আলোর মানুষের বাধা পেরোনোর গল্প

মাজে প্রতিষ্ঠিত, আলোকিত মানুষদের গড়ে ওঠার নেপথ্যে থাকে অনেক বাধা পেরোনো গল্প। যে যত বেশি বাধা পেরোতে পারে তার গন্তব্য হয় তত বেশি দূরবর্তী। 'কোনো বাধা মানবো না'_ প্রত্যয়ে আয়োজিত সুহৃদ সমাবেশের মহাসমাবেশ ২০১১-এর গুরুত্বপূর্ণ এক পর্ব ছিল আলোকিত মানুষদের বাধা পেরোনোর গল্প। সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের সঞ্চালনায় দেশের ৯ বিশিষ্ট ব্যক্তি বলেন নিজের জীবনে পেরিয়ে আসা বাধার গল্প।


মহাসমাবেশের এই পর্বের সংক্ষিপ্তসার পত্রস্থ হলো... রাশেদা কে চৌধুরী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে এমন একটি অনুষ্ঠানের আয়োজনের জন্য আমি সমকাল-সুহৃদ সমাবেশকে ধন্যবাদ দিই। আমাদের অনেক ব্যর্থতা। আমরা বাধা পেরোতে পেরোতেই যেন পিছিয়ে যাচ্ছি। বইয়ের ভারে আমরা হাঁপিয়ে উঠেছি। স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি, দেখাতেও ভুলে গেছি। সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিনিয়ত মানুষকে বাধা পেরোনোর সংগ্রামে লিপ্ত হতে হচ্ছে। এ সংগ্রামে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার বাধাটাকেই আমি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই। বিভিন্ন কাজে সমাজের আর দশটা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি বাধাগ্রস্ত হয় নারীরা। আমার কলেজ জীবনে সরস্বতী পূজার অনুষ্ঠানে এক নাটকে সরস্বতী চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। এ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় কানাঘুষা চলছিল বেশ জোরেশোরেই। এক লোক আমার বাবার কাছে বলেই ফেললেন, 'এ মেয়ের তো বিয়েই হবে না!' আমার বাবা তখন সেই লোককে প্রশ্ন করেছিলেন, 'যে ছেলেটি কালীদাস চরিত্রে অভিনয় করেছিল তার বিয়ে হবে তো?' লোকটি বাবার কথার কোনো উত্তর দিতে পারেননি সেদিন। আমার আজকের অবস্থানে আসতে অনেক নারীর পাশাপাশি বিভিন্ন পুরুষের অবদানও আছে। কিন্তু এ বিষয়টা সমাজের সব স্তরে সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে শিক্ষাটা পরিবার থেকেই আসতে হবে। পরিবারই বড় বিশ্ববিদ্যালয়। পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও পরিবর্তন করতে হবে। বাবার সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত হয়নি আজও। সেই জায়গায়ও দৃষ্টি দিতে হবে। জমির জন্য নারীদের সন্ত্রাসের শিকার হতে হচ্ছে। এ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে।

