কল্পকথার গল্প-ফোঁস করা কি দোষের হবে! by আলী হাবিব

কবির কল্পনাশক্তিকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। কেন? কবি লিখছেন, 'অপেক্ষায় আছি প্রতীক্ষায় থেকো।' আমাদের অপেক্ষা আর ফুরোয় না। প্রতীক্ষায় আছি, কিন্তু 'জানি না ফুরোবে কবে এই পথ চাওয়া।' 'কী করিলে কী হয়' জাতীয় নানা টোটকার বই বাজারে বিকোয়। কোনো টোটকায় আমাদের কাজ হচ্ছে না।
আমরা এখানে-সেখানে হেঁদিয়ে মরছি। কতই না স্বপ্ন ছিল আমাদের। স্বপ্নের সোনার বাংলা। স্বপ্ন পুড়ে খাক। কিছুতেই কিছু হলো না আমাদের।
'ওপর দিকে থুথু ছিটালে নিজের মুখে এসে পড়ে'- আমাদের জানা আছে। কেন পড়ে? নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র আমরা সবাই জানি। গল্প আছে, একটা আপেল নিউটনকে বিজ্ঞানী বানিয়ে দিল। আমাদের দেশে আপেল হয় না। আম, কাঁঠাল, আনারস তো হয়। ওসব নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। নিউটন সাহেবের মাথায় আপেল পড়েছিল। খেয়ে ফেলতে পারতেন। খাননি। পাড়া-প্রতিবেশীদের দিয়ে দিতে পারতেন। দেননি। পাড়ার ছেলেদের ডেকে ভাগ করে দিতে পারতেন। দেননি। ওসব বিষয় বোধহয় তাঁর মাথায়ই আসেনি। তিনি আপেলটাকে নিয়ে ভাবতে বসে গেলেন। আর বলিহারি যাই সেই আপেলগাছটিকে। ওই আপেলগাছের নিচে কেবল যে নিউটন সাহেবই বসতেন, এমন কোনো কথা কি কোথাও লেখা আছে? তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, অনেকেই সেই গাছের নিচে বসলেও আপেল পড়েছিল নিউটন সাহেবের মাথায়। কেন? আপেল কি মাথা চিনত? নাকি গাছটি বুঝতে পেরেছিল যে গাছের নিচে বসা ঝাঁকড়া চুলের এই লোকটি আপেল পতনের মর্ম বুঝবে। নাকি যে সময়ে আপেলটি নিউটন সাহেবের মাথায় পতিত হয়, সেই মুহূর্তটি ছিল মাহেন্দ্রক্ষণ?
অনেক কিছুই হতে পারে। রূপকথায় ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীর কথা পড়েছি আমরা। রাজপুত্র পথ চলতে চলতে পথ হারিয়ে ক্লান্ত হয়ে একটা গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই গাছের ওপর বসে ছিল ব্যঙ্গমা ও ব্যঙ্গমী। তারা আলোচনা করছিল রাজপুত্রকে নিয়ে। তাদের কথা শুনে রাজপুত্রের ঘুম ভেঙে যায়। তাদের কথার ভেতর দিয়ে রাজপুত্র পেয়ে যায় নতুন পথের দিশা। কোথায় গেলে কী হবে বা 'কী করিলে কী হইবে' জাতীয় সমাধান জুটে যায় তার। নতুন উদ্যমে পথ চলতে শুরু করে রাজপুত্র। আমাদের জীবনে তেমন কিছু হলো না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়াটা এখন যেন আমাদের জন্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন দীর্ঘশ্বাস? অপেক্ষা সময়ের। কেমন সে সময়। এই যে যেমন সময় গেল নভেম্বরের শেষদিনে আর ডিসেম্বরের দ্বিতীয় দিনে। ওহ্ একটা দিন বটে! ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলকে পরপর দুই ম্যাচে ঘোল খাইয়ে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। পেরে তো দেখাল বাংলাদেশ।
অনেক কিছুই পারছি আমরা। পারছি না কেবল নিজেদের ভেতর একটু বোঝাপড়া করে নিতে। সামান্য বোঝাপড়া। তাতেই হয়তো আমাদের কপাল খুলে যেতে পারত। সামান্য বোঝাপড়া হলেই হয়তো আমরা দেখতে পেতাম আমাদের দুয়ার খুলে গেছে। কিন্তু 'সম্মুখে শান্তির পারাবার' দেখা হয়ে উঠল না আমাদের। শুরু থেকে সেই যে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই পথ আর ফুরোচ্ছেই না। না, তাতে রোমাঞ্চিত হওয়ার কিছু নেই। পুলকিত বোধ করার কিছু নেই। 'পথ যদি না শেষ হয়', তাহলে সামনে যে ঘোর দুর্দিন- সেটা বুঝতে বোধ হয় ডিগ্রিধারী হওয়ার প্রয়োজন পড়বে না; বরং ডিক্রি জারির আশঙ্কা দূর করার মোক্ষম উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
