ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে হবে by মইনুল ইসলাম
১৫
জুন ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে যান
চলাচলে রূপরেখা চুক্তি সই হয়। এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে দেশগুলোর মধ্যে
যাত্রী ও পণ্যবাহী যান চলাচল করতে পারবে। এতে বাংলাদেশ কী আর্থিক সুবিধা
পেতে পারে এবং কী ধরনের ঝুঁকি দেখা দিতে পারে, সে সম্পর্কে বলেছেন
অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম
বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান—এই চার দেশের মধ্যে যাত্রী ও পণ্যবাহী যান চলাচলের যে রূপরেখা চুক্তি সই হলো, তা উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি বলে আমি মনে করি। চুক্তিটি ছয় মাস পর থেকে কার্যকর হবে। তবে এতে ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে যেসব অনুমতি ও শর্তের কথা বলা হয়েছে, তাতে মানুষ নিরুৎসাহিত হতে পারে। তবে পণ্যবাহী যান চলাচলের ক্ষেত্রে এটি আকর্ষণীয় হতে পারে। সেটা আবার নির্ভর করবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর প্রয়োজনীয়তার ওপর।
এই চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি বিষয় খেয়াল করতে হবে। ভারতীয় ট্রাক বাংলাদেশের ট্রাকের তুলনায় অনেক বড়। আমাদের ট্রাকগুলোর ভার বহনের ক্ষমতা যেখানে সর্বোচ্চ ১২ টন, সেখানে ভারতীয় ট্রাক বা লরির ভারবহন ক্ষমতা ১৭ টন। ফলে বাংলাদেশের সড়কে ১২ টনের চেয়ে বেশি ভারবাহী ট্রাক চলাচল করলে তা টিকবে না, ভেঙে যাবে। সে কারণে সরাসরি ভারতীয় এই বিশালাকৃতির লরিগুলো বাংলাদেশের সড়কে চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। চুক্তিতে এ বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়েছে বলে দেখিনি। আবার চুক্তি যেহেতু কার্যকর হবে ছয় মাস পর, এর মধ্যে বাংলাদেশের সড়কগুলো সংস্কার করা যেতে পারে। সেটা সম্ভব না হলে বাংলাদেশের ট্রাক ভারতীয় পণ্য এক সীমান্ত থেকে আরেক সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। সেটা হলে বাংলাদেশের ট্রাকমালিকেরাও উপকৃত হবেন।
এদিকে নৌ-চলাচল তো আরও আগেই শুরু হয়ে গেছে। এখন আমাদের এর টোল/মাশুল নির্ধারণ করতে হবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ট্রানজিটের টোল নির্ধারণে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধি অনুসরণ করা হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধিতে কী আছে, আমরা তা জানি না। ফলে সেটার ওপর মন্তব্য করা ঠিক হবে না। কিন্তু মাশুল নির্ধারণে একটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। শিলিগুড়ির পার্বত্য এলাকার চিকেন নেক দিয়ে সেভেন সিস্টার বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য নিতে গেলে ভারতের অনেক খরচ হয়। তারা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সেটা করলে পরিবহন খরচ কমে যাবে। ফলে ভারতের পণ্য পরিবহনে অনেক সাশ্রয় হবে। এই সাশ্রয়ের একটা অংশ বাংলাদেশের পাওয়া উচিত। অর্থাৎ এ থেকে শুধু ভারতই লাভবান হলে সেটা ন্যায্য বিচার হবে না। ট্রানজিটের টোল নির্ধারণে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। তারা তাদের মতামতও দিয়েছিল। কিন্তু সরকার সেটা গ্রহণ করেছে না করেনি, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু বলেনি। প্রখ্যাত সড়ক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ প্রয়াত এম রহমতউল্লাহ এই টাস্কফোর্সে কাজ করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ট্রানজিট পেলে ভারতের যে ব্যয় সাশ্রয় হবে, তার অর্ধেক বাংলাদেশের দাবি করা উচিত।
