা নানজিং ও জার্মানদের হাতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় রাশিয়ায় সংঘটিত ঘটনাবলির তুলনা করেছেন। তাঁর ভাষ্য, 'সর্বমোট চার লাখের মতো নারী পাকিস্তানিদের হাতে মুুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ধর্ষিত হয়েছে। কেবল তাদের ধর্ষণই করা হয়নি, হাজার হাজার মেয়েকে ওরা অপহরণ করেছে এবং জোর করে তাদের সেনাছাউনিতে নিয়ে গেছে। ্বলার অপেক্ষা রাখে না, মুুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দেশীয় অনুচরদের হাতে এই হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্ব ইতিহাসের ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ ও নারী নিপীড়ন।' রুয়ান্ডায় আট লাখ মানুষ মারা গেছে, ১৯৬৫-৬৯ সালে ইন্দোনেশিয়ায় মারা গেছে প্রায় ১৫ লাখ। কিন্তু বাংলাদেশে তার চেয়ে অনেক বেশি।
টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক ডেন কগিন, যাঁকে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ দেশ থেকে বহিষ্কার করার পরও তিনি ভারত হয়ে আবারও প্রবেশ করেছিলেন, একজন পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনের বরাত দিয়ে লিখেছেন : 'আমরা যে কাউকে হত্যা করার অধিকার রাখি। এর জন্য কোনো জবাবদিহিতার প্রয়োজন নেই।' মুক্তিযুদ্ধের পর এসব অপরাধীর বিচার শুরু করা হলেও পরিপূর্ণ হয়নি। ১৯৭৫-এর রক্তপাত সব কিছু ম্লান করেছে। ৭৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ডসহ নানা মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, ১১ হাজার বিচারাধীন ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর সবাইকেই জেনারেল জিয়ার প্রশাসন মুক্ত করেছে। এমনকি বিচার হয়নি ১৯৫ জন পাকিস্তানি জেনারেল, সেনা কর্মকর্তার। এসব যুদ্ধাপরাধী তাদের দেশে ফিরে গেছে। কোনো আঁচড় লাগেনি পকিস্তানি বাহিনীর কোনো দেশীয় ঘাতকের গায়ে এবং ইতিহাসের এ ন্যায্য দাবি পূরণের ব্যর্থতায় দ্রুত পাল্টে দিতে সহায়তা করেছে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়কে। কাজেই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের বিচার ইতিহাসের অমোঘ দাবি। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিরোধী দল সরকারের সমালোচনা করবে, বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতিচর্চার আবরণে যখন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মতো ভিত্তিসূচক ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে আঘাতের চেষ্টা করা হয়, তখন কোনো বিবেকবান চুপ থাকতে পারেন না।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সম্প্রতি প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেছে। এ দলটি মুক্তিযুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপরাধকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করলেও সম্প্রতি তাদের সে সমর্থন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে এবং তারা যুদ্ধাপরাধের বিচারকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বসেছে। দলটি, তাদের ভাষায়, অবিলম্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বন্ধ করারও দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে তারা সব রীতিনীতি ও জাতীয় সম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই বিচার বন্ধ করার লক্ষ্যে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিরও আহ্বান জানিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দলটির এ অবস্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পূর্ণ প্রতারণামূলক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ। দেশপ্রেমিক নাগরিক ও নবীন প্রজন্মকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ, তার ইতিহাস ও চেতনাবিরোধী এসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে অবশ্যই সোচ্চার ভূমিকা রাখতে হবে। এখন বিচার সম্পন্ন করতে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে।
