‘পোয়া আইতোত ঢেঁকিশাক পান্তা খায়া ওজা আছোং’ -সংসদীয় কমিটির সুপারিশ by মিলন পাটোয়ারী
‘তিস্তাপাড়োত
মোর বাড়ি, নদী মোর ৯ বার খাইল ভিটাবাড়ি, ভুট্টার গুঁড়া জলপান ভাজা ভিজিয়া
দিয়ে পানি খায়া ওজা খুলং, আর পোয়া আইতোত পান্তা খায়া ওজা থাকোং বাহে মুই
গরিব মানুষ রমজান মাস কষ্টে আছোং মোর কায়েও উদ্দিস করে নাই মুই মরিম নাকি
বাহে।’ এভাবেই রোজা রাখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন তিস্তাপাড়ের ১১০ বছরের
আব্বাস আলী। আব্বাস আলীর শরীর বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে। চোখে দেখে আবছা আবছা।
কপালে পড়েছে ভাঁজ। ক্ষুধার জ্বালায় পুড়ছে বৃদ্ধা আব্বাস। পারে না চলতে
তিস্তার সঙ্গে লড়াই করে তবু আছে বেঁচে। লালমনিরহাট সদরের খুনিয়াগাছ
ইউনিয়নের ওয়াপদার বাঁধে চালা ঘরে থাকলেও বৃষ্টি এলে টপটপ করে পানিতে ভিজে
যায় গা। প্রতিবন্ধী কন্যা সন্তান, স্ত্রী নিয়ে কষ্টে কাটে আবদার আলীর
সংসার। এক সময়ে আবদার আলীর ছিলো ২ শ’ একর জমি, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা
মাছ সর্বনাশী তিস্তা নিয়ে গেছে সহায় সম্বল। হালের গরুও নিয়ে গেছে বানের
পানিত ভাসি। রাস্তার পাশে অন্যের জায়গায় ঝুপড়ি ঘরে কষ্টে কাটছে জীবন। বাড়ি
ভিটার জমিটুকুও নেই তার। কায়েও কি মোক বাঁচাইবেন বাহে। ঈদোত নয়া তপন
(লুঙ্গি)ও নাই, নাই নয়া জামা। মোরোও ইচ্ছে হয় নয়া কাপড়ের কি করিম মুই নদী
ভাঙা মানুষ কপাল মোর ভাঙছে নদীত। ওয়াপদার বাঁধে কেউ ফুলপ্যান্ট পররা দেখলেই
তার আর্তনাদ মোক বাঁচান বাহে, মোক বাঁচান। তিস্তার পাড়ের রহিমন, সাদেক,
রসুল মিয়া, কাদেরসহ আরও অনেকে কষ্টে রাখছে রোজা। চরাঞ্চলে সরজমিন গিয়ে দেখা
গেছে, নদী ভাঙা পরিবারগুলোর রমজানে কষ্ট। মাছ-মাংস কিনে খাওয়ার সমর্থন নেই
চরের পরিবারগুলোর। কেউ নদীতে সারাদিন জাল ফেলে কখনো এক পোয়া মাছ পায় কখনো
বা সারাদিন জাল ফেলে পায়না একটিও মাছ। মহিলারা নদীর ধারে ধারে তুলছে
ঢেঁকিশাক। কেউ বা কোমর পানিতে ভিজে তুলছে কলমিশাক। তাদের মনে নেই শান্তি।
কষ্টে ওদের জীবনগাথা। কখনো জলে, কখনো ডাঙ্গায় বাস এ নিয়ে জীবন-জীবিকা
উত্তরের জেলা লালমনিরহাটের তিস্তাপাড়ের লাখো মানুষের। হতভাগা চরাঞ্চলের
মানুষের বাঁচা-মরার শেষ আশ্রয়স্থল নদীপাড়ের জায়গা-জমি তাও ভেসে নিয়ে যায়
বন্যার পানি। রমজান মাসে নদী ভাঙা পরিবারগুলো কষ্টে পালন করছে রোজা। জলপান
গুঁড়া করে পানি খেয়ে ভাঙে রোজা আর কাঁঠালের বিচির ভর্তা আর পানি দেয়া ভাত
দিয়ে সেহরি খেয়ে রাখছে কষ্টে রোজা। অভাব-অনটন লেগে থাকে সব সময় তিস্তাপাড়ের
মানুষের। রাতে এক বেলা খাবার জুটলেও শেষ রাতে সেহরিতে রোজা রাখতে হয়
অনাহারে-অর্ধাহারে। সর্বনাশী তিস্তাপাড়ের খুনিয়াগাছের ৬৬ বছরের জরিনা বেওয়া
বলেন, মুই শেষ আইতোত কচুশাক, শুঁটকির ভর্তা, পান্থা খায়া ওজা আছোং সানজোত
জলপানের গুঁড়া ভিজিয়া ইফতারি করমো গরিব মানুষ কায়েও হামার খোঁজ করে না। ৭৮
বছরের সাদেক মুন্সি জানান, গরিব মানুষ রোজার মাসেও কষ্ট। শেষ রাইতোত
কাঁঠালের বিচি আর পান্তা খায়া রোজা আছি, ইফতারি যে কি দিয়া করমো তা আল্লাহ
জানে। সুরুত আলী ও মর্জিনা জানান, আগা আইতোত কচুশাক ও খুদির ভাত জুটলেও
সেহরির খাবার নিয়া পড়ে চিন্তা। তিস্তাপাড়ের মোজাম্মেল হক জানান, হামার গিলা
ঈদ নাই ঈদ ধনী মানুষের। কপাল হামার খাইছে তিস্তা। ছাওয়া পাওয়া নয়া জামার
জন্যে বায়না ধরছে দিবার টাকা নাই দিমো কেমনে। রাজ্জাক আলী জানান, রোজার মাস
কাম কামাই নাই দুকনা হাঁস ছিলো তাকে হাটোত বেচে চাউল কিননো আইজ কাইল কি
