বড় নীরবে চলে গেলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী
ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সোচ্চার কণ্ঠ, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, খ্যাতিমান লেখক-অনুবাদক, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী আর নেই। নয়াপল্টনের নিজ বাসায় সম্ভবত গতকাল মঙ্গলবার ভোররাতের দিকে ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাদ আসর জানাজা ও রাষ্ট্রীয় সম্মান শেষে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়েছে। কবীর চৌধুরীর মেয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহীন কবীর জানান, সকাল ৬টার
দিকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে তিনি দেখেন, কবীর চৌধুরীর দেহ নিথর হয়ে আছে, কোনো সাড়া-শব্দ নেই। রাতে শেষবারের মতো তাঁকে ওষুধ সেবন করানো হয়েছিল। এর মধ্যে রাতের কোনো এক সময়ে তিনি মারা যান বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগসহ বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যয় ভুগছিলেন। তিনি স্ত্রী মেহের কবীর ও তিন মেয়ে রেখে গেছেন।
জীবিত অবস্থায় দিয়ে যাওয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে কবীর চৌধুরীর মরদেহ সর্বস্তরের মানুষের সম্মান জানানোর জন্য অন্যান্য বরেণ্য ব্যক্তিত্বের মতো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হয়নি। মৃত্যু-পরবর্তী অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার ক্ষেত্রেও আড়ম্বরতা পরিহার করা হয়।
বাসায় বিশিষ্টজন : গতকাল সকালে কবীর চৌধুরীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। রাষ্ট্র ও সমাজের বিশিষ্টজনরা প্রয়াতের ৪১ নম্বর নয়াপল্টনের গাজী ভবনের বাসায় ছুটে আসেন। তাঁর মরদেহ রাখা হয় চতুর্থ তলায় গাজী ভবন মিলনায়তনে। এখানে ফুল দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। দুপুর পৌনে ১টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসে জাতীয় অধ্যাপকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রধানমন্ত্রী গাজী ভবনের অষ্টম তলায় গিয়ে পরিবারের সদস্যদের প্রতিও সমবেদনা জানান। বিকেলে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে পিএস ফজলুল হক কবীর চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
এ ছাড়া কবীর চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম, পূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইদুজ্জামান, সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মনজুরুল আহসান খান, সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জাসদ নেতা নাজমুল হক প্রধান, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, সাংবাদিক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রাবন্ধিক মফিদুল হক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ, সহসভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম, গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর, চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পী নেসার হোসেন, আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্যজন ম. হামিদ, প্রকাশক ওসমান গনিসহ নানা অঙ্গনের বরেণ্য ব্যক্তিত্বরা। এ ছাড়া সরকারের শিক্ষাসচিব কামাল চৌধুরী, সংস্কৃতিসচিব সুরাইয়া বেগম, পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার, বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষও শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
জানাজা ও রাষ্ট্রীয় সম্মান : গতকাল বাদ আসর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কবীর চৌধুরীকে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এ সময় তাঁর মরদেহ জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত করা হয়। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। এরপর এখানেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মান জানানো হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় আবদুল্লাহ আল নোমানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল।
জানাজায় অংশ নেন ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, আওয়ামী লীগ নেতা আমীর হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, বিচারপতি গোলাম রাব্বানী, অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অভিনেতা আলী যাকের, রহমতউল্লাহ, তারিক আনাম খান, খায়রুল আলম সবুজ, ম. হামিদ, সাংবাদিক আবেদ খান, হারুন হাবিব, আবুল হাসনাত, অর্থনীতিবিদ ড. খলীকুজ্জমান, ইব্রাহিম খালেদ, অধ্যাপক এম এম আকাশ, সাবেক উপদেষ্টা সি এম শফি সামি, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক মনসুর মুসা, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান আইনজীবী গোলাম আরিফ টিপু প্রমুখ। আরো উপস্থিত ছিলেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, কবি নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা প্রমুখ।
নায়াখালী থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরীর মৃত্যুতে তাঁর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে শোকের ছায়া নেমে আসে। সেখানে সোমপাড়া কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কালো ব্যাজ ধারণ করে শোক পালন করে।
কবীর চৌধুরীর পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীর চাটখিলের গোপাইরবাগ গ্রামে। তাঁর জন্ম ১৯২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারির ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বাবা খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী ও মা আফিয়া বেগম। নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার শাহাপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর ভাতিজা গোলাম হায়দার কাজল জানান, কবীর চৌধুরীর বাবা আবদুল হালিম ডেপুটির নামে পরবর্তীকলে এ বাড়ি ডেপুটি বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়। এখানে বর্তমানে তাঁর একমাত্র চাচা শহীদ উল্যাসহ অন্য আত্মীয়স্বজন থাকেন। কবীর চৌধুরী সর্বশেষ ১৯৭৬ সালে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে আসেন। এলাকায় সোমপাড়া বয়েজ হাই স্কুল ও সোমপাড়া গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠায় তিনি বড় অবদান রাখেন।
কীর্তিময় জীবন : ৯ ভাইবোনের মধ্যে কবীর চৌধুরী ছিলেন সবার বড়। ভাইবোনদের মধ্যে রয়েছেন শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও বোন অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজমুদার। তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ সালে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও ১৯৪৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। দুই পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৪ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ইংরেজির অস্থায়ী অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু। এরপর ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে রাজশাহী সরকারি কলেজ, ঢাকা কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়েছেন জ্ঞানের আলো।
