সমকালীন প্রসঙ্গ-ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতি by বদরুদ্দীন উমর
৩০ নভেম্বর ২০১২ তারিখে ফিলিস্তিন জাতিসংঘে একটি অসদস্য রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। অসদস্য রাষ্ট্রের অর্থ ভোট দেওয়ার অধিকারহীন রাষ্ট্র, ভ্যাটিকানের মতো।
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস জাতিসংঘের সাধারণ সভায় রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির জন্য যে প্রস্তাব করেছিলেন তার পক্ষে ১৯৩ সদস্যের মধ্যে ১৩৮টি ভোট প্রদান করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলসহ ৯টি রাষ্ট্র বিরুদ্ধে ভোট দেয়। ৪১টি ভোটদানে বিরত থাকে এবং ৫টির কোনো ধরনের অংশগ্রহণ থাকেনি। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও বিপুল ভোটাধিক্যে ফিলিস্তিন একটি রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি লাভ করেছে। জাতিসংঘের বিগত অধিবেশনেও মাহমুদ আব্বাস এই স্বীকৃতির চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু তার সে চেষ্টা সফল হয়নি। এবার তা হয়েছে। এর থেকেই বোঝা যায়, ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্বের সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তার থেকে বড় কথা ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে মার্কিন ও ইসরায়েল কঠোর অবস্থান নিলেও তাদের অবস্থান আগের থেকে দুর্বল হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্বজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য এখনও পর্যন্ত শক্তিশালী থাকলেও সে আধিপত্য আগের থেকে দুর্বল হয়েছে। তাদের সব রকম আদেশ-নির্দেশ যে সকলে সবসময় মান্য করে চলবে এমন অবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর নেই।
শুধু জাতিসংঘের এই ভোটের মাধ্যমেই নয়, অন্যভাবেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বল হতে থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। মাত্র কয়েকদিন আগে হঠাৎ করেই ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় যে বিমান ও মিসাইল হামলা চালায়, তার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের মধ্যেও এটা দেখা যায়। এই ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে গাজা থেকে ইসরায়েলে রকেট নিক্ষেপ করা হতে থাকে। তাদের আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয়েই এই প্রতিআক্রমণ করতে হয়। এর গ্রাহ্যতা যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ স্বীকার করবেন। কিন্তু গাজার এই রকেট নিক্ষেপকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল উভয়েই ইসরায়েলের ওপর ফিলিস্তিনের আক্রমণ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলে যে, এর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার অধিকার ইসরায়েলের আছে! এই আত্মরক্ষার জন্যই নাকি ইসরায়েল গাজায় বিমান ও মিসাইল আক্রমণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এটা প্রতিআক্রমণ ছাড়া অন্য কিছু নয়! এর থেকে বড় মিথ্যা ও গায়ের জোর দেখানো কথা আর কী হতে পারে? কারণ গাজা নয়, ইসরায়েলই প্রথম গাজার ওপর বিমান ও মিসাইল হামলা পরিচালনা করে। ক্ষমতা মদমত্ত সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার আশ্রিত রাষ্ট্র ইসরায়েল যতই বলুক, এ নিয়ে বিশ্ব জনমত বিভ্রান্ত হয়নি। সারাবিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল আগ্রাসী হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে। তারই প্রতিফলন ঘটেছে ৩০ নভেম্বর জাতিসংঘের ভোটাভুটির মধ্যে।
