গুলশান কার্যালয় গুলিয়ে ফেলছে বিএনপিকে by কামরুল হাসান
গুলশান
কার্যালয়মুখী আর নয়...। রাজনীতি করতে চাই। কিন্তু অপমান-অপদস্থ হতে চাই
না। এমনটাই মনোভাব বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম থেকে শুরু করে
জেলা-উপজেলা পর্যায়ের তৃণমূল নেতাকর্মীদের। খুব বেশি দরকার না হলে কিংবা
দলের চেয়ারপার্সনের ডাক না পড়লে প্রকাশ্যেই এ কার্যালয় এড়িয়ে চলেন নেতারা।
মোসাহেবী, সিন্ডিকেট, দুর্ব্যবহার আর দুর্নীতির সবকিছুই যেন এখানে
স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। তবে এবার ঘুরে দাঁড়াতে চান দলের পোড় খাওয়া
নেতারা। পরিবর্তন চান দলের সব স্তরে। তাদের এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই
শিগগিরই শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে গুলশান কার্যালয় থেকে শুরু করে দলের
প্রধান কার্যালয় নয়াপল্টন পর্যন্ত। পরিবর্তনের সুবাতাস বইয়ে দিতে চান মূল
দল থেকে অঙ্গ সংগঠনগুলোর ভেতরেও। এর জন্য দলের ভেতর গড়ে তোলা হয়েছে প্রেসার
গ্রুপ। সাবেক ছাত্রনেতাদের নিয়ে এ গ্রুপে অন্তত ২৫ জন সাবেক এমপি মিলে
দলের জন্য প্রয়োজনীয় রূপরেখাও তৈরি করছেন বলে জানা গেছে।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান ২। এই এলাকার ৮৬ নম্বর সড়কে অবস্থিত ৬ নম্বর বাড়ি। ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়ে এ বাড়িটিতেই চেয়াপার্সনের রাজনৈতিক কার্যালয় করা হয়। এর আগে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বনানীর হাওয়া ভবনে রাজনৈতিক কার্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। কিন্তু এ কার্যালয়কে কেন্দ্র করে নেতিবাচক বিতর্কের পর রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দু থেকে অনেক দূরে এবং অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান এলাকাতে ভাড়ায় এ নতুন কার্যালয় নেয়া হয়। কিন্তু শুরু থেকেই দূরত্বের কারণে নেতাকর্মীরা এ কার্যালয়মুখী হতে চান না। এর সঙ্গে উপদ্রব হিসেবে কার্যালয়ে অবস্থানরত কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের দৌরাত্ম্যে তটস্থ থাকতে হয় দলের সব স্তরের নেতাকর্মীকে।
এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও নেতাকর্মী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন বলে দলে বহুল প্রচলিত মতবাদ রয়েছে। এছাড়া কার্যালয়ের গোপন তথ্য পাচার, সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাত, টাকার বিনিময়ে বাড়তি সুবিধা প্রদানসহ নেতাকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে। এসব অনিয়মের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে তাদের দৌরাত্ম্য আরো বেড়েছে বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা। যার কারণে তারা বছরের পর বছর বহাল তবিয়তেই আছেন।
বিএনপির সিনিয়র নেতাদের দাবি, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নিরিবিলিতে রাজনৈতিক কাজ পরিচালনার জন্যই এমন জায়গায় তার কার্যালয় নেয়া হয়েছে। তবে এ সঙ্গে তারা এও স্বীকার করেন, এর ফলে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার (খালেদা জিয়া) যোগাযোগ অনেকটা কমে গেছে। এছাড়া একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে যেসব উয়িং সচল রাখার আবশ্যকতা ছিল তাও এখানে অপ্রতুল রয়েছে বলেও তারা অকপটে স্বীকার করেন।
নেতারা বলেন, এই কার্যালয়ে রাজনৈতিক চর্চার জন্য তথ্য ও গবেষণা সেল, আর্কাইভ, শক্তিশালী মিডিয়া সেলসহ আরো অনেক কিছুর অভাব বোধ করা হচ্ছে, যা খুব শিগগিরই পূরণ করা হবে বলেও তারা জানান।
