'গ্রাম উজাড়ের সাক্ষী' সে কি আমরা? by ড. মীজানূর রহমান শেলী
একদিকে সংঘাতময় রাজনীতি, অন্যদিকে দুর্ঘটনার শোকাবহ কাতার। সারা দেশে সৃষ্টি করেছে বিপুল উদ্বেগ এবং বিশাল বিষাদের আবহ। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে এক তৈরি পোশাকশিল্প-কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে ১১১ জন (মতান্তরে আরো বেশিসংখ্যক) দুর্ভাগা শ্রমিক।
এই দুর্ঘটনায় বহুসংখ্যক শ্রমিক আহতও হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই এই শিল্পের পাঁচ শতাধিক শ্রমিক অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ দিয়েছে ও আহত হয়েছে। ২৫ নভেম্বরের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ। তাই এবার সমাজের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে গণমাধ্যমে মূর্ত হয়ে উঠেছে গভীর শোক ও ব্যাপক উদ্বেগ। এত বড় মাত্রায় না হলেও আগের একই রকম দুর্ঘটনায় দেশ ও জাতি বেদনার্ত হয়েছে, দাবি উঠেছে শ্রমিক তথা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আশু ও টেকসই ব্যবস্থার পদক্ষেপ গ্রহণের। শুধু আগুনের 'লাল ঘোড়ার' কারণেই নয়, সরকারি ও বেসরকারি খাতে কর্তব্যে অবহেলা ও ব্যাপক দুর্নীতির ফলেও সাধারণ মানুষ আকস্মিক দুর্ঘটনার শিকারে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে নির্মীয়মাণ উড়াল সেতুর ভগ্নখণ্ড ১৫ জন পথচারীর জীবন কেড়ে নিয়েছে। এই মৃত্যুর মিছিলের শোক রূপ নিয়েছে ২৭ নভেম্বরের রাষ্ট্রীয় শোকে।
সরকার অবশ্য শুধু রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন করেই তার কাজ শেষ মনে করেনি। দোষী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে বিচার করা ও শাস্তি দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। আশুলিয়ার কারখানায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে যারা করুণ মৃত্যুর শিকার হয়েছে, তাদের জন্য তৈরি পোশাকশিল্প মালিক সমিতি মাথাপিছু এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দানের ঘোষণা দিয়েছে। সেই সঙ্গে সরকারও প্রাথমিকভাবে প্রতি নিহত শ্রমিকের জন্য ২০ হাজার টাকা করে অনুদান ঘোষণা করে এবং এর পরপর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে মাথাপিছু দুই লাখ টাকা সহায়তা দানের ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভবিষ্যতে কর্মরত শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশও সরকার থেকে দেওয়া হয়। ওই মারাত্মক দুর্ঘটনা সম্পর্কে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা যে বক্তব্য দেন, তাতে এর পেছনে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ জড়িত থাকার আশঙ্কা ব্যক্ত হয়। এ নিয়ে তদন্তও চলছে। ওই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরদিনই ঢাকার দক্ষিণখান এলাকায় আরেকটি পোশাক তৈরির কারখানায়ও আগুন লাগে, যদিও এতে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। তার পরের দিনও চট্টগ্রামে একই শিল্পের আরেক প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগায় দ্রুত বেরিয়ে আসার সময় ৫০ জনেরও বেশি শ্রমিক আহত হয়। ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের ফল বা দৈব-দুর্বিপাকের ঘটনা যা-ই হোক না কেন, সারিবদ্ধভাবে ঘটে যাওয়া এসব দুর্ঘটনা জনমনে দারুণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও ভীতির জন্ম দিয়েছে।
নিছক দুর্ঘটনা অথবা নাশকতামূলক কার্যক্রমের ফল যা-ই হোক না কেন, এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড শুধু মর্মান্তিকই নয়, জাতীয় অর্থনীতির জন্যও এক ভয়ংকর অশনিসংকেত। বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানিমুখী খাত তৈরি পোশাকশিল্প বছরে প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণ মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে আনে। সঠিকভাবে সংগঠিত ও পরিচালিত হলে এ খাত থেকে ২০২০ সাল নাগাদ এ অর্জনের পরিমাণ হতে পারে ৪২ থেকে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিপুল সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে সুরক্ষিত রাখা এবং টেকসই করে গড়ে তোলা জাতির সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কল্যাণের স্বার্থে অপরিহার্য। অবহেলা ও উপেক্ষা, অসাবধানতা, শিথিলতা ও অদক্ষতা জর্জরিত ব্যবস্থাপনা একে আরো পঙ্গু ও নির্জীব করে তুলবে।
তৈরি পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডসহ অন্যান্য দুর্ঘটনার পাশাপাশি শ্রমিক অসন্তোষ, মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের অবনতি ও অবিন্যস্ত অবস্থা দেশে সুশাসনের ঘাটতির প্রতিফলন। তৈরি পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প স্থাপনায় যেমন, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং ব্যাংকিং ও শেয়ারবাজারসহ অর্থনীতির সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায়ও সুশাসনের অভাব স্পষ্ট।