গাজার ওপর সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলার পর ২৫ নভেম্বর আমি লিখেছিলাম (যুগান্তর) যে, প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর কায়রোতে গিয়ে তার মধ্যপ্রাচ্য নীতি ঘোষণার সময় যা বলেছিলেন পরবর্তীকালে তিনি কার্যত সে নীতি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। এদিক দিয়ে তিনি তার পূর্ববর্তীদের মতো অভিন্ন অবস্থান রক্ষা করেই ইসরায়েলকে সর্বতোভাবে সমর্থন করে যাচ্ছেন। যে কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতিই তার গার্হস্থ্য নীতির গাঁটছড়ায় বাঁধা থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও আর্থিক নীতির ওপর ইহুদিবাদী (তরড়হরংঃ) পুঁজির প্রবল আধিপত্য, এমনকি নিয়ন্ত্রণই হলো সর্বপ্রধান খুঁটি, যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি বাঁধা আছে। ওয়ালস্ট্রিটকে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবি্লউ বুশ যেভাবে সালাম করে চলতেন, বারাক ওবামাও সেই একইভাবে তাকে সালাম করে আসছেন। তারা প্রধানত রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক হলেও ডেমোক্রেটিক পার্টিকেও তাদের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে কাজ করতে হয়। এটা করতে তারা বাস্তব কারণেই বাধ্য থাকে। তবে ২০১২-এর সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে যা ঘটেছে সেটাও লক্ষ্য করার মতো। ওয়ালস্ট্রিট একেবারে খোলাখুলিভাবে রিপাবলিকান প্রার্থী রমনির পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীও প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে রিপাবলিকান প্রার্থীকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিবর্তনের যে হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে তার প্রতিফলনই এর মধ্যে ঘটেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নির্বাচনে জয়লাভ করে প্রেসিডেন্ট ওবামা তার ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্য নীতি পরিবর্তন করতে পারেননি। এর কারণ, মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী সকল আর্থিক বিষয়ের ওপর তাদের নিম্নপক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসের নিয়ন্ত্রণ থাকে। এ কারণে তাকে অগ্রাহ্য করে বা মানিয়ে না চলে প্রশাসন পরিচালনা অসম্ভব। নির্বাচনে পরাজয় সত্ত্বেও নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় রিপাবলিকানরা শুধু অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেই নয়, বৈদেশিক ক্ষেত্রেও যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে ও বজায় রাখতে সক্ষম। এই অবস্থায় যে কোনো ডেমোক্রেটিক মার্কিন প্রেসিডেন্টকেও ইহুদিবাদী পুঁজি এবং ইসরায়েলকে হিসাবের মধ্যে রেখে কাজ করতে হবে এটাই স্বাভাবিক। বারাক ওবামাও তাই করছেন এবং যে কায়দায় সাম্রাজ্যবাদীরা তা করে থাকে, সেই কায়দা অনুযায়ীই তিনি এটা করছেন। তার প্রশাসন করছে।
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে বিরত করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের প্রস্তাব বিপুল ভোটাধিক্যে পাস হওয়ার পরই মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হিলারি ক্লিনটন ফিলিস্তিনকে এর গুরুতর পরিণতি সম্পর্কে হুশিয়ার করেছেন। তার এই হুশিয়ারি থেকে বোঝা যায়, ফিলিস্তিনের এই 'অবাধ্যতার' জন্য তাকে শাস্তি দিতে তারা বদ্ধপরিকর। পররাষ্ট্র সচিবের পর স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ওবামাও একই ভাষায় কথা বলেছেন। শুধু কথা বলেছেন তাই নয়, ফিলিস্তিনকে দেয় অর্থ তারা তাকে না দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন। ২ ডিসেম্বর ইসরায়েলও ঘোষণা করেছে যে, ফিলিস্তিনিদের জন্য যে লাখ লাখ ডলার তারা ট্যাক্স বাবদ আদায় করে, সেটা তারা ফিলিস্তিনের কাছে হস্তাস্তর করবে না। তাছাড়া জাতিসংঘে আলোচ্য প্রস্তাবটি পাস হওয়ার পরই তারা ঘোষণা করেছে যে, তারা জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে নতুন করে তিন হাজার সেটলার বাড়ি তৈরি করবে।
