সোনালী ব্যাংক-মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার by মনির হোসেন
জালিয়াতি করে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে কয়েকটি গ্রুপ প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনায় এখন সারাদেশ তোলপাড়। দেশের ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই জালিয়াতির ঘটনায় শুধু হলমার্ক নামের একটি গ্রুপই তুলে নিয়েছে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
এ ঘটনা প্রথম সংবাদমাধ্যমে আসার পর সবাই এখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ওপর। মনে হচ্ছে, এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত মূল হোতাদের আড়াল করতেই পরিকল্পিতভাবে শুধু পরিচালনা পর্ষদকে টার্গেট করা হয়েছে।
প্রতিটি ব্যাংকের প্রধান দৈনন্দিন কার্যক্রম হচ্ছে আমদানি-রফতানি ব্যবসায়িক কার্যক্রমে অর্থায়ন করা। এটি অনেকটা গ্রাহককে আজ টাকা দিয়ে কাল বা পরশু তা আদায় করে নেওয়ার মতো। কোনো গ্রাহক প্রতিষ্ঠান দেশের ভেতরে বা বিদেশে যে পণ্য কেনাবেচা করে তাতে কয়েকদিনের জন্য অর্থায়নের মাধ্যমে কমিশন আদায় করে ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি ঋণপত্র (এলসি) খোলে এবং ইনল্যান্ড বিল বিক্রি করে ব্যাংকের কাছ থেকে অল্প কয়েকদিনের জন্য টাকা নেয়। ব্যাংক যখন এই বিল কেনে তখন একে বলে ইনল্যান্ড বিল পারচেজ বা আইবিপি। এলসি কিংবা আইবিপির টাকা সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে ব্যাংককে পরিশোধ করে দিতে হয়। এ সময়ের জন্য সর্বোচ্চ হারে সুদের পাশাপাশি কমিশনও দিতে হয়। বড় ও ভালো প্রতিষ্ঠানের ইনল্যান্ড বিল কেনা ব্যাংকগুলোর জন্য লাভজনক ব্যবসা, যা ব্যাংকের দৈনন্দিন বাণিজ্যিক কাজ।
ব্যাংক একটি গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের জন্য কত টাকার এলসি খুলবে বা কত টাকার ইনল্যান্ড বিল কিনতে পারবে_ তা ব্যাংক কর্মকর্তাদের ওপরই নির্ভর করে। এ জন্য একেক ব্যাংকের একেক নিয়ম। সোনালী ব্যাংকের বেলায় এ নিয়মটি ছিল একজন জেনারেল ম্যানেজার বা ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার কোনো একক গ্রাহকের জন্য যত ইচ্ছা টাকার এলসি খোলা বা ইনল্যান্ড বিল কেনার ক্ষমতা রাখতেন। সহকারী জেনারেল ম্যানেজারের জন্য এ ক্ষমতা ছিল কোনো একক বেসরকারি গ্রাহকের জন্য সর্বোচ্চ ২ কোটি টাকা।
সোনালী ব্যাংক রূপসী বাংলা হোটেল শাখার ম্যানেজার আজিজুর রহমানের পদবি ছিল ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার। তিনি কোনো একক গ্রাহকের জন্য যত টাকার ইচ্ছা এলসি খুলতে পারতেন, কিনতে পারতেন যত খুশি তত ইনল্যান্ড বিল।
এ ক্ষমতা পেয়েই ম্যানেজার আজিজুর রহমান সাহেব হলমার্কসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে দেদার এলসি খুলে টাকা দিয়েছেন, নগদ টাকায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ইচ্ছামতো কিনেছেন ইনল্যান্ড বিল। প্রতিষ্ঠানগুলো ৯০ দিনের মধ্যে এলসি বা আইবিপির টাকা পরিশোধ করল কি-না সেদিকেও ভ্রূক্ষেপ করেননি তিনি। অবশ্য শুধু রূপসী বাংলা হোটেল শাখা নয়_ সোনালী ব্যাংকের আরও কয়েকটি শাখার ম্যানেজাররা এ কাণ্ড করেছেন। তবে তাদের কারোই আজিজ সাহেবের মতো 'বুকের পাটা' ছিল না। আজিজ সাহেব বিশ্বাস করেন, 'মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার।' তিনি সোনালী ব্যাংকের ভাণ্ডার লুট করতেই নেমেছিলেন, 'ছুচো মেরে হাত কালা' করতে রাজি নন তিনি।
