লুট হওয়া বুদ্ধমূর্তিগুলো কোথায়? by আব্দুল কুদ্দুস

সেই রাতে দুর্বৃত্তরা মন্দিরে হামলা চালিয়ে ৫০০ বছরের পুরোনো প্রায় এক কেজি ওজনের একটি স্বর্ণের বুদ্ধমূর্তি, ৬০০ বছরের পুরোনো দেড়ফুট লম্বা একটি কষ্টিপাথরের মূর্তিসহ ৬৪টি মূল্যবান মূর্তি লুট করে। কিন্তু ঘটনার এত দিন পরও পুলিশ কোনো মূর্তি উদ্ধার করতে পারেনি।


গত সোমবার সকালে এ কথা বলেন কক্সবাজার জেলার রামুর চেরাংঘাটায় অবস্থিত ‘রামু রাখাইন বড় মন্দির’ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক উ থোয়াই চিং রাখাইন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা এই মন্দিরসহ রামুর ১২টি মন্দিরে অগ্নিসংযোগ, হামলা ও লুটপাট চালায়। বুড্ডিস্ট ফেডারেশন কক্সবাজার জেলার নেতাদের অভিযোগ, ওই দিন রামু, উখিয়া ও টেকনাফের ১৯টি মন্দির থেকে প্রায় ৩০০ বুদ্ধমূর্তি লুট করে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। মন্দির ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এ পর্যন্ত পুলিশের পক্ষ থেকে ১৭টি মামলা করা হলেও মূর্তি লুটের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।
উ থোয়াই চিং প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূর্তি লুট করার পাশাপাশি হামলাকারী ব্যক্তিরা আরও ৫০টি মূল্যবান ধাতব বুদ্ধমূর্তি ভাঙচুর করে। হামলার পর আমরা নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তাই থানায় মামলাও করা হয়নি।’
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘লুণ্ঠিত ৬০টি রুপার বুদ্ধমূর্তির বয়সও ৪০০ থেকে ৫০০ বছর। ১৮৮৫ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠার আগে থেকে বুদ্ধমূর্তিগুলো বিভিন্ন মন্দিরে সংরক্ষিত ছিল।’
উপজেলার শ্রীকুলের লালচিং বৌদ্ধমন্দিরের ভিক্ষু ওয়েছেকা ছারা মহাথেরো (৮৭) বলেন, ‘৩০ সেপ্টেম্বর রাতে এই মন্দিরে হামলা চালিয়ে ১০টি বুদ্ধমূর্তি লুট করে দুর্বৃত্তরা। লুট হওয়া মূর্তিগুলো এখনো উদ্ধার হয়নি।’
বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশন জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক বঙ্কিম বড়ুয়া জানান, রামুর ১২টিসহ উখিয়া ও টেকনাফের ১৯টি প্রাচীন বৌদ্ধমন্দিরে হামলা চালিয়ে দুর্বৃত্তরা প্রায় ৩০০টি মূর্তি লুট করে। এ ছাড়া দুর্বৃত্তরা প্রায় সাত শতাধিক বুদ্ধমূর্তিসহ মূল্যবান দলিলপত্র পুড়িয়ে দেয়। সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় শত কোটি টাকা।
রামুর বৌদ্ধমন্দিরগুলো থেকে মূর্তি লুটের পাশাপাশি বহু মূল্যবান মূর্তিও ধ্বংস করেছে দুর্বৃত্তরা। রামুর কেন্দ্রীয় সীমা বিহারে দুটি কষ্টিপাথরের, দুটি স্বর্ণের, ৫০টি পিতলের, ২০টি রুপার ও ৩০টি ব্রোঞ্জের মূর্তিসহ ছোট-বড় প্রায় ৩০০টি বুদ্ধমূর্তি আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে।
সীমা বিহারের অধ্যক্ষ ও বৌদ্ধধর্মীয় গুরু সত্যপ্রিয় মহাথেরো (৮৩) বলেন, ‘বুদ্ধমূর্তির পাশাপাশি আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে বার্মিজ, বাংলা, সিংহলি ও ইংরেজি ভাষায় লেখা প্রায় পাঁচ হাজার প্রাচীন ত্রিপিটক, পাণ্ডুলিপি, পুঁথিপত্র এবং দুর্লভ বই। লুট হয়েছে অসংখ্য ধাতব বুদ্ধমূর্তি। শুধু এই একটি মন্দিরে ক্ষতি হয়েছে পাঁচ কোটি ২৯ লাখ টাকার সম্পদ।’
মন্দিরের আবাসিক পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু জানান, প্রায় আট মাস আগে থাইল্যান্ড থেকে এই মন্দিরে আনা হয়েছিল পাঁচ মণ ওজনের ১২ ফুট উঁচু ও আট ফুট প্রস্থের সোনালি রঙের অষ্টধাতুর একটি বুদ্ধমূর্তি। জায়গার অভাবে বিশাল এই মূর্তিটি বিহারের নিচে রাখা হয়েছিল। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে আগুনে পুড়ে এই মূর্তিটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সীমা বিহার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক তরুণ বড়ুয়া বলেন, ‘আগুনে পোড়া মন্দিরের ধংসস্তূপের ভেতরে এখনো অনেক মূল্যবান ধাতবমূর্তি পড়ে রয়েছে। লুট হওয়া মূর্তি উদ্ধার হবে কি না, সে বিষয়েও সংশয় রয়েছে। যে পুলিশ মন্দির রক্ষা করতে পারেনি, তাঁরা মূর্তি উদ্ধার করবে—এমন ভরসা আমাদের নেই।’ এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘বৌদ্ধমন্দির থেকে মূর্তি লুটের ব্যাপারে কেউ অভিযোগ করেনি। কোনো তালিকাও পুলিশকে সরবরাহ করা হয়নি। তার পরও পুলিশ লুণ্ঠিত মূর্তির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে উদ্ধারের তৎপরতা চালাচ্ছে।’

No comments

Powered by Blogger.