১৯৪৫ সালের জুন মাসে মেহের কবীরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৫৭ সালে ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে মার্কিন সাহিত্যের ওপর লেখাপড়া করতে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৫ সালে সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসনে উচ্চতর গবেষণা সম্পন্ন করেন। দেশে ফিরে তিনি বাংলা একাডেমীতে পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলা একাডেমীর প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ সময় তিনি একাডেমীতে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র রাখাসহ নানা ধরনের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক তৎপরতায় নিজেকে যুক্ত করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের শিক্ষা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে তিনি প্রথম জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্যসচিব হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৭৪ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নাট্যকলা বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পাঠদান করেছেন। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মনোনীত করে। মৃত্যুকালে তিনি বাংলা একাডেমীর সভাপতিসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন।
সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য অধ্যাপক কবীর চৌধুরী অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, গভর্নর স্বর্ণপদক, হাবিব সাহিত্য পুরস্কার, ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কার, কাজী মাহবুবউল্লাহ পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, নাসিরউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার, লোকনাট্যদল স্বর্ণপদক প্রভৃতি।
বিশ্বসাহিত্যের বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে কবীর চৌধুরী ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলাদেশের কবিতাকেও বিশ্বে পরিচিত করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অগ্রগণ্য। বাংলা ও ইংরেজিতে মৌলিক রচনা ও অনুবাদ মিলিয়ে কবীর চৌধুরীর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২১৭টি। তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ ও অনূদিত গল্প-কবিতা ভারত, রাশিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার পত্রপত্রিকা এবং সংকলন-গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।
শোক প্রকাশ : জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর মৃত্যুতে বিশিষ্টজন, বিভিন্ন দল ও সংগঠনসহ বিভিন্ন মহল পৃথক বিবৃতিতে শোক প্রকাশ করেছে। শোক জ্ঞাপনকারীদের মধ্যে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও কর্মকর্তা সমিতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানসহ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), জাতীয় ছাত্রলীগ, জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্ট, মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম, মহিলা পরিষদ, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, জাতীয় কবিতা পরিষদ, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ, পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি, জয় বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, জয় বাংলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ফরিদপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সংস্থা অন্যতম।
জীবিত অবস্থায় দিয়ে যাওয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে কবীর চৌধুরীর মরদেহ সর্বস্তরের মানুষের সম্মান জানানোর জন্য অন্যান্য বরেণ্য ব্যক্তিত্বের মতো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হয়নি। মৃত্যু-পরবর্তী অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার ক্ষেত্রেও আড়ম্বরতা পরিহার করা হয়।
বাসায় বিশিষ্টজন : গতকাল সকালে কবীর চৌধুরীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। রাষ্ট্র ও সমাজের বিশিষ্টজনরা প্রয়াতের ৪১ নম্বর নয়াপল্টনের গাজী ভবনের বাসায় ছুটে আসেন। তাঁর মরদেহ রাখা হয় চতুর্থ তলায় গাজী ভবন মিলনায়তনে। এখানে ফুল দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। দুপুর পৌনে ১টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসে জাতীয় অধ্যাপকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রধানমন্ত্রী গাজী ভবনের অষ্টম তলায় গিয়ে পরিবারের সদস্যদের প্রতিও সমবেদনা জানান। বিকেলে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে পিএস ফজলুল হক কবীর চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
এ ছাড়া কবীর চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম, পূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইদুজ্জামান, সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মনজুরুল আহসান খান, সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জাসদ নেতা নাজমুল হক প্রধান, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, সাংবাদিক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রাবন্ধিক মফিদুল হক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ, সহসভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম, গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর, চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পী নেসার হোসেন, আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্যজন ম. হামিদ, প্রকাশক ওসমান গনিসহ নানা অঙ্গনের বরেণ্য ব্যক্তিত্বরা। এ ছাড়া সরকারের শিক্ষাসচিব কামাল চৌধুরী, সংস্কৃতিসচিব সুরাইয়া বেগম, পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার, বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষও শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
জানাজা ও রাষ্ট্রীয় সম্মান : গতকাল বাদ আসর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কবীর চৌধুরীকে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এ সময় তাঁর মরদেহ জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত করা হয়। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। এরপর এখানেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মান জানানো হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় আবদুল্লাহ আল নোমানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল।