সোনালী ব্যাংকের কাগজপত্র বলছে : একই গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের মধ্যে পণ্য কেনাবেচার ইনল্যান্ড বিল কিনে আসছিলেন রূপসী বাংলা হোটেল শাখাসহ বেশ কয়েকটি শাখার ম্যানেজাররা। এটি গোচরে আসার পর চলতি বছর ২ জানুয়ারি পরিচালনা পর্ষদের সভায় একই গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের পরস্পরের ড্র করা ইনল্যান্ড বিল না কেনার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এ নির্দেশের থোড়াই কেয়ার করেছেন রূপসী বাংলা শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আজিজুর রহমান।
শুধু তাই নয়, ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ পর্যন্ত ১৪টি শাখার ইনল্যান্ড বিল কেনার দায় দাঁড়ায় এক হাজার ৭০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু রূপসী বাংলা শাখার দায় ছিল ৫৭৩ কোটি টাকা। এ তথ্য গোচরে আসার পর পরিচালনা পর্ষদ এবার শাখা ম্যানেজারদের বেসরকারি একক গ্রাহকের ইনল্যান্ড বিল কেনার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেয় ৩০ কোটি টাকা। আগে যার সীমা ছিল যে কোনো পরিমাণ।
সর্বোচ্চ সীমা কীভাবে ফাঁকি দিতে হয় সেই পদ্ধতি জানেন ডিজিএম আজিজুর রহমান। এই 'মেধাবী' কর্মকর্তা একদিনেই হলমার্ক গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৩০ কোটি টাকা করে ৪০০ কোটি টাকারও বেশি ইনল্যান্ড বিল কিনেছেন!
আজিজ সাহেবের এমন কর্মকাণ্ডের কথা অনেক আগেই সোনালী ব্যাংকের হেড অফিসের কর্মকর্তারা জেনে গিয়েছিলেন। তাকে ঠেকাতে চেষ্টা করেন দু'একজন কর্মকর্তা। রূপসী বাংলা শাখায় অডিট করার জন্য ব্যাংকের এমডির অনুমোদনও আদায় করেন তারা। কিন্তু বাদ সাধেন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মাইনুল হক সাহেব। জানুয়ারিতে অডিটের অনুমোদন পেয়েও ডিএমডির ধমকে এপ্রিলেও অডিট শুরু করতে পারেননি এসব কর্মকর্তা। এমনকি এপ্রিলের শুরুতে এ অডিট টিম রূপসী বাংলা শাখায় যাওয়ার জন্য রওনা দিলে তাদের সেখানে না গিয়ে হেড অফিসে ফিরে আসার নির্দেশ দেন ইন্সপেকশন অ্যান্ড মনিটরিং সেলের জেনারেল ম্যানেজার। এসব বিষয় এমডির নজরে এলেও 'নির্বিকার দর্শকের' ভূমিকা নেন তিনি।
এপ্রিলের ১৬ তারিখে রূপসী বাংলা শাখা পরিদর্শন করেন একজন জেনারেল ম্যানেজার। তার রিপোর্টে উঠে আসে ইনল্যান্ড বিল কেনায় অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারের ভয়াবহ চিত্র। ১৪ ফেব্রুয়ারিতে এ শাখার ইনল্যান্ড বিল কেনার দায় যেখানে ছিল ৫৭৩ কোটি টাকা, মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ১২ এপ্রিল এই দায়ের পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এর প্রায় পুরোটাই ছিল হলমার্ক গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়।