স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার নিজস্ব আইনে জাতির মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা, নির্বিচার নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অপহরণ ও অগি্নসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার অধিকার রাখে। ১৯৭৩ সালের যে আইন প্রয়োগ করে এ বিচারকাজ সম্পাদিত হচ্ছে, সে আইনটি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে পাসকৃত একটি বৈধ আইন। যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আইনে গঠিত একটি দেশীয় ট্রাইব্যুনাল। এর আওতায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপরাধগুলোরই বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কাজেই দেশের পবিত্র সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত এ বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ, চার লাখ মা-বোনের ইজ্জত এবং জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। এটিও সবার জানা যে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন এবং এর অধীনে গৃহীত বিধিমালায় অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের এমন সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা যুদ্ধাপরাধ বিচারে পৃথিবীর অন্য কোনো ট্রাইব্যুনালে দেওয়া হয়নি। আমরা আরো জানি যে ন্যুরেমবার্গ, টোকিও, রুয়ান্ডা, সিয়েরা লিওন, কম্বোডিয়াসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে যেসব ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধের বিচার এযাবৎ সম্পাদন করেছে, সেখানে কোথাও দণ্ডপ্রাপ্তদের আপিলের সুযোগ রাখা হয়নি, যা বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালে রাখা হয়েছে। অতএব এ বিচারপ্রক্রিয়াকে ভণ্ডুল বা বিতর্কিত করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দেশীয় অনুচরদের তাড়া করে একের পর এক গঞ্জ ও শহর মুক্ত করতে থাকে। যে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা ৯টি মাস গোটা দেশে নির্বিচার গণহত্যা-নারী ধর্ষণ ও লুণ্ঠন-রাহাজানি চালিয়েছে, তারা দিশেহারা হয়ে ঢাকায় জড়ো হয়ে পরাজয়ের দিন গুনতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষদিকে আহত হওয়ার কারণে আমি ঢাকার (সেদিনকার) রেসকোর্স ময়দানে পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্যদের ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ দেখার সুযোগ পাইনি। ব্যক্তিজীবনে এ আমার এক বড় আক্ষেপ। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে যৌথ বাহিনীর কাছে পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি তাঁর ৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। সেদিন থেকেই ঐতিহাসিক এ বিজয় দিবসের যাত্রা, যা অনাদিকাল ধরে চলবে। কিন্তু জাতীয় বিজয়ের সেই মহা-আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছিল ১৬ ডিসেম্বরের আগে কয়েকটি দিনে নিষ্ঠুর বুদ্ধিজীবী হত্যায়। পরাজয় নিশ্চিত জেনে, পাকিস্তানি সেনানায়কদের সঙ্গে পরামর্শ করে, ভয়ংকর এ হত্যাযজ্ঞের নীলনকশা তৈরি করেছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধী আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর মূল কুশীলবরা। জাতির মেধা ও মননকে ধ্বংস করার এই নীলনকশার বলি হয়েছিলেন সেদিন শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা_দার্শনিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কবি, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ বুদ্ধিবৃত্তির শ্রেষ্ঠ মানুষ। ভয়াবহ এই হত্যাযজ্ঞের হৃদয়বিদারক বর্ণনা সঙ্গে সঙ্গে জানা যায়নি। জানা গেছে, ১৬ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর। দুমড়ানো-মোচড়ানো, ক্ষত-বিক্ষত শত শত লাশ পাওয়া গেছে রায়েরবাজার, মিরপুরসহ ঢাকার নানা বধ্যভূমিতে। দেশি-বিদেশি নানা অনুসন্ধানে জানা গেছে, একমাত্র ঢাকা শহরেই ১৪ ডিসেম্বর প্রায় ২০০ বুদ্ধিজীবীকে পাকিস্তানিদের সহযোগীরা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই ঘৃণিত অপরাধীদের বিচার আজও সম্ভব হয়নি, ৪০ বছরেও নয়! আমরা প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালন করি, কিন্তু আমাদের নমস্য ব্যক্তিদের হত্যাকারীদের আইনের হাতে সোপর্দ করতে ব্যর্থ হয়েছি। বরং নানা রাজনৈতিক পালাবর্তে সেই হত্যাকারীদের অনেকেই সামরিক ও আধাসামরিক শাসকদের ছত্রচ্ছায়ায় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে। এদেরই অনেককেই আবার জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া মন্ত্রিসভার সদস্য পর্যন্ত করেছিলেন!