জাতিসংঘ কর্তৃক রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির পর মাহমুদ আব্বাস দেশে ফিরে গিয়ে বলেছেন, 'এখন আমাদের একটা রাষ্ট্র হয়েছে। এটা জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের এক ঐতিহাসিক অর্জন।' ঐতিহাসিক অর্জনই বটে। ১৯৪৮ সালে ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি সাম্রাজ্যবাদীরা ফিলিস্তিনিদের ফিলিস্তিনে তার নিজস্ব ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করে, তাদের এক রাষ্ট্রবিহীন জাতিতে পরিণত করে, সেখানে কৃত্রিমভাবে ইহুদিদের তথা সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় মৌলবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করেছিল। দুনিয়ার বিভিন্ন অংশ থেকে বিরাট সংখ্যায় ইহুদিদের ইসরায়েলে এনে বসতি করিয়ে নতুন রাষ্ট্রটিকে সাম্রাজ্যবাদের একটি মজবুত ঘাঁটি হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। সেই ঘাঁটি রক্ষার জন্য তারা এখনও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের পূর্ব নীতিই কার্যকর করে যাচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো তা হলো, ১৯৪৮ সালে এবং পরবর্তী কয়েক দশকে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থান বজায় রাখার জন্য ইসরায়েলকে যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল এখন সে প্রয়োজন আগের মতো আর নেই। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব, কুয়েত, উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো, জর্ডান, ইরাক, লিবিয়া ইত্যাদি দেশে তারা যেভাবে নিজেদের তাঁবেদার শাসকগোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে পারছে তাতে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য এই রাষ্ট্রগুলোই এখন পরিণত হয়েছে তাদের সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ারে। এদিক দিয়ে পরিস্থিতির মধ্যে পরিবর্তন বেশ কিছুদিন থেকে হচ্ছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা চলে, ইসরায়েল এখন বাস্তবত পরিণত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গলায় আটকানো গাবের মতো। যতদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর ইহুদিবাদীদের বর্তমান নিয়ন্ত্রণ থাকবে, ততদিন এ অবস্থানের পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে এটা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনের অবস্থা যে একই রকম থাকবে এমন নয়। যেভাবে মার্কিন হুমকি উপেক্ষা করে তারা জাতিসংঘে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে, সেভাবেই তারা ভবিষ্যতে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বাধীনতা অর্জন করে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। অন্যদিকে বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে আধিপত্যবাদী অবস্থান আছে, তা অদূর ভবিষ্যতে ওই অঞ্চলের জনগণের উত্থানের মধ্য দিয়ে যে বিলুপ্ত হবে তার শর্ত ইতিমধ্যেই স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। সে পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের পক্ষে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কীভাবে ও কতদূর সম্ভব হবে এটা অগ্রাহ্য করার মতো প্রশ্ন নয়।
৩.১২.২০১২
বদরুদ্দীন উমর :সভাপতি
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
শুধু জাতিসংঘের এই ভোটের মাধ্যমেই নয়, অন্যভাবেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বল হতে থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। মাত্র কয়েকদিন আগে হঠাৎ করেই ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় যে বিমান ও মিসাইল হামলা চালায়, তার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের মধ্যেও এটা দেখা যায়। এই ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে গাজা থেকে ইসরায়েলে রকেট নিক্ষেপ করা হতে থাকে। তাদের আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয়েই এই প্রতিআক্রমণ করতে হয়। এর গ্রাহ্যতা যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ স্বীকার করবেন। কিন্তু গাজার এই রকেট নিক্ষেপকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল উভয়েই ইসরায়েলের ওপর ফিলিস্তিনের আক্রমণ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলে যে, এর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার অধিকার ইসরায়েলের আছে! এই আত্মরক্ষার জন্যই নাকি ইসরায়েল গাজায় বিমান ও