বিএনপি দলীয় সূত্র জানায়, কাগজে-কলমে রাজনৈতিক কার্যালয় হলেও এখানে কর্মরত প্রায় সব অফিস কর্মকর্তা-কর্মচারী অরাজনৈতিক। ফলে তাদের অরাজনৈতিক আচার আচরণ আর দুর্নীতির কারণে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম থেকে শুরু করে তৃণমূল বিএনপি পর্যন্ত ক্ষুব্ধ। এ নিয়ে তারা একাধিকবার দলীয় ফোরামে আলাপ-আলোচনা করলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো সুফল পাওয়া যায়নি বলেও সূত্র জানায়।
তবে এবার দলের মধ্য থেকে সাবেক ছাত্রনেতারা পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করছেন। তারা দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে যেমন দল থেকে মান-অভিমানে আর বহিষ্কারের কারণে দূরে সরে যাওয়া নেতাকর্মীকে আবার দলে পুনর্বাসন করতে চাইছেন তেমনি নিষ্ক্রিয় নেতাদের সক্রিয় করাতেও উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। একইসঙ্গে দলের মৌসুমি নেতাদের কাছ থেকে দলকে রক্ষা করতেও মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
এসব নেতা জানান, দলের একটি সুবিধাবাদী গ্রুপের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে বিএনপির অনেক ডাকসাইটে নেতা এখন বাইরে রয়েছেন। এখন সময় এসেছে এই সিন্ডিকেট ভাঙার। তোষামোদির রাজনীতি শেষ করতে না পারলে একসময়ে আমাদেরও নিঃশেষ হয়ে যেতে হবে। যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দলকে পুনর্গঠন করতে হবে। আধুনিকতার ছোঁয়া সর্বত্র দিতে না পারলে দেশের সিংহভাগ তরুণ আমাদের দলকে কেন সমর্থন দেবে বলেও তারা প্রশ্ন ছুড়ে দেন।
তারা অভিযোগ করে বলেন, এখন পর্যন্ত দলের একটি কার্যকর ওয়েবসাইট নেই। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের তৃণমূল নেতাকর্মীদের আধুনিক ডাটাবেজ সংগৃহীত নেই। তথ্য ও গবেষণা সেল ও তথ্য সংগ্রহশালা নেই। শুধু নেই নেই আর নেই। এভাবে একটি দল চলতে পারে না।
প্রেসার গ্রুপের এক সদস্য জানান, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আমাদের মা। তাকে ভুল বুঝিয়ে, মাঠের প্রকৃত চিত্র আড়াল করে এতদিন অনেকে অনেক কিছু করেছেন। কিন্তু তার দুর্দিনে তাকে তারা ছেড়েও গেছেন। মাকে ফেলে যারা নিজেদের আখের গুছিয়েছেন তাদের এবার পাকড়াও করতে হবে তাদের মুখোশ উšে§াচন করতে হবে। এজন্য তারা দলের অনেক তৃণমূল নেতাকর্মীর কাছ থেকে তাদের মতামত নিচ্ছেন, যা লিখিত আকারে দলের চেয়ারপার্সনের নিকট তুলে ধরা হবে বলেও তিনি জানান।
অপর এক সদস্য জানান, বিএনপি চেয়ারপার্সন এখন সরকারি বা বিরোধী দলের প্রধান না থাকা সত্ত্বেও গুলশান কার্যালয়ে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছে যাতে নেতা-কর্মীরা তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ না করতে পারেন। তৃণমূলের অনেক নেতা গুলশান কার্যালয়ে এসে আক্ষেপ করে ফিরে যাওয়ার বহু নজির রয়েছে। দলের চেয়ারপার্সনকে একনজর দেখতে এবং মনের কথাগুলো বলার জন্যই মাঝে-মধ্যে ঢাকায় আসেন তারা। কিন্তু কার্যালয়ের ওইসব প্রভাবশালী কর্মকর্তার পাশাপাশি কিছু সিএসএফ সদস্যের দুর্ব্যবহারের কারণে মনে কষ্ট নিয়ে তাদের ফিরে যেতে হয়।
তিনি জানান, চেয়ারপার্সনের সঙ্গে দেখা করতে তাদেরও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয় ড্রইংরুমে। ওইসব প্রভাবশালী কর্মকর্তাই সর্বক্ষণ বিএনপি প্রধানকে ঘিরে রাখেন। গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকা সত্ত্বেও রাগে-অভিমানে একাধিকবার কার্যালয় ত্যাগ করার কথাও জানান তিনি।
