চারদিক- ব্যাঙ দিয়ে মাছ ধরা by ফারুখ আহমেদ

জৈন্তাপুর থেকে হরিপুর। জৈন্তাপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে চেপে হরিপুর বাসস্ট্যান্ডে আসতে হয়। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করেও যাওয়া যায়। যাওয়া যায় ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে চেপে। আমরা বাসে চেপে বসলাম।


আমাদের গন্তব্য রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট। হরিপুর পর্যন্ত বাসে এলেও এবার আমাদের অটোরিকশায় চেপে রাতারগুল যেতে হবে। এখানকার অটোরিকশাচালকেরা আমাদের দেখলে ভাড়া দ্বিগুণ করে ফেলেন। সে জন্য পূর্বপরিচিত স্থানীয় একজনকে অটোরিকশা ভাড়া করতে পাঠিয়ে পাশের দোকানে ভাজাভুনা খেতে বসি।
সিলেটে বেড়াতে এলে জৈন্তাপুর খাসিয়া সংঘের সভাপতি বিশ্বজিৎ সুমেরের বাড়িতে উঠব, এমনটাই নিয়ম হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম ঘটল। এবার ডেরা গেড়েছি সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রে। দারুণ জায়গা সাইট্রাস। রূপ-রস আর গন্ধ নিয়ে প্রাকৃতিক অকৃত্রিমতা। ইতিমধ্যে অটোরিকশা ভাড়া হয়ে গেছে, আসা-যাওয়া ৫০০ টাকা। আমরা খুশি মনে পথে নামি। গত তিন দিন বৃষ্টির জন্য ঘর থেকে বের হতে পারিনি। আজ আকাশ একেবারে ফকফকা। মানানসই শরতের আকাশ যাকে বলে, আজকের আকাশ ঠিক তাই। আমরা চলেছি সালুটিকরের দিকে। রাস্তার দুই পাশে ধানখেত। দূরে মেঘালয়ের পাহাড়। এসবের সঙ্গে ঘন সবুজ প্রকৃতি আর পাখপাখালির কলতান মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে দেখছিলাম। এখানে প্রকৃতি যেন অকৃপণভাবে উজাড় করে দিয়েছে তার যাবতীয় ভালোবাসা। চলতি পথে প্রচুর তেজপাতাগাছ এখানকার উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ।
ফতেহপুর আসতেই চালকের ডাক শুনে সংবিৎ ফিরে পাই। আমরা গন্তব্যে চলে এসেছি। অটোরিকশা থেকে যে জায়গায় নামলাম, তার নাম মহিষখেত। এখানে গ্রামজুড়ে ধানের সুঘ্রাণ। সে ঘ্রাণে ঘ্রাণে আমরা সামনে এগিয়ে চলি। এতক্ষণ চমৎকার পিচঢালা মোটরপথে চলছিলাম। এবার পায়ে চলা মেঠোপথ ধরলাম। প্রায় এক কিলোমিটার পথ হেঁটে তারপর নৌকায় চড়ে যেতে হবে রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে।
আমাদের সঙ্গে অনেকেই হাঁটছেন। হণ্টনরত তেমন একজনের হাতে মাছ ধরার ছিপ দেখে কৌতূহলী হই। ‘মাছ ধরবেন বুঝি’—প্রশ্ন করি। জবাবে তিনি যা বলেন তার সারমর্ম হলো, তিনি আসলে মাছ না, ব্যাঙ ধরেন। ভাবলাম, খাওয়ার জন্য ব্যাঙ ধরেন। দারুণ! এবার প্রশ্ন করি, ‘আপনারা ব্যাঙ খান?’ তিনি হেসে কুটিকুটি। ভাবি, কোথায় ভুল বললাম! ভুল আমি বলেছি, আর সে ভুল ভাঙায় পাশের জন; বলেন, ‘তিনি ব্যাঙ ধরেন। কারণ, ব্যাঙ দিয়ে বড় মাছ ধরবেন।’
বর্ষা শেষ, তবু সিলেটের হাওরাঞ্চলের পানি নামেনি। বর্ষার শুরুতে এখানে মৎস্য শিকারিদের তৎপরতা শুরু হয়। সে তৎপরতার এক অংশ ব্যাঙ ধরা। নিরঞ্জন বিশ্বাস একজন ব্যাঙ শিকারি। বড়শি দিয়ে ব্যাঙ ধরা তাঁর পেশা। বিবাহিত নিরঞ্জন বিশ্বাসের তিন ছেলেমেয়ে। থাকেন গোয়াইনঘাটের বৈঠাখালী গ্রামে। বাবার নাম পুতুল বিশ্বাস। বাবার কাছেই ব্যাঙ ধরার দীক্ষা পেয়েছেন। ফতেহপুর ইউনিয়নের পাহাড়ি ঝরনা নিরঞ্জন বিশ্বাসের কাজের পরিধি। এখানকার পানিতে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিনি ব্যাঙ শিকার করে থাকেন। মূলত, তিনি বড়শি দিয়ে ব্যাঙ ধরলেও মাঝেমধ্যে ঝরনার পানি হাতড়েও ব্যাঙ ধরে থাকেন। এভাবে ব্যাঙ ধরতে গিয়ে প্রায় সময়ই ভয়ানক অভিজ্ঞতার সামনে পড়তে হয় তাঁকে। যেমন, একদিন ব্যাঙ মনে করে হাত ওপরে তুলতেই চেয়ে দেখেন, তাঁর হাতে সাপ চলে এসেছে। এবার জানতে চাই, ‘সাপ দেখে ভয় করে বুঝি?’ নিরঞ্জন বিশ্বাস বলেন, ‘আগে ভয় করত। পরে দেখছি ভয়ের কিছু নাই, ঢোঁড়া সাপ কামড়ায় না! আমার এক ভাই ব্যাঙ ধরতে গিয়ে সাপ ধরে ভয়ে অন্য পেশায় চলে গেল।’
নিরঞ্জন বিশ্বাস প্রতিদিন শতাধিক ব্যাঙ শিকার করেন। সে ব্যাঙ বিকেলে মাছের