সুশাসন মূলত এক ইতিবাচক ও সৃজনশীল মানবিক উদ্যোগ। এর অন্তত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- রাষ্ট্র গঠন, জাতি গঠন, অর্থনীতি সংগঠন, ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিতকরণ এবং রাজনীতি ও শাসনে জনসম্পৃক্ততা বলিষ্ঠকরণ। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের চার দশক এবং সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের দুই দশক পরেও এসব ক্ষেত্রে বিশাল ঘাটতি দৃশ্যমান। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, ব্যক্তিশাসন এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও ব্যক্তিনির্ভর রাজনৈতিক দলের বল্গাহীন দলবাজি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্জীব করে তুলেছে এবং তাদের বিকাশের পথ রুদ্ধ করেছে। নির্বাচিত জাতীয় সংসদ রাষ্ট্র ও সমাজে তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারেনি, বিচার বিভাগও তার যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারেনি, জনপ্রশাসন হয়েছে স্থবির এবং স্থানীয় সরকারব্যবস্থা হয়ে পড়েছে পঙ্গু। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রেই যাত্রা শুরু করেছিল উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কর্মক্ষম ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে।
জাতি গঠনের ক্ষেত্রেও প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো এবং সেগুলোর নেতারা অনেক বিষয়েই অপারগ রয়ে গেছেন। ৪০ বছর পরও মূল জাতীয় বিষয়গুলোতে ঐকমত্য সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। বাঙালি বনাম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিতর্ক, ইতিহাসে ভিন্ন ভিন্ন দল সমর্থিত জাতীয় নেতাদের স্থান ও মর্যাদা নিয়ে মতানৈক্য জাতিকে বিভক্ত করে রেখেছে। ফলে সুদৃঢ় ঐক্যের বন্ধনে সমৃদ্ধ জাতি গঠন এখনো সম্ভব হয়নি; বরং দেশ ও সমাজ হয়েছে মারাত্মক বিভক্তির শিকার। রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে অপারগতা, অর্থনৈতিক জীবনে ও সামগ্রিক উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় নেতিবাচক অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। জনসাধারণের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের ফলে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্ব দূরদর্শী ও দক্ষ হলে তার মাত্রা ও পরিমাণ হতো আরো বিশাল, উন্নয়নের গতি হতো আরো প্রবল। অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা যথার্থভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। পরিণতিতে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সীমিতসংখ্যক গোষ্ঠী ও ব্যক্তি ছলে-বলে-কৌশলে বিপুল অর্থ ও বিত্তের মালিক হয়েছে। এই বৈষম্য সুশাসনের অভাবকে আরো প্রকট করেছে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য দরিদ্র ও ভাগ্যাহত মানুষকে সরকার পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেয়নি। প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় বা সরকারি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার সুযোগ তাদের নেই বললেই চলে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশে রাজনৈতিক সংকট জটিল ও প্রবল রূপ ধারণ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠন ছাত্রশিবির মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর মারাত্মক আক্রমণ চালাচ্ছে- এই অভিযোগে সরকারি মহল ও ক্ষমতাসীন দল সরব। অন্যদিকে আন্দোলনকারী ওই সব সংগঠনের নেতা ও সমর্থকরা দাবি করছে যে সরকার তাদের সভা-সমাবেশ ও মিছিলের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বল প্রয়োগে বঞ্চিত রাখছে এবং এর ফলেই সৃষ্টি হচ্ছে সংঘাত ও সংঘর্ষ।
আবার প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও এর মিত্ররা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রচলনের দাবিতে অনড় অবস্থান নিয়েছে। সরকার ও ক্ষমতাসীন দল বলছে, উচ্চতর আদালতের রায় অনুযায়ী পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংশোধিত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান নেই। তাই আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের তদারকিতে। এভাবে দুই প্রতিযোগী রাজনৈতিক দল ও মোর্চা নেমেছে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও সংঘাতের পটভূমি ব্যাপক ও বিস্তৃত রূপ লাভ করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশ ও সমাজকে অস্থিতিশীল করে তোলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন হয়েছে সুদূরপরাহত। এ অবস্থায় শিল্পে, বাণিজ্যে, শিক্ষাঙ্গনে অঘটন যদি নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে বিস্মিত হওয়ার কারণ থাকবে না। অগ্নিকাণ্ড, অপরাধ, সহিংসতা দীর্ঘ করবে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মিছিল আর আমরা কি ক্রমাগত গ্রাম পতনের শব্দ শুনে শুনে পরিণত হব 'গ্রাম উজাড়ের সাক্ষীতে'?
