বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি কি পরিত্যক্ত by ড. তারেক শামসুর রেহমান
এক
সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি যথেষ্ট গুরুত্ব
পেয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এই পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তেমন কোনো
কথাবার্তা শোনা যায় না। এমনকি সরকার প্রধান কিংবা পররাষ্ট্র মন্ত্রীর
বক্তব্যেও এটা প্রমাণিত হয়নি যে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে
বেশ কিছু দূর এগিয়ে গেছে। বলতে গেলে চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামালেই
(২০০১-২০০৬) বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করে এবং তা
বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার
পররাষ্ট্রনীতিতে পূর্বমুখিতার কথা বলে বাংলাদেশের জন্য নতুন একটি সম্ভাবনার
দ্বার উন্মোচন করেছিলেন। বাংলাদেশের গত ৪৪ বছরের পররাষ্ট্রনীতিতে পূর্ব
দিগন্তের দেশগুলো ছিল উপেক্ষিত। বিশেষ করে মিয়ানমার কিংবা থাইল্যান্ডের মতো
দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার কোনো বড় উদ্যোগ অতীতে লক্ষ্য করা যায়নি।
পূর্বমুখী নীতি বলতে সাধারণত দক্ষিণ পূর্ব ও প্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে
সম্পর্ক উন্নয়ন, জোরদার ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্যোগকে বোঝায়। এটি
ছিল অনেকটা উপেক্ষিত। যেমন বলা যেতে পারে সিঙ্গাপুরের কথা। ১৯৭৩ সালে
সিঙ্গাপুর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো
বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশটি সফর করেছিলেন। এরপর ২০০৪
সালে সিঙ্গাপুরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোহ চোক টং বাংলাদেশে এসেছিলেন।
এরপর থেকে দেশ দুটির মাঝে উচ্চ পর্যায়ে তেমন একটা সফর বিনিময় হয়নি। তবে
বেগম জিয়া ২০০৫ সালে সিঙ্গাপুর সফর করেছিলেন। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আমাদের
সম্পর্কের একটা গুরুত্ব আছে। সিঙ্গাপুর কর্তৃক প্রস্তাবিত আমেড-৮ এ
বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী এশিয়া মিডিল
ইস্ট ডায়লগ-৮ (আমেড-৮) এর প্রস্তাব করেছিলেন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া,
থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, মিসর, জর্ডান, কুয়েত এবং বাহরাইনের সমন্বয়ে
প্রস্তাবিত এই ফোরামের লক্ষ্য হবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় এবং
পারস্পরিক উন্নয়নের জন্য একে অপরকে সাহায্য করা। পরবর্তীতে চীনের উদ্যোগে ও
ভারতের সমর্থনে নতুন একটি অর্থনৈতিক জোট বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও
মিয়ানমার) গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপর নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় শোনা
গেল বিসিআই’র (ভুটান, বাংলাদেশ ভারত-সাতবোন রাজ্য ও নেপাল) কথা। এগুলো সবই
আঞ্চলিক সহযোগিতা। তবে এর মাঝে বিসিআইএম’র গুরুত্ব অনেক বেশি। ২০০৩ সালে
চীনের প্রস্তাবিত উদ্যোগই পরবর্তীতে বিসিআইএম নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। মজার
ব্যাপার ভারত এ ব্যাপারে আগ্রহী হওয়ার পরেই এই বিসিআইএম জোটের ধারণা
শক্তিশালী হয়। এই জোটটি কার্যকরী হলে কুনমিং (ইউনান প্রদেশের রাজধানী) থেকে
সড়ক পথে বাংলাদেশে ও ভারতেও আসা যাবে এবং পণ্য আনা নেয়া করা যাবে। এর ফলে
চীনা পণ্যের দামও কমে যাবে।
দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালের মধ্যে আসিয়ানে মুক্তবাজার সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য প্রবেশাধিকারের পথ সহজ হবে। বিসিআইএম’র আওতায় কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক হবে। তিনটি রুটে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারত সংযুক্ত হবে। নর্থ রুটে কুনমিং থেকে মিয়ানমারের মিয়াতকিহা হয়ে ভারতের লিডো পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। এই রুটে বাংলাদেশ সংযুক্ত হবে না। এই রুটটি অনেক কঠিন। সাউথ রুটে ইউনান থেকে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র বন্দর সোনাদিয়া পর্যন্ত সংযুক্ত ছিল। কুনমিং মান্দালয় (মিয়ানমার) ও এওয়ে (মিয়ানমার) হয়ে এই রুটটি চট্টগ্রামে প্রবেশ করবে। পরে ঢাকা হয়ে কলকাতা যাবে। এখন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মিত না হওয়ায় (ভারতের আপত্তির কারণে) এই প্রস্তাবিত রুটটির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। তৃতীয় প্রস্তাবিত রুটটি হচ্ছে মিডল রুট। এই রুটটি ভালো এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটাই প্রাচীন সিল্ক রুট। কুনমিং বামো-লেসহিয়ো-টামু (মিয়ানমার), ইমফল (ভারত)-সিলেট-ঢাকা ও কলকাতা হচ্ছে এই রুট, যা কীনা কেটুকে নামেও পরিচিত। অর্থাৎ কুনমিং থেকে কলকাতা। অনেকের স্মরণ থাকার কথা এই রুটে (২৮০০ কিলোমিটার) একটি মোটর র্যালি (২০১৩) চালু হয়েছিল। এই জোটের সম্ভাবনা ছিল বিশাল। কেননা এই চারটি দেশের (বিসিআইএম) রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাস সম্পদ (মিয়ানমার), রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত), রয়েছে শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টর, রয়েছে বিশাল অব্যবহৃত জমি (মিয়ানমার) এবং সমুদ্র বন্দর (বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার)। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে আগামীতে যদি বিসিআইএম জোটকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়। আঞ্চলিক অর্থনীতি তো বটেই, বিশ্ব অর্থনীতিকে অনেক অংশে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এই জোট। এই চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কিনা বিশ্ব জিডিপির ১০ ভাগ। ১৯৯১ সালে বিসিআইএম’র অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যেখানে ১.২ মিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১১ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৯০.২১ মিলিয়ন ডলারে। ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন স্কয়ার কিলোমিটার এলাকা আর ৪৪০ মিলিয়ন মানুষের বাস এই বিসিআইএম জোটভুক্ত দেশগুলোতে। পূর্বে রয়েছে কুনমিং আর পশ্চিমে কলকাতা। ভারত এ জোটের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল এ কারণে যে এতে করে আগামী দিনে ভারতের আসিয়ানের সদস্যপদ পেতে সহজ হয়। ভারত ২০০৭ সালে আসিয়ানের সঙ্গে যুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ইতোমধ্যে ভারত আসিয়ানের ‘ডায়লগ পার্টনার’ এর মর্যাদা লাভ করেছে (বাংলাদেশের অবস্থান আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামে)। ‘ডালগ পার্টনার’ এর পরবর্তী ধাপ হচ্ছে পূর্ণ সদস্য। তাই ভারতের আগ্রহ ছিল, যাতে করে ভারত তার পণ্য নিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা গ্রহণ করে আসিয়ান বাজারে প্রবেশ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি সরকার এই বিসিআইএম নিয়ে আদৌ এগিয়ে যাবে কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। তার আগ্রহ বেশি বিবিআইএন জোট নিয়ে। ফলে বিসিআইএম জোট নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ্য করেছি ভারত মহাসাগরে প্রভাব বলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীন এক ধরনের সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি, নৌ তৎপরতা এবং জিবুতিতে একটি নৌ ঘাঁটি স্থাপনের উদ্যোগ, এমনকি হামবানতোতায় চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। ফলে শ্রীলংকায় সরকার পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এমনকি ভারত মহাসাগরভুক্ত সিসিলি, মরিশাসে ভারত নৌ ঘাঁটি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জেন পিং ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এর যে মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, তাতে ৬০ দেশকে তিনি চীনের প্রভাব বিস্তারের আওতায় আনতে চান। ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোও এর মাঝে আছে। এটা সেই পুরনো ‘সিল্ক রোড’ এরই আধুনিক সংস্করণ। ভারত এতে উদ্বিগ্ন। ফলে ভারত তার সেই পুরনো ‘কটন রুট’ নিয়েই চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে চীন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হলেও এই প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা দেশ দুটির মাঝে এক আস্থাহীনতার সৃষ্টি করবে। এতে করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও প্রভাবিত হতে বাধ্য। তাই বিসিআইএম জোট নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হলেও এ অঞ্চলে ভারতীয় কর্তৃত্ব বাড়বে। চীনের প্রভাব এর মাঝ দিয়ে সংকুচিত হবে। তাই খুব স্পষ্ট করেই বলা যায় বিসিআইএম জোটের বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখানে চীনের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বাড়বে, এটাই মনে করেন ভারতীয় নীতি-নির্ধারকরা। ভারতীয় স্বার্থ ক্ষুণœ হয় এমন কোনো সিদ্ধান্তে যাবে না ভারত। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বিসিআইএম জোট তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে। দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশে ভারতের প্রভাব বাড়ছে। আগামীতে এ অঞ্চলের তিনটি দেশ (ভুটান, নেপাল ও বাংলাদেশ) ভারতের ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হবে। বিশেষ করে জ্বালানি ও বাণিজ্য নির্ভরতা এই দেশগুলোকে ভারতমুখী করে তুলবে। আর এ ক্ষেত্রে ভারতের স্ট্র্যাটেজি হবে বিবিআইএন জোটকে গুরুত্ব দেয়া এবং বিসিআইএমকে নিষ্ক্রিয় করা। এতে করে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, এ প্রশ্ন এখন উঠেছে। বিবিআইএন’র গুরুত্ব যেমনি রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে বিসিআইএম এরও গুরুত্ব। এমনকি আমেড-৮ কেও অস্বীকার করা যায় না।
বাংলাদেশের বিপুল জ্বালানি এবং পানি সমস্যার সমাধান করতে হলে বিবিআইএন জোটকে গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা এ অঞ্চলে বিশাল এক জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে। শুধুমাত্র ভারতের সাত বোন রাজ্যে ৭০ হাজার মেগাটাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। ভুটান ও নেপালেও রয়েছে বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনা ভারত এখন দ্বিপাক্ষিকভাবে ব্যবহার করছে, যেখানে বাংলাদেশের দাবি উপেক্ষিত ছিল। একই কথা প্রযোজ্য পানি জলাধারের মাধ্যমে সংরক্ষণের একটি সম্ভাবনার ক্ষেত্রেও। শুষ্ক মৌসুমে ভারতের যেমনি পানির প্রয়োজন, ঠিক তেমনি প্রয়োজন আমাদেরও। এ ক্ষেত্রে বর্ষার সময় পানি ধরে রেখে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। এমনকি বাংলাদেশ যে গঙ্গা ব্যারাজ করতে চাচ্ছে এ ক্ষেত্রেও ভারতের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। রাজবাড়ীর পাংশা থেকে ভারতের সীমান্তের পাংখ্যা পর্যন্ত ১৬৫ কিলোমিটার এলাকায় জলাধার নির্মাণ করা যায়। যাতে করে বছরে ২৫ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সমস্যা হচ্ছে ভারত এ বিষয়টি দেখছে দ্বিপাক্ষিকতার আলোকে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির এপ্রোচটা ভিন্ন বলেই মনে হয়। তিনি বাংলাদেশে এসেও বলে গেলেন সবাইকে নিয়েই তিনি চলতে চান। তাই একটা প্রশ্ন থাকলই যে, বিবিআইএন জোটটি না শেষ পর্যন্ত একটি দ্বিপাক্ষিক জোটে পরিণত হয়। যেখানে ভারতের স্বার্থ বেশি! একই সঙ্গে আমরা যদি বিসিআইএম জোটের দিকে তাকাই