হরতালের সমর্থনে ভাঙচুর, আগুন-দিনাজপুরে শিবিরকর্মী নিহত
পুলিশের ব্যাপক প্রস্তুতি ও সতর্ক পাহারার কারণে রাজধানীসহ সারা দেশে সমাবেশ করতে না পেরে হরতালের ডাক দিয়েই গতকাল সোমবার জঙ্গি রূপে আবির্ভূত হয় জামায়াতে ইসলামী। সন্ধ্যায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা।
এ ঘটনায় রাজধানীতে ৭০ জনকে আটক করে পুলিশ।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, দিনাজপুর, মুন্সীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে জামায়াত-শিবিরের ৩৫ নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়ছে। হরতালের সমর্থনে মিছিল করার সময় দিনাজপুর ও রাজশাহীতেও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার রানীবাজারে সংঘর্ষে ছাত্রশিবিরের এক কর্মী নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে জামায়াত। চট্টগ্রামে অন্তত চারটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া ফরিদপুর ও বগুড়াসহ বিভিন্ন স্থানে জামায়াত-শিবিরের আরো ৩৯ জনকে আটক করা হয়।
সমাবেশ কর্মসূচি পালন করতে না দেওয়ার প্রতিবাদে জামায়াত আজ মঙ্গলবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে।
রাজধানীতে ঝটিকা মিছিল : গত রাত ১২টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ৭০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। এ ছাড়া কারওয়ান বাজার ও মতিঝিল এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে মতিঝিল আয়কর অফিসের কর্মচারী হাদিউল ইসলাম আহত হয়েছেন।
পুলিশ জানায়, গতকাল সন্ধ্যায় মতিঝিল বিজয়নগর আয়কর অঞ্চল-১৪-এর অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে ককটেল বিস্ফোরণে হাদিউল ইসলাম আহত হন। এ ছাড়া মতিঝিল, পল্টন, কারওয়ান বাজার, মহাখালী, মালিবাগ, মিরপুরসহ কয়েকটি স্থানে ঝটিকা মিছিল করে জামায়াত-শিবির। কারওয়ান বাজারে পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় সেখানে একটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। এ ছাড়া সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা একটি ঝটিকা মিছিল থেকে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ১৫টি গাড়ি ভাঙচুর করে এবং কয়েকটি গাড়িতে আগুন দেয়। এ ছাড়া টায়ার জ্বালিয়ে বেশ কিছুক্ষণ রাস্তা অবরোধ করে রাখে তারা। ওই সময় সেখান থেকে জামায়াত-শিবিরের ছয় কর্মীকে আটক করা হয়।
তেজগাঁও জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) জাহিদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা মিছিল বের করার চেষ্টা করলে মতিঝিল এলাকা থেকে ২১ জনকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর উত্তরা, লালবাগ, মিরপুর, মহাখালী, নয়াপল্টনসহ বিভিন্ন এলাকায় ঝটিকা মিছিল করে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। সন্ধ্যায় ছাত্রশিবিরের এক বিবৃতিতে রাজধানীতে অর্ধশতসহ সারা দেশে শিবিরের দুই শতাধিক নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়।
নাশকতার আশঙ্কায় কঠোর নিরাপত্তা : গতকাল জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি না দেওয়ার কারণ হিসেবে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র ও গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, জামায়াত-শিবির যেকোনো সময় দেশে বড় ধরনের নাশকতা চালাতে পারে। তাদের সঙ্গে জঙ্গিদের যোগাযোগ বেড়েছে। মিছিল-সমাবেশের নামে এর আগে তারা পুলিশের ওপর হামলা, অগ্নিসংযোগসহ অনেক তাণ্ডব চালিয়েছে। তিনি জানান, ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। মিছিল থেকে নাশকতার আশঙ্কায় রাজধানীর নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি এক হয়ে সোমবার রাজধানীতে নাশকতা চালাতে পারে- এমন আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তাব্যবস্থা আরো জোরদার করা হয়। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক ক্যাপ্টেন অভিষেক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গত শনিবার গভীর রাতে গোপন বৈঠক করার সময় মিরপুর থানা এলাকা থেকে পাঁচ জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। সম্প্রতি তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকায় আসে।'
গতকাল সকাল থেকে রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১৩ হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়। জামায়াত-শিবির ঝটিকা মিছিল করতে পারে- এমন এলাকা আগে চিহ্নিত করা হয়। ডিএমপির আটটি ক্রাইম জোনের প্রতিটি থানা এলাকায় জামায়াত-শিবিরের মেস ও আস্তানায় চালানো হয়েছে তল্লাশি।