এ. কে. আজাদ
সভাপতি, এফবিসিসিআই ও প্রকাশক সমকাল
ছাত্রজীবনে আমি ছিলাম বামপন্থি রাজনীতির অনুসারী। শোষণহীন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতাম। দেখতাম এমন একটি সমাজের স্বপ্ন যেখানে মানুষ অনাহারে থাকবে না, সবার সমান অধিকার থাকবে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। রাজনীতির কারণে ১৯৮৩ সালের ১৪ আগস্ট গ্রেফতার হয়ে জেলে যাই। শারীরিকভাবে নির্যাতিত হই। অন্ধকার কারাগারে সঙ্গী হয় দুটি কম্বল। আর বাইরে তখন আমার রাজনৈতিক নেতারা এরশাদ সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন। তারা খোঁজও নিচ্ছেন না আমরা কর্মীরা কে কেমন আছি! আমার মোহভঙ্গ হতে শুরু হলো। বুঝলাম, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। জেল থেকে বেরিয়ে আর ডানে-বামে তাকালাম না। কয়েক বন্ধু মিলে শুরু করলাম গার্মেন্ট ব্যবসা। তখন ১৯৮৪ সাল। কোটা ব্যবস্থা উঠে যাওয়ায় তিন মাসের মধ্যে ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। ৭০০ ফ্যাক্টরির মধ্যে ৫০-৬০টির ব্যবসা তখনও ছিল। আমরা বাকিরা একজোট হলাম এবং ১৯৮৫ সালে গার্মেন্টভিত্তিক নির্বাচনে জয়লাভ করলাম। এর পরপর ইউরোপের পাঁচটি দেশ ভ্রমণের সুযোগ পাই। তারপর আর আমাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আস্তে আস্তে ব্যবসা সম্প্রসারণ করি। তবে শুরু থেকেই আমি ভেবেছি জীবনে অর্থবিত্তের খুব বেশি প্রয়োজন নেই। মৌলিক চাহিদা অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি নিশ্চিত হলে আর খুব বেশি চাওয়ার থাকে না আমার। তাই সময় সামনের দিকে যাচ্ছিল_ আমিও ছুটে চলছিলাম আরও সামনের দিকে। পেছনে ফিরে দেখি আমি আমার অতীত সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাস থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। যদিও আমার সেই বামপন্থি বন্ধুদের অনেকের সঙ্গেই আমার এখনও ভালো সম্পর্ক। তাদের পাশে মাঝে মাঝে দাঁড়াতে আমার ভালো লাগে। তাদের আমি আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু বুঝে গেছি, আমার পক্ষে আর জীবনত্যাগী বামপন্থী হওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য আমার অন্য কোনো উপায় অবলম্বন প্রয়োজন ছিল। আর সমাজের প্রান্তিক মানুষের হয়ে আমার কথা বলা এই অবলম্বনের নাম দৈনিক সমকাল। সমকাল আমার ব্যবসায়িক কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। এটি ব্যক্তিগতভাবে আমার সামাজিক অঙ্গীকার।

আফজাল হোসেন
অভিনেতা ও নির্মাতা
বাধা থাকলেই তো বুঝতে পারব আমরা মানুষ। আর সে বাধাকে পেরিয়ে আসাই মানুষের অভিজ্ঞতা। কিছুদিন আগে বিদেশি একটি বিমানবন্দরে নামাজের ঘরে নামাজ পড়ে বের হচ্ছি। এক শ্মশ্রুধারী আমার হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললেন, 'খুশি হলাম যে আপনি নামাজ পড়ছেন।' তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, আমি যেহেতু অভিনয় করি তাই লম্পট। নামাজের ধারেকাছে আমি কেন যাবো? শিল্পীদের সম্পর্কে এ চিন্তা কি আমাদের জন্য বাধা নয়? যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি, বড়রা নাটকের রিহার্সেল করছেন। উঁকি দিতেই আমাদের বের করে দিলেন। তখন আমরা সবাই স্থির করলাম আমরাই একটি নাটক করব। তবে সেটা সহজ ছিল না। কারণ আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। পরে ঘরে রাখা গ্রামোফোন রেকর্ড বাজিয়ে বাঁশঝাড়ে সংলাপ মুখস্থ করে নাটকটি করেছিলাম। বেশ ভালো হয়েছিল। পরে বড়রা আমাদের নাটক করার জন্য ডেকে নিয়েছিলেন। যারা এক দিন বের করে দিয়েছিলেন তারাও নাটক দেখেছিলেন। আসলে কোনো বাধাই বাধা নয়। তা অতিক্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে।
[২৪ পৃষ্ঠার পর]

সৈয়দ আলমগীর
নির্বাহী পরিচালক, এসিআই
মফস্বলের থানা শহর থেকে এসে ঢাকার কোনো কলেজে চান্স পাওয়া কঠিন ছিল। আমি জীবনের শুরুতে সে বাধাটি পার হই। এরপর আইবিএর মতো বিভাগে ভর্তি হই। কিন্তু বাধাটা সেখানেই শেষ ছিল না। নতুন বাধা শুরু হয় চাকরি জীবনে। তখন আমি অ্যারোমেটিক কসমেটিকস লিমিটেডে। বাজার দখলে ছিল বর্তমান ইউনিলিভারের লাক্স সাবানের। কোম্পানি থেকে একটি সাবান বের করার চিন্তা করলাম। শতভাগ হালাল সাবান নামে একটি সাবান বাজারে নিয়ে এলাম। আমার আশপাশের অনেকেরই অনাগ্রহমূলক কথাবার্তা আমাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি সে সময়। সাবানটি ভোক্তারা গ্রহণ করেন এবং বাজারের ১৫ ভাগ দখল করে নেয়। জীবনে চলতে অনেক বাধাই আসবে। আমি মনে করি সব বাধার মুখোমুখি হওয়ার দুঃসাহস না দেখিয়ে যে বাধাগুলো অতিক্রম করা জরুরি কেবল সেই বাধা অতিক্রম করা উচিত।