এদিকে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, বিএনপি চেয়ারপার্সনকে অনেকটা জিম্মি করে রেখেছে গুলশান কার্যালয়ের ওইসব প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও স্টাফরা। তাদের বাইরে কোনো নেতাই নিজের মনের কথা বলতে পারেন না। আলাদাভাবে কেউ কথা বললে তার প্রতিও রুষ্ট হন ওই প্রভাবশালীরা। বেগম জিয়াকে ওই জিম্মিদশা থেকে বের করে আনতে না পারলে আগামীতে এই সরকারের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনই সফলতার মুখ দেখবে না বলেও জানান তারা।
ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা বলছেন, গুলশান কার্যালয়ের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের কারণে তৃণমূল বিএনপির আসল চিত্রও জানতে পারছেন না চেয়ারপার্সন। কমিটি কিংবা আন্দোলনের ক্ষেত্রেও নিতে পারছেন না সঠিক সিদ্ধান্ত। ওইসব কর্মকর্তার সঙ্গে যারা যোগসাজশ করে চলেন, তাদেরই গুলশান কার্যালয়ে কদর বেশি। দলের দুঃসময়ে কিংবা আন্দোলনে না থাকলেও বেগম জিয়ার সঙ্গে এখন তাদেরই বারবার দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে গোপন আঁতাতকারী এসব নেতার বিরুদ্ধে কোনো মামলা পর্যন্ত নেই। এসব কারণেই অভিমানে ক্ষুব্ধ হয়ে ত্যাগী নেতারা গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়া না ডাকলে পারতপক্ষে যাচ্ছেন না।
তারা অভিযোগ করে আরো বলেন, দেশের বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের মিডিয়া সেল বলতে কিছুই নেই। এই সেলের কর্মকর্তা সামসুদ্দিন দিদার ও শায়রুল কবির খান সংবাদকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সংবাদ মাধ্যম থেকে আড়ালেই থাকছেন চেয়ারপার্সনের প্রেস সচিব। বিভিন্ন সময়ে বিতর্কের সঙ্গে নিজের নামটি জড়িয়েছেন তার একান্ত সহকারী। গুলশান কার্যালয় থেকে উদ্ধার হওয়া তথ্য পাচার যন্ত্রের সঙ্গে তার নামটিও জড়িত রয়েছে বলে সন্দেহ নেতাকর্মীদের। দলের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত সিএসএফকে নিয়েও ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। তাদের দুর্ব্যবহারের হাত থেকে রেহাই পান না সংবাদকর্মী থেকে শুরু করে দলের অনেক নেতাকর্মীও। এছাড়া বিগত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে রাজধানীর বাংলামটরে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে সরকার সমর্থকদের হামলার ঘটনায় দলের চেয়ারপার্সনকে অরক্ষিত রেখে তারা কাপুরুষের মতো পালিয়ে যায় বলেও নেতাকর্মীরা জানান। এমনকি ওই সময়ে তাদের এক সহকর্মীকেও তারা ফেলে পালিয়ে যান বলে সরকার সমর্থকরা তাকেও পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। এছাড়া খালেদা জিয়ার গাড়িবহরের রুট সম্পর্কে দলের নেতাকর্মীরা না জানলেও ছাত্রলীগ পূর্ব পরিকল্পনামাফিক এ আক্রমণ করার সুযোগ পায় বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা। এ কারণেই গুলশান কার্যালয়ের কে কার এজেন্ট তা নিয়েও মুখরোচক আলোচনা চলছে বিএনপিতে।
গুলশান কার্যালয়ে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অর্থ-বিপত্তি নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন নেতাকর্মীরা। তারা জানান, এ কার্যালয়ে কর্মরত অনেকেরই গাড়ি-বাড়ির অভাব নেই। সামান্য অসুস্থ হলে তারা চিকিৎসার জন্য বিদেশেও পাড়ি জমান। এসব অর্থের উৎস সম্পর্কে তারা গুলশান কার্যালয়কেন্দ্রিক দুর্নীতিকেই দায়ী করছেন।