এক মতে এক পথে চলতে পারি না আমরা। আমাদের 'দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে।' সেখানে কার পথ আলোয় ভরা তা আমরা জানি না। এর সঙ্গে ওর শত্রুতা। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। এ যে পথে যাচ্ছে ও সে পথ মাড়াবে না। কেন? কিন্তু পথের শেষে আলোর দিশা খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, সেটাই বা জানার উপায় কী? আমরা যে যার মতো করে যার যার পথ চলছি। পাবলিক কিছু একটা পেলেই কাউকে না কাউকে মাথায় তুলে নাচছে। আবার সময়মতো কাউকে না কাউকে মাথার ওপর থেকে আছাড় মেরে ফেলে দিতেও মুহূর্ত ভাবছে না। তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের ওঠানামার মতো আমরা কেউ উঠছি, কেউ নামছি। তবে একটা জিনিস আমাদের শেখা হয়ে গেছে। বেশ কষে অন্যকে উদ্ধার করে দিতে পারি আমরা। পরিবর্তনের যুগ। সব কিছু বদলে যাচ্ছে। কিছু কিছু শব্দের অর্থও বদলে গেছে। ওই যে উদ্ধার করার কথা বলা হলো, এর অর্থও নাকি বদলে গেছে। চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার বলে একটা ব্যাপার ছিল। আজকাল ধোলাই কথাটা খুব চালু হয়েছে। যে যখন যেভাবে পারছে, এ ওকে, সে তাকে ধোলাই করে যাচ্ছে। কোনো বাছবিচার নেই। পেলেই হলো। অ্যাটাকটা বিলো দ্য বেল্ট হচ্ছে কি না, ওসব নর্মস মানার কী দরকার? আঘাত করতে হবে। করা হলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রীতিমতো প্র্যাকটিস করে যে যেভাবে পারছে আঘাত করে যাচ্ছে। আমরা সেই কবে থেকেই তো দেখে আসছি, এ 'হ্যাঁ' বললে সে বলে 'না'। এ যদি 'না' বলে তো সে বলবে 'হ্যাঁ'। এই 'হ্যাঁ' ও 'না'র চোরাবালি থেকে বের হতেই পারছি না আমরা।
আজকের যুগটা পরিবর্তনের যুগ। তাবড় তাবড় সাহেবরা পর্যন্ত পরিবর্তনের কথা বলেছেন। বলেই চলেছেন। কিন্তু আমাদের অন্তর্জগতে কোনো পরিবর্তন হলো না। এই পরিবর্তনের কোনো চিহ্ন আমাদের জাতীয় জীবনে এখন পর্যন্ত দেখা গেল না। 'সিন্দাবাদের ভূত' একবার ঘাড়ে চেপে বসলে সহজে যে নামতে চায় না, সেটা আমরা ভালো করেই জানি। কিন্তু তবু আমরা একে অন্যের ঘাড়কে নিরাপদ রাখতে চাই না। আমাদের পথ এক ও অভিন্ন হলো না। 'বুকে বুকে মিল হলো নাকো হলো পিঠে পিঠে, তাই সই'- আমাদের মধ্যে 'দূর হতে তোমাকে দেখেছি' জাতীয় একটা ব্যাপার ঘটে গেল। কিন্তু দৃষ্টির ভেতর দিয়ে ভাবের কোনো আদান-প্রদান হয়েছে কি না তা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহাজনরা বলতে পারবেন। তবে নিকট-অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি, বাঘে-মোষে না হলেও পরস্পরবিরোধীরা এক ঘাটে জল খায়। নিজেরা নিজেদের মতো করে ওল্টায়, পাল্টায়। উল্টে গিয়েও পাল্টে যাওয়ার অভ্যাস আমাদের আছে।
এই যে উল্টে গিয়েও পাল্টে যাওয়া, এক ঘাটে জল খাওয়ার পরও দুটি পথ দুটি দিকে বেঁকে যাওয়া- এসব কি সহজে মেনে নিতে পারে সাধারণ মানুষ? মানুষ তো নিরাপত্তা চায়। মোটা ভাত আর ঘুমের নিশ্চয়তা- এই যাদের সহজ চাওয়া, তাদের খুব সাধারণ ভাবলে ভুল হবে। আখেরে এই পাবলিকের হাতেই তো শেষ বিচার। আমাদের বাতচিত না থাকলেও সিনেমার সস্তা ডায়ালগ আছে, পাবলিকের মার কেওড়াতলা পার। পাবলিক যদি একবার ফোঁস করে ওঠে, সেটা খুব কি দোষের হবে? অতএব, 'ভাবিয়া করিও...।'
নিউটন সাহেবের মাথায় আপেল পড়েছিল। বিজ্ঞান পেয়েছিল কিছু সূত্র। আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও আমাদের বোধোদয় হয় না কেন?
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.