এখন কথা হচ্ছে, এই মাশুল নির্ধারণের পাশাপাশি বাংলাদেশকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ শুরু করতে হবে। নৌপরিবহন তো শুরু হয়ে গেছে। ফলে আশুগঞ্জ নদীবন্দরের উন্নয়নকাজ শুরু করে দিতে হবে। একই সঙ্গে আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কের সংস্কারকাজও শুরু করতে হবে। ফেনী নদীর ওপর ত্রিপুরার সাব্রুম থেকে বাংলাদেশের রামগড় পর্যন্ত একটি সেতু নির্মাণের কথা রয়েছে, সেটি যত শিগগির সম্ভব শেষ করতে হবে। এটি তেমন বড় সেতু নয়, আর ভারতই এর খরচ বহন করবে। ওদিকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ হয়ে রামগড় পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণ হওয়ার কথা। সেটির কাজ এখনো শুরু হয়নি। এটি হয়ে গেলে চট্টগ্রাম থেকে রামগড় পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করা যাবে, আর সেখান থেকে অনায়াসে তা ত্রিপুরায় নেওয়া যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা আমরা পুরোপুরি ব্যবহার করছি না, এর ২০ শতাংশ অব্যবহৃত থেকে যায়। ফলে প্রাথমিকভাবে এই বন্দরের সেভেন সিস্টারগামী পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু পুরোদমে এই পণ্য পরিবহন শুরু হয়ে গেলে সেটা আর সম্ভব হবে না। তখন কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে আরও কিছু জেটি নির্মাণ করতে হবে। এ বছরই কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা। সেটির কাজ দ্রুত শুরু করে দিতে হবে। এদিকে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক করলেও ভারতের আপত্তির মুখে বাংলাদেশ সেখান থেকে সরে এসেছে। কিন্তু সেটা করা উচিত হয়নি। এই বন্দর হলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমত। এই গভীর সমুদ্রবন্দর আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। ফলে সেটি নির্মাণের ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে হবে।
উন্নয়নের ক্ষেত্রে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকল্প নেই। এ সত্যটি আমাদের বুঝতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশই অন্য দেশকে ট্রানজিট দেয়। ফলে আমরাও তা দিতে পারি, তবে সে ক্ষেত্রে নিজেদের ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে হবে।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান—এই চার দেশের মধ্যে যাত্রী ও পণ্যবাহী যান চলাচলের যে রূপরেখা চুক্তি সই হলো, তা উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি বলে আমি মনে করি। চুক্তিটি ছয় মাস পর থেকে কার্যকর হবে। তবে এতে ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে যেসব অনুমতি ও শর্তের কথা বলা হয়েছে, তাতে মানুষ নিরুৎসাহিত হতে পারে। তবে পণ্যবাহী যান চলাচলের ক্ষেত্রে এটি আকর্ষণীয় হতে পারে। সেটা আবার নির্ভর করবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর প্রয়োজনীয়তার ওপর।
এই চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি বিষয় খেয়াল করতে হবে। ভারতীয় ট্রাক বাংলাদেশের ট্রাকের তুলনায় অনেক বড়। আমাদের ট্রাকগুলোর ভার বহনের ক্ষমতা যেখানে সর্বোচ্চ ১২ টন, সেখানে ভারতীয় ট্রাক বা লরির ভারবহন ক্ষমতা ১৭ টন। ফলে বাংলাদেশের সড়কে ১২ টনের চেয়ে বেশি ভারবাহী ট্রাক চলাচল করলে তা টিকবে না, ভেঙে যাবে। সে কারণে সরাসরি ভারতীয় এই বিশালাকৃতির লরিগুলো বাংলাদেশের সড়কে চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। চুক্তিতে এ বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়েছে বলে দেখিনি। আবার চুক্তি যেহেতু কার্যকর হবে ছয় মাস পর, এর মধ্যে বাংলাদেশের সড়কগুলো সংস্কার করা যেতে পারে। সেটা সম্ভব না হলে বাংলাদেশের ট্রাক ভারতীয় পণ্য এক সীমান্ত থেকে আরেক সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। সেটা হলে বাংলাদেশের ট্রাকমালিকেরাও উপকৃত হবেন।
এদিকে নৌ-চলাচল তো আরও আগেই শুরু হয়ে গেছে। এখন আমাদের এর টোল/মাশুল নির্ধারণ করতে হবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ট্রানজিটের টোল নির্ধারণে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধি অনুসরণ করা হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধিতে কী আছে, আমরা তা জানি না। ফলে সেটার ওপর মন্তব্য করা ঠিক হবে না। কিন্তু মাশুল নির্ধারণে একটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। শিলিগুড়ির পার্বত্য এলাকার চিকেন নেক দিয়ে সেভেন সিস্টার বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য নিতে গেলে ভারতের অনেক খরচ হয়। তারা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সেটা করলে পরিবহন খরচ কমে যাবে। ফলে ভারতের পণ্য পরিবহনে অনেক সাশ্রয় হবে। এই সাশ্রয়ের একটা অংশ বাংলাদেশের পাওয়া উচিত। অর্থাৎ এ থেকে শুধু ভারতই লাভবান হলে সেটা ন্যায্য বিচার হবে না। ট্রানজিটের টোল নির্ধারণে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। তারা তাদের মতামতও দিয়েছিল। কিন্তু সরকার সেটা গ্রহণ করেছে না করেনি, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু বলেনি। প্রখ্যাত সড়ক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ প্রয়াত এম রহমতউল্লাহ এই টাস্কফোর্সে কাজ করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ট্রানজিট পেলে ভারতের যে ব্যয় সাশ্রয় হবে, তার অর্ধেক বাংলাদেশের দাবি করা উচিত।
এখন কথা হচ্ছে, এই মাশুল নির্ধারণের পাশাপাশি বাংলাদেশকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ শুরু করতে হবে। নৌপরিবহন তো শুরু হয়ে গেছে। ফলে আশুগঞ্জ নদীবন্দরের উন্নয়নকাজ শুরু করে দিতে হবে। একই সঙ্গে আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কের সংস্কারকাজও শুরু করতে হবে। ফেনী নদীর ওপর ত্রিপুরার সাব্রুম থেকে বাংলাদেশের রামগড় পর্যন্ত একটি সেতু নির্মাণের কথা রয়েছে, সেটি যত শিগগির সম্ভব শেষ করতে হবে। এটি তেমন বড় সেতু নয়, আর ভারতই এর খরচ বহন করবে। ওদিকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ হয়ে রামগড় পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণ হওয়ার কথা। সেটির কাজ এখনো শুরু হয়নি। এটি হয়ে গেলে চট্টগ্রাম থেকে রামগড় পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করা যাবে, আর সেখান থেকে অনায়াসে তা ত্রিপুরায় নেওয়া যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা আমরা পুরোপুরি ব্যবহার করছি না, এর ২০ শতাংশ অব্যবহৃত থেকে যায়। ফলে প্রাথমিকভাবে এই বন্দরের সেভেন সিস্টারগামী পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু পুরোদমে এই পণ্য পরিবহন শুরু হয়ে গেলে সেটা আর সম্ভব হবে না। তখন কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে আরও কিছু জেটি নির্মাণ করতে হবে। এ বছরই কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা। সেটির কাজ দ্রুত শুরু করে দিতে হবে। এদিকে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক করলেও ভারতের আপত্তির মুখে বাংলাদেশ সেখান থেকে সরে এসেছে। কিন্তু সেটা করা উচিত হয়নি। এই বন্দর হলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমত। এই গভীর সমুদ্রবন্দর আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। ফলে সেটি নির্মাণের ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে হবে।
উন্নয়নের ক্ষেত্রে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকল্প নেই। এ সত্যটি আমাদের বুঝতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশই অন্য দেশকে ট্রানজিট দেয়। ফলে আমরাও তা দিতে পারি, তবে সে ক্ষেত্রে নিজেদের ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে হবে।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments