দেশে-বিদেশে গণমাধ্যম ও সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক by লে. কর্নেল (অব.) ওয়ালিউল্লাহ
সত্যই শক্তি, কখনো সত্যকে গোপন কোরো না- কথাগুলো লেখা রয়েছে এবং বলা হয়েছে ডিফেন্স ইনফরমেশন স্কুলে। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে অবস্থিত পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কোর্সে অংশগ্রহণের সুযোগ আমার হয়েছিল।
ডিপ্লোমা কোর্সটিতে ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার ওপর বিস্তর জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ মেলে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে সারা বিশ্বে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে গণমাধ্যমের অম্লমধুর সম্পর্কের কারণে বিভিন্ন সময় বিচার-বিশ্লেষণ করে ত্রুটিবিচ্যুতি সংশোধন করা হয়। নতুন থেকে নতুনতর ঘটনাগুলো বিভিন্ন সময় ঘটে থাকে। যার ব্যাখ্যা পাওয়ার জন্য যেমন একদিকে ব্যাকুল হয়ে থাকে গণমাধ্যমকর্মীরা, তেমনি অন্যদিকে সংবাদ সরবরাহকারী সংগঠনগুলো ধীরে সংবাদ প্রকাশ করতে চায়। গণমাধ্যমের জন্য প্রয়োজন দ্রুত সংবাদ সংগ্রহ করা এবং একমাত্র দ্রুত সংবাদ প্রদান করেই এ সমস্যার সমাধান দেওয়া সম্ভব হয়েছে। আজকের তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিকায়নের যুগে দ্রুত সংবাদপ্রাপ্তির মাধ্যমগুলো তৎপর রয়েছে। কোনো সংস্থায় ঘটে যাওয়া ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ না করলেও তা ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে প্রকাশিত হয়ে যায়। বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদপত্রগুলো তৎপর হয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রকাশ করে ফেলে। ফলে সংবাদ প্রদানকারী সংস্থা বিব্রত হয়ে পড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনীর সংবাদ গ্রহণ করার জন্য ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় সামরিক সংবাদকর্মী ও বিশ্লেষকরা দায়িত্ব পালন করে থাকে। সামরিক বাহিনীর সংবাদ গ্রহণের ওপর তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। ফলে সংবাদ গ্রহণে পেশাদারিত্ব প্রকাশ পায়। যুক্তরাষ্ট্রে ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী সংবাদকর্মীরা সংবাদ গ্রহণ ও প্রদান করে থাকে। নীতিমালায় সংবাদ প্রদান ও গ্রহণের ধাপগুলো বর্ণিত আছে।
সামরিক বাহিনীতে সংঘটিত বিভিন্ন দুর্ঘটনা অথবা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অফিসার বা মিলিটারি স্পোকসপারসন কতটুকু বলতে পারবেন বা পারবেন না, সাংবাদিকরা ও সামরিক বাহিনীসংক্রান্ত ঘটনার কতটুকু জানতে বা জানাতে পারবেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত শিক্ষা প্রদান করা হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে সাংবাদিকদের ভিন্নতর পরিস্থিতির সম্মুখীন করিয়ে ইন ক্যামেরা, অফ ক্যামেরা প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের কিভাবে তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তারও পুঁথিগত এবং ব্যবহারিক শিক্ষা দেওয়া হয়।
এ যাবৎকাল বিভিন্ন যুদ্ধে সামরিক কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকদের সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণে গঠিত কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট ও সুপারিশমালা আলোচিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশে যুগে যুগে কী যত্নের সঙ্গে মিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলো গড়ে তোলা হয়েছিল, তার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। তথ্যপ্রবাহের এই যুগে তথ্যযুদ্ধ ও তথ্যকৌশল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কর্মকর্তারা সামরিক বাহিনীর সর্বনিম্ন সংগঠন পর্যায়ে নিয়োজিত।
সাংবাদিকদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রতি সব সময় গুরুত্বারোপ করা হয়। সে দেশে ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে করণীয় সম্পর্কে অভিজ্ঞতা বিনিময় একটি চলমান প্রক্রিয়া। সমস্ত কমিশন রিপোর্ট পর্যালোচনা করাকালে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও সাংবাদিকদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক অনেক সময় সুখকর ছিল না। একে অপরকে দোষ দিতে কখনো দ্বিধা করেননি। এসব কারণে অভিযোগের পাহাড় যখন ক্রমান্বয়ে বেড়েছে, তখনই কমিশন গঠিত হয়েছে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিকরা সে দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বিরাজমান প্রশিক্ষণ, সামাজিক, অসামাজিক কার্যকলাপসংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে এবং এর প্রতিকার চাইতে দ্বিধা করে না, সামরিক বাহিনীও এর ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। সংবাদপত্র এবং গণমাধ্যমের প্রতি যথাযথ আচরণের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্ট প্রতিবছর একটি লক্ষ্য নিয়ে সামরিক ও বেসামরিক সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সব সাংবাদিক জানেন, জাতীয় স্বার্থে এবং সেনাবাহিনীর নিরাপত্তার স্বার্থে কতটুকু জানা যাবে ও জানানো যাবে এবং দেশমাতৃকার প্রয়োজনে কখন তাঁরা মার্কিন সরকারকে সমর্থন দেবেন এবং দেবেন না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মার্কিন জনগণের ঐক্য একটি কারণে অটুট রয়েছে, কেননা তারা বোঝে, আজ বিশ্বে নেতৃত্বদানকারী তারাই একমাত্র পরাশক্তি। এ ক্ষেত্রে কূটনীতি আর রণনীতির ব্যর্থতা বা সাফল্যের কথা বিশ্ববাসী যতই বলুক, তারা তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবে- এ রকম দৃঢ় সংকল্প তাদের রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সংবাদ সরবরাহের যে ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রে চালু আছে, তা সংবাদকর্মী ও সামরিক সংবাদ প্রদানকারী মুখপাত্রদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়তে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে এবং বৈরিতা দূর করতে সাহায্য করেছে।
উপমহাদেশের দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী এবং সংবাদকর্মীদের গণমাধ্যম সম্পর্কে করণীয় দেশ দুটির রাষ্ট্রীয় নীতিমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। ভারতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত ডাইরেক্টরেট অব পাবলিক রিলেশন প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংবাদ দেশব্যাপী ২৪টি দপ্তরের মাধ্যমে প্রচার করে থাকে। সৈনিকদের জন্য রেডিও অনুষ্ঠানসহ সৈনিক সমাচার বহু ভাষায় প্রকাশিত হয়ে থাকে। পাকিস্তানে আইএসপিআর একজন মেজর জেনারেল পদবির সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক পরিচালিত। আইএসপিআর মহাপরিচালককে সরাসরি জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ সচিবালয়ের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। পাকিস্তানের সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে সামরিক বাহিনীর খবরাখবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আইএসপিআরের অবস্থা কিছুটা ভিন্নতর। আইএসপিআরের সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক উষ্ণ হওয়ার কথা থাকলেও মাঝেমধ্যে তা শীতল পর্যায়ে চলে যায়। আইএসপিআরের জন্য প্রণীত নীতিমালা সময়োপযোগী নয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন এই পরিদপ্তর সব সময় সংবাদ গ্রহণ করে থাকে সেনা, নৌ ও বিমান সদর দপ্তরের গোয়েন্দা পরিদপ্তর ও অন্যান্য সূত্রের মাধ্যমে। গত কয়েক দশকে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার প্রসার ঘটলেও আইএসপিআরকে যুগোপযোগী করা হয়নি, প্রণয়ন করা হয়নি এর জন্য সময়োপযোগী নীতিমালা। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল এবং সরঞ্জামাদির অভাবে সংবাদ আদান-প্রদানের এই প্রতিষ্ঠানটির জন্য কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। আইএসপিআরে কর্মরত কর্মকর্তাদের উচ্চতর পেশাগত প্রশিক্ষণ না থাকায় একমাত্র পেশাগত অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করেই দায়িত্ব পালন করে যেতে হচ্ছে। এসব কর্মকর্তার দেশে এবং বিদেশে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হলে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের কর্মপদ্ধতিতে গুণগত মান অর্জন সম্ভব হবে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আইএসপিআর একটি পরিদপ্তর হলেও সেনা, নৌ ও বিমান সদর দপ্তরসহ আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের পরামর্শ নিয়ে আইএসপিআরকে তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সংবাদ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার না হলে আইএসপিআরের ওপর এর দায় বর্তায়। সংবাদ কেন প্রচার হলো না, তার ব্যাখ্যা সংবাদমাধ্যমগুলো দিতে বাধ্য না হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এর ব্যাখ্যা দিতে হয় আইএসপিআরকে। কখনো কখনো আইএসপিআর সংবাদমাধ্যমের চাহিদা অনুযায়ী তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে এর বিশ্বাসযোগ্যতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রশ্ন ওঠে। বর্তমান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য প্রচার করতে