যা এখনো পূর্র্ণভাবে আত্মপ্রকাশ করেনি, তাহলে দেখব এতে করে বাংলাদেশের স্বার্থ অনেক বেশি। এর মাধ্যমে কুনমিং-কক্সবাজার প্রস্তাবিত সড়কটি তৈরি শেষ হবে। সড়ক পথে চীনা পণ্য এ দেশে আসবে। ফলে চীনা পণ্যের দাম কমবে। এই জোটের মাধ্যমে পূর্বের দিকে আমাদের পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হবে। আসিয়ানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরো জোরদার হবে। আসিয়ান রেজিওনাল ফোরাম থেকে আমাদের সদস্যপদ ভারতের মতো আসিয়ান ডায়ালগ পার্টনারে উন্নীত হতে পারে। এতে করে ভবিষ্যতে আসিয়ানের পূর্ণ সদস্যপদ পেতেও আমাদের সুবিধা হবে, যা ভারত এখন চাচ্ছে। উপরন্তু আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে আগামী ৫ বছরের মধ্যে যে শুল্কমুক্ত বাজার সৃষ্টি হচ্ছে, সেখানে শুল্কমুক্তভাবে আমাদের পণ্যের প্রবেশাধিকার সহজ হবে। অন্যদিকে আমেড-৮ এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমনি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে, অন্যদিকে তেমনি বিশ্বে বাংলাদেশ যে একটি সহনীয় ইসলাম (মডারেট ইসলাম) ধারণ করে, এই ধারণা আরো শক্তিশালী হবে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা হবে গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর।
বর্তমান সরকারের আমলে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কিছুটা ভারতের দিকে ঝুঁকে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে না, এটাই প্রত্যাশা করি। ভুলে গেলে চলবে না এই পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি সরাসরিভাবে জড়িত।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশ-বিদেশের রাজনীতির বিশ্লেষক
দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালের মধ্যে আসিয়ানে মুক্তবাজার সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য প্রবেশাধিকারের পথ সহজ হবে। বিসিআইএম’র আওতায় কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক হবে। তিনটি রুটে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারত সংযুক্ত হবে। নর্থ রুটে কুনমিং থেকে মিয়ানমারের মিয়াতকিহা হয়ে ভারতের লিডো পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। এই রুটে বাংলাদেশ সংযুক্ত হবে না। এই রুটটি অনেক কঠিন। সাউথ রুটে ইউনান থেকে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র বন্দর সোনাদিয়া পর্যন্ত সংযুক্ত ছিল। কুনমিং মান্দালয় (মিয়ানমার) ও এওয়ে (মিয়ানমার) হয়ে এই রুটটি চট্টগ্রামে প্রবেশ করবে। পরে ঢাকা হয়ে কলকাতা যাবে। এখন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মিত না হওয়ায় (ভারতের আপত্তির কারণে) এই প্রস্তাবিত রুটটির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। তৃতীয় প্রস্তাবিত রুটটি হচ্ছে মিডল রুট। এই রুটটি ভালো এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটাই প্রাচীন সিল্ক রুট। কুনমিং বামো-লেসহিয়ো-টামু (মিয়ানমার), ইমফল (ভারত)-সিলেট-ঢাকা ও কলকাতা হচ্ছে এই রুট, যা কীনা কেটুকে নামেও পরিচিত। অর্থাৎ কুনমিং থেকে কলকাতা। অনেকের স্মরণ থাকার কথা এই রুটে (২৮০০ কিলোমিটার) একটি মোটর র্যালি (২০১৩) চালু হয়েছিল। এই জোটের সম্ভাবনা ছিল বিশাল। কেননা এই চারটি দেশের (বিসিআইএম) রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাস সম্পদ (মিয়ানমার), রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত), রয়েছে শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টর, রয়েছে বিশাল অব্যবহৃত জমি (মিয়ানমার) এবং সমুদ্র বন্দর (বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার)। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে আগামীতে যদি বিসিআইএম জোটকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়। আঞ্চলিক অর্থনীতি তো বটেই, বিশ্ব অর্থনীতিকে অনেক অংশে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এই জোট। এই চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কিনা বিশ্ব জিডিপির ১০ ভাগ। ১৯৯১ সালে বিসিআইএম’র অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যেখানে ১.২ মিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১১ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৯০.২১ মিলিয়ন ডলারে। ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন স্কয়ার কিলোমিটার এলাকা আর ৪৪০ মিলিয়ন মানুষের বাস এই বিসিআইএম জোটভুক্ত দেশগুলোতে। পূর্বে রয়েছে কুনমিং আর পশ্চিমে কলকাতা। ভারত এ জোটের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল এ কারণে যে এতে করে আগামী দিনে ভারতের আসিয়ানের সদস্যপদ পেতে সহজ হয়। ভারত ২০০৭ সালে আসিয়ানের সঙ্গে যুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ইতোমধ্যে ভারত আসিয়ানের ‘ডায়লগ পার্টনার’ এর মর্যাদা লাভ করেছে (বাংলাদেশের অবস্থান আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামে)। ‘ডালগ পার্টনার’ এর পরবর্তী ধাপ হচ্ছে পূর্ণ সদস্য। তাই ভারতের আগ্রহ ছিল, যাতে করে ভারত তার পণ্য নিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা গ্রহণ করে আসিয়ান বাজারে প্রবেশ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি সরকার এই বিসিআইএম নিয়ে আদৌ এগিয়ে যাবে কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। তার আগ্রহ বেশি বিবিআইএন জোট নিয়ে। ফলে বিসিআইএম জোট নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ্য করেছি ভারত মহাসাগরে প্রভাব বলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীন এক ধরনের সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি, নৌ তৎপরতা এবং জিবুতিতে একটি নৌ ঘাঁটি স্থাপনের উদ্যোগ, এমনকি হামবানতোতায় চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। ফলে শ্রীলংকায় সরকার পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এমনকি ভারত মহাসাগরভুক্ত সিসিলি, মরিশাসে ভারত নৌ ঘাঁটি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জেন পিং ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এর যে মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, তাতে ৬০ দেশকে তিনি চীনের প্রভাব বিস্তারের আওতায় আনতে চান। ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোও এর মাঝে আছে। এটা সেই পুরনো ‘সিল্ক রোড’ এরই আধুনিক সংস্করণ। ভারত এতে উদ্বিগ্ন। ফলে ভারত তার সেই পুরনো ‘কটন রুট’ নিয়েই চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে চীন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হলেও এই প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা দেশ দুটির মাঝে এক আস্থাহীনতার সৃষ্টি করবে। এতে করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও প্রভাবিত হতে বাধ্য। তাই বিসিআইএম জোট নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হলেও এ অঞ্চলে ভারতীয় কর্তৃত্ব বাড়বে। চীনের প্রভাব এর মাঝ দিয়ে সংকুচিত হবে। তাই খুব স্পষ্ট করেই বলা যায় বিসিআইএম জোটের বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখানে চীনের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বাড়বে, এটাই মনে করেন ভারতীয় নীতি-নির্ধারকরা। ভারতীয় স্বার্থ ক্ষুণœ হয় এমন কোনো সিদ্ধান্তে যাবে না ভারত। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বিসিআইএম জোট তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে। দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশে ভারতের প্রভাব বাড়ছে। আগামীতে এ অঞ্চলের তিনটি দেশ (ভুটান, নেপাল ও বাংলাদেশ) ভারতের ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হবে। বিশেষ করে জ্বালানি ও বাণিজ্য নির্ভরতা এই দেশগুলোকে ভারতমুখী করে তুলবে। আর এ ক্ষেত্রে ভারতের স্ট্র্যাটেজি হবে বিবিআইএন জোটকে গুরুত্ব দেয়া এবং বিসিআইএমকে নিষ্ক্রিয় করা। এতে করে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, এ প্রশ্ন এখন উঠেছে। বিবিআইএন’র গুরুত্ব যেমনি রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে বিসিআইএম এরও গুরুত্ব। এমনকি আমেড-৮ কেও অস্বীকার করা যায় না।