হবে তার চিন্তা পড়ছে। পরিবারগুলো বেঁচে থাকে অভাব-অনটনের সঙ্গে।
দারিদ্র্যতাকে সঙ্গী করে তিস্তার সঙ্গে লড়াই করে আঁকড়ে ধরে রয়েছে পৈতৃক
ভিটার চিহ্নটুকু। উজানের পানির প্রবল স্রোত বার বার তাদের বাঁচার স্বপ্নকে
করে দেয় ভেঙে চুরমার। সব সময় লড়াই করে বেঁচে থাকে পরিবারগুলো। এক সময়ে
পরিবারগুলোর জায়গা-জমি সবই ছিলো তিস্তার কড়াল গ্রাসে এখন তারা নিঃস্ব।
বন্যার পর আবারো নতুন করে দেখছে বাঁচার স্বপ্ন। ঘর-বাড়িতে ফিরে গিয়ে ফেলছে
চোখের জল। রমজানে পরিবারগুলো কষ্টে রাখছে রোজা। কাঁঠালের বিচি, ভুট্টার
গুঁড়া, কচুশাক, পাটাশাক খেয়ে রাখছে রোজা। রোজায় শেষ রাতে পান্তা, শুঁটকি
ভর্তা, শাক ও কাঁঠালের বিচি খেয়ে রোজা রাখে। মাছ-মাংস নদীপাড়ের মানুষের
কপালে জুটে না কখনো। ভালো- মন্দ খাবার নেই। পরিবারগুলো ইফতারি ভুট্টার
গুঁড়া, মুড়ি, চাউলের খুদি দিয়ে করে। শেষ রাতে সেহরির সময় জুটে না ভালো
খাবার। নদীপাড়ের মানুষগুলোর এখন দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হলেও এক সময়
পরিবারগুলো ছিলো স্বয়ং সম্পূর্ণ। একেক জন পরিবারে ছিলো ৫০ বিঘা থেকে শত
বিঘা জায়গা-জমি। ছিলো পুকুর ভরা মাছ ও ক্ষেত জুড়ে চাষাবাদ। এছাড়াও ছিলো
গোলাভরা ধান। এখন সবই যেন স্বপ্ন। লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধার চর
পারুলিয়া, চর ডাউয়াবাড়ী, সানিয়াজান, সিন্দুরনা, কালীগঞ্জের চর ভোটমারী, চর
শৈলমারী, আদিতমারীর চরগোবর্ধন, মহিষখোঁচা, সদরের রাজপুরের চর, চরমধুরাম,
খুনিয়াগাছ, চর চিনাতুলী, বাদামতলী, চর হরিণচড়াসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলে সরজমিন
গিয়ে দেখা গেছে পরিবারগুলোর রমজান মাস কাটছে কষ্টের। সরকারি ভাবে রমজান
মাসে সাহায্য পায়নি পরিবারগুলো। নদীপাড়ের কচুপাতা, ঢেঁকিশাক খেয়ে রাখছে
রোজা। রমজান মাসেও কষ্ট ছাড়ছে না চরাঞ্চলের পরিবারগুলোর। যদিও সরকারি কিছু
ত্রাণ সামগ্রী রমজান মাসে আসলেও তাও সঠিক ভাবে হচ্ছে না বিতরণ। গরিরের
রোজার ত্রাণ নিয়ে মেম্বার-চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ।
গরিবের রমজানের সাহায্য খাচ্ছে মেম্বার-চেয়ারম্যানদের আত্মীয়রা। গরিব
খাচ্ছে কচু। রমজান মাসে রোজা রাখতে চরের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য
সরকারি ভাবে উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে বরাদ্দের সিংহভাগ টাকা চলে যায় লুটেরার
হাতে। নদী ভাঙা পরিবারের ভাগ্য উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন
বোর্ডের বাঁধ নির্মাণের কাজ করলেও লুটপাট হয়েছে সে টাকা। চরের মানুষের টাকা
ক্ষমতাসীনদের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটিয়েছে। রমজান মাসে তারা কেউ নেই নদী ভাঙা
পরিবারগুলোর পাশে। এক লাখের বেশি তিস্তাপাড়ে অভাবী পরিবার থাকলেও বরাদ্দের
তুলনায় তা খুবই কম। তবুও জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসেন জানান, নদী
পাড়ের মানুষের জন্য সরকারি ৬ শ’ ৭০ টন চাল পাওয়া গেছে যা ৬৭ হাজার ৩ শ’ ৮৪
জন পরিবারের মাঝে ১০ কেজি করে চাল ঈদ ও রোজা উপলক্ষে বরাদ্দ পাওয়া গেছে যদি
বিতরণে অনিয়ম হয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে। রমজানে চরাঞ্চলের
মানুষের দাবি নদী ভাঙা পরিবারগুলোর রোজায় দ্রুত সরকারি সাহায্য সহযোগিতার।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান জানান, ঈদ ও রমজান উপলক্ষে
ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে কোন অনিয়ম হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
No comments