আইন-কানুন আর চক্ষুলজ্জা বলে একটা কথা আছে। তাই এ পরিদর্শন রিপোর্টটি ১৮ এপ্রিল পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করে রূপসী বাংলা শাখা প্রি-অডিটের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগের অনুমতি চান ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবির। এ অনুমতি দেওয়ার পাশাপাশি রূপসী বাংলা শাখায় সব ইনল্যান্ড বিল মঞ্জুরি স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয় পরিচালনা পর্ষদ।
কিন্তু পরিচালনা পর্ষদকে পাত্তা দেওয়ার পাত্র নন ডিএমডি মাইনুল হক, রূপসী বাংলার ডিজিএম আজিজুর রহমান ও তাদের সহযোগীরা। এ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই হলমার্কসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের এলসি খোলা ও ইনল্যান্ড বিল কেনার কাজ চালিয়ে যান তারা। এভাবে আর মাত্র দুই মাসে রূপসী বাংলা শাখা থেকে বের হয়ে যায় আরও আড়াই হাজার কোটি টাকা। সব মিলে এ শাখা থেকে লোপাট হয়ে যায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকাই হাতিয়ে নেয় হলমার্ক গ্রুপ।
প্রথমে এ গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের পরস্পরের বিল না কেনার নির্দেশ, পরে বিল কেনার সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া এবং এপ্রিলে সব বিল কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা পরিচালনা পর্ষদের এমন তিনটি সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার 'হিম্মত' কোথায় পেলেন আজিজুর রহমান ও তার সঙ্গীরা? দুর্জনেরা বলে, আজিজুর রহমানের কাছেই নিয়মিত যাতায়াত করতেন প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা। শুধু তাই নয়, আজিজুর রহমান নিজেও শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে 'ব্রেকফাস্ট' ও 'ডিনার' করার গল্প শোনাতেন সহকর্মীদের।
বর্তমানে গণমাধ্যমে এ আজিজ-মাইনুলদের কথা যতটা না জোর দিয়ে বলা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি সোচ্চার পরিচালনা পর্ষদকে 'ধরার' জন্য। অথচ পরিচালনা পর্ষদ অন্তত কাগজে-কলমে হলেও জালিয়াতি করে ব্যাংকের টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা ঠেকানোর চেষ্টা করেছে। পর্ষদের যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের; কিন্তু পর্ষদের তিন তিনটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগই নেয়নি।
মনির হোসেন :সাংবাদিক
monir@mail.com
প্রতিটি ব্যাংকের প্রধান দৈনন্দিন কার্যক্রম হচ্ছে আমদানি-রফতানি ব্যবসায়িক কার্যক্রমে অর্থায়ন করা। এটি অনেকটা গ্রাহককে আজ টাকা দিয়ে কাল বা পরশু তা আদায় করে নেওয়ার মতো। কোনো গ্রাহক প্রতিষ্ঠান দেশের ভেতরে বা বিদেশে যে পণ্য কেনাবেচা করে তাতে কয়েকদিনের জন্য অর্থায়নের মাধ্যমে কমিশন আদায় করে ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি ঋণপত্র (এলসি) খোলে এবং ইনল্যান্ড বিল বিক্রি করে ব্যাংকের কাছ থেকে অল্প কয়েকদিনের জন্য টাকা নেয়। ব্যাংক যখন এই বিল কেনে তখন একে বলে ইনল্যান্ড বিল পারচেজ বা আইবিপি। এলসি কিংবা আইবিপির টাকা সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে ব্যাংককে পরিশোধ করে দিতে হয়। এ সময়ের জন্য সর্বোচ্চ হারে সুদের পাশাপাশি কমিশনও দিতে হয়। বড় ও ভালো প্রতিষ্ঠানের ইনল্যান্ড বিল কেনা ব্যাংকগুলোর জন্য লাভজনক ব্যবসা, যা ব্যাংকের দৈনন্দিন বাণিজ্যিক কাজ।
ব্যাংক একটি গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের জন্য কত টাকার এলসি খুলবে বা কত টাকার ইনল্যান্ড বিল কিনতে পারবে_ তা ব্যাংক কর্মকর্তাদের ওপরই নির্ভর করে। এ জন্য একেক ব্যাংকের একেক নিয়ম। সোনালী ব্যাংকের বেলায় এ নিয়মটি ছিল একজন জেনারেল ম্যানেজার বা ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার কোনো একক গ্রাহকের জন্য যত ইচ্ছা টাকার এলসি খোলা বা ইনল্যান্ড বিল কেনার ক্ষমতা রাখতেন। সহকারী জেনারেল ম্যানেজারের জন্য এ ক্ষমতা ছিল কোনো একক বেসরকারি গ্রাহকের জন্য সর্বোচ্চ ২ কোটি টাকা।
সোনালী ব্যাংক রূপসী বাংলা হোটেল শাখার ম্যানেজার আজিজুর রহমানের পদবি ছিল ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার। তিনি কোনো একক গ্রাহকের জন্য যত টাকার ইচ্ছা এলসি খুলতে পারতেন, কিনতে পারতেন যত খুশি তত ইনল্যান্ড বিল।
এ ক্ষমতা পেয়েই ম্যানেজার আজিজুর রহমান সাহেব হলমার্কসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে দেদার এলসি খুলে টাকা দিয়েছেন, নগদ টাকায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ইচ্ছামতো কিনেছেন ইনল্যান্ড বিল। প্রতিষ্ঠানগুলো ৯০ দিনের মধ্যে এলসি বা আইবিপির টাকা পরিশোধ করল কি-না সেদিকেও ভ্রূক্ষেপ করেননি তিনি। অবশ্য শুধু রূপসী বাংলা হোটেল শাখা নয়_ সোনালী ব্যাংকের আরও কয়েকটি শাখার ম্যানেজাররা এ কাণ্ড করেছেন। তবে তাদের কারোই আজিজ সাহেবের মতো 'বুকের পাটা' ছিল না। আজিজ সাহেব বিশ্বাস করেন, 'মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার।' তিনি সোনালী ব্যাংকের ভাণ্ডার লুট করতেই নেমেছিলেন, 'ছুচো মেরে হাত কালা' করতে রাজি নন তিনি।
সোনালী ব্যাংকের কাগজপত্র বলছে : একই গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের মধ্যে পণ্য কেনাবেচার ইনল্যান্ড বিল কিনে আসছিলেন রূপসী বাংলা হোটেল শাখাসহ বেশ কয়েকটি শাখার ম্যানেজাররা। এটি গোচরে আসার পর চলতি বছর ২ জানুয়ারি পরিচালনা পর্ষদের সভায় একই গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের পরস্পরের ড্র করা ইনল্যান্ড বিল না কেনার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এ নির্দেশের থোড়াই কেয়ার করেছেন রূপসী বাংলা শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আজিজুর রহমান।
শুধু তাই নয়, ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ পর্যন্ত ১৪টি শাখার ইনল্যান্ড বিল কেনার দায় দাঁড়ায় এক হাজার ৭০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু রূপসী বাংলা শাখার দায় ছিল ৫৭৩ কোটি টাকা। এ তথ্য গোচরে আসার পর পরিচালনা পর্ষদ এবার শাখা ম্যানেজারদের বেসরকারি একক গ্রাহকের ইনল্যান্ড বিল কেনার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেয় ৩০ কোটি টাকা। আগে যার সীমা ছিল যে কোনো পরিমাণ।
সর্বোচ্চ সীমা কীভাবে ফাঁকি দিতে হয় সেই পদ্ধতি জানেন ডিজিএম আজিজুর রহমান। এই 'মেধাবী' কর্মকর্তা একদিনেই হলমার্ক গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৩০ কোটি টাকা করে ৪০০ কোটি টাকারও বেশি ইনল্যান্ড বিল কিনেছেন!