জানাজায় অংশ নেন ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, আওয়ামী লীগ নেতা আমীর হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, বিচারপতি গোলাম রাব্বানী, অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অভিনেতা আলী যাকের, রহমতউল্লাহ, তারিক আনাম খান, খায়রুল আলম সবুজ, ম. হামিদ, সাংবাদিক আবেদ খান, হারুন হাবিব, আবুল হাসনাত, অর্থনীতিবিদ ড. খলীকুজ্জমান, ইব্রাহিম খালেদ, অধ্যাপক এম এম আকাশ, সাবেক উপদেষ্টা সি এম শফি সামি, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক মনসুর মুসা, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান আইনজীবী গোলাম আরিফ টিপু প্রমুখ। আরো উপস্থিত ছিলেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, কবি নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা প্রমুখ।
নায়াখালী থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরীর মৃত্যুতে তাঁর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে শোকের ছায়া নেমে আসে। সেখানে সোমপাড়া কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কালো ব্যাজ ধারণ করে শোক পালন করে।
কবীর চৌধুরীর পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীর চাটখিলের গোপাইরবাগ গ্রামে। তাঁর জন্ম ১৯২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারির ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বাবা খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী ও মা আফিয়া বেগম। নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার শাহাপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর ভাতিজা গোলাম হায়দার কাজল জানান, কবীর চৌধুরীর বাবা আবদুল হালিম ডেপুটির নামে পরবর্তীকলে এ বাড়ি ডেপুটি বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়। এখানে বর্তমানে তাঁর একমাত্র চাচা শহীদ উল্যাসহ অন্য আত্মীয়স্বজন থাকেন। কবীর চৌধুরী সর্বশেষ ১৯৭৬ সালে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে আসেন। এলাকায় সোমপাড়া বয়েজ হাই স্কুল ও সোমপাড়া গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠায় তিনি বড় অবদান রাখেন।
কীর্তিময় জীবন : ৯ ভাইবোনের মধ্যে কবীর চৌধুরী ছিলেন সবার বড়। ভাইবোনদের মধ্যে রয়েছেন শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও বোন অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজমুদার। তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ সালে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও ১৯৪৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। দুই পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৪ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ইংরেজির অস্থায়ী অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু। এরপর ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে রাজশাহী সরকারি কলেজ, ঢাকা কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়েছেন জ্ঞানের আলো।
১৯৪৫ সালের জুন মাসে মেহের কবীরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৫৭ সালে ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে মার্কিন সাহিত্যের ওপর লেখাপড়া করতে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৫ সালে সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসনে উচ্চতর গবেষণা সম্পন্ন করেন। দেশে ফিরে তিনি বাংলা একাডেমীতে পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলা একাডেমীর প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ সময় তিনি একাডেমীতে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র রাখাসহ নানা ধরনের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক তৎপরতায় নিজেকে যুক্ত করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের শিক্ষা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে তিনি প্রথম জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্যসচিব হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৭৪ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নাট্যকলা বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পাঠদান করেছেন। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মনোনীত করে। মৃত্যুকালে তিনি বাংলা একাডেমীর সভাপতিসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন।
সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য অধ্যাপক কবীর চৌধুরী অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, গভর্নর স্বর্ণপদক, হাবিব সাহিত্য পুরস্কার, ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কার, কাজী মাহবুবউল্লাহ পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, নাসিরউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার, লোকনাট্যদল স্বর্ণপদক প্রভৃতি।
বিশ্বসাহিত্যের বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে কবীর চৌধুরী ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলাদেশের কবিতাকেও বিশ্বে পরিচিত করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অগ্রগণ্য। বাংলা ও ইংরেজিতে মৌলিক রচনা ও অনুবাদ মিলিয়ে কবীর চৌধুরীর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২১৭টি। তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ ও অনূদিত গল্প-কবিতা ভারত, রাশিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার পত্রপত্রিকা এবং সংকলন-গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।
শোক প্রকাশ : জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর মৃত্যুতে বিশিষ্টজন, বিভিন্ন দল ও সংগঠনসহ বিভিন্ন মহল পৃথক বিবৃতিতে শোক প্রকাশ করেছে। শোক জ্ঞাপনকারীদের মধ্যে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও কর্মকর্তা সমিতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানসহ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), জাতীয় ছাত্রলীগ, জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্ট, মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম, মহিলা পরিষদ, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, জাতীয় কবিতা পরিষদ, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ, পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি, জয় বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, জয় বাংলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ফরিদপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সংস্থা অন্যতম।
No comments