সাতক্ষীরার হঠাৎ ‘চমক’ by হিলাল ফয়েজী
এমন
‘চমক’-এর জন্য এই ভূভারতে ক’জন প্রস্তুত ছিলেন জানি না। অন্তত ‘ভুবনজয়ী’
ভারতীয় ক্রিকেট বাহিনী এবং পৃথিবীর ক্রিকেটপাগল জনতার কেউ যে ছিলেন না,
সেটা নিয়ে কেউ তর্ক করবেন কি? পৃথিবীতে আনুষ্ঠানিকভাবে শিশুর বয়স ১৮। তা
আঠারো থেকে উনিশ মাত্র এক বছরের ব্যবধান। উনিশ বছর বয়সী কাউকে তাই ‘বালক’
বললে বেমানান হবে কি? বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা এক জনপদ। সুন্দরবন ছোঁওয়া।
ঝোঁপঝাড়। লতাগুল্মে আকীর্ণ। সেই অরণ্যানী থেকে হঠাৎ এক মানবরূপী
ব্যাঘ্রবালক যে এমনিভাবে লাফিয়ে পড়ে ক্রিকেট বিশ্বের সব হিসাব-কিতাব
উল্টেপাল্টে লণ্ডভণ্ড করে দেবে, সেজন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেন কি? না, কেউ না।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সংশ্লিষ্ট কোচ বরং সাবধানী। এক্ষুনি মূল একাদশে
নিতে উৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু ওই সাতক্ষীরার কাছাকাছি নড়াইল। সেই নড়াইলের
এক্সপ্রেস পরিচয়ে ভূষিত, শরীরে বড় বড় ছয়টি শল্য অপারেশন হয়েছে যার, তিনিই
এখন বাংলাদেশ দলের কাণ্ডারি, কাপ্তান। তিনি মনে করলেন, সাতক্ষীরার সুন্দরবন
জনপদের মানবব্যাঘ্র বালকটিকে দলে নিতেই হবে। তাহলেই ঘটে যেতে পারে মোক্ষম
ব্যাপারটি। তা সেই মাশরাফিও কি ঠিক এতটাই ভাবতে পেরেছিলেন? এমন সরল, সহজ,
নির্দোষ-হাস্যময় এক সাধারণ চেহারার ছিপছিপে বাঙালি বালক, মুস্তাফিজ যার
নাম, সব হিসাব উল্টে দিল সে। এই চমকনায়ক যা ঘটিয়ে দিল তার যে অনেক অনেক
প্রভাব।
এখনকার পৃথিবীতে র্যাংকিং, রেটিং ইত্যাদির গাণিতিক হিসাব গিজগিজ করছে। আগামী ২০১৭ সালে র্যাংকিংয়ে দুনিয়ার প্রথম আটটি ক্রিকেট দেশ ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশ এবং জিম্বাবুয়ের মতো ‘পুঁচকে’ দল এসব প্রতিযোগিতায় ঢুকে অযথা সময় অপচয় ঘটায়। অতএব ওদের দূরে রাখ। ক্রিকেটের বিশ্ব পরিচালকদের হিসাবের নাক আইফেল টাওয়ারের চেয়েও উঁচু। সেই হিসাবের নাকটিকে সহজ-সরলভাবে হাসতে হাসতে থ্যাবড়া করে দিল সাতক্ষীরার ‘পুঁচকে’ মানব ব্যাঘ্র শাবকটি। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যে পাকিস্তান ক্রিকেট দলে আমাদের বাংলাপ্রান্তের একজন খেলোয়াড়েরও ঠাঁই মেলেনি ওদের ‘অনৈতিক-অনৈসলামিক’ বৈষম্যনীতির জন্য, আজ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পৃথিবীর ৭ নম্বর লাকি দেশটি বাংলাদেশ। আর পাকিস্তান? অমন দুর্ধর্ষ, দুরন্ত, দুর্বার, গ্ল্যামারভরা দলটি কিনা ৯ নম্বরে নেমে নট হয়ে গেছে। জীবনে প্রথম একদিনের টেস্টে খেলতে নেমেই উনিশ বছরের বালকটি পাকিস্তানেরই বিশ্ব ক্রিকেট কিংবদন্তি ওয়াসিম আকরামের ভাবমূর্তির কিঞ্চিৎ ভাব আদায় করে নিয়েছে হেসে খেলে। একদিনের খেলার রাজা ভারত তাতেই কুপোকাত। আর প্রভাবে তার চেয়েও বেশি কুপোকাত পাকিস্তান। জীবনে একদিনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দু’দুটি খেলায় সাতক্ষীরার চমক বালকটি মোট ১১টি উইকেট নিয়ে ক্রিকেট রাজাধিরাজ ভারতকে প্রায় নাভিঃশ্বাস তুলে দিল। ক্রিকেট হিসাবের কম্পিউটারগুলোতে সাতক্ষীরার গ্রাম-বাংলার একটি ছেলে ঢুকে পড়ল অনেকটা নব যুবরাজের মতো।
না, হে পৃথিবীর মানুষ, এসবে বিপুল আনন্দ পাচ্ছি, কিন্তু এতটুকু দাম্ভিকতার দূষণ-রসায়নে বিনষ্ট হচ্ছি না। এতকাল স্টার, হিরো, সেলিব্রিটি সব খুঁজে পেতাম হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোনো খানে। বিগত কয়েক বছর ধরে একজন সাকিব আল হাসান ওই র্যাংকিং, রেটিং সূত্রে ক্রিকেট বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার হয়ে আমাদের নিজস্ব তারকাতৃষা বেশ মিটিয়েছেন, মেটাচ্ছেন। যদি এমন তারকা এতকালের বড় আটটি কোনো দেশের হতো, তবে বিশ্ব ক্রিকেট মিডিয়ার ঢোলক বাদ্যে কর্ণ পর্দা আমাদের বিপন্ন হয়ে পড়ত। আজ ক্রিকেট বিশ্বে সাকিবের পর আমাদের বিস্ময় বালক মুস্তাফিজ। ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ জয়। এ লেখাটি যখন লিখছি, কয়েক ঘণ্টা পর তৃতীয় খেলাটি হওয়ার কথা। এর আগে আমরা নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং জিম্বাবুয়েকে ‘বাংলাওয়াশ’ শব্দটি উপহার দিয়েছিলাম। ক’দিন আগে সেই ওয়াশ হলো পাকিস্তান এদেশে এসে। আর তাতেই ওদের কপাল ফাটল। পয়েন্ট কমতেই থাকল। বাংলা-ভারত খেলার পর বাংলাদেশের পয়েন্ট আরো বাড়ল। এখন এতকালের ‘পুঁচকে’ বাংলাদেশ যথাসম্ভব ছয় নম্বরে ঠাঁই নিয়ে চ্যাম্পিয়ন ট্রফির প্রস্তুতিতে কফি-টফি তৃপ্তিতে প্লাবিত হবে। এমন গর্ব আর গৌরব বোধে এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের পথ চলা। গরিবের গৌরব আর গর্ববোধকে বাঁকা চোখে দেখে নাক উঁচু এলিট ধনীরা। এই অধম অক্ষর-উৎপাতকারীর লেখায় ‘আবেগ আর উচ্ছ্বাস’ খুঁজে পাচ্ছেন প্রকৃত লিখিয়েরা? তা যদি পানও, কিছুই করার নেই। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সেরা ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। সেসময়কার একজন সৌভাগ্যবান তরুণ হিসেবে ওই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার সুবাদে ‘সাহসী যৌবন’ এর প্রকৃত প্রতীক কত শত সহযোদ্ধাকে দেখেছি গ্রামবাংলার পথে-প্রান্তরে। এখনকার কিছু নাক উঁচু তরুণকে দেখি ‘একাত্তর’ নিয়ে কথা উঠলেই বিরক্তি বিবমিষায় বিচ্ছিরি চেহারা করে ফেলেন। তা হে নাসিকাকুঞ্চনের জ্ঞান-ভানের একালের বঙ্গপুঙ্গব, আপনাদের প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়নি, আপনাদের বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে যাচাই-বাছাই করার সুযোগ হয়নি, আপনারা ‘বুঝবার পারেন নাই।’ একাত্তরে সামরিক জ্ঞানে কার্যত নিরক্ষর বাঙালি গাঁও গেরামের তরুণেরা মাত্র দু’এক মাসের প্রশিক্ষণেই সাহসের মিশেলে কেমন দুর্ধর্ষ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল সামরিক বর্ণমালা আয়ত্ত করে।
বিশেষত গাঁও-গেরামের কিষান জোয়ানেরা পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পৃথিবীর বৃহত্তম সক্রিয় বদ্বীপের পলিমাটিতে পৃথিবী সেরা কৃষিসভ্যতা গড়ে তুলেছে। হাজার বছরের বিদ্রোহ-শ্রম-কারুকার্যে গড়ে তুলেছে এক মহান সাংস্কৃতিক বাংলা পাদপীঠ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রান্তরে দুর্দান্ত সাহসী প্রান্তরে দেখেছি কিষান জোয়ান জহিরুল হক দুদু মিয়ার দুনিয়া কাঁপানো ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। শত্রু তাকে ধরে ফেলে গুলিতে বিদীর্ণ করছে। দুদু মিয়া জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও বাংলার চিরায়ত জয়ের কথা আকাশ-বাতাস, মাটির জমিন আর শস্যের মাঠকে জানিয়ে দিয়ে গেছে। এমন রতœভাণ্ডার দেখেছি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের কাছে বেতিয়ারা রণাঙ্গনে একাত্তরের ১১ নভেম্বর রাতে।
বাংলার এই রত্ন ঐতিহ্যের প্রতি গভীর আস্থা আছে বলেই তো এই ষাটোর্ধ্ব প্রহরেও শত বৈরী বাস্তবতাকে অতিক্রম করে গৌরব বন্দনায় মেতে উঠি। কেউ কেউ এর ভেতর ‘আবেগ আর উচ্ছ্বাস’ খুঁজে পেতে পারেন। পরিমিত পরিমাণে হলেও ‘আবেগ’ থাকা প্রয়োজন। না হলে রিমোট কন্ট্রোলের রোবট হয়ে প্রাণের স্পর্শ জোগান দেয়ার ক্ষমতা রহিত হয়ে যাবেন। আমি সাতক্ষীরার বিস্ময় বালকের গভীরে মুক্তিযুদ্ধের সাহসী রতেœর সন্ধান পেয়ে গেছি। আমি বাংলার ইতিহাসের প্রাণভোমরাকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছি একালের ক্রিকেট প্রতিযোগিতার ধুন্ধুমার ভুবনে। এটুকু অন্তত পেতে দিন হে নাসিকাকুঞ্চনের ‘বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ’ মহাজনেরা! না, সত্যি বলছি, না, এই গৌরববোধের সঙ্গে এতটুকু দম্ভের মিশেল ঘটাচ্ছি না। দাম্ভিকতার বিনাশবুদ্ধি যেন আমাদের পেয়ে না বসে, আমাদের আনন্দ-উল্লাসবোধে যেন সামান্যতম বিদ্বেষবোধও না থাকে। এবারকার বাংলা-ভারত খেলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ফেসবুকে একটি মজাদার নির্দোষ কৌতুকের মতো বাক্য পেলাম: ‘ধনী হয়ে যাবে গরিব। বিরাট হয়ে যাবে ছোট।’ কেননা তামিম আর সৌম্য পিটিয়ে চলেছে বেধড়কভাবে। সৌম্য সরকার যে এমন ব্যাটে-বলে নির্মম ও নিষ্ঠুর, তা এমনিতে বোঝা মুশকিল। অমন মজাদার কৌতুক যে বাস্তবে এভাবে ফলে যাবে, ভাবিনি। ভারত দলের প্রধান রাজা সত্যিই নিঃস্ব হয়ে গেল এক সাতক্ষীরার বিস্ময় বালকের তোপেই। ধনী হয়ে গেল গরিব। না, ক্রিকেটীয় জয়-পরাজয়ের সামান্যতায় এ কথা নয়। গোটা ক্রিকেট বিশ্বের এক নম্বর ক্যাপ্টেন হিসেবে যার মহিমা, ‘ক্যাপ্টেনকুল’ হিসেবে যার প্রধান ভাবমূর্তি, সেই কিনা হয়ে গেল ‘ক্যাপ্টেন মাথা গরম পোলা’। একটি সামান্য ছোকড়ার তোপের গোলায় যখন ভারত শিবির তছনছ-লণ্ডভণ্ড, তখন ওই বালকটিকে ওভাবে আঘাত করার মতো বুদ্ধি-বিবেচনা রহিত হয়ে গেল এককালের ঝাড়খন্ডের নাম না জানা ক্রিকেটারটি। এখন যিনি বিশ্ব ক্রিকেট এলিট। প্রযুক্তিতে ধরা পড়ে গেছে, কী বীভৎস আক্রোশে তিনি সাতক্ষীরার জীর্ণ-শীর্ণ পুঁচকে বালকটিকে কনুইয়ের ধাক্কায় গোখরোর বিষ ঢালছেন। ঘটনাটিতে ধনী আসলেই ভাবমূর্তিতে গরিব হয়ে গেছেন। বাংলার মানুষ তাকে খুবই ভালো জানতেন। ১৬ কোটি বাঙালির চোখে আজ তিনিই বরং ব্যবহারিকভাবে পুঁচকে হয়ে গেছেন। এদিকে সাতক্ষীরার সরল সাধারণ মুস্তা মিয়ার তোপের গোলায় পৃথিবীর সেরা ক্যাপ্টেনটির কাপ্তানগিরি পদটি যায় যায় প্রায়। ফেসবুকে ভালো-মন্দ হাজারো পোস্টিং চলছে। তার ভেতর বুদ্ধিদীপ্ত-মজাদার পোস্টিং দেখলে মন প্রাণ ভরে যায়। তবে বিদ্বেষের-বিভেদের সূক্ষ্ম খেলোয়াড়রাও এসব পোস্টিংয়ে ঢুকে গেছেন মতলবী মানসিকতায়। সেটি ভারতেও, বাংলাদেশেও।
এদিকে পাকিস্তানের এক প্রাক্তন তারকা সরফরাজ মিয়া পত্রিকার শিরোনামে আসতে প্রায়শ মন্তব্য ক্যারিকেচার করে থাকেন। এবার বলেছেন, চ্যাম্পিয়ন ট্রফি থেকে পাকিস্তানকে হটিয়ে দিতে ভারত এই পরাজয় বরণের কাণ্ড ঘটিয়ে দিল ঢাকার মিরপুরে, ‘বাংলার বাঘ’ স্টেডিয়ামে। উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিদ্বেষ-বিভাজন-বিভেদের কাল যে কবে ফুরাবে? হায়রে নির্বোধ সরফরাজ, ভারত তার দীর্ঘকায় নাসিকা কেটে পাকিস্তানের ক্রিকেট যাত্রা বন্ধ করবে, এমন কথা নির্বোধ উন্মাদও বিশ্বাস করতে চাইবে কী? কিন্তু এদিকে দেখুন, আরেকটি প্রাণবন্ত ফেসবুক পোস্টিং : ‘সফরে আসার আগে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ ক্রিকেটের সিলেবাসটি ভালোভাবে আয়ত্ত করে ভালো ছাত্রের প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল। কিন্তু মিরপুরের শেরেবাংলা মাঠের পরীক্ষার হলে ঢুকে দেখে প্রশ্ন এসেছে আউট অব সিলেবাস।’ বস্তুত ওই ছিলা বাঁশেই ঘটে গেল এমন কাণ্ড। সাতক্ষীরার মুস্তা রহস্য তাৎক্ষণিকভাবে ভেদ করতে পারেনি ওরা। পরের খেলায়ও সে রহস্য আরো জটিল হয়ে উঠেছে। দেখা যাক, আজ বিকেলে কী করে ওরা! মুস্তা-সিলেবাস কতটুকু আয়ত্ত হলো ওদের!
এতটুকু দম্ভ তো নয়ই, উল্লাসেও ফেটে পড়ছি না বরং ভাবছি শঙ্কার কথা। এই বিজয় সংহত করতে পারব কিনা, আমাদের অগ্রগতি ধরে রাখতে পারব কিনা, সেটাই একালের ভাষায় ‘চ্যালেঞ্জিং’। এবার একটু আসতেই হয় আসল এবং তিক্ত কথায়। পাঠক নিশ্চয়ই ভুলে যাননি বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘আশার ফুল’ তরুণটির কথা। সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে যার ছিল বিশ্বরেকর্ড। কলকাতায় অনেকের কাছে শুনেছি, ওর কিছু কিছু মার নাকি শচীনকেও অতিক্রম করে যেত। সেই আশরাফুল ‘প্রলোভন’ নামক এক ঘাতক বোলারের কাছে চিরতরে হেরে গেছে। আমাদের সাতক্ষীরার মুস্তাফিজের আদর্শ বোলার হচ্ছেন পাকিস্তানের মোহাম্মদ আমির। যে আমির ক্রিকেটীয় জীবনের সূচনা-সাফল্যের দিনগুলোতেই ‘ফকির’ হয়ে গেছে ওই প্রলোভন-ফাঁদে পড়ে। এই ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব দক্ষিণ আফ্রিকার হ্যান্সি ক্রনিয়ে। আর কব্জির মোচড়ে চার-ছক্কার ক্রিকেটার ভারতের দীর্ঘ সময়ের ক্রিকেট ক্যাপ্টেন আজহারউদ্দিন? গ্ল্যামারে-প্রলোভনে-বদনামে এমন বিশাল অর্জনের লোকটি বর্জ্যে পরিণত হয়ে গেল। মিষ্টি হাসির ভয়ঙ্কর ক্রিকেটার অজয় জাদেজা? মাঠ থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে গেল লোভের পিচ্ছিলতায়, কমেন্ট্রি বক্সেও আজকাল ঠাঁই মেলে না।
ক্রিকেট দুনিয়ার র্যাংকিং, রেটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেটিং। এই বেটিং-জুয়ার ছোবলে প্রাণ হারিয়েছে পাকিস্তানি কোচও। এককালের কতিপয়ের অভিজাত-পঙ্ক্তির সামন্ত খেলাটিকে পুঁজিবাদ খাস দরবার থেকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছে আম-জনতার দরবারে। ক্রিকেট আর এন্টারনেইনমেন্টকে মিলিয়ে এখন ‘ক্রিকেটেইনমেন্ট’ চালু করা হয়েছে। পুঁজিবাদ চায় এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ভোক্তা। ক্রিকেট প্রান্তরে তাই ভোক্তা সংখ্যা বিচারে অস্ট্রেলিয়াকেও ডজ দিয়ে ১২০ কোটি জনতার ভারতের কদর। এখন যে কত বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য। আইপিএল, বিপিএল, এসপিএল, বিগ ব্যাশ প্রভৃতি কত যে কাণ্ড। এখন শাহরুখ খান, প্রীতি জিনতা, শিল্পা শেঠি, ম্যাডাম আম্বানি সবাই এই বিনোদন বাণিজ্যে। আইপিএলকে কেন্দ্র করে সুপার চালু মাল ললিত মোদি আর সুপারড্যাশিং শ্রীনিবাসন মাফিয়াগিরির যে হিংস্র লড়াইয়ে নেমেছেন, তার যে কী পরিণতি কোন দিকে যায়! ওখানেও পাতানো আঁতাতী মৌতাত। বাংলাদেশের বিপিএল তো আমাদের ‘আশার ফুল’ ছেলেটিকে ক্রিকেটবৃন্ত থেকে বলতে গেলে ছিঁড়ে ছুড়েই ফেলে দিল। অন্যরা মাঠে খেলে, এই প্রলোভন-এতিনটি চ্যানেলে চ্যানেলে খুচরা মন্তব্য বিশ্লেষণ করে। বড় বড় মাফিয়ার তেমন অসুবিধা হয় না, মালপানির জোরে ওরা বেঁচে যায়। মরে ওই সব খুচরা-ফুচরা গরিবের পোলা। সংকট আছে আরেকখানে। এসব সাধারণ বালকেরা যখন হঠাৎ ‘অসাধারণ’ হয়ে যায়, তখন জীবনের বিনোদনের নানা আকর্ষণে ওরা সেলিব্রিটি-ফাঁদে পড়ে যায়। মেহরাব অপি, হান্নান সরকার অকালে শেষ হয়ে গেল। রুবেল বেঁচে গেল কোনোক্রমে। অতএব মুস্তাফিজের কোচ জিম্বাবুইয়ের হিথ স্ট্র্রিক যখন বলেন, মুস্তাফিজ সম্ভাবনাময়, তবে তার পরিচর্যা চালাতে হবে সঠিকভাবে। নিশ্চয়ই বিসিবি যথাযথ নজর রাখবে। ক্রিকেট সহযোদ্ধারা নজর রাখবেন। কোচবৃন্দ নজর রাখবেন। আমাদের আদরের মুস্তা যেন জগতের কোনো প্রকার স্থূল আকর্ষণে ওর অভাবনীয় অর্জনকে ম্লান না করে। এগিয়ে চলো মুস্তাফিজ। এগিয়ে চলো বাংলাদেশ। এগিয়ে চলো শান্তিময় পৃথিবী। সাতক্ষীরার মতো অজানা জনপদ থেকে জীবনের সব প্রান্তরে বেরিয়ে আসুক অজস্র মুস্তাফিজ। চমকিত হোক ভুবন।
লেখক: রম্যলেখক ও গবেষক
এখনকার পৃথিবীতে র্যাংকিং, রেটিং ইত্যাদির গাণিতিক হিসাব গিজগিজ করছে। আগামী ২০১৭ সালে র্যাংকিংয়ে দুনিয়ার প্রথম আটটি ক্রিকেট দেশ ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশ এবং জিম্বাবুয়ের মতো ‘পুঁচকে’ দল এসব প্রতিযোগিতায় ঢুকে অযথা সময় অপচয় ঘটায়। অতএব ওদের দূরে রাখ। ক্রিকেটের বিশ্ব পরিচালকদের হিসাবের নাক আইফেল টাওয়ারের চেয়েও উঁচু। সেই হিসাবের নাকটিকে সহজ-সরলভাবে হাসতে হাসতে থ্যাবড়া করে দিল সাতক্ষীরার ‘পুঁচকে’ মানব ব্যাঘ্র শাবকটি। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যে পাকিস্তান ক্রিকেট দলে আমাদের বাংলাপ্রান্তের একজন খেলোয়াড়েরও ঠাঁই মেলেনি ওদের ‘অনৈতিক-অনৈসলামিক’ বৈষম্যনীতির জন্য, আজ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পৃথিবীর ৭ নম্বর লাকি দেশটি বাংলাদেশ। আর পাকিস্তান? অমন দুর্ধর্ষ, দুরন্ত, দুর্বার, গ্ল্যামারভরা দলটি কিনা ৯ নম্বরে নেমে নট হয়ে গেছে। জীবনে প্রথম একদিনের টেস্টে খেলতে নেমেই উনিশ বছরের বালকটি পাকিস্তানেরই বিশ্ব ক্রিকেট কিংবদন্তি ওয়াসিম আকরামের ভাবমূর্তির কিঞ্চিৎ ভাব আদায় করে নিয়েছে হেসে খেলে। একদিনের খেলার রাজা ভারত তাতেই কুপোকাত। আর প্রভাবে তার চেয়েও বেশি কুপোকাত পাকিস্তান। জীবনে একদিনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দু’দুটি খেলায় সাতক্ষীরার চমক বালকটি মোট ১১টি উইকেট নিয়ে ক্রিকেট রাজাধিরাজ ভারতকে প্রায় নাভিঃশ্বাস তুলে দিল। ক্রিকেট হিসাবের কম্পিউটারগুলোতে সাতক্ষীরার গ্রাম-বাংলার একটি ছেলে ঢুকে পড়ল অনেকটা নব যুবরাজের মতো।
না, হে পৃথিবীর মানুষ, এসবে বিপুল আনন্দ পাচ্ছি, কিন্তু এতটুকু দাম্ভিকতার দূষণ-রসায়নে বিনষ্ট হচ্ছি না। এতকাল স্টার, হিরো, সেলিব্রিটি সব খুঁজে পেতাম হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোনো খানে। বিগত কয়েক বছর ধরে একজন সাকিব আল হাসান ওই র্যাংকিং, রেটিং সূত্রে ক্রিকেট বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার হয়ে আমাদের নিজস্ব তারকাতৃষা বেশ মিটিয়েছেন, মেটাচ্ছেন। যদি এমন তারকা এতকালের বড় আটটি কোনো দেশের হতো, তবে বিশ্ব ক্রিকেট মিডিয়ার ঢোলক বাদ্যে কর্ণ পর্দা আমাদের বিপন্ন হয়ে পড়ত। আজ ক্রিকেট বিশ্বে সাকিবের পর আমাদের বিস্ময় বালক মুস্তাফিজ। ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ জয়। এ লেখাটি যখন লিখছি, কয়েক ঘণ্টা পর তৃতীয় খেলাটি হওয়ার কথা। এর আগে আমরা নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং জিম্বাবুয়েকে ‘বাংলাওয়াশ’ শব্দটি উপহার দিয়েছিলাম। ক’দিন আগে সেই ওয়াশ হলো পাকিস্তান এদেশে এসে। আর তাতেই ওদের কপাল ফাটল। পয়েন্ট কমতেই থাকল। বাংলা-ভারত খেলার পর বাংলাদেশের পয়েন্ট আরো বাড়ল। এখন এতকালের ‘পুঁচকে’ বাংলাদেশ যথাসম্ভব ছয় নম্বরে ঠাঁই নিয়ে চ্যাম্পিয়ন ট্রফির প্রস্তুতিতে কফি-টফি তৃপ্তিতে প্লাবিত হবে। এমন গর্ব আর গৌরব বোধে এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের পথ চলা। গরিবের গৌরব আর গর্ববোধকে বাঁকা চোখে দেখে নাক উঁচু এলিট ধনীরা। এই অধম অক্ষর-উৎপাতকারীর লেখায় ‘আবেগ আর উচ্ছ্বাস’ খুঁজে পাচ্ছেন প্রকৃত লিখিয়েরা? তা যদি পানও, কিছুই করার নেই। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সেরা ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। সেসময়কার একজন সৌভাগ্যবান তরুণ হিসেবে ওই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার সুবাদে ‘সাহসী যৌবন’ এর প্রকৃত প্রতীক কত শত সহযোদ্ধাকে দেখেছি গ্রামবাংলার পথে-প্রান্তরে। এখনকার কিছু নাক উঁচু তরুণকে দেখি ‘একাত্তর’ নিয়ে কথা উঠলেই বিরক্তি বিবমিষায় বিচ্ছিরি চেহারা করে ফেলেন। তা হে নাসিকাকুঞ্চনের জ্ঞান-ভানের একালের বঙ্গপুঙ্গব, আপনাদের প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়নি, আপনাদের বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে যাচাই-বাছাই করার সুযোগ হয়নি, আপনারা ‘বুঝবার পারেন নাই।’ একাত্তরে সামরিক জ্ঞানে কার্যত নিরক্ষর বাঙালি গাঁও গেরামের তরুণেরা মাত্র দু’এক মাসের প্রশিক্ষণেই সাহসের মিশেলে কেমন দুর্ধর্ষ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল সামরিক বর্ণমালা আয়ত্ত করে।
বিশেষত গাঁও-গেরামের কিষান জোয়ানেরা পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পৃথিবীর বৃহত্তম সক্রিয় বদ্বীপের পলিমাটিতে পৃথিবী সেরা কৃষিসভ্যতা গড়ে তুলেছে। হাজার বছরের বিদ্রোহ-শ্রম-কারুকার্যে গড়ে তুলেছে এক মহান সাংস্কৃতিক বাংলা পাদপীঠ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রান্তরে দুর্দান্ত সাহসী প্রান্তরে দেখেছি কিষান জোয়ান জহিরুল হক দুদু মিয়ার দুনিয়া কাঁপানো ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। শত্রু তাকে ধরে ফেলে গুলিতে বিদীর্ণ করছে। দুদু মিয়া জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও বাংলার চিরায়ত জয়ের কথা আকাশ-বাতাস, মাটির জমিন আর শস্যের মাঠকে জানিয়ে দিয়ে গেছে। এমন রতœভাণ্ডার দেখেছি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের কাছে বেতিয়ারা রণাঙ্গনে একাত্তরের ১১ নভেম্বর রাতে।
বাংলার এই রত্ন ঐতিহ্যের প্রতি গভীর আস্থা আছে বলেই তো এই ষাটোর্ধ্ব প্রহরেও শত বৈরী বাস্তবতাকে অতিক্রম করে গৌরব বন্দনায় মেতে উঠি। কেউ কেউ এর ভেতর ‘আবেগ আর উচ্ছ্বাস’ খুঁজে পেতে পারেন। পরিমিত পরিমাণে হলেও ‘আবেগ’ থাকা প্রয়োজন। না হলে রিমোট কন্ট্রোলের রোবট হয়ে প্রাণের স্পর্শ জোগান দেয়ার ক্ষমতা রহিত হয়ে যাবেন। আমি সাতক্ষীরার বিস্ময় বালকের গভীরে মুক্তিযুদ্ধের সাহসী রতেœর সন্ধান পেয়ে গেছি। আমি বাংলার ইতিহাসের প্রাণভোমরাকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছি একালের ক্রিকেট প্রতিযোগিতার ধুন্ধুমার ভুবনে। এটুকু অন্তত পেতে দিন হে নাসিকাকুঞ্চনের ‘বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ’ মহাজনেরা! না, সত্যি বলছি, না, এই গৌরববোধের সঙ্গে এতটুকু দম্ভের মিশেল ঘটাচ্ছি না। দাম্ভিকতার বিনাশবুদ্ধি যেন আমাদের পেয়ে না বসে, আমাদের আনন্দ-উল্লাসবোধে যেন সামান্যতম বিদ্বেষবোধও না থাকে। এবারকার বাংলা-ভারত খেলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ফেসবুকে একটি মজাদার নির্দোষ কৌতুকের মতো বাক্য পেলাম: ‘ধনী হয়ে যাবে গরিব। বিরাট হয়ে যাবে ছোট।’ কেননা তামিম আর সৌম্য পিটিয়ে চলেছে বেধড়কভাবে। সৌম্য সরকার যে এমন ব্যাটে-বলে নির্মম ও নিষ্ঠুর, তা এমনিতে বোঝা মুশকিল। অমন মজাদার কৌতুক যে বাস্তবে এভাবে ফলে যাবে, ভাবিনি। ভারত দলের প্রধান রাজা সত্যিই নিঃস্ব হয়ে গেল এক সাতক্ষীরার বিস্ময় বালকের তোপেই। ধনী হয়ে গেল গরিব। না, ক্রিকেটীয় জয়-পরাজয়ের সামান্যতায় এ কথা নয়। গোটা ক্রিকেট বিশ্বের এক নম্বর ক্যাপ্টেন হিসেবে যার মহিমা, ‘ক্যাপ্টেনকুল’ হিসেবে যার প্রধান ভাবমূর্তি, সেই কিনা হয়ে গেল ‘ক্যাপ্টেন মাথা গরম পোলা’। একটি সামান্য ছোকড়ার তোপের গোলায় যখন ভারত শিবির তছনছ-লণ্ডভণ্ড, তখন ওই বালকটিকে ওভাবে আঘাত করার মতো বুদ্ধি-বিবেচনা রহিত হয়ে গেল এককালের ঝাড়খন্ডের নাম না জানা ক্রিকেটারটি। এখন যিনি বিশ্ব ক্রিকেট এলিট। প্রযুক্তিতে ধরা পড়ে গেছে, কী বীভৎস আক্রোশে তিনি সাতক্ষীরার জীর্ণ-শীর্ণ পুঁচকে বালকটিকে কনুইয়ের ধাক্কায় গোখরোর বিষ ঢালছেন। ঘটনাটিতে ধনী আসলেই ভাবমূর্তিতে গরিব হয়ে গেছেন। বাংলার মানুষ তাকে খুবই ভালো জানতেন। ১৬ কোটি বাঙালির চোখে আজ তিনিই বরং ব্যবহারিকভাবে পুঁচকে হয়ে গেছেন। এদিকে সাতক্ষীরার সরল সাধারণ মুস্তা মিয়ার তোপের গোলায় পৃথিবীর সেরা ক্যাপ্টেনটির কাপ্তানগিরি পদটি যায় যায় প্রায়। ফেসবুকে ভালো-মন্দ হাজারো পোস্টিং চলছে। তার ভেতর বুদ্ধিদীপ্ত-মজাদার পোস্টিং দেখলে মন প্রাণ ভরে যায়। তবে বিদ্বেষের-বিভেদের সূক্ষ্ম খেলোয়াড়রাও এসব পোস্টিংয়ে ঢুকে গেছেন মতলবী মানসিকতায়। সেটি ভারতেও, বাংলাদেশেও।
এদিকে পাকিস্তানের এক প্রাক্তন তারকা সরফরাজ মিয়া পত্রিকার শিরোনামে আসতে প্রায়শ মন্তব্য ক্যারিকেচার করে থাকেন। এবার বলেছেন, চ্যাম্পিয়ন ট্রফি থেকে পাকিস্তানকে হটিয়ে দিতে ভারত এই পরাজয় বরণের কাণ্ড ঘটিয়ে দিল ঢাকার মিরপুরে, ‘বাংলার বাঘ’ স্টেডিয়ামে। উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিদ্বেষ-বিভাজন-বিভেদের কাল যে কবে ফুরাবে? হায়রে নির্বোধ সরফরাজ, ভারত তার দীর্ঘকায় নাসিকা কেটে পাকিস্তানের ক্রিকেট যাত্রা বন্ধ করবে, এমন কথা নির্বোধ উন্মাদও বিশ্বাস করতে চাইবে কী? কিন্তু এদিকে দেখুন, আরেকটি প্রাণবন্ত ফেসবুক পোস্টিং : ‘সফরে আসার আগে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ ক্রিকেটের সিলেবাসটি ভালোভাবে আয়ত্ত করে ভালো ছাত্রের প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল। কিন্তু মিরপুরের শেরেবাংলা মাঠের পরীক্ষার হলে ঢুকে দেখে প্রশ্ন এসেছে আউট অব সিলেবাস।’ বস্তুত ওই ছিলা বাঁশেই ঘটে গেল এমন কাণ্ড। সাতক্ষীরার মুস্তা রহস্য তাৎক্ষণিকভাবে ভেদ করতে পারেনি ওরা। পরের খেলায়ও সে রহস্য আরো জটিল হয়ে উঠেছে। দেখা যাক, আজ বিকেলে কী করে ওরা! মুস্তা-সিলেবাস কতটুকু আয়ত্ত হলো ওদের!