আজিজ সাহেবের এমন কর্মকাণ্ডের কথা অনেক আগেই সোনালী ব্যাংকের হেড অফিসের কর্মকর্তারা জেনে গিয়েছিলেন। তাকে ঠেকাতে চেষ্টা করেন দু'একজন কর্মকর্তা। রূপসী বাংলা শাখায় অডিট করার জন্য ব্যাংকের এমডির অনুমোদনও আদায় করেন তারা। কিন্তু বাদ সাধেন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মাইনুল হক সাহেব। জানুয়ারিতে অডিটের অনুমোদন পেয়েও ডিএমডির ধমকে এপ্রিলেও অডিট শুরু করতে পারেননি এসব কর্মকর্তা। এমনকি এপ্রিলের শুরুতে এ অডিট টিম রূপসী বাংলা শাখায় যাওয়ার জন্য রওনা দিলে তাদের সেখানে না গিয়ে হেড অফিসে ফিরে আসার নির্দেশ দেন ইন্সপেকশন অ্যান্ড মনিটরিং সেলের জেনারেল ম্যানেজার। এসব বিষয় এমডির নজরে এলেও 'নির্বিকার দর্শকের' ভূমিকা নেন তিনি।
এপ্রিলের ১৬ তারিখে রূপসী বাংলা শাখা পরিদর্শন করেন একজন জেনারেল ম্যানেজার। তার রিপোর্টে উঠে আসে ইনল্যান্ড বিল কেনায় অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারের ভয়াবহ চিত্র। ১৪ ফেব্রুয়ারিতে এ শাখার ইনল্যান্ড বিল কেনার দায় যেখানে ছিল ৫৭৩ কোটি টাকা, মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ১২ এপ্রিল এই দায়ের পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এর প্রায় পুরোটাই ছিল হলমার্ক গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়।
আইন-কানুন আর চক্ষুলজ্জা বলে একটা কথা আছে। তাই এ পরিদর্শন রিপোর্টটি ১৮ এপ্রিল পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করে রূপসী বাংলা শাখা প্রি-অডিটের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগের অনুমতি চান ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবির। এ অনুমতি দেওয়ার পাশাপাশি রূপসী বাংলা শাখায় সব ইনল্যান্ড বিল মঞ্জুরি স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয় পরিচালনা পর্ষদ।
কিন্তু পরিচালনা পর্ষদকে পাত্তা দেওয়ার পাত্র নন ডিএমডি মাইনুল হক, রূপসী বাংলার ডিজিএম আজিজুর রহমান ও তাদের সহযোগীরা। এ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই হলমার্কসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের এলসি খোলা ও ইনল্যান্ড বিল কেনার কাজ চালিয়ে যান তারা। এভাবে আর মাত্র দুই মাসে রূপসী বাংলা শাখা থেকে বের হয়ে যায় আরও আড়াই হাজার কোটি টাকা। সব মিলে এ শাখা থেকে লোপাট হয়ে যায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকাই হাতিয়ে নেয় হলমার্ক গ্রুপ।
প্রথমে এ গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের পরস্পরের বিল না কেনার নির্দেশ, পরে বিল কেনার সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া এবং এপ্রিলে সব বিল কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা পরিচালনা পর্ষদের এমন তিনটি সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার 'হিম্মত' কোথায় পেলেন আজিজুর রহমান ও তার সঙ্গীরা? দুর্জনেরা বলে, আজিজুর রহমানের কাছেই নিয়মিত যাতায়াত করতেন প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা। শুধু তাই নয়, আজিজুর রহমান নিজেও শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে 'ব্রেকফাস্ট' ও 'ডিনার' করার গল্প শোনাতেন সহকর্মীদের।
বর্তমানে গণমাধ্যমে এ আজিজ-মাইনুলদের কথা যতটা না জোর দিয়ে বলা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি সোচ্চার পরিচালনা পর্ষদকে 'ধরার' জন্য। অথচ পরিচালনা পর্ষদ অন্তত কাগজে-কলমে হলেও জালিয়াতি করে ব্যাংকের টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা ঠেকানোর চেষ্টা করেছে। পর্ষদের যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের; কিন্তু পর্ষদের তিন তিনটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগই নেয়নি।
মনির হোসেন :সাংবাদিক
monir@mail.com
No comments