এই করুণ পরিণতির আগ্রাসী কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার কি কোনো উপায় নেই? যে জাতি সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে বিপুল বাধা-বন্ধন অতিক্রম করে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, তার জন্য নেতির এই নরক তো কোনোক্রমেই অবধারিত হতে পারে না। আসলে সংগঠিত মানবসমাজের জন্য কোনো নেতিবাচক অবস্থাই অমোঘ নয়। সংকল্পে দৃঢ় এবং সত্যাদর্শে অবিচল কোনো মানবগোষ্ঠী অবনতি ও দুর্ভোগকে আকাট্য ললাট লিখন হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না। এ কথা বাংলাদেশের বাঙালি জাতির জন্য অক্ষরে অক্ষরে সত্য। জাতি যদি দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে চেষ্টা করে, তাহলে পরে-আগের অনেক সংকটের মতোই আজকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট থেকেও ত্রাণ পাওয়া সম্ভব। আর রাহুমুক্তির সেই পথ হলো যুক্তিযুক্ত ও শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনা এবং সমঝোতার প্রশস্ত ও মসৃণ সরণি।
বস্তুত বাংলাদেশের বিরাজমান রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তি অনেকাংশেই কৃত্রিম। দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব দেশ ও জাতিকে বিপাকে ফেলেছে, তা আদর্শগত বিভেদ যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি ক্ষমতার লড়াই। সহনশীলতার অভাব দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরাধিকারকে দুর্বল করে ফেলেছে। পারস্পরিক অবিশ্বাস উভয় পক্ষকে অসহিষ্ণু করেছে, ঠেলে দিয়েছে প্রতিহিংসার নেতিবাচক পথে। গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রতিযোগিতা করে সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়-পরাজয় মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ক্ষমতার বাইরে থেকে যে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে- এ বিশ্বাস এদের কারোই বুঝি নেই। তাই এই মারাত্মক বিবাদ-বিসংবাদ এবং হানাহানি সৃষ্টি করছে ভয়াল ভবিষ্যতের পটভূমি। এই সংকটের নিরসন নিহিত রয়েছে হারিয়ে যাওয়া আস্থা ও বিশ্বাসের পুনঃ স্থাপনে। আর তা তারা করতে পারে একে অন্যের সঙ্গে আলাপ করে সমঝোতা সৃষ্টির মাধ্যমে। এমনটি করতে না পারলে তাদের বিবাদ আনবে ভয়াবহ সংঘর্ষ এবং অনিশ্চিতি। এর ফলে উজাড় হবে আরো অসংখ্য গ্রাম, বিরান হবে বহু জনপদ। তারপর কী হবে তা একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারে।
লেখক : চিন্তাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক। সেন্টার
ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ, বাংলাদেশের (সিডিআরবি)
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং আর্থসামাজিক ত্রৈমাসিক 'এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সের' সম্পাদক
cdrb@agni.com
সরকার অবশ্য শুধু রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন করেই তার কাজ শেষ মনে করেনি। দোষী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে বিচার করা ও শাস্তি দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। আশুলিয়ার কারখানায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে যারা করুণ মৃত্যুর শিকার হয়েছে, তাদের জন্য তৈরি পোশাকশিল্প মালিক সমিতি মাথাপিছু এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দানের ঘোষণা দিয়েছে। সেই সঙ্গে সরকারও প্রাথমিকভাবে প্রতি নিহত শ্রমিকের জন্য ২০ হাজার টাকা করে অনুদান ঘোষণা করে এবং এর পরপর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে মাথাপিছু দুই লাখ টাকা সহায়তা দানের ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভবিষ্যতে কর্মরত শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশও সরকার থেকে দেওয়া হয়। ওই মারাত্মক দুর্ঘটনা সম্পর্কে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা যে বক্তব্য দেন, তাতে এর পেছনে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ জড়িত থাকার আশঙ্কা ব্যক্ত হয়। এ নিয়ে তদন্তও চলছে। ওই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরদিনই ঢাকার দক্ষিণখান এলাকায় আরেকটি পোশাক তৈরির কারখানায়ও আগুন লাগে, যদিও এতে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। তার পরের দিনও চট্টগ্রামে একই শিল্পের আরেক প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগায় দ্রুত বেরিয়ে আসার সময় ৫০ জনেরও বেশি শ্রমিক আহত হয়। ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের ফল বা দৈব-দুর্বিপাকের ঘটনা যা-ই হোক না কেন, সারিবদ্ধভাবে ঘটে যাওয়া এসব দুর্ঘটনা জনমনে দারুণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও ভীতির জন্ম দিয়েছে।