রাজধানীতে জামায়াত-শিবিরের সমাবেশের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গতকাল সকাল থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য মোতায়েন দেখা যায়। পুলিশ সদস্যদের গায়ে দেখা যায় বিশেষ জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট ও হাতে বন্দুক। এপিসি, রায়ট কার ও জলকামানও প্রস্তুত রাখা হয়।
সার্বিক নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মেহেদি হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশের অনুমতি ছাড়াই জামায়াত-শিবির কর্মসূচি দেয়। এর আগেও তারা কর্মসূচির নামে বিভিন্ন সময়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তাই ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। হরতাল উপলক্ষে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হবে। হামলার আশঙ্কা মাথায় রেখে হরতালের দিন পুলিশের দায়িত্ব বণ্টন করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ অন্যান্য কার্যালয়ে নজরদারি ছাড়াও বাড়তি টহল পুলিশ মোতায়েন করা হবে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধের মামলায় শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে গত মাসের শুরু থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে আসছে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা। কারওয়ান বাজারে আইনমন্ত্রীর গাড়িবহরও তাদের হামলার মুখে পড়ে। এ ছাড়া জয়পুরহাটে এক পুলিশ সদস্যের গায়ে আগুন দেয় ছাত্রশিবিরের কর্মীরা। এসব ঘটনায় এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
দিনাজপুরে একজন নিহত : আমাদের দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, চিরিরবন্দর উপজেলার রানীরবন্দর বাজারে গতকাল সন্ধ্যায় পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিপেটা করে। একপর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে শিবিরের এক কর্মী নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে জামায়াত। তবে পুলিশ বলেছে, তারা এ বিষয়ে কিছু জানে না।
স্থানীয় ছাত্রশিবিরের নেতা আজমির দাবি করেছেন, পুলিশের গুলিতে আহত শিবিরের তিন কর্মীকে চিকিৎসার জন্য রংপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে পথে মারা গেছে খানসামা উপজেলা শাখা জামায়াতের আমির আতাউর রহমানের ছেলে শিবিরকর্মী মুজাহিদ ইসলাম। গুলিবিদ্ধ অন্য দুজন হলেন রানীরবন্দর সাংগঠনিক থানার সভাপতি আসাদুল্লাহ সরকার ও কর্মী বকুল।
আমাদের রংপুর অফিস জানায়, মুজাহিদের লাশ রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে। রংপুর কোতোয়ালি থানার ওসি আলতাফ হোসেন জানান, রাত ৮টার পর রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহত মুজাহিদকে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হওয়ায় কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেনি। তিনি জানান, মুজাহিদ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তাঁরা শুনেছেন, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনার আগে তাকে ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতাল নামে অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল।
রাতে চিরিরবন্দর থানার ওসি তারিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, শিবিরকর্মী নিহত হওয়ার বিষয়টি তাঁদের জানা নেই। তিনি জানান, পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ শটগান থেকে ৮৭টি রাবার বুলেট, চায়নিজ রাইফেলের সাতটি গুলি এবং ২১টি কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে।
ওসি জানান, ঘটনার সময় বিদ্যুৎ ছিল না। ওই সময় কী হয়েছে সেটা তিনি বলতে পারছেন না।
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন জানায়, সংঘর্ষে পুলিশসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে। জামায়াত দাবি করেছে তাদের অন্তত ১২ জন আহত হয়েছে।
এদিকে দিনাজপুর জেলা শাখা শিবিরের সেক্রেটারি আবদুল মতিন জানিয়েছেন, মুজাহিদের জানাজা ও লাশ দাফনের জন্য চিরিরবন্দর ও খানসামা উপজেলা হরতালের আওতামুক্ত থাকবে।
রাজশাহীতে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া : রাজশাহী অফিস জানায়, সন্ধ্যায় নগরীর সাহেব বাজার ও সোনাদীঘি এলাকায় শিবির ঝটিকা মিছিল বের করলে পুলিশ ধাওয়া দেয়। শিবিরকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশও অন্তত ছয়টি রাবার বুলেট ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে শিবিরের পাঁচ নেতা-কর্মী আহত হয়। নগরীর উপকণ্ঠ কাটাখালী বাজারে মিছিল বের করলে পুলিশ লাঠিপেটা করে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ দুটি ঘটনায় পুলিশ ১১ জনকে আটক করেছে। নগরীর বোয়ালিয়া থানার ওসি আলমগীর হোসেন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন।
চট্টগ্রামে বোমা বিস্ফোরণ : চট্টগ্রাম অফিস জানায়, নগরের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল করেছে জামায়াত। এ সময় তারা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়েছে এবং চারটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। নগরের অলংকার মোড়ে বোমা ফাটানোর এ ঘটনায় তিন পথচারী আহত হয়েছে। তবে তাৎক্ষণিক তাদের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (উত্তর) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বোমার ঘটনা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, মিছিলের চেষ্টাকালে ডবলমুরিং ও হালিশহর থানার পুলিশ দুজনকে আটক করেছে। অন্যদিকে চান্দগাঁও থানার পুলিশ আটক করেছে দুজনকে।
সিলেটে আটক ছয় : সিলেট অফিস জানায়, রবিবার থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা ও নগরে অভিযান চালিয়ে জামায়াত-শিবিরের ছয় নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জেলা পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া বিশ্বনাথ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, কানাইঘাট, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরের বিভিন্ন স্থানে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে।
এ ছাড়া নরসিংদীতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা। ওই সময় অন্তত পাঁচটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। গতকাল রাত ৯টার দিকে দগরিয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নারায়ণগঞ্জে পুলিশ জামায়াত-শিবিরের দুজনকে আটক করেছে। হরতালে নাশকতা ঠেকাতে গতকাল দুপুর থেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ। মুন্সীগঞ্জে জামায়াতের দুই নেতা, নারায়ণগঞ্জে জামায়াত-শিবিরের দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, দিনাজপুর, মুন্সীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে জামায়াত-শিবিরের ৩৫ নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়ছে। হরতালের সমর্থনে মিছিল করার সময় দিনাজপুর ও রাজশাহীতেও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার রানীবাজারে সংঘর্ষে ছাত্রশিবিরের এক কর্মী নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে জামায়াত। চট্টগ্রামে অন্তত চারটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া ফরিদপুর ও বগুড়াসহ বিভিন্ন স্থানে জামায়াত-শিবিরের আরো ৩৯ জনকে আটক করা হয়।
সমাবেশ কর্মসূচি পালন করতে না দেওয়ার প্রতিবাদে জামায়াত আজ মঙ্গলবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে।
রাজধানীতে ঝটিকা মিছিল : গত রাত ১২টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ৭০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। এ ছাড়া কারওয়ান বাজার ও মতিঝিল এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে মতিঝিল আয়কর অফিসের কর্মচারী হাদিউল ইসলাম আহত হয়েছেন।
পুলিশ জানায়, গতকাল সন্ধ্যায় মতিঝিল বিজয়নগর আয়কর অঞ্চল-১৪-এর অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে ককটেল বিস্ফোরণে হাদিউল ইসলাম আহত হন। এ ছাড়া মতিঝিল, পল্টন, কারওয়ান বাজার, মহাখালী, মালিবাগ, মিরপুরসহ কয়েকটি স্থানে ঝটিকা মিছিল করে জামায়াত-শিবির। কারওয়ান বাজারে পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় সেখানে একটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। এ ছাড়া সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা একটি ঝটিকা মিছিল থেকে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ১৫টি গাড়ি ভাঙচুর করে এবং কয়েকটি গাড়িতে আগুন দেয়। এ ছাড়া টায়ার জ্বালিয়ে বেশ কিছুক্ষণ রাস্তা অবরোধ করে রাখে তারা। ওই সময় সেখান থেকে জামায়াত-শিবিরের ছয় কর্মীকে আটক করা হয়।
তেজগাঁও জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) জাহিদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা মিছিল বের করার চেষ্টা করলে মতিঝিল এলাকা থেকে ২১ জনকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর উত্তরা, লালবাগ, মিরপুর, মহাখালী, নয়াপল্টনসহ বিভিন্ন এলাকায় ঝটিকা মিছিল করে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। সন্ধ্যায় ছাত্রশিবিরের এক বিবৃতিতে রাজধানীতে অর্ধশতসহ সারা দেশে শিবিরের দুই শতাধিক নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়।
নাশকতার আশঙ্কায় কঠোর নিরাপত্তা : গতকাল জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি না দেওয়ার কারণ হিসেবে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র ও গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, জামায়াত-শিবির যেকোনো সময় দেশে বড় ধরনের নাশকতা চালাতে পারে। তাদের সঙ্গে জঙ্গিদের যোগাযোগ বেড়েছে। মিছিল-সমাবেশের নামে এর আগে তারা পুলিশের ওপর হামলা, অগ্নিসংযোগসহ অনেক তাণ্ডব চালিয়েছে। তিনি জানান, ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। মিছিল থেকে নাশকতার আশঙ্কায় রাজধানীর নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি এক হয়ে সোমবার রাজধানীতে নাশকতা চালাতে পারে- এমন আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তাব্যবস্থা আরো জোরদার করা হয়। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক ক্যাপ্টেন অভিষেক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গত শনিবার গভীর রাতে গোপন বৈঠক করার সময় মিরপুর থানা এলাকা থেকে পাঁচ জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। সম্প্রতি তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকায় আসে।'
গতকাল সকাল থেকে রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১৩ হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়। জামায়াত-শিবির ঝটিকা মিছিল করতে পারে- এমন এলাকা আগে চিহ্নিত করা হয়। ডিএমপির আটটি ক্রাইম জোনের প্রতিটি থানা এলাকায় জামায়াত-শিবিরের মেস ও আস্তানায় চালানো হয়েছে তল্লাশি।
রাজধানীতে জামায়াত-শিবিরের সমাবেশের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গতকাল সকাল থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য মোতায়েন দেখা যায়। পুলিশ সদস্যদের গায়ে দেখা যায় বিশেষ জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট ও হাতে বন্দুক। এপিসি, রায়ট কার ও জলকামানও প্রস্তুত রাখা হয়।
সার্বিক নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মেহেদি হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশের অনুমতি ছাড়াই জামায়াত-শিবির কর্মসূচি দেয়। এর আগেও তারা কর্মসূচির নামে বিভিন্ন সময়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তাই ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। হরতাল উপলক্ষে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হবে। হামলার আশঙ্কা মাথায় রেখে হরতালের দিন পুলিশের দায়িত্ব বণ্টন করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ অন্যান্য কার্যালয়ে নজরদারি ছাড়াও বাড়তি টহল পুলিশ মোতায়েন করা হবে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধের মামলায় শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে গত মাসের শুরু থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে আসছে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা। কারওয়ান বাজারে আইনমন্ত্রীর গাড়িবহরও তাদের হামলার মুখে পড়ে। এ ছাড়া জয়পুরহাটে এক পুলিশ সদস্যের গায়ে আগুন দেয় ছাত্রশিবিরের কর্মীরা। এসব ঘটনায় এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
দিনাজপুরে একজন নিহত : আমাদের দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, চিরিরবন্দর উপজেলার রানীরবন্দর বাজারে গতকাল সন্ধ্যায় পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিপেটা করে। একপর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে শিবিরের এক কর্মী নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে জামায়াত। তবে পুলিশ বলেছে, তারা এ বিষয়ে কিছু জানে না।