গোলাম সারওয়ার
সম্পাদক, সমকাল
সমাজের অন্য সবার চেয়ে সাংবাদিকতা পেশায় বাধা পেরোনোটা কঠিন। কোনো কোনো পত্রিকায় এমন মালিকও আছেন, যারা নিজেদের স্বার্থে পত্রিকাকে ব্যবহার করেন। এ বাধা আমরা কবে পেরোব? তবে সমকালের প্রকাশকের পক্ষ থেকে সংবাদ প্রকাশে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ নেই। সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের। অনেক রাজনৈতিক দল সত্য ঘটনায় তাদের বিপক্ষে সংবাদ ছাপা হলে নাখোশ হন। এখন সাংবাদিকতা বিত্ত-বৈভবের পেশা হয়ে উঠেছে অনেকের কাছে। নতুন যারা এ পেশায় আসছেন তাদের প্রতি উপদেশ বিত্ত-বৈভবের জন্য নয়, বিবেকের তাড়নায় এ পেশায় আসুন।

ফারুক মঈনুদ্দীন
অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিটি ব্যাংক
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পড়ি। তখন আমার কবিতার রোগে ধরেছিল। 'ফার্সদ্বইয়ারে ড্যামকেয়ার'। এ কথা মাথায় থাকায় পড়াশোনা শিকেয় উঠেছিল। তখন আমি একটি পত্রিকা বের করতাম। হোস্টেল জীবনে প্রচণ্ড স্বাধীনতা পেতাম। আমার বন্ধু ছিল চারজন। আমার বন্ধুরা বিজ্ঞান বিভাগের ছিল। তারা পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিল। আর আমি ছিলাম পত্রিকা নিয়ে। তখন একটা ঘটনায় পরীক্ষা ছাড়াই আমরা সবাই সেকেন্ড ইয়ারে প্রমোশন পেয়েছিলাম। এক শিক্ষক বলেছিলেন, তুমি তো পড়ো না, পাস করবে কী করে? আমি দুঃখ পেয়েছিলাম। প্রায়ই আমি দুঃস্বপ্ন দেখতাম। পরীক্ষার কয়েক মাস আগে থেকে দুঃস্বপ্ন দেখতাম। বেশিরভাগ দুঃস্বপ্নই ছিল পরীক্ষা নিয়ে। সময় চলে যাচ্ছে আমি কিছুই লিখতে পারছি না। তখনও পরীক্ষার তিন মাস বাকি। আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করলাম পড়াশোনা করার। বাকি তিন মাস সব ছেড়ে-ছুড়ে পড়াশোনা করলাম। ফল বেরুনোর পর দেখা গেল আমি কুমিল্লা বোর্ডে দ্বিতীয় স্ট্যান্ড করেছি। ইত্তেফাকে আমার নাম এসেছিল। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। সত্যিকার অর্থেই অধ্যবসায়ের সঙ্গে কোনো কাজ করলে সব বাধাই পেরোনো সম্ভব।
নাভীদ মাহবুব
কান্ট্রি হেড, আইবিএম
আমার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের পর বাসায় পত্রিকার লোকদের ভিড় পড়ে যায়। আমি মাধ্যমিকে পঞ্চম স্ট্যান্ড করেছিলাম। তবে সাংবাদিকরা আমাকে বাসায় দেখে হতাশ হয়ে পড়েন! বোর্ডের কাগজে ভুলে আমার নাম এসেছে নায়ীদ। তাই দেখে সম্ভবত মেয়ে মনে করেই আমার বাসায় তারা একযোগে জড়ো হয়েছিলেন। তখন সমাজের একটা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, হতে হবে ডাক্তার_ ল'ইয়ার, ইঞ্জিনিয়ার নয়তো তুমি লুজার। আমি ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিলাম। তবে প্রকৌশল বিদ্যার চেয়ে আমার মন টানত কমেডির মধ্য দিয়ে মানুষকে মজা দেওয়াতে। কিন্তু পেশাটাতে আমার কাছের মানুষরা কেউই উৎসাহ দিলেন না। উল্টো বলাবলি শুরু করে দিলেন তোমার মেয়েদের কী পরিচয়ে তুমি বিয়ে দেবে। তুমি একজন কমেডিয়ান? তখন আমি আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষার জন্য অবস্থান করছিলাম। ইতিমধ্যেই এক/এগারোতে টুইন টাওয়ারে হামলা হয়ে গেছে। তখন সবাই ইসলামকে অপছন্দ করতে শুরু করেছে। আমরা কমেডির মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে বার্তা দিতে চেষ্টা করতাম। সে সময় এক আমেরিকান সৈনিক এসে বলল, নাভীদ তোমার সাত মিনিটের কৌতুকে ইসলাম সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টে গেল। আমি দুই বছর ইরাক যুদ্ধে থেকেও ইসলাম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিতে পারিনি। হাসিও একটা মাধ্যম যার মাধ্যমে বার্তা দেওয়া যায়। এখন আমি প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এ অবস্থানে আসতে আমাকে অনেক বাধা পেরোতে হয়েছে। একসময় কেউ আমার বাবাকে আমার কথা প্রশ্ন করলে বাবা বলতেন তার মেয়ে পিএইচডি করছে। কৌশলে আমার কথা এড়িয়ে যেতেন। তবে আমি মনে করি পেশা হিসেবে একদিন কৌতুকাভিনয় স্বীকৃত পেশার স্বীকৃতি পাবে। যার ঝোঁক যে কাজের প্রতি সেই কাজকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এতে কী বাধা পেরোনো সহজ হয়।