নিছক দুর্ঘটনা অথবা নাশকতামূলক কার্যক্রমের ফল যা-ই হোক না কেন, এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড শুধু মর্মান্তিকই নয়, জাতীয় অর্থনীতির জন্যও এক ভয়ংকর অশনিসংকেত। বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানিমুখী খাত তৈরি পোশাকশিল্প বছরে প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণ মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে আনে। সঠিকভাবে সংগঠিত ও পরিচালিত হলে এ খাত থেকে ২০২০ সাল নাগাদ এ অর্জনের পরিমাণ হতে পারে ৪২ থেকে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিপুল সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে সুরক্ষিত রাখা এবং টেকসই করে গড়ে তোলা জাতির সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কল্যাণের স্বার্থে অপরিহার্য। অবহেলা ও উপেক্ষা, অসাবধানতা, শিথিলতা ও অদক্ষতা জর্জরিত ব্যবস্থাপনা একে আরো পঙ্গু ও নির্জীব করে তুলবে।
তৈরি পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডসহ অন্যান্য দুর্ঘটনার পাশাপাশি শ্রমিক অসন্তোষ, মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের অবনতি ও অবিন্যস্ত অবস্থা দেশে সুশাসনের ঘাটতির প্রতিফলন। তৈরি পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প স্থাপনায় যেমন, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং ব্যাংকিং ও শেয়ারবাজারসহ অর্থনীতির সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায়ও সুশাসনের অভাব স্পষ্ট।
সুশাসন মূলত এক ইতিবাচক ও সৃজনশীল মানবিক উদ্যোগ। এর অন্তত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- রাষ্ট্র গঠন, জাতি গঠন, অর্থনীতি সংগঠন, ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিতকরণ এবং রাজনীতি ও শাসনে জনসম্পৃক্ততা বলিষ্ঠকরণ। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের চার দশক এবং সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের দুই দশক পরেও এসব ক্ষেত্রে বিশাল ঘাটতি দৃশ্যমান। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, ব্যক্তিশাসন এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও ব্যক্তিনির্ভর রাজনৈতিক দলের বল্গাহীন দলবাজি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্জীব করে তুলেছে এবং তাদের বিকাশের পথ রুদ্ধ করেছে। নির্বাচিত জাতীয় সংসদ রাষ্ট্র ও সমাজে তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারেনি, বিচার বিভাগও তার যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারেনি, জনপ্রশাসন হয়েছে স্থবির এবং স্থানীয় সরকারব্যবস্থা হয়ে পড়েছে পঙ্গু। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রেই যাত্রা শুরু করেছিল উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কর্মক্ষম ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে।
জাতি গঠনের ক্ষেত্রেও প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো এবং সেগুলোর নেতারা অনেক বিষয়েই অপারগ রয়ে গেছেন। ৪০ বছর পরও মূল জাতীয় বিষয়গুলোতে ঐকমত্য সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। বাঙালি বনাম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিতর্ক, ইতিহাসে ভিন্ন ভিন্ন দল সমর্থিত জাতীয় নেতাদের স্থান ও মর্যাদা নিয়ে মতানৈক্য জাতিকে বিভক্ত করে রেখেছে। ফলে সুদৃঢ় ঐক্যের বন্ধনে সমৃদ্ধ জাতি গঠন এখনো সম্ভব হয়নি; বরং দেশ ও সমাজ হয়েছে মারাত্মক বিভক্তির শিকার। রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে অপারগতা, অর্থনৈতিক জীবনে ও সামগ্রিক উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় নেতিবাচক অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। জনসাধারণের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের ফলে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্ব দূরদর্শী ও দক্ষ হলে তার মাত্রা ও পরিমাণ হতো আরো বিশাল, উন্নয়নের গতি হতো আরো প্রবল। অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা যথার্থভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। পরিণতিতে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সীমিতসংখ্যক গোষ্ঠী ও ব্যক্তি ছলে-বলে-কৌশলে বিপুল অর্থ ও বিত্তের মালিক হয়েছে। এই বৈষম্য সুশাসনের অভাবকে আরো প্রকট করেছে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য দরিদ্র ও ভাগ্যাহত মানুষকে সরকার পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেয়নি। প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় বা সরকারি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার সুযোগ তাদের নেই বললেই চলে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশে রাজনৈতিক সংকট জটিল ও প্রবল রূপ ধারণ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠন ছাত্রশিবির মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর মারাত্মক আক্রমণ চালাচ্ছে- এই অভিযোগে সরকারি মহল ও ক্ষমতাসীন দল সরব। অন্যদিকে আন্দোলনকারী ওই সব সংগঠনের নেতা ও সমর্থকরা দাবি করছে যে সরকার তাদের সভা-সমাবেশ ও মিছিলের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বল প্রয়োগে বঞ্চিত রাখছে এবং এর ফলেই সৃষ্টি হচ্ছে সংঘাত ও সংঘর্ষ।