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে গোটা দেশ ছিল এক বিরাট বধ্যভূমি। গোটা পৃথিবীতেই নির্বিচার সে গণহত্যা ও নারী ধর্ষণের বিবরণ আছে। রবার্ট পাইন তাঁর 'ম্যাসাকার' গ্রন্থে লিখেছেন, ফেব্রুয়ারি মাসের এক সেনা-বৈঠকে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেন প্রেসিডেন্ট জে. ইয়াহিয়া খান, 'ওদের তিন মিলিয়নকে খতম করে দাও, দেখবে বাদবাকিরা আমাদের হাত থেকেই খাবার নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে।' পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যা শুরু হয় ২৫ মার্চ, ১৯৭১। রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে অভিযান চালানো হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ইপিআরের সদর দপ্তর পিলখানায়। এরপর ঘাতক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যা ছিল দেশের পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের মূল উৎস। প্রথম রাতেই হত্যা করা হয় সাত হাজার নিরীহ ছাত্র-জনতাকে। রবার্ট পাইনের বহুলালোচিত 'ম্যাসাকার' গ্রন্থে বলা হয় : 'কিন্তু এটা ছিল কেবলই শুরু। এক সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকার অর্ধেক মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়, এবং কমপক্ষে কেবল ঢাকায়ই ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রামেরও অধিকাংশ মানুষ পালিয়ে যায়। বলতে গেলে গোটা পূর্ব পাকিস্তানেই মানুষ পালাতে থাকে প্রাণভয়ে।'
নিরস্ত্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যুদ্ধটি অগ্রসর হয় মূলত লিঙ্গভিত্তিক গণহত্যার রূপ নিয়ে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ভাষ্যমতে, 'এই গণহত্যার মূল টার্গেট ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্য, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ, বাঙালি প্যারা-মিলিটারি আনসার এবং মুজাহিদ, হিন্দু, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থক, ছাত্র, বিশেষত যারা প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিতে পারে। এরপর বাঙালি বুদ্ধিজীবী, যেমন অধ্যাপক, শিক্ষক।' গবেষক আর জে রুমেল তাঁর 'ডেথ বাই গভর্নমেন্ট' বইয়ে লেখেন, 'পাকিস্তানি সৈন্যরা বেছে বেছে তরুণদের তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এসব ছেলের দেহ কখনো পাওয়া যেত মাঠে, নদীর স্রোতে অথবা কোনো আর্মি ক্যাম্পের পাশে।' নাৎসিরা যেভাবে ইহুদি পুরুষদের বর্বরভাবে হত্যা করেছে, সেই রীতির পুনরাবৃত্তির কথা উল্লেখ করেছেন রুমেল। তাঁর ভাষায়, 'গোটা প্রদেশে যেভাবে গণহত্যা চলেছিল, তাতে হিন্দুদের দেখামাত্র গুলি করা হতো। অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম পার্থক্য নির্ণয় করতে সৈন্যরা কাপড় খুলে তাদের লিঙ্গ পরীক্ষা করত। যদি লিঙ্গ 'মুসলমানি' করানো থাকত, তাহলে হয়তো বাঁচা গেলেও বাঁচা যেত। তা না হলেই অনিবার্য মৃত্যু।'
আজ সবই ইতিহাস, কিন্তু এটিই সত্য যে ঢাকার চারদিক ঘিরে মৃত্যু-উপত্যকা সৃষ্টি করা হয়েছিল। রবার্ট পাইনের ভাষায় : 'শুধু হত্যার পদ্ধতি নয়, মৃত্যুর পর এসব হতভাগ্য মানুষের লাশও গুম করা হতো, নদীতে ফেলে দেওয়া হতো।' বিদেশি সাংবাদিকদের বর্ণনা অনুযায়ী এসব মানুষের বেশির ভাগকেই একসঙ্গে দড়িতে বেঁধে গুলি করে বা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নদীতে ফেলা হতো। ঠিক একই ধরনের গণহত্যার নারকীয় পদ্ধতি জানা যায় আর্মেনিয়া এবং ১৯৩৭ সালের নানজিং গণহত্যার বিবরণে। ১৯৭১ সালে সংঘটিত নারকীয় ঘটনাবলিতে দেখা যায়, বাঙালি মেয়েদের ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার করা হয়েছে যত্রতত্র, চালানো হয়েছে অবর্ণনীয় পাশবিক এবং দলগত ধর্ষণ-পীড়ন। শুধু ধর্ষণ নয়, তাদের বহুসংখ্যককেই হত্যা করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি বেশি করে পশ্চিমা দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে পরিকল্পিত এসব হত্যাকাণ্ড এবং বাঙালি নারীদের ওপর গণহারে ধর্ষণের ঘটনাবলি প্রকাশ হয়ে পড়ার পর থেকেই। বহুলালোচিত গ্রন্থ 'অ্যাগেইনস্ট আওয়ার উইল : মেন-উইমেন অ্যান্ড রেপ'-এ সুজান ব্রাউন মিলার বাংলাদেশের নারী নির্যাতনের সঙ্গে জাপানি সৈন্যদের দ্বারা নানজিং ও জার্মানদের হাতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় রাশিয়ায় সংঘটিত ঘটনাবলির তুলনা করেছেন। তাঁর ভাষ্য, 'সর্বমোট চার লাখের মতো নারী পাকিস্তানিদের হাতে মুুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ধর্ষিত হয়েছে। কেবল তাদের ধর্ষণই করা হয়নি, হাজার হাজার মেয়েকে ওরা অপহরণ করেছে এবং জোর করে তাদের সেনাছাউনিতে নিয়ে গেছে। ্বলার অপেক্ষা রাখে না, মুুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দেশীয় অনুচরদের হাতে এই হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্ব ইতিহাসের ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ ও নারী নিপীড়ন।' রুয়ান্ডায় আট লাখ মানুষ মারা গেছে, ১৯৬৫-৬৯ সালে ইন্দোনেশিয়ায় মারা গেছে প্রায় ১৫ লাখ। কিন্তু বাংলাদেশে তার চেয়ে অনেক বেশি।
টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক ডেন কগিন, যাঁকে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ দেশ থেকে বহিষ্কার করার পরও তিনি ভারত হয়ে আবারও প্রবেশ করেছিলেন, একজন পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনের বরাত দিয়ে লিখেছেন : 'আমরা যে কাউকে হত্যা করার অধিকার রাখি। এর জন্য কোনো জবাবদিহিতার প্রয়োজন নেই।' মুক্তিযুদ্ধের পর এসব অপরাধীর বিচার শুরু করা হলেও পরিপূর্ণ হয়নি। ১৯৭৫-এর রক্তপাত সব কিছু ম্লান করেছে। ৭৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ডসহ নানা মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, ১১ হাজার বিচারাধীন ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর সবাইকেই জেনারেল জিয়ার প্রশাসন মুক্ত করেছে। এমনকি বিচার হয়নি ১৯৫ জন পাকিস্তানি জেনারেল, সেনা কর্মকর্তার। এসব যুদ্ধাপরাধী তাদের দেশে ফিরে গেছে। কোনো আঁচড় লাগেনি পকিস্তানি বাহিনীর কোনো দেশীয় ঘাতকের গায়ে এবং ইতিহাসের এ ন্যায্য দাবি পূরণের ব্যর্থতায় দ্রুত পাল্টে দিতে সহায়তা করেছে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়কে। কাজেই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের বিচার ইতিহাসের অমোঘ দাবি। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিরোধী দল সরকারের সমালোচনা করবে, বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতিচর্চার আবরণে যখন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মতো ভিত্তিসূচক ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে আঘাতের চেষ্টা করা হয়, তখন কোনো বিবেকবান চুপ থাকতে পারেন না।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সম্প্রতি প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেছে। এ দলটি মুক্তিযুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপরাধকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করলেও সম্প্রতি তাদের সে সমর্থন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে এবং তারা যুদ্ধাপরাধের বিচারকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বসেছে। দলটি, তাদের ভাষায়, অবিলম্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বন্ধ করারও দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে তারা সব রীতিনীতি ও জাতীয় সম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই বিচার বন্ধ করার লক্ষ্যে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিরও আহ্বান জানিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দলটির এ অবস্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পূর্ণ প্রতারণামূলক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ। দেশপ্রেমিক নাগরিক ও নবীন প্রজন্মকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ, তার ইতিহাস ও চেতনাবিরোধী এসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে অবশ্যই সোচ্চার ভূমিকা রাখতে হবে। এখন বিচার সম্পন্ন করতে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে।
স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার নিজস্ব আইনে জাতির মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা, নির্বিচার নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অপহরণ ও অগি্নসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার অধিকার রাখে। ১৯৭৩ সালের যে আইন প্রয়োগ করে এ বিচারকাজ সম্পাদিত হচ্ছে, সে আইনটি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে পাসকৃত একটি বৈধ আইন। যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আইনে গঠিত একটি দেশীয় ট্রাইব্যুনাল। এর আওতায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপরাধগুলোরই বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কাজেই দেশের পবিত্র সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত এ বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ, চার লাখ মা-বোনের ইজ্জত এবং জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। এটিও সবার জানা যে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন এবং এর অধীনে গৃহীত বিধিমালায় অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের এমন সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা যুদ্ধাপরাধ বিচারে পৃথিবীর অন্য কোনো ট্রাইব্যুনালে দেওয়া হয়নি। আমরা আরো জানি যে ন্যুরেমবার্গ, টোকিও, রুয়ান্ডা, সিয়েরা লিওন, কম্বোডিয়াসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে যেসব ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধের বিচার এযাবৎ সম্পাদন করেছে, সেখানে কোথাও দণ্ডপ্রাপ্তদের আপিলের সুযোগ রাখা হয়নি, যা বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালে রাখা হয়েছে। অতএব এ বিচারপ্রক্রিয়াকে ভণ্ডুল বা বিতর্কিত করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments