হাসিনাকে হত্যা চক্রান্তে ছিলেন খুনি ডালিম by মিজানুর রহমান খান
শরিফুল হক ডালিম, মেজর জিয়াউল হক, ইশরাক আহমেদ |
সাড়ে
তিন বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থানের
চেষ্টা হয়েছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা
মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম। ঢাকার সৌদি আরবের
দূতাবাস রিয়াদে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সে রকমটিই জানিয়েছিল।
উইকিলিকসে সদ্য ফাঁস হওয়া সৌদি কূটনৈতিক বার্তায় এ তথ্য পাওয়া গেছে।
উইকিলিকসে সৌদি গোপন নথি: ‘২০১১ ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টায় বিএনপি, তারেক ও জামায়াতকে জড়িত করা যুক্তিযুক্ত নয়’ আরবি ভাষায় পাঠানো এসব বার্তার বাংলা ভাষান্তর করে দেখা যায় যে সৌদি দূতাবাস রিয়াদে তাদের মন্ত্রণালয়কে ঘটনাবলির যে বিবরণ জানিয়েছিল, তাতে বলা হয়েছে যে অভ্যুত্থানকারীরা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধানসহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিল। সৌদি দূতাবাসের মতে, ঘটনাটি কার্যত ছিল ‘অত্যন্ত সীমিত’। তবে সরকার বিষয়টিকে তার পক্ষে প্রচারণার কাজে লাগিয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে বিএনপি, তারেক রহমান ও জামায়াতকে জড়িত করা ‘যুক্তিযুক্ত নয়’ বলেও ওই বার্তায় অভিমত প্রকাশ করা হয়।
১৪৩৩ হিজরি সনের (ইংরেজি ২০১২ সাল) ২৪ রবিউল আউয়াল বাংলাদেশে সৌদি দূতাবাস তাদের অতিগোপনীয় এক পত্রের মাধ্যমে এসব তথ্য সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছিল। বাংলাদেশ-সংক্রান্ত এসব সৌদি বার্তার ইংরেজি তরজমা গত ৩০ জুন ই-মেইলে সৌদি দূতাবাসে পাঠিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে যোগাযোগ ও মতামত চাওয়া হলেও দূতাবাস কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
২০১২ সালের ৩ জানুয়ারি বর্তমানে বন্ধ থাকা দৈনিক পত্রিকা আমার দেশ ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মধ্যম সারির কর্মকর্তারা অচিরেই বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন’ মর্মে মেজর জিয়াউল হক প্রচারিত একটি ই-মেইল প্রকাশ করে। এর ছয় দিন পরে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে এক জনসভায় সেনাবাহিনীতে গুমের ঘটনা ঘটছে বলে উল্লেখ করেন।
আমার দেশ-এর ওই বিবৃতি প্রকাশ এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতার অভিযোগের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ব্যর্থ করে দেওয়া একটি অভ্যুত্থানচেষ্টার কথা প্রকাশ করে। তবে সেনাবাহিনীর প্রকাশিত বিবরণে শরিফুল হক ডালিমের কোনো উল্লেখ ছিল না। বাংলাদেশে এর আগে কখনোই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো ব্যর্থ অভ্যুত্থান-চেষ্টার তথ্য সেনাবাহিনী বা সরকার প্রকাশ করেনি।
সৌদি নথিতেই প্রথম দেখা যাচ্ছে যে ওই অভ্যুত্থানচেষ্টার পরিকল্পনা তিনটি দেশে বসে ঘটেছে এবং এর ‘সমন্বয়কারীর’ দায়িত্ব পালন করেছেন পঁচাত্তরের আগস্ট অভ্যুত্থানের অন্যতম কুশীলব ডালিম, যিনি ‘বর্তমানে আফগানিস্তানে রয়েছেন’ বলেও উল্লেখ করা হয়।
সামরিক বাহিনীর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরে (আইএসপিআর) যোগাযোগ করে বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তাৎক্ষণিকভাবে তারা কোনো কথা বলতে চায়নি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি বর্তমানে চিকিৎসাধীন বলে জানা গেছে। পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক উইকিলিকসের এ বিষয়টি তাঁর জানা নেই বলে কোনো মন্তব্য করেননি।
গত ১৯ জুন উইকিলিকস ওয়েবসাইটে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সৌদি আরবের গোপন নথি প্রকাশের ঘটনায় বিশ্বব্যাপী একটা হইচই পড়ে যায়। গত দুই সপ্তাহে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত অনেক নথি সৌদি সরকার ও রাজপরিবারের সদস্যদের বিব্রত করেছে। কিন্তু সৌদি আরব সরকার কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত রয়েছে। বরং সৌদি সরকার তাদের নাগরিকদের হুঁশিয়ার করে বলেছে যে তারা যেন ‘ভুয়া হতে পারে এমন সব নথিপত্র বিতরণ করা থেকে বিরত থাকে’। সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় টুইটারের মাধ্যমে দেওয়া বিবৃতিতে অবশ্য সরাসরি কোনো নথিপত্রের সত্যতা নাকচ করে দেয়নি। এর পরদিন সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘কোনো নথি বিনিময় কিংবা প্রকাশ করে রাষ্ট্রের শত্রুদের উদ্দেশ্য পূরণ করতে দেওয়া কোনো নাগরিকের উচিত হবে না। এর অনেক নথিই বিভিন্ন উপায়ে বানোয়াট হতে পারে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে, জড়িতদের শাস্তি দেওয়া হবে।’
উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে অবরুদ্ধ থাকার তিন বছর পূর্তিতে ১৯ জুন সৌদি আরব সরকারের পাঁচ লাখের বেশি গোপন নথি প্রকাশের ঘোষণা দেওয়া হয়। ফাঁস করে দেওয়া মার্কিন নথি-সংবলিত উইকিলিকস ওয়েবসাইটে ওই দিন সৌদি প্রশাসনের প্রায় ৬১ হাজার গোপন নথি প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ-সংক্রান্ত কিছু নথির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে।
প্রথম আলোর খুঁজে পাওয়া ঢাকার সৌদি দূতাবাসের স্মারক নং ২১৮/৫/৫-৩২৬ তাং ২৪ রবিউল আউয়াল ১৪৩৩ তারবার্তাটিতে এক মাস আগে পাঠানো আরও দুটি বার্তা (‘অতিগোপনীয়’ চিহ্নিত স্মারক নং ৫/৫/৬৫০৭৭ তাং ২৬/২/১৪৩৩ এবং স্মারক নং ২১৮/৫/৫/২২৮ তাং ২/৩/১৪৩৩) উল্লেখ রয়েছে যা পাওয়া যায়নি। ওই তারবার্তায় দূতাবাস মিডিয়ার বরাতে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ জন কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালায়, যার লক্ষ্য ছিল সেনাপ্রধানসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো। এই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা হয়েছিল হংকং, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায়।
ওই সৌদি নথিতে বলা হয়, ‘এ অভ্যুত্থানের সমন্বয়কারী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার দায়ে অভিযুক্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা শরিফুল হক ডালিম এবং হংকংয়ে বসবাসরত একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ইশরাক আহমেদ ওই কাজে অর্থায়ন করেন এবং অভিযোগ রয়েছে যে তিনি নিষিদ্ধঘোষিত হিযবুত তাহ্রীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সামরিক কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে সরকার এই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়।’
এরপর ওই নথিতেই বলা হয় যে ‘সৌদি দূতাবাস মনে করে অভ্যুত্থানচেষ্টা খুব সীমিত আকারে ছিল। কিন্তু সরকার এ ঘটনাকে তার পক্ষে প্রচারণার জন্য কাজে লাগিয়েছে এবং বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার দলকে এ ঘটনায় অভিযুক্ত করছে। কিন্তু দূতাবাস মনে করে এই অভিযোগ সত্য নয়।’
২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ রাজ্জাক আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য প্রকাশ করেছিলেন যে ১৬ জন ইসলামি উগ্রপন্থী সেনা কর্মকর্তা ২০১১ সালের ডিসেম্বরে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উৎখাতের চক্রান্ত করেছিলেন, কিন্তু তাঁদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে। এর আগের বছরের (২০১১) ১৩ ডিসেম্বর এ পরিকল্পনা সেনাবাহিনী জানতে পারে। এরপর ঘটনা তদন্তে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মিলে প্রথমে পাঁচটি, পরে আরও ছয়টিসহ মোট ১১টি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়। আদালত মোট ৭৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ তদন্ত করে ও তাঁদের জবানবন্দি গ্রহণ করে। শেষ পর্যন্ত একজন মেজর জেনারেল, একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলসহ ১৫ কর্মকর্তাকে বিচারের মুখোমুখি করে।
ওই সময় অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে দুজন অবসরপ্রাপ্ত এবং ১৩ জন কর্মরত কর্মকর্তা ছিলেন। অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে আটজন বিভিন্ন সময় ফৌজদারি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এসব জবানবন্দিতে তাঁরা ঘটনার সঙ্গে নিজে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন এবং বিভিন্ন কর্মকর্তার নাম বলেন। এসব জবানবন্দি ও সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে পরে কয়েকজন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন ধরনের সাজা দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার পর মেজর জেনারেল পদের কর্মকর্তাকে স্বাভাবিক অবসর দেওয়া হয় এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের ২১ জানুয়ারি গণভবনে এক মতবিনিময় সভায় খালেদা জিয়াকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘তিনি বলেছিলেন ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। এখন তাঁর কথার অর্থ বোঝা গেল এবং এর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।’ পরদিনই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনীকে বিতর্কিত করার অপপ্রয়াসের অংশ হিসেবে সরকার বিরোধী দলের দিকে ইঙ্গিত করছে।’ সেনাসদরের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাসুদ রাজ্জাক চট্টগ্রামে দেওয়া খালেদা জিয়ার মন্তব্যের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দল সেনাবাহিনীতে গুমের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করে, যা সেনাবাহিনীসহ সচেতন নাগরিকের মধ্যে উসকানিমূলক বিতর্কের সৃষ্টি করে।’ মির্জা ফখরুল এর উত্তরে বলেছিলেন, সেনাসদরের কিছু কটাক্ষপূর্ণ মন্তব্য রাজনৈতিক রঙে রঞ্জিত। ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রচারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’
সৌদি দূতাবাস তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল, ‘সরকার ওই অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টার সঙ্গে ব্রিটেনে বসবাসরত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমিরের ছেলে লোকমান আল আজমিকেও অভিযুক্ত করেছে। সরকার আরও প্রচার করেছে যে এই অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত সামরিক কর্মকর্তাগণ কট্টর ইসলামপন্থী। মনে হয় সরকার এই অপবাদ দিয়ে ইসলামি কট্টরপন্থী লোকজনকে অপসারণের মাধ্যমে সেনাবাহিনী শুদ্ধকরণে ব্যবহার করবে।’
ওই অভ্যুত্থানে জড়িতদের পরিচয় সম্পর্কে সেনাসদরের মুখপাত্র ‘ধর্মান্ধের অনুভূতি’ এবং ‘ধর্মীয় অনুশাসন পালনে হঠাৎ অতিমাত্রায় কট্টর’ বলে উল্লেখ এবং তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ২০১২ সালের ২০ জানুয়ারি এ ঘটনার সঙ্গে ‘বিএনপি-জামায়াত জোটেরও সংশ্লিষ্টতা’ রয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন।
ওই সৌদি নথিতে উল্লেখ রয়েছে যে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে এবং ভারত এ জন্য বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানকেও অভিযুক্ত করেছে।’ এই নথিটির এর পরের অংশ পাওয়া যায়নি। কিন্তু তৎকালীন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদ আল ফয়সাল (বর্তমানে তিনি বাদশাহর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা) এই নথিটিই হিজরি ১৪৩৩ সনের ২৭ রবিউল আউয়াল তৎকালীন সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহর নজরে এনেছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত এক পৃষ্ঠার ‘একটি বিশেষ গোপনীয় পত্র’ থেকে দেখা যায়, ওই নথিতে তারেক প্রসঙ্গের পরে দূতাবাসের মূল্যায়ন হিসেবে লেখা আছে, ‘এই বিষয়ে বেগম খালেদা জিয়ার দল ও তাঁর ছেলে এবং জামায়াতে ইসলামীকে অভিযুক্ত করা যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো দেখা যায়নি যে বিরোধী দল বিশেষ করে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া সরকার পতনের জন্য কখনো সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে বিরোধী দল যখন ভালো করেই জানে যে সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্ব শেখ হাসিনা সরকারের অনুগত।’ সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই চিঠির অনুলিপি সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধানকেও দিয়েছিলেন।
এই বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেনাবাহিনী স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী। তাদের অবশ্যই বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। সৌদি নথিতে ওই ঘটনা সম্পর্কে তাদের সরকারের যে মনোভাবের ইঙ্গিত পাচ্ছি, তাতে বাস্তবতারই প্রতিফলন ঘটেছে।’
উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা যায় এই অভ্যুত্থানচেষ্টা বিষয়ে পাকিস্তানে সৌদি আরবের ইসলামাবাদের দূতাবাস তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি কূটনৈতিক নোট (নং-৩/১/৭১২১ তাং-৭-৩-১৪৩৩ হিজরি) পাঠিয়েছিল। ওই নোটে বলা হয় যে ‘অধিকাংশ পাকিস্তানি মনে করে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের ক্রীড়নক হিসেবে তাঁর দেশে ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন এবং গত সপ্তাহের অভ্যুত্থানচেষ্টাবিষয়ক প্রচারণার উদ্দেশ্য ছিল এর সঙ্গে জড়িয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেই সমস্ত কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করা, যাঁরা বাংলাদেশের সামরিক ও বেসামরিক বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করছিলেন। উপরন্তু শেখ হাসিনা এই অভ্যুত্থানের ঘটনাকে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তাঁর যারা বিরোধী রয়েছে, তাদের শায়েস্তা করতেও একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন।’
উইকিলিকসে সৌদি গোপন নথি: ‘২০১১ ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টায় বিএনপি, তারেক ও জামায়াতকে জড়িত করা যুক্তিযুক্ত নয়’ আরবি ভাষায় পাঠানো এসব বার্তার বাংলা ভাষান্তর করে দেখা যায় যে সৌদি দূতাবাস রিয়াদে তাদের মন্ত্রণালয়কে ঘটনাবলির যে বিবরণ জানিয়েছিল, তাতে বলা হয়েছে যে অভ্যুত্থানকারীরা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধানসহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিল। সৌদি দূতাবাসের মতে, ঘটনাটি কার্যত ছিল ‘অত্যন্ত সীমিত’। তবে সরকার বিষয়টিকে তার পক্ষে প্রচারণার কাজে লাগিয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে বিএনপি, তারেক রহমান ও জামায়াতকে জড়িত করা ‘যুক্তিযুক্ত নয়’ বলেও ওই বার্তায় অভিমত প্রকাশ করা হয়।
১৪৩৩ হিজরি সনের (ইংরেজি ২০১২ সাল) ২৪ রবিউল আউয়াল বাংলাদেশে সৌদি দূতাবাস তাদের অতিগোপনীয় এক পত্রের মাধ্যমে এসব তথ্য সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছিল। বাংলাদেশ-সংক্রান্ত এসব সৌদি বার্তার ইংরেজি তরজমা গত ৩০ জুন ই-মেইলে সৌদি দূতাবাসে পাঠিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে যোগাযোগ ও মতামত চাওয়া হলেও দূতাবাস কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
২০১২ সালের ৩ জানুয়ারি বর্তমানে বন্ধ থাকা দৈনিক পত্রিকা আমার দেশ ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মধ্যম সারির কর্মকর্তারা অচিরেই বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন’ মর্মে মেজর জিয়াউল হক প্রচারিত একটি ই-মেইল প্রকাশ করে। এর ছয় দিন পরে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে এক জনসভায় সেনাবাহিনীতে গুমের ঘটনা ঘটছে বলে উল্লেখ করেন।
আমার দেশ-এর ওই বিবৃতি প্রকাশ এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতার অভিযোগের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ব্যর্থ করে দেওয়া একটি অভ্যুত্থানচেষ্টার কথা প্রকাশ করে। তবে সেনাবাহিনীর প্রকাশিত বিবরণে শরিফুল হক ডালিমের কোনো উল্লেখ ছিল না। বাংলাদেশে এর আগে কখনোই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো ব্যর্থ অভ্যুত্থান-চেষ্টার তথ্য সেনাবাহিনী বা সরকার প্রকাশ করেনি।
সৌদি নথিতেই প্রথম দেখা যাচ্ছে যে ওই অভ্যুত্থানচেষ্টার পরিকল্পনা তিনটি দেশে বসে ঘটেছে এবং এর ‘সমন্বয়কারীর’ দায়িত্ব পালন করেছেন পঁচাত্তরের আগস্ট অভ্যুত্থানের অন্যতম কুশীলব ডালিম, যিনি ‘বর্তমানে আফগানিস্তানে রয়েছেন’ বলেও উল্লেখ করা হয়।
সামরিক বাহিনীর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরে (আইএসপিআর) যোগাযোগ করে বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তাৎক্ষণিকভাবে তারা কোনো কথা বলতে চায়নি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি বর্তমানে চিকিৎসাধীন বলে জানা গেছে। পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক উইকিলিকসের এ বিষয়টি তাঁর জানা নেই বলে কোনো মন্তব্য করেননি।
গত ১৯ জুন উইকিলিকস ওয়েবসাইটে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সৌদি আরবের গোপন নথি প্রকাশের ঘটনায় বিশ্বব্যাপী একটা হইচই পড়ে যায়। গত দুই সপ্তাহে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত অনেক নথি সৌদি সরকার ও রাজপরিবারের সদস্যদের বিব্রত করেছে। কিন্তু সৌদি আরব সরকার কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত রয়েছে। বরং সৌদি সরকার তাদের নাগরিকদের হুঁশিয়ার করে বলেছে যে তারা যেন ‘ভুয়া হতে পারে এমন সব নথিপত্র বিতরণ করা থেকে বিরত থাকে’। সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় টুইটারের মাধ্যমে দেওয়া বিবৃতিতে অবশ্য সরাসরি কোনো নথিপত্রের সত্যতা নাকচ করে দেয়নি। এর পরদিন সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘কোনো নথি বিনিময় কিংবা প্রকাশ করে রাষ্ট্রের শত্রুদের উদ্দেশ্য পূরণ করতে দেওয়া কোনো নাগরিকের উচিত হবে না। এর অনেক নথিই বিভিন্ন উপায়ে বানোয়াট হতে পারে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে, জড়িতদের শাস্তি দেওয়া হবে।’
উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে অবরুদ্ধ থাকার তিন বছর পূর্তিতে ১৯ জুন সৌদি আরব সরকারের পাঁচ লাখের বেশি গোপন নথি প্রকাশের ঘোষণা দেওয়া হয়। ফাঁস করে দেওয়া মার্কিন নথি-সংবলিত উইকিলিকস ওয়েবসাইটে ওই দিন সৌদি প্রশাসনের প্রায় ৬১ হাজার গোপন নথি প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ-সংক্রান্ত কিছু নথির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে।
প্রথম আলোর খুঁজে পাওয়া ঢাকার সৌদি দূতাবাসের স্মারক নং ২১৮/৫/৫-৩২৬ তাং ২৪ রবিউল আউয়াল ১৪৩৩ তারবার্তাটিতে এক মাস আগে পাঠানো আরও দুটি বার্তা (‘অতিগোপনীয়’ চিহ্নিত স্মারক নং ৫/৫/৬৫০৭৭ তাং ২৬/২/১৪৩৩ এবং স্মারক নং ২১৮/৫/৫/২২৮ তাং ২/৩/১৪৩৩) উল্লেখ রয়েছে যা পাওয়া যায়নি। ওই তারবার্তায় দূতাবাস মিডিয়ার বরাতে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ জন কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালায়, যার লক্ষ্য ছিল সেনাপ্রধানসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো। এই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা হয়েছিল হংকং, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায়।
ওই সৌদি নথিতে বলা হয়, ‘এ অভ্যুত্থানের সমন্বয়কারী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার দায়ে অভিযুক্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা শরিফুল হক ডালিম এবং হংকংয়ে বসবাসরত একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ইশরাক আহমেদ ওই কাজে অর্থায়ন করেন এবং অভিযোগ রয়েছে যে তিনি নিষিদ্ধঘোষিত হিযবুত তাহ্রীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সামরিক কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে সরকার এই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়।’
এরপর ওই নথিতেই বলা হয় যে ‘সৌদি দূতাবাস মনে করে অভ্যুত্থানচেষ্টা খুব সীমিত আকারে ছিল। কিন্তু সরকার এ ঘটনাকে তার পক্ষে প্রচারণার জন্য কাজে লাগিয়েছে এবং বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার দলকে এ ঘটনায় অভিযুক্ত করছে। কিন্তু দূতাবাস মনে করে এই অভিযোগ সত্য নয়।’
২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ রাজ্জাক আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য প্রকাশ করেছিলেন যে ১৬ জন ইসলামি উগ্রপন্থী সেনা কর্মকর্তা ২০১১ সালের ডিসেম্বরে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উৎখাতের চক্রান্ত করেছিলেন, কিন্তু তাঁদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে। এর আগের বছরের (২০১১) ১৩ ডিসেম্বর এ পরিকল্পনা সেনাবাহিনী জানতে পারে। এরপর ঘটনা তদন্তে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মিলে প্রথমে পাঁচটি, পরে আরও ছয়টিসহ মোট ১১টি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়। আদালত মোট ৭৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ তদন্ত করে ও তাঁদের জবানবন্দি গ্রহণ করে। শেষ পর্যন্ত একজন মেজর জেনারেল, একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলসহ ১৫ কর্মকর্তাকে বিচারের মুখোমুখি করে।
ওই সময় অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে দুজন অবসরপ্রাপ্ত এবং ১৩ জন কর্মরত কর্মকর্তা ছিলেন। অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে আটজন বিভিন্ন সময় ফৌজদারি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এসব জবানবন্দিতে তাঁরা ঘটনার সঙ্গে নিজে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন এবং বিভিন্ন কর্মকর্তার নাম বলেন। এসব জবানবন্দি ও সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে পরে কয়েকজন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন ধরনের সাজা দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার পর মেজর জেনারেল পদের কর্মকর্তাকে স্বাভাবিক অবসর দেওয়া হয় এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের ২১ জানুয়ারি গণভবনে এক মতবিনিময় সভায় খালেদা জিয়াকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘তিনি বলেছিলেন ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। এখন তাঁর কথার অর্থ বোঝা গেল এবং এর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।’ পরদিনই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনীকে বিতর্কিত করার অপপ্রয়াসের অংশ হিসেবে সরকার বিরোধী দলের দিকে ইঙ্গিত করছে।’ সেনাসদরের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাসুদ রাজ্জাক চট্টগ্রামে দেওয়া খালেদা জিয়ার মন্তব্যের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দল সেনাবাহিনীতে গুমের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করে, যা সেনাবাহিনীসহ সচেতন নাগরিকের মধ্যে উসকানিমূলক বিতর্কের সৃষ্টি করে।’ মির্জা ফখরুল এর উত্তরে বলেছিলেন, সেনাসদরের কিছু কটাক্ষপূর্ণ মন্তব্য রাজনৈতিক রঙে রঞ্জিত। ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রচারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’