আবার প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও এর মিত্ররা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রচলনের দাবিতে অনড় অবস্থান নিয়েছে। সরকার ও ক্ষমতাসীন দল বলছে, উচ্চতর আদালতের রায় অনুযায়ী পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংশোধিত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান নেই। তাই আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের তদারকিতে। এভাবে দুই প্রতিযোগী রাজনৈতিক দল ও মোর্চা নেমেছে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও সংঘাতের পটভূমি ব্যাপক ও বিস্তৃত রূপ লাভ করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশ ও সমাজকে অস্থিতিশীল করে তোলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন হয়েছে সুদূরপরাহত। এ অবস্থায় শিল্পে, বাণিজ্যে, শিক্ষাঙ্গনে অঘটন যদি নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে বিস্মিত হওয়ার কারণ থাকবে না। অগ্নিকাণ্ড, অপরাধ, সহিংসতা দীর্ঘ করবে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মিছিল আর আমরা কি ক্রমাগত গ্রাম পতনের শব্দ শুনে শুনে পরিণত হব 'গ্রাম উজাড়ের সাক্ষীতে'?
এই করুণ পরিণতির আগ্রাসী কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার কি কোনো উপায় নেই? যে জাতি সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে বিপুল বাধা-বন্ধন অতিক্রম করে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, তার জন্য নেতির এই নরক তো কোনোক্রমেই অবধারিত হতে পারে না। আসলে সংগঠিত মানবসমাজের জন্য কোনো নেতিবাচক অবস্থাই অমোঘ নয়। সংকল্পে দৃঢ় এবং সত্যাদর্শে অবিচল কোনো মানবগোষ্ঠী অবনতি ও দুর্ভোগকে আকাট্য ললাট লিখন হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না। এ কথা বাংলাদেশের বাঙালি জাতির জন্য অক্ষরে অক্ষরে সত্য। জাতি যদি দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে চেষ্টা করে, তাহলে পরে-আগের অনেক সংকটের মতোই আজকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট থেকেও ত্রাণ পাওয়া সম্ভব। আর রাহুমুক্তির সেই পথ হলো যুক্তিযুক্ত ও শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনা এবং সমঝোতার প্রশস্ত ও মসৃণ সরণি।
বস্তুত বাংলাদেশের বিরাজমান রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তি অনেকাংশেই কৃত্রিম। দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব দেশ ও জাতিকে বিপাকে ফেলেছে, তা আদর্শগত বিভেদ যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি ক্ষমতার লড়াই। সহনশীলতার অভাব দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরাধিকারকে দুর্বল করে ফেলেছে। পারস্পরিক অবিশ্বাস উভয় পক্ষকে অসহিষ্ণু করেছে, ঠেলে দিয়েছে প্রতিহিংসার নেতিবাচক পথে। গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রতিযোগিতা করে সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়-পরাজয় মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ক্ষমতার বাইরে থেকে যে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে- এ বিশ্বাস এদের কারোই বুঝি নেই। তাই এই মারাত্মক বিবাদ-বিসংবাদ এবং হানাহানি সৃষ্টি করছে ভয়াল ভবিষ্যতের পটভূমি। এই সংকটের নিরসন নিহিত রয়েছে হারিয়ে যাওয়া আস্থা ও বিশ্বাসের পুনঃ স্থাপনে। আর তা তারা করতে পারে একে অন্যের সঙ্গে আলাপ করে সমঝোতা সৃষ্টির মাধ্যমে। এমনটি করতে না পারলে তাদের বিবাদ আনবে ভয়াবহ সংঘর্ষ এবং অনিশ্চিতি। এর ফলে উজাড় হবে আরো অসংখ্য গ্রাম, বিরান হবে বহু জনপদ। তারপর কী হবে তা একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারে।
লেখক : চিন্তাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক। সেন্টার
ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ, বাংলাদেশের (সিডিআরবি)
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং আর্থসামাজিক ত্রৈমাসিক 'এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সের' সম্পাদক
cdrb@agni.com
No comments