লাঞ্ছিত তৈয়ব মাস্টার-সামাজিক অবক্ষয়ের পোস্টার
বয়স সত্তর বছর। তৈয়ব আলী মাস্টার নামে তাকে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার মৈশামুণ্ডা গ্রামের সবাই চেনে-জানে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ এই বৃদ্ধ মানুষটিকেই পিঠমোড়া করে বেঁধে মারতে মারতে গ্রাম ঘুরানো হয়েছে। ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ অনেকেই বিস্ময়ে সে দৃশ্য দেখেছেনও।
বয়সের ভার সয়েও যে মানুষটি এতদিন মাথা উঁচু করে চলতেন, তাকে হঠাৎ গ্রামের মানুষের চোখের সামনে এতটা অপমানের জ্বালা সইতে হবে কেন? তৈয়ব মাস্টার নিজে কোনো অপরাধ করেননি। তার ছেলে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পাওনাদারকে অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি বলে পিতাকেই পুত্রের কৃতকর্মের দায় নিতে হলো! এ কেমন আদিমতা? 'পাওনাদার এমন কাণ্ড নিছক উত্তেজনার বশে ঘটিয়েছেন' বলে যখন একজন স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধি সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেন, তখন আমাদের সমাজের একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে মানসিক বিকারগ্রস্ততা কী পর্যায়ে পেঁৗছেছে, তা অঁাঁচ করে আঁতকে উঠতে হয়। বুধবার সমকালে 'নিষ্ঠুরতা!' শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদনটি যেন আমাদের সমাজের রসাতলে যাওয়ার বাস্তব চিত্র। আমরা মানুষ বলে নিজেদের যারা দাবি করি, তারা কতটা নিচে নামতে পারি সেটাই যেন মূর্ত হয়ে উঠল এই ধরনের ঘটনায়। কেবল নিন্দা জানানোতেই এ ঘটনার প্রায়শ্চিত্ত সম্পন্ন হতে পারে না। যারা এই প্রবীণ মানুষটিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে গ্রাম ঘোরালেন, তারা তো এই সমাজেরই মানুষ। যারা এই ঘৃণ্য কাজটি প্রতিবাদহীন চেয়ে চেয়ে দেখলেন তারাও কি লাজলজ্জার মাথা খেয়েছিলেন, নাকি তাদের মনের সুকোমল বৃত্তিগুলো শুকিয়ে গিয়ে সেখানে চর পড়ে গেছে? আমরা এখন ডিজিটাল যুগে বাস করছি। সমাজেও আধুনিকতার অভিঘাত নানা ধরনের সম্ভাবনার দুয়ার যেমন খুলে দিচ্ছে, আবার সঠিক উপলব্ধির অভাবে বিকৃতিও ছড়িয়ে পড়ছে। তৈয়ব আলী মাস্টারের অপমানিত হওয়ার ঘটনাটি সে বিকৃতিরই নগ্ন প্রকাশ। বিস্ময়কর হলো, গোটা গ্রামে এ নিয়ে কোনো ধরনের বাদ-প্রতিবাদের শোর উঠল না! আমাদের সমাজ কি আত্মকেন্দ্রিকতায় এতটাই অন্ধ হয়ে যাচ্ছে? চারপাশে যা ঘটছে তা থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার একটা স্বার্থপর নিষ্ক্রিয় মনোভাব কাজ করে এখন অনেকের মধ্যেই। এ ঘটনা যেন আমাদের সমাজের অবক্ষয়ের পোস্টার। শুধুু আইন করে, শাস্তি বিধান করে কি এ থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে?
No comments