জীশান কিংশুক হক
হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, ব্র্যাক ব্যাংক
জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বাধা আছে। যানজট কি একটি বড় বাধা নয়? এটি তো প্রতিদিনের বাধা। তবে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা বাধা আমি যৌবনে পেরিয়ে এসেছি। তখন আমি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করি। বিজ্ঞাপনের মডেলের জন্য সি্নগ্ধ এক মেয়েকে মডেল হিসেবে পেতে চান আমার গ্রাহক। এমন এক তরুণী পেয়েও যাই। কিন্তু বাধাটা আসে তার পরিবার থেকে। কারণটা ছিল তারা নবাব পরিবার। পারিবারিক ঐতিহ্য ও রক্ষণশীলতাই ছিল সেই কাজে বাধা। কিন্তু আমার নাছোড়বান্দা গ্রাহক ওই মেয়েটিকেই মডেল হিসেবে পেতে চান। আমার নাছোড় মনোভাব ও লেগে থাকার মানসিকতায় আমি ওই নবাব পরিবারের মন গলাতে পেরেছিলাম। পেশাগত জীবনে বাধার সম্মুখীন হয়েছি অনেক বার। তখন আমি একটি সিমেন্ট কোম্পানিতে কাজ করি। এক পত্রিকা তার বিশেষ পার্ক নির্মাণ করেছে ওই সিমেন্ট দিয়ে। এখন গো ধরেছে টাকা দেবে না। আমরাও টাকা চাইছি। তখন পত্রিকা ওই সিমেন্টের বিরুদ্ধে সংবাদ ছাপিয়ে বসল_ 'সিমেন্ট না ছাই'। আমরা বুয়েট থেকে পরীক্ষা করে নির্ভুলভাবে প্রমাণ করে দিলাম ওটা ছাই নয়। সিমেন্ট। এবং সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করা হলো। দেশের সবগুলো পত্রিকা সংবাদ সম্মেলনের খবর ফলাও করে প্রকাশ করল। সেই মাসে ওই সিমেন্ট কোম্পানি বছরের সব থেকে বেশি লাভ করল। আসলে আন্তরিকভাবে কাজ করলে কোনো বাধাই বাধা থাকে না।