হবে। সামরিক বাহিনীসংক্রান্ত খবরাখবর পরিবেশনার জন্য গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। গণমাধ্যমকে বুঝতে হবে, স্পর্শকাতর বিষয়ে সংবাদ পরিবেশনকালে তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদপ্রাপ্তির গুরুত্ব যেমন প্রয়োজন, তেমনি ঘটনার তদন্তের স্বার্থে পর্যায়ক্রমে সংবাদপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সংবাদ সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষকে সময় দিতে হবে এবং দায়িত্বশীল সূত্রের কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করে প্রকাশ করলে তা সংশ্লিষ্ট সবার আপত্তির কারণ হবে না। বিশ্বের সব গণমাধ্যমের কার্যক্রমের দিকটি বিশ্লেষণ করে সংবাদপ্রাপ্তি ও সরবরাহের বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। সত্যই শক্তি, সত্যকে গোপন না করে, স্বচ্ছতা এবং দ্রুততার সঙ্গে সংবাদ প্রদান ও গ্রহণের আবহ তৈরি করলেই এ দেশে গণমাধ্যম ও সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হবে।
লেখক : পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিষয়ে
যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত
সামরিক বাহিনীতে সংঘটিত বিভিন্ন দুর্ঘটনা অথবা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অফিসার বা মিলিটারি স্পোকসপারসন কতটুকু বলতে পারবেন বা পারবেন না, সাংবাদিকরা ও সামরিক বাহিনীসংক্রান্ত ঘটনার কতটুকু জানতে বা জানাতে পারবেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত শিক্ষা প্রদান করা হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে সাংবাদিকদের ভিন্নতর পরিস্থিতির সম্মুখীন করিয়ে ইন ক্যামেরা, অফ ক্যামেরা প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের কিভাবে তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তারও পুঁথিগত এবং ব্যবহারিক শিক্ষা দেওয়া হয়।
এ যাবৎকাল বিভিন্ন যুদ্ধে সামরিক কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকদের সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণে গঠিত কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট ও সুপারিশমালা আলোচিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশে যুগে যুগে কী যত্নের সঙ্গে মিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলো গড়ে তোলা হয়েছিল, তার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। তথ্যপ্রবাহের এই যুগে তথ্যযুদ্ধ ও তথ্যকৌশল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কর্মকর্তারা সামরিক বাহিনীর সর্বনিম্ন সংগঠন পর্যায়ে নিয়োজিত।
সাংবাদিকদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রতি সব সময় গুরুত্বারোপ করা হয়। সে দেশে ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে করণীয় সম্পর্কে অভিজ্ঞতা বিনিময় একটি চলমান প্রক্রিয়া। সমস্ত কমিশন রিপোর্ট পর্যালোচনা করাকালে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও সাংবাদিকদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক অনেক সময় সুখকর ছিল না। একে অপরকে দোষ দিতে কখনো দ্বিধা করেননি। এসব কারণে অভিযোগের পাহাড় যখন ক্রমান্বয়ে বেড়েছে, তখনই কমিশন গঠিত হয়েছে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিকরা সে দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বিরাজমান প্রশিক্ষণ, সামাজিক, অসামাজিক কার্যকলাপসংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে এবং এর প্রতিকার চাইতে দ্বিধা করে না, সামরিক বাহিনীও এর ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। সংবাদপত্র এবং গণমাধ্যমের প্রতি যথাযথ আচরণের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্ট প্রতিবছর একটি লক্ষ্য নিয়ে সামরিক ও বেসামরিক সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সব সাংবাদিক জানেন, জাতীয় স্বার্থে এবং সেনাবাহিনীর নিরাপত্তার স্বার্থে কতটুকু জানা যাবে ও জানানো যাবে এবং দেশমাতৃকার প্রয়োজনে কখন তাঁরা মার্কিন সরকারকে সমর্থন দেবেন এবং দেবেন না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মার্কিন জনগণের ঐক্য একটি কারণে অটুট রয়েছে, কেননা তারা বোঝে, আজ বিশ্বে নেতৃত্বদানকারী তারাই একমাত্র পরাশক্তি। এ ক্ষেত্রে কূটনীতি আর রণনীতির ব্যর্থতা বা সাফল্যের কথা বিশ্ববাসী যতই বলুক, তারা তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবে- এ রকম দৃঢ় সংকল্প তাদের রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সংবাদ সরবরাহের যে ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রে চালু আছে, তা সংবাদকর্মী ও সামরিক সংবাদ প্রদানকারী মুখপাত্রদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়তে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে এবং বৈরিতা দূর করতে সাহায্য করেছে।
উপমহাদেশের দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী এবং সংবাদকর্মীদের গণমাধ্যম সম্পর্কে করণীয় দেশ দুটির রাষ্ট্রীয় নীতিমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। ভারতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত ডাইরেক্টরেট অব পাবলিক রিলেশন প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংবাদ দেশব্যাপী ২৪টি দপ্তরের মাধ্যমে প্রচার করে থাকে। সৈনিকদের জন্য রেডিও অনুষ্ঠানসহ সৈনিক সমাচার বহু ভাষায় প্রকাশিত হয়ে থাকে। পাকিস্তানে আইএসপিআর একজন মেজর জেনারেল পদবির সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক পরিচালিত। আইএসপিআর মহাপরিচালককে সরাসরি জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ সচিবালয়ের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। পাকিস্তানের সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে সামরিক বাহিনীর খবরাখবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আইএসপিআরের অবস্থা কিছুটা ভিন্নতর। আইএসপিআরের সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক উষ্ণ হওয়ার কথা থাকলেও মাঝেমধ্যে তা শীতল পর্যায়ে চলে যায়। আইএসপিআরের জন্য প্রণীত নীতিমালা সময়োপযোগী নয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন এই পরিদপ্তর সব সময় সংবাদ গ্রহণ করে থাকে সেনা, নৌ ও বিমান সদর দপ্তরের গোয়েন্দা পরিদপ্তর ও অন্যান্য সূত্রের মাধ্যমে। গত কয়েক দশকে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার প্রসার ঘটলেও আইএসপিআরকে যুগোপযোগী করা হয়নি, প্রণয়ন করা হয়নি এর জন্য সময়োপযোগী নীতিমালা। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল এবং সরঞ্জামাদির অভাবে সংবাদ আদান-প্রদানের এই প্রতিষ্ঠানটির জন্য কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। আইএসপিআরে কর্মরত কর্মকর্তাদের উচ্চতর পেশাগত প্রশিক্ষণ না থাকায় একমাত্র পেশাগত অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করেই দায়িত্ব পালন করে যেতে হচ্ছে। এসব কর্মকর্তার দেশে এবং বিদেশে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হলে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের কর্মপদ্ধতিতে গুণগত মান অর্জন সম্ভব হবে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আইএসপিআর একটি পরিদপ্তর হলেও সেনা, নৌ ও বিমান সদর দপ্তরসহ আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের পরামর্শ নিয়ে আইএসপিআরকে তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সংবাদ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার না হলে আইএসপিআরের ওপর এর দায় বর্তায়। সংবাদ কেন প্রচার হলো না, তার ব্যাখ্যা সংবাদমাধ্যমগুলো দিতে বাধ্য না হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এর ব্যাখ্যা দিতে হয় আইএসপিআরকে। কখনো কখনো আইএসপিআর সংবাদমাধ্যমের চাহিদা অনুযায়ী তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে এর বিশ্বাসযোগ্যতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রশ্ন ওঠে। বর্তমান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য প্রচার করতে হবে। সামরিক বাহিনীসংক্রান্ত খবরাখবর পরিবেশনার জন্য গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। গণমাধ্যমকে বুঝতে হবে, স্পর্শকাতর বিষয়ে সংবাদ পরিবেশনকালে তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদপ্রাপ্তির গুরুত্ব যেমন প্রয়োজন, তেমনি ঘটনার তদন্তের স্বার্থে পর্যায়ক্রমে সংবাদপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সংবাদ সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষকে সময় দিতে হবে এবং দায়িত্বশীল সূত্রের কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করে প্রকাশ করলে তা সংশ্লিষ্ট সবার আপত্তির কারণ হবে না। বিশ্বের সব গণমাধ্যমের কার্যক্রমের দিকটি বিশ্লেষণ করে সংবাদপ্রাপ্তি ও সরবরাহের বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। সত্যই শক্তি, সত্যকে গোপন না করে, স্বচ্ছতা এবং দ্রুততার সঙ্গে সংবাদ প্রদান ও গ্রহণের আবহ তৈরি করলেই এ দেশে গণমাধ্যম ও সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হবে।
লেখক : পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিষয়ে
যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত
No comments