সৌদি দূতাবাস তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল, ‘সরকার ওই অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টার সঙ্গে ব্রিটেনে বসবাসরত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমিরের ছেলে লোকমান আল আজমিকেও অভিযুক্ত করেছে। সরকার আরও প্রচার করেছে যে এই অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত সামরিক কর্মকর্তাগণ কট্টর ইসলামপন্থী। মনে হয় সরকার এই অপবাদ দিয়ে ইসলামি কট্টরপন্থী লোকজনকে অপসারণের মাধ্যমে সেনাবাহিনী শুদ্ধকরণে ব্যবহার করবে।’
ওই অভ্যুত্থানে জড়িতদের পরিচয় সম্পর্কে সেনাসদরের মুখপাত্র ‘ধর্মান্ধের অনুভূতি’ এবং ‘ধর্মীয় অনুশাসন পালনে হঠাৎ অতিমাত্রায় কট্টর’ বলে উল্লেখ এবং তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ২০১২ সালের ২০ জানুয়ারি এ ঘটনার সঙ্গে ‘বিএনপি-জামায়াত জোটেরও সংশ্লিষ্টতা’ রয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন।
ওই সৌদি নথিতে উল্লেখ রয়েছে যে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে এবং ভারত এ জন্য বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানকেও অভিযুক্ত করেছে।’ এই নথিটির এর পরের অংশ পাওয়া যায়নি। কিন্তু তৎকালীন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদ আল ফয়সাল (বর্তমানে তিনি বাদশাহর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা) এই নথিটিই হিজরি ১৪৩৩ সনের ২৭ রবিউল আউয়াল তৎকালীন সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহর নজরে এনেছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত এক পৃষ্ঠার ‘একটি বিশেষ গোপনীয় পত্র’ থেকে দেখা যায়, ওই নথিতে তারেক প্রসঙ্গের পরে দূতাবাসের মূল্যায়ন হিসেবে লেখা আছে, ‘এই বিষয়ে বেগম খালেদা জিয়ার দল ও তাঁর ছেলে এবং জামায়াতে ইসলামীকে অভিযুক্ত করা যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো দেখা যায়নি যে বিরোধী দল বিশেষ করে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া সরকার পতনের জন্য কখনো সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে বিরোধী দল যখন ভালো করেই জানে যে সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্ব শেখ হাসিনা সরকারের অনুগত।’ সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই চিঠির অনুলিপি সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধানকেও দিয়েছিলেন।
এই বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেনাবাহিনী স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী। তাদের অবশ্যই বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। সৌদি নথিতে ওই ঘটনা সম্পর্কে তাদের সরকারের যে মনোভাবের ইঙ্গিত পাচ্ছি, তাতে বাস্তবতারই প্রতিফলন ঘটেছে।’
উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা যায় এই অভ্যুত্থানচেষ্টা বিষয়ে পাকিস্তানে সৌদি আরবের ইসলামাবাদের দূতাবাস তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি কূটনৈতিক নোট (নং-৩/১/৭১২১ তাং-৭-৩-১৪৩৩ হিজরি) পাঠিয়েছিল। ওই নোটে বলা হয় যে ‘অধিকাংশ পাকিস্তানি মনে করে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের ক্রীড়নক হিসেবে তাঁর দেশে ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন এবং গত সপ্তাহের অভ্যুত্থানচেষ্টাবিষয়ক প্রচারণার উদ্দেশ্য ছিল এর সঙ্গে জড়িয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেই সমস্ত কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করা, যাঁরা বাংলাদেশের সামরিক ও বেসামরিক বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করছিলেন। উপরন্তু শেখ হাসিনা এই অভ্যুত্থানের ঘটনাকে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তাঁর যারা বিরোধী রয়েছে, তাদের শায়েস্তা করতেও একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন।’
No comments