স্থানীয় ছাত্রশিবিরের নেতা আজমির দাবি করেছেন, পুলিশের গুলিতে আহত শিবিরের তিন কর্মীকে চিকিৎসার জন্য রংপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে পথে মারা গেছে খানসামা উপজেলা শাখা জামায়াতের আমির আতাউর রহমানের ছেলে শিবিরকর্মী মুজাহিদ ইসলাম। গুলিবিদ্ধ অন্য দুজন হলেন রানীরবন্দর সাংগঠনিক থানার সভাপতি আসাদুল্লাহ সরকার ও কর্মী বকুল।
আমাদের রংপুর অফিস জানায়, মুজাহিদের লাশ রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে। রংপুর কোতোয়ালি থানার ওসি আলতাফ হোসেন জানান, রাত ৮টার পর রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহত মুজাহিদকে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হওয়ায় কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেনি। তিনি জানান, মুজাহিদ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তাঁরা শুনেছেন, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনার আগে তাকে ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতাল নামে অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল।
রাতে চিরিরবন্দর থানার ওসি তারিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, শিবিরকর্মী নিহত হওয়ার বিষয়টি তাঁদের জানা নেই। তিনি জানান, পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ শটগান থেকে ৮৭টি রাবার বুলেট, চায়নিজ রাইফেলের সাতটি গুলি এবং ২১টি কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে।
ওসি জানান, ঘটনার সময় বিদ্যুৎ ছিল না। ওই সময় কী হয়েছে সেটা তিনি বলতে পারছেন না।
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন জানায়, সংঘর্ষে পুলিশসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে। জামায়াত দাবি করেছে তাদের অন্তত ১২ জন আহত হয়েছে।
এদিকে দিনাজপুর জেলা শাখা শিবিরের সেক্রেটারি আবদুল মতিন জানিয়েছেন, মুজাহিদের জানাজা ও লাশ দাফনের জন্য চিরিরবন্দর ও খানসামা উপজেলা হরতালের আওতামুক্ত থাকবে।
রাজশাহীতে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া : রাজশাহী অফিস জানায়, সন্ধ্যায় নগরীর সাহেব বাজার ও সোনাদীঘি এলাকায় শিবির ঝটিকা মিছিল বের করলে পুলিশ ধাওয়া দেয়। শিবিরকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশও অন্তত ছয়টি রাবার বুলেট ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে শিবিরের পাঁচ নেতা-কর্মী আহত হয়। নগরীর উপকণ্ঠ কাটাখালী বাজারে মিছিল বের করলে পুলিশ লাঠিপেটা করে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ দুটি ঘটনায় পুলিশ ১১ জনকে আটক করেছে। নগরীর বোয়ালিয়া থানার ওসি আলমগীর হোসেন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন।
চট্টগ্রামে বোমা বিস্ফোরণ : চট্টগ্রাম অফিস জানায়, নগরের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল করেছে জামায়াত। এ সময় তারা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়েছে এবং চারটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। নগরের অলংকার মোড়ে বোমা ফাটানোর এ ঘটনায় তিন পথচারী আহত হয়েছে। তবে তাৎক্ষণিক তাদের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (উত্তর) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বোমার ঘটনা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, মিছিলের চেষ্টাকালে ডবলমুরিং ও হালিশহর থানার পুলিশ দুজনকে আটক করেছে। অন্যদিকে চান্দগাঁও থানার পুলিশ আটক করেছে দুজনকে।
সিলেটে আটক ছয় : সিলেট অফিস জানায়, রবিবার থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা ও নগরে অভিযান চালিয়ে জামায়াত-শিবিরের ছয় নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জেলা পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া বিশ্বনাথ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, কানাইঘাট, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরের বিভিন্ন স্থানে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে।
এ ছাড়া নরসিংদীতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা। ওই সময় অন্তত পাঁচটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। গতকাল রাত ৯টার দিকে দগরিয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নারায়ণগঞ্জে পুলিশ জামায়াত-শিবিরের দুজনকে আটক করেছে। হরতালে নাশকতা ঠেকাতে গতকাল দুপুর থেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ। মুন্সীগঞ্জে জামায়াতের দুই নেতা, নারায়ণগঞ্জে জামায়াত-শিবিরের দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
No comments