দলের প্রাণকেন্দ্র গুলশানকেন্দ্রিক এরকম অপতৎপরতা রোধ করার জন্য এবার সাবেক ছাত্রনেতাদের কাজে লাগাতে চাইছেন প্রেসার গ্রুপটি। চেয়ারপার্সনের নিরাপত্তা থেকে শুরু করে মিডিয়া সেল, তথ্য ও গবেষণা সেল, তথ্য সংগ্রহশালাতে দলের সাবেক ছাত্রনেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে দল যেমন উপকৃত হবে তেমনি তারাও রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতে পারবে বলে মনে করছেন নেতারা। এরকম একটি প্রস্তবনা নিয়ে তারা খুব শিগগির দলের চেয়ারপার্সনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন বলেও তারা উল্লেখ করেন।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান ২। এই এলাকার ৮৬ নম্বর সড়কে অবস্থিত ৬ নম্বর বাড়ি। ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়ে এ বাড়িটিতেই চেয়াপার্সনের রাজনৈতিক কার্যালয় করা হয়। এর আগে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বনানীর হাওয়া ভবনে রাজনৈতিক কার্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। কিন্তু এ কার্যালয়কে কেন্দ্র করে নেতিবাচক বিতর্কের পর রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দু থেকে অনেক দূরে এবং অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান এলাকাতে ভাড়ায় এ নতুন কার্যালয় নেয়া হয়। কিন্তু শুরু থেকেই দূরত্বের কারণে নেতাকর্মীরা এ কার্যালয়মুখী হতে চান না। এর সঙ্গে উপদ্রব হিসেবে কার্যালয়ে অবস্থানরত কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের দৌরাত্ম্যে তটস্থ থাকতে হয় দলের সব স্তরের নেতাকর্মীকে।
এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও নেতাকর্মী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন বলে দলে বহুল প্রচলিত মতবাদ রয়েছে। এছাড়া কার্যালয়ের গোপন তথ্য পাচার, সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাত, টাকার বিনিময়ে বাড়তি সুবিধা প্রদানসহ নেতাকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে। এসব অনিয়মের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে তাদের দৌরাত্ম্য আরো বেড়েছে বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা। যার কারণে তারা বছরের পর বছর বহাল তবিয়তেই আছেন।
বিএনপির সিনিয়র নেতাদের দাবি, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নিরিবিলিতে রাজনৈতিক কাজ পরিচালনার জন্যই এমন জায়গায় তার কার্যালয় নেয়া হয়েছে। তবে এ সঙ্গে তারা এও স্বীকার করেন, এর ফলে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার (খালেদা জিয়া) যোগাযোগ অনেকটা কমে গেছে। এছাড়া একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে যেসব উয়িং সচল রাখার আবশ্যকতা ছিল তাও এখানে অপ্রতুল রয়েছে বলেও তারা অকপটে স্বীকার করেন।
নেতারা বলেন, এই কার্যালয়ে রাজনৈতিক চর্চার জন্য তথ্য ও গবেষণা সেল, আর্কাইভ, শক্তিশালী মিডিয়া সেলসহ আরো অনেক কিছুর অভাব বোধ করা হচ্ছে, যা খুব শিগগিরই পূরণ করা হবে বলেও তারা জানান।
বিএনপি দলীয় সূত্র জানায়, কাগজে-কলমে রাজনৈতিক কার্যালয় হলেও এখানে কর্মরত প্রায় সব অফিস কর্মকর্তা-কর্মচারী অরাজনৈতিক। ফলে তাদের অরাজনৈতিক আচার আচরণ আর দুর্নীতির কারণে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম থেকে শুরু করে তৃণমূল বিএনপি পর্যন্ত ক্ষুব্ধ। এ নিয়ে তারা একাধিকবার দলীয় ফোরামে আলাপ-আলোচনা করলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো সুফল পাওয়া যায়নি বলেও সূত্র জানায়।