বাংলাদেশের বিপুল জ্বালানি এবং পানি সমস্যার সমাধান করতে হলে বিবিআইএন জোটকে গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা এ অঞ্চলে বিশাল এক জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে। শুধুমাত্র ভারতের সাত বোন রাজ্যে ৭০ হাজার মেগাটাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। ভুটান ও নেপালেও রয়েছে বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনা ভারত এখন দ্বিপাক্ষিকভাবে ব্যবহার করছে, যেখানে বাংলাদেশের দাবি উপেক্ষিত ছিল। একই কথা প্রযোজ্য পানি জলাধারের মাধ্যমে সংরক্ষণের একটি সম্ভাবনার ক্ষেত্রেও। শুষ্ক মৌসুমে ভারতের যেমনি পানির প্রয়োজন, ঠিক তেমনি প্রয়োজন আমাদেরও। এ ক্ষেত্রে বর্ষার সময় পানি ধরে রেখে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। এমনকি বাংলাদেশ যে গঙ্গা ব্যারাজ করতে চাচ্ছে এ ক্ষেত্রেও ভারতের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। রাজবাড়ীর পাংশা থেকে ভারতের সীমান্তের পাংখ্যা পর্যন্ত ১৬৫ কিলোমিটার এলাকায় জলাধার নির্মাণ করা যায়। যাতে করে বছরে ২৫ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সমস্যা হচ্ছে ভারত এ বিষয়টি দেখছে দ্বিপাক্ষিকতার আলোকে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির এপ্রোচটা ভিন্ন বলেই মনে হয়। তিনি বাংলাদেশে এসেও বলে গেলেন সবাইকে নিয়েই তিনি চলতে চান। তাই একটা প্রশ্ন থাকলই যে, বিবিআইএন জোটটি না শেষ পর্যন্ত একটি দ্বিপাক্ষিক জোটে পরিণত হয়। যেখানে ভারতের স্বার্থ বেশি! একই সঙ্গে আমরা যদি বিসিআইএম জোটের দিকে তাকাই যা এখনো পূর্র্ণভাবে আত্মপ্রকাশ করেনি, তাহলে দেখব এতে করে বাংলাদেশের স্বার্থ অনেক বেশি। এর মাধ্যমে কুনমিং-কক্সবাজার প্রস্তাবিত সড়কটি তৈরি শেষ হবে। সড়ক পথে চীনা পণ্য এ দেশে আসবে। ফলে চীনা পণ্যের দাম কমবে। এই জোটের মাধ্যমে পূর্বের দিকে আমাদের পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হবে। আসিয়ানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরো জোরদার হবে। আসিয়ান রেজিওনাল ফোরাম থেকে আমাদের সদস্যপদ ভারতের মতো আসিয়ান ডায়ালগ পার্টনারে উন্নীত হতে পারে। এতে করে ভবিষ্যতে আসিয়ানের পূর্ণ সদস্যপদ পেতেও আমাদের সুবিধা হবে, যা ভারত এখন চাচ্ছে। উপরন্তু আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে আগামী ৫ বছরের মধ্যে যে শুল্কমুক্ত বাজার সৃষ্টি হচ্ছে, সেখানে শুল্কমুক্তভাবে আমাদের পণ্যের প্রবেশাধিকার সহজ হবে। অন্যদিকে আমেড-৮ এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমনি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে, অন্যদিকে তেমনি বিশ্বে বাংলাদেশ যে একটি সহনীয় ইসলাম (মডারেট ইসলাম) ধারণ করে, এই ধারণা আরো শক্তিশালী হবে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা হবে গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর।
বর্তমান সরকারের আমলে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কিছুটা ভারতের দিকে ঝুঁকে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে না, এটাই প্রত্যাশা করি। ভুলে গেলে চলবে না এই পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি সরাসরিভাবে জড়িত।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশ-বিদেশের রাজনীতির বিশ্লেষক
No comments