মিসাইল আক্রমণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এটা প্রতিআক্রমণ ছাড়া অন্য কিছু নয়! এর থেকে বড় মিথ্যা ও গায়ের জোর দেখানো কথা আর কী হতে পারে? কারণ গাজা নয়, ইসরায়েলই প্রথম গাজার ওপর বিমান ও মিসাইল হামলা পরিচালনা করে। ক্ষমতা মদমত্ত সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার আশ্রিত রাষ্ট্র ইসরায়েল যতই বলুক, এ নিয়ে বিশ্ব জনমত বিভ্রান্ত হয়নি। সারাবিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল আগ্রাসী হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে। তারই প্রতিফলন ঘটেছে ৩০ নভেম্বর জাতিসংঘের ভোটাভুটির মধ্যে।
গাজার ওপর সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলার পর ২৫ নভেম্বর আমি লিখেছিলাম (যুগান্তর) যে, প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর কায়রোতে গিয়ে তার মধ্যপ্রাচ্য নীতি ঘোষণার সময় যা বলেছিলেন পরবর্তীকালে তিনি কার্যত সে নীতি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। এদিক দিয়ে তিনি তার পূর্ববর্তীদের মতো অভিন্ন অবস্থান রক্ষা করেই ইসরায়েলকে সর্বতোভাবে সমর্থন করে যাচ্ছেন। যে কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতিই তার গার্হস্থ্য নীতির গাঁটছড়ায় বাঁধা থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও আর্থিক নীতির ওপর ইহুদিবাদী (তরড়হরংঃ) পুঁজির প্রবল আধিপত্য, এমনকি নিয়ন্ত্রণই হলো সর্বপ্রধান খুঁটি, যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি বাঁধা আছে। ওয়ালস্ট্রিটকে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবি্লউ বুশ যেভাবে সালাম করে চলতেন, বারাক ওবামাও সেই একইভাবে তাকে সালাম করে আসছেন। তারা প্রধানত রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক হলেও ডেমোক্রেটিক পার্টিকেও তাদের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে কাজ করতে হয়। এটা করতে তারা বাস্তব কারণেই বাধ্য থাকে। তবে ২০১২-এর সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে যা ঘটেছে সেটাও লক্ষ্য করার মতো। ওয়ালস্ট্রিট একেবারে খোলাখুলিভাবে রিপাবলিকান প্রার্থী রমনির পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীও প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে রিপাবলিকান প্রার্থীকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিবর্তনের যে হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে তার প্রতিফলনই এর মধ্যে ঘটেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নির্বাচনে জয়লাভ করে প্রেসিডেন্ট ওবামা তার ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্য নীতি পরিবর্তন করতে পারেননি। এর কারণ, মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী সকল আর্থিক বিষয়ের ওপর তাদের নিম্নপক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসের নিয়ন্ত্রণ থাকে। এ কারণে তাকে অগ্রাহ্য করে বা মানিয়ে না চলে প্রশাসন পরিচালনা অসম্ভব। নির্বাচনে পরাজয় সত্ত্বেও নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় রিপাবলিকানরা শুধু অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেই নয়, বৈদেশিক ক্ষেত্রেও যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে ও বজায় রাখতে সক্ষম। এই অবস্থায় যে কোনো ডেমোক্রেটিক মার্কিন প্রেসিডেন্টকেও ইহুদিবাদী পুঁজি এবং ইসরায়েলকে হিসাবের মধ্যে রেখে কাজ করতে হবে এটাই স্বাভাবিক। বারাক ওবামাও তাই করছেন এবং যে কায়দায় সাম্রাজ্যবাদীরা তা করে থাকে, সেই কায়দা অনুযায়ীই তিনি এটা করছেন। তার প্রশাসন করছে।
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে বিরত করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের প্রস্তাব বিপুল ভোটাধিক্যে পাস হওয়ার পরই মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হিলারি ক্লিনটন ফিলিস্তিনকে এর গুরুতর পরিণতি সম্পর্কে হুশিয়ার করেছেন। তার এই হুশিয়ারি থেকে বোঝা যায়, ফিলিস্তিনের এই 'অবাধ্যতার' জন্য তাকে শাস্তি দিতে তারা বদ্ধপরিকর। পররাষ্ট্র সচিবের পর স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ওবামাও একই ভাষায় কথা বলেছেন। শুধু কথা বলেছেন তাই নয়, ফিলিস্তিনকে দেয় অর্থ তারা তাকে না দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন। ২ ডিসেম্বর ইসরায়েলও ঘোষণা করেছে যে, ফিলিস্তিনিদের জন্য যে লাখ লাখ ডলার তারা ট্যাক্স বাবদ আদায় করে, সেটা তারা ফিলিস্তিনের কাছে হস্তাস্তর করবে না। তাছাড়া জাতিসংঘে আলোচ্য প্রস্তাবটি পাস হওয়ার পরই তারা ঘোষণা করেছে যে, তারা জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে নতুন করে তিন হাজার সেটলার বাড়ি তৈরি করবে।
জাতিসংঘ কর্তৃক রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির পর মাহমুদ আব্বাস দেশে ফিরে গিয়ে বলেছেন, 'এখন আমাদের একটা রাষ্ট্র হয়েছে। এটা জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের এক ঐতিহাসিক অর্জন।' ঐতিহাসিক অর্জনই বটে। ১৯৪৮ সালে ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি সাম্রাজ্যবাদীরা ফিলিস্তিনিদের ফিলিস্তিনে তার নিজস্ব ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করে, তাদের এক রাষ্ট্রবিহীন জাতিতে পরিণত করে, সেখানে কৃত্রিমভাবে ইহুদিদের তথা সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় মৌলবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করেছিল। দুনিয়ার বিভিন্ন অংশ থেকে বিরাট সংখ্যায় ইহুদিদের ইসরায়েলে এনে বসতি করিয়ে নতুন রাষ্ট্রটিকে সাম্রাজ্যবাদের একটি মজবুত ঘাঁটি হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। সেই ঘাঁটি রক্ষার জন্য তারা এখনও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের পূর্ব নীতিই কার্যকর করে যাচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো তা হলো, ১৯৪৮ সালে এবং পরবর্তী কয়েক দশকে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থান বজায় রাখার জন্য ইসরায়েলকে যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল এখন সে প্রয়োজন আগের মতো আর নেই। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব, কুয়েত, উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো, জর্ডান, ইরাক, লিবিয়া ইত্যাদি দেশে তারা যেভাবে নিজেদের তাঁবেদার শাসকগোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে পারছে তাতে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য এই রাষ্ট্রগুলোই এখন পরিণত হয়েছে তাদের সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ারে। এদিক দিয়ে পরিস্থিতির মধ্যে পরিবর্তন বেশ কিছুদিন থেকে হচ্ছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা চলে, ইসরায়েল এখন বাস্তবত পরিণত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গলায় আটকানো গাবের মতো। যতদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর ইহুদিবাদীদের বর্তমান নিয়ন্ত্রণ থাকবে, ততদিন এ অবস্থানের পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে এটা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনের অবস্থা যে একই রকম থাকবে এমন নয়। যেভাবে মার্কিন হুমকি উপেক্ষা করে তারা জাতিসংঘে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে, সেভাবেই তারা ভবিষ্যতে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বাধীনতা অর্জন করে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। অন্যদিকে বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে আধিপত্যবাদী অবস্থান আছে, তা অদূর ভবিষ্যতে ওই অঞ্চলের জনগণের উত্থানের মধ্য দিয়ে যে বিলুপ্ত হবে তার শর্ত ইতিমধ্যেই স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। সে পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের পক্ষে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কীভাবে ও কতদূর সম্ভব হবে এটা অগ্রাহ্য করার মতো প্রশ্ন নয়।
৩.১২.২০১২
বদরুদ্দীন উমর :সভাপতি
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
No comments