এতটুকু দম্ভ তো নয়ই, উল্লাসেও ফেটে পড়ছি না বরং ভাবছি শঙ্কার কথা। এই বিজয় সংহত করতে পারব কিনা, আমাদের অগ্রগতি ধরে রাখতে পারব কিনা, সেটাই একালের ভাষায় ‘চ্যালেঞ্জিং’। এবার একটু আসতেই হয় আসল এবং তিক্ত কথায়। পাঠক নিশ্চয়ই ভুলে যাননি বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘আশার ফুল’ তরুণটির কথা। সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে যার ছিল বিশ্বরেকর্ড। কলকাতায় অনেকের কাছে শুনেছি, ওর কিছু কিছু মার নাকি শচীনকেও অতিক্রম করে যেত। সেই আশরাফুল ‘প্রলোভন’ নামক এক ঘাতক বোলারের কাছে চিরতরে হেরে গেছে। আমাদের সাতক্ষীরার মুস্তাফিজের আদর্শ বোলার হচ্ছেন পাকিস্তানের মোহাম্মদ আমির। যে আমির ক্রিকেটীয় জীবনের সূচনা-সাফল্যের দিনগুলোতেই ‘ফকির’ হয়ে গেছে ওই প্রলোভন-ফাঁদে পড়ে। এই ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব দক্ষিণ আফ্রিকার হ্যান্সি ক্রনিয়ে। আর কব্জির মোচড়ে চার-ছক্কার ক্রিকেটার ভারতের দীর্ঘ সময়ের ক্রিকেট ক্যাপ্টেন আজহারউদ্দিন? গ্ল্যামারে-প্রলোভনে-বদনামে এমন বিশাল অর্জনের লোকটি বর্জ্যে পরিণত হয়ে গেল। মিষ্টি হাসির ভয়ঙ্কর ক্রিকেটার অজয় জাদেজা? মাঠ থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে গেল লোভের পিচ্ছিলতায়, কমেন্ট্রি বক্সেও আজকাল ঠাঁই মেলে না।
ক্রিকেট দুনিয়ার র্যাংকিং, রেটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেটিং। এই বেটিং-জুয়ার ছোবলে প্রাণ হারিয়েছে পাকিস্তানি কোচও। এককালের কতিপয়ের অভিজাত-পঙ্ক্তির সামন্ত খেলাটিকে পুঁজিবাদ খাস দরবার থেকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছে আম-জনতার দরবারে। ক্রিকেট আর এন্টারনেইনমেন্টকে মিলিয়ে এখন ‘ক্রিকেটেইনমেন্ট’ চালু করা হয়েছে। পুঁজিবাদ চায় এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ভোক্তা। ক্রিকেট প্রান্তরে তাই ভোক্তা সংখ্যা বিচারে অস্ট্রেলিয়াকেও ডজ দিয়ে ১২০ কোটি জনতার ভারতের কদর। এখন যে কত বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য। আইপিএল, বিপিএল, এসপিএল, বিগ ব্যাশ প্রভৃতি কত যে কাণ্ড। এখন শাহরুখ খান, প্রীতি জিনতা, শিল্পা শেঠি, ম্যাডাম আম্বানি সবাই এই বিনোদন বাণিজ্যে। আইপিএলকে কেন্দ্র করে সুপার চালু মাল ললিত মোদি আর সুপারড্যাশিং শ্রীনিবাসন মাফিয়াগিরির যে হিংস্র লড়াইয়ে নেমেছেন, তার যে কী পরিণতি কোন দিকে যায়! ওখানেও পাতানো আঁতাতী মৌতাত। বাংলাদেশের বিপিএল তো আমাদের ‘আশার ফুল’ ছেলেটিকে ক্রিকেটবৃন্ত থেকে বলতে গেলে ছিঁড়ে ছুড়েই ফেলে দিল। অন্যরা মাঠে খেলে, এই প্রলোভন-এতিনটি চ্যানেলে চ্যানেলে খুচরা মন্তব্য বিশ্লেষণ করে। বড় বড় মাফিয়ার তেমন অসুবিধা হয় না, মালপানির জোরে ওরা বেঁচে যায়। মরে ওই সব খুচরা-ফুচরা গরিবের পোলা। সংকট আছে আরেকখানে। এসব সাধারণ বালকেরা যখন হঠাৎ ‘অসাধারণ’ হয়ে যায়, তখন জীবনের বিনোদনের নানা আকর্ষণে ওরা সেলিব্রিটি-ফাঁদে পড়ে যায়। মেহরাব অপি, হান্নান সরকার অকালে শেষ হয়ে গেল। রুবেল বেঁচে গেল কোনোক্রমে। অতএব মুস্তাফিজের কোচ জিম্বাবুইয়ের হিথ স্ট্র্রিক যখন বলেন, মুস্তাফিজ সম্ভাবনাময়, তবে তার পরিচর্যা চালাতে হবে সঠিকভাবে। নিশ্চয়ই বিসিবি যথাযথ নজর রাখবে। ক্রিকেট সহযোদ্ধারা নজর রাখবেন। কোচবৃন্দ নজর রাখবেন। আমাদের আদরের মুস্তা যেন জগতের কোনো প্রকার স্থূল আকর্ষণে ওর অভাবনীয় অর্জনকে ম্লান না করে। এগিয়ে চলো মুস্তাফিজ। এগিয়ে চলো বাংলাদেশ। এগিয়ে চলো শান্তিময় পৃথিবী। সাতক্ষীরার মতো অজানা জনপদ থেকে জীবনের সব প্রান্তরে বেরিয়ে আসুক অজস্র মুস্তাফিজ। চমকিত হোক ভুবন।
লেখক: রম্যলেখক ও গবেষক
No comments