ডেসটিনির সম্পদ বেচে গ্রাহকদের টাকা ফেরত by আবুল কাশেম

ডেসটিনি গ্রুপের সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকদের বিনিয়োগের অর্থ ফেরত দেবেন প্রশাসক। প্রশাসক নিয়োগের দিন থেকেই ডেসটিনি গ্রুপের সব সম্পদ তাঁর আওতায় জব্দ হয়ে যাবে। একই সঙ্গে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস


কো-অপারেটিভ সোসাইটি থেকে পরিচালকদের সরিয়ে নেওয়া অর্থ বা সরিয়ে নেওয়া অর্থে পরিচালকদের কেনা ব্যক্তিগত সম্পত্তিও জব্দ করবে সমবায় বিভাগ। তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সমবায় বিভাগকে চিঠি পাঠাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া পরিচালকদের কাছ থেকে ফেরত আনা অর্থ বা সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেবেন প্রশাসক।
এসব তথ্য জানা গেছে যৌথ মূলধনী কম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) রেজিস্ট্রার বিজন কুমার বৈশ্য স্বাক্ষরিত ডেসটিনির প্রশাসকের ক্ষমতাসংক্রান্ত একটি প্রস্তাবপত্র, তার ভিত্তিতে কম্পানি আইন সংশোধনের জন্য তৈরি করা চূড়ান্ত খসড়া, ডেসটিনির বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশমালা ও প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। আরজেএসসির প্রস্তাবপত্রটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় গত মঙ্গলবার। সেদিন দুপুরেই এর ভিত্তিতে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয় আন্তমন্ত্রণালয় সভায়। এটি বিদ্যমান কম্পানি আইনের ২৩৩(৩)(খ) ধারায় সংযোজন করা হবে। খসড়াটি আজ বৃহস্পতিবার সকালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। আর দুপুর দেড়টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সভা হওয়ার কথা রয়েছে, সেখানেই খসড়াটি অনুমোদন পেতে পারে বলে জানা গেছে।
আরো জানা গেছে, তদন্ত কমিটির সুপারিশ ও প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরিচালকদের সরিয়ে নেওয়া অর্থ আদায় ও সমবায় আইন লঙ্ঘনের দায়ে পরিচালকদের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশও করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনে মোট তিন হাজার ৭৯৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকার লেনদেনকে আর্থিক অনিয়ম ও সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর বেশির ভাগই গ্রুপটির প্রেসেডিন্ট লে. জে. (অব) হারুন-অর-রশিদ, এমডি রফিকুল আমীনসহ ২২ পরিচালকের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরের পর তা তুলে নেওয়া হয়েছে। এসব অর্থ ডেসটিনি গ্রুপে ফেরত আনা হবে। এ ছাড়া কম্পানির আয়কর ফাঁকি দেওয়ায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), অবৈধ আর্থিক লেনদেন ও ব্যাংকিং কার্যক্রমের অপরাধে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাল-জালিয়াতির অপরাধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আলাদাভাবে মামলা করার অনুরোধ করে চিঠি পাঠাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আজ বৃহস্পতিবার বা আগামী রবিবার এসব মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে চিঠিগুলো পাঠানো হতে পারে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।
বিজন কুমার বৈশ্য স্বাক্ষরিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, 'ডেসটিনি ও সংশ্লিষ্ট অঙ্গসংগঠনগুলোতে নিয়োগ দেওয়া একজন বা একাধিক প্রশাসক দায়িত্ব গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে কম্পানির পরিচালনা পরিষদ বিলুপ্ত বলিয়া গণ্য হইবে এবং পরিচালনা পরিষদের যাবতীয় দায়িত্ব ও ক্ষমতা প্রশাসকের উপর ন্যস্ত হইবে। একই সাথে ডেসটিনির সমস্ত পরিসম্পদ অধিগ্রহণপূর্বক ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের প্রাপ্য অর্থ পর্যায়ক্রমে ফেরত প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা যাইতে পারে।'