তবে এবার দলের মধ্য থেকে সাবেক ছাত্রনেতারা পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করছেন। তারা দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে যেমন দল থেকে মান-অভিমানে আর বহিষ্কারের কারণে দূরে সরে যাওয়া নেতাকর্মীকে আবার দলে পুনর্বাসন করতে চাইছেন তেমনি নিষ্ক্রিয় নেতাদের সক্রিয় করাতেও উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। একইসঙ্গে দলের মৌসুমি নেতাদের কাছ থেকে দলকে রক্ষা করতেও মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
এসব নেতা জানান, দলের একটি সুবিধাবাদী গ্রুপের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে বিএনপির অনেক ডাকসাইটে নেতা এখন বাইরে রয়েছেন। এখন সময় এসেছে এই সিন্ডিকেট ভাঙার। তোষামোদির রাজনীতি শেষ করতে না পারলে একসময়ে আমাদেরও নিঃশেষ হয়ে যেতে হবে। যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দলকে পুনর্গঠন করতে হবে। আধুনিকতার ছোঁয়া সর্বত্র দিতে না পারলে দেশের সিংহভাগ তরুণ আমাদের দলকে কেন সমর্থন দেবে বলেও তারা প্রশ্ন ছুড়ে দেন।
তারা অভিযোগ করে বলেন, এখন পর্যন্ত দলের একটি কার্যকর ওয়েবসাইট নেই। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের তৃণমূল নেতাকর্মীদের আধুনিক ডাটাবেজ সংগৃহীত নেই। তথ্য ও গবেষণা সেল ও তথ্য সংগ্রহশালা নেই। শুধু নেই নেই আর নেই। এভাবে একটি দল চলতে পারে না।
প্রেসার গ্রুপের এক সদস্য জানান, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আমাদের মা। তাকে ভুল বুঝিয়ে, মাঠের প্রকৃত চিত্র আড়াল করে এতদিন অনেকে অনেক কিছু করেছেন। কিন্তু তার দুর্দিনে তাকে তারা ছেড়েও গেছেন। মাকে ফেলে যারা নিজেদের আখের গুছিয়েছেন তাদের এবার পাকড়াও করতে হবে তাদের মুখোশ উšে§াচন করতে হবে। এজন্য তারা দলের অনেক তৃণমূল নেতাকর্মীর কাছ থেকে তাদের মতামত নিচ্ছেন, যা লিখিত আকারে দলের চেয়ারপার্সনের নিকট তুলে ধরা হবে বলেও তিনি জানান।
অপর এক সদস্য জানান, বিএনপি চেয়ারপার্সন এখন সরকারি বা বিরোধী দলের প্রধান না থাকা সত্ত্বেও গুলশান কার্যালয়ে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছে যাতে নেতা-কর্মীরা তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ না করতে পারেন। তৃণমূলের অনেক নেতা গুলশান কার্যালয়ে এসে আক্ষেপ করে ফিরে যাওয়ার বহু নজির রয়েছে। দলের চেয়ারপার্সনকে একনজর দেখতে এবং মনের কথাগুলো বলার জন্যই মাঝে-মধ্যে ঢাকায় আসেন তারা। কিন্তু কার্যালয়ের ওইসব প্রভাবশালী কর্মকর্তার পাশাপাশি কিছু সিএসএফ সদস্যের দুর্ব্যবহারের কারণে মনে কষ্ট নিয়ে তাদের ফিরে যেতে হয়।
তিনি জানান, চেয়ারপার্সনের সঙ্গে দেখা করতে তাদেরও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয় ড্রইংরুমে। ওইসব প্রভাবশালী কর্মকর্তাই সর্বক্ষণ বিএনপি প্রধানকে ঘিরে রাখেন। গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকা সত্ত্বেও রাগে-অভিমানে একাধিকবার কার্যালয় ত্যাগ করার কথাও জানান তিনি।
এদিকে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, বিএনপি চেয়ারপার্সনকে অনেকটা জিম্মি করে রেখেছে গুলশান কার্যালয়ের ওইসব প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও স্টাফরা। তাদের বাইরে কোনো নেতাই নিজের মনের কথা বলতে পারেন না। আলাদাভাবে কেউ কথা বললে তার প্রতিও রুষ্ট হন ওই প্রভাবশালীরা। বেগম জিয়াকে ওই জিম্মিদশা থেকে বের করে আনতে না পারলে আগামীতে এই সরকারের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনই সফলতার মুখ দেখবে না বলেও জানান তারা।
ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা বলছেন, গুলশান কার্যালয়ের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের কারণে তৃণমূল বিএনপির আসল চিত্রও জানতে পারছেন না চেয়ারপার্সন। কমিটি কিংবা আন্দোলনের ক্ষেত্রেও নিতে পারছেন না সঠিক সিদ্ধান্ত। ওইসব কর্মকর্তার সঙ্গে যারা যোগসাজশ করে চলেন, তাদেরই গুলশান কার্যালয়ে কদর বেশি। দলের দুঃসময়ে কিংবা আন্দোলনে না থাকলেও বেগম জিয়ার সঙ্গে এখন তাদেরই বারবার দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে গোপন আঁতাতকারী এসব নেতার বিরুদ্ধে কোনো মামলা পর্যন্ত নেই। এসব কারণেই অভিমানে ক্ষুব্ধ হয়ে ত্যাগী নেতারা গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়া না ডাকলে পারতপক্ষে যাচ্ছেন না।
তারা অভিযোগ করে আরো বলেন, দেশের বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের মিডিয়া সেল বলতে কিছুই নেই। এই সেলের কর্মকর্তা সামসুদ্দিন দিদার ও শায়রুল কবির খান সংবাদকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সংবাদ মাধ্যম থেকে আড়ালেই থাকছেন চেয়ারপার্সনের প্রেস সচিব। বিভিন্ন সময়ে বিতর্কের সঙ্গে নিজের নামটি জড়িয়েছেন তার একান্ত সহকারী। গুলশান কার্যালয় থেকে উদ্ধার হওয়া তথ্য পাচার যন্ত্রের সঙ্গে তার নামটিও জড়িত রয়েছে বলে সন্দেহ নেতাকর্মীদের। দলের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত সিএসএফকে নিয়েও ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। তাদের দুর্ব্যবহারের হাত থেকে রেহাই পান না সংবাদকর্মী থেকে শুরু করে দলের অনেক নেতাকর্মীও। এছাড়া বিগত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে রাজধানীর বাংলামটরে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে সরকার সমর্থকদের হামলার ঘটনায় দলের চেয়ারপার্সনকে অরক্ষিত রেখে তারা কাপুরুষের মতো পালিয়ে যায় বলেও নেতাকর্মীরা জানান। এমনকি ওই সময়ে তাদের এক সহকর্মীকেও তারা ফেলে পালিয়ে যান বলে সরকার সমর্থকরা তাকেও পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। এছাড়া খালেদা জিয়ার গাড়িবহরের রুট সম্পর্কে দলের নেতাকর্মীরা না জানলেও ছাত্রলীগ পূর্ব পরিকল্পনামাফিক এ আক্রমণ করার সুযোগ পায় বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা। এ কারণেই গুলশান কার্যালয়ের কে কার এজেন্ট তা নিয়েও মুখরোচক আলোচনা চলছে বিএনপিতে।
গুলশান কার্যালয়ে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অর্থ-বিপত্তি নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন নেতাকর্মীরা। তারা জানান, এ কার্যালয়ে কর্মরত অনেকেরই গাড়ি-বাড়ির অভাব নেই। সামান্য অসুস্থ হলে তারা চিকিৎসার জন্য বিদেশেও পাড়ি জমান। এসব অর্থের উৎস সম্পর্কে তারা গুলশান কার্যালয়কেন্দ্রিক দুর্নীতিকেই দায়ী করছেন।
দলের প্রাণকেন্দ্র গুলশানকেন্দ্রিক এরকম অপতৎপরতা রোধ করার জন্য এবার সাবেক ছাত্রনেতাদের কাজে লাগাতে চাইছেন প্রেসার গ্রুপটি। চেয়ারপার্সনের নিরাপত্তা থেকে শুরু করে মিডিয়া সেল, তথ্য ও গবেষণা সেল, তথ্য সংগ্রহশালাতে দলের সাবেক ছাত্রনেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে দল যেমন উপকৃত হবে তেমনি তারাও রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতে পারবে বলে মনে করছেন নেতারা। এরকম একটি প্রস্তবনা নিয়ে তারা খুব শিগগির দলের চেয়ারপার্সনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন বলেও তারা উল্লেখ করেন।
No comments