অনিমেষ কুণ্ডু
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অটবি
সোনারগাঁও হোটেলের সামনে সার্ক ফোয়ারা আমার বাবা নিতুন কুণ্ডুর তৈরি। তখন তার হাতে সময় ছিল মাত্র চার সপ্তাহ, ভাস্কর্যটি তৈরি করতে আসলে সময় লাগার কথা ৫-৬ মাস। প্রথমে তিনি ডিজাইন করলেন। স্টেইনলেস স্টিলে। ঠিক অর্ধেক কাজ করার পর সরকার পক্ষের এক লোক আপত্তিকর প্রস্তাব করলেন_ তার নামে কাজটি করে দিতে। কিন্তু বাবা তা করেননি। তিনি মনে মনে ভেবেছেন_ জীবন থাকতে তিনি এই অন্যায় করবেন না। বরং এমন এক ভাস্কর্য তৈরি করবেন যা ওই সরকারি কর্মচারিকে কারওয়ান বাজার দিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিদিন দেখতে হবে। টানা চার সপ্তাহ কাজ করে তিনি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। তিনি অসম্ভব একাগ্রতা থেকে কাজটি শেষ করেন। তার সেই অনমনীয় মানসিকতা ও বাধা পেরিয়ে আসার শক্তি আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে।

কুদ্দুস বয়াতি
পালাকার
আমি কুদ্দুস্যা থেকে কুদ্দুস বয়াতি হয়েছি। সারা রাত আমি গান গাইতাম এক টাকার জন্য। তবে এ এক টাকার জন্য জুতা খুলে আমাকে দৌড়াতে হয়েছিল অনেক মোল্লা-মৌলভির ধাওয়ায়। লেখাপড়া না জানার জন্য আমার অনেক অসুবিধা হয়েছে। আমি স্কুলে যাওয়া তো দূরের কথা স্কুলের সামনে কখনও আছাড়ও খাইনি। তাহলে বুঝতেই পারছেন এই অশিক্ষিত মানুষটির জন্য চলতি পথে বাধার কি অন্ত আছে? এক ঘণ্টা তো দূরের কথা টানা ১৪ দিন বললেও আমার জীবনে পেরিয়ে আসা বাধার গল্প বলা শেষ হবে না। তবে মনের জোর আমার সাংঘাতিক। তাই ক-অক্ষর না জানা আমি পাঁচবার আমেরিকা, পাঁচবার লন্ডন, কয়েকবার অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশে যাই। প্রথম লন্ডন যাওয়ার সময় মজার ঘটনা ঘটে। এক কলমও ইংরেজি জানি না। বিমানে তো বসছি। বাঙালি ভাইয়েরা দুবাই পর্যন্ত আরামে নিয়ে গেল। দুবাই থেকে হিথ্রো যাব। মহা মুসিবত। পাশের সিটে ইংরেজ ভদ্রলোক। দেখি একটু পরপর এটা সেটা খায়। আর বিমানবালার সঙ্গে ইংরেজিতে কটরমটর করে। বিমানবালার দেওয়া কাগজ থেকে নতুন নতুন খাবার চায় আর খায়। আমি তো কাগজ পড়তে পারি না। তাই চাইতেও পারি না। এভাবে পাঁচ ঘণ্টা যায়। আমার মুখে পানিটাও পড়ে না। করি কি? পাশে দেখি ভদ্রলোক বিমানবালাকে ডেকে বলছেন, চিকেন রাইস। আমি উৎসাহ নিয়ে তাকাই_ কী আসে? দেখি কাগজের মোড়কে করে বিমানবালা খাবার নিয়ে এলো। ভদ্রলোক খুললেন, ভেতরে সাদা ভাত, কাঁচা মাংসের মতো কি জানি। আমি সাহস পাইলাম। বিমান বালারে সাহসে ভর করে বলেই ফেললাম, চিকেন রাইস। এবং ওই মহিলা হাসিমুখে কিছুক্ষণ পরে আমাকে খাবার এনে দিলেন। সেই চিকেন রাইস। আমি জীবন ফিরে পেলাম। আসলে অশিক্ষাই জীবনের সবচেয়ে বড় বাধা। লেখাপড়া শিখলে অনেক বাধা সহজে পেরোনো যায়। এটা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে বলে মনে হয় না।

No comments

Powered by Blogger.