প্রশাসকের ক্ষমতা ও কার্যপরিধি সম্পর্কে প্রস্তাবে আছে, কম্পানি আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রশাসক নিশ্চিত হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তিনি দণ্ডবিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার যাবতীয় দায় ও ব্যয়ভার ডেসটিনি গ্রুপের পরিচালক বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আদায় করা হবে। এমনকি প্রশাসকের নির্দেশ মানতে ডেসটিনির কর্মকর্তারা বাধ্য থাকবেন। নিয়োগ পাওয়া প্রশাসক বা তাঁর সহকারীরা যাতে ভবিষ্যতে কোনো ধরনের আইনি ঝামেলায় না পড়েন, সে জন্য দায়মুক্তির সুযোগও থাকবে তাঁদের জন্য।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, 'এই আইনের অধীনে প্রশাসক বা তাহার অধীনস্থ কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরল বিশ্বাসে সম্পাদিত হইয়াছে এইরূপ কোন কার্যের ফলে কেহ ক্ষতিগ্রস্ত হইলে বা উহার সম্ভাবনা থাকিলে, তাহা দেশের প্রচলিত কোন আইনে আমলযোগ্য হইবে না।' একই সঙ্গে প্রশাসককে আইনি সহায়তা দিতে একজন চুক্তিভিত্তিক আইনজীবী নিয়োগের ক্ষমতা রাখারও প্রস্তাব রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, আরজেএসসির প্রস্তাবের ভিত্তিতেই কম্পানি আইন সংশোধন ও প্রশাসকের ক্ষমতা নির্ধারণ করা হচ্ছে এবং সেভাবেই ডেসটিনির অনিয়মের ফয়সালা আর গ্রাহকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, তদন্ত কমিটির সুপারিশে ডেসটিনি গ্রুপের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার পাশাপাশি ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি থেকে গ্রুপটির ২২ পরিচালক যে অর্থ সরিয়েছেন, তাও ফেরত এনে বাজেয়াপ্ত করার কথা বলা হয়েছে। গত ১১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী যখন প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, একই সময় তিনি তদন্ত কমিটির ওই সব সুপারিশ বাস্তবায়নেরও নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক ডেসটিনি গ্রুপের ২২ পরিচালকের সরিয়ে নেওয়া অর্থ বা ওই অর্থে গড়ে তোলা ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা প্রতিষ্ঠানটির অধীনে নিয়ে আসতে সমবায় বিভাগকে যে চিঠি দেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, তাতে সমবায় আইন ভঙ্গের দায়ে পরিচালকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সুপারিশও থাকবে বলে জানা গেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এনবিআরকে যে চিঠি পাঠানো হবে তাতে কম্পানির কর ফাঁকির বাইরেও ডেসটিনির পরিবেশকদের দেওয়া কমিশনের অর্থের আয়কর ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টিও তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হবে।
এদিকে প্রশাসক নিয়োগসংক্রান্ত গত ১৬ অক্টোবরের আন্তমন্ত্রণালয় সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, ডেসটিনি ২০০০ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু অবৈধ আর্থিক লেনদেনের কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ নয়; প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো বিশেষ পণ্যের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও নয়; কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের ব্যবসায়ীও নয়; আবার কোনো পণ্যের আমদানি বা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানও নয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী, ডেসটিনি ২০০০ ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে জনস্বার্থে প্রশাসক নিয়োগের জন্য কম্পানি আইনের ২৩৩(৩)(খ) ধারায় সংশোধনীটি সংযোজনের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। এ সংশোধনী আনা হলে আমানতকারী, সদস্য বা অন্যদের সঙ্গে প্রতারণা করলে, অবৈধ উপায়ে কম্পানির কার্যক্রম পরিচালনা করলে, কম্পানির পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ প্রতারণার সঙ্গে জড়িত হলে, তথ্য গোপন করলে সরকার ওই কম্পানিতে এক বা একাধিক প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কম্পানিকে আগে থেকে শোকজ করার কোনো প্রয়োজন পড়বে না।
এসব বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত সচিব এ টি এম মর্তুজা রেজা এবং আরজেএসসির রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত সচিব) বিজন কুমার বৈশ্যর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। তাঁদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তা রিসিভ করেননি তাঁরা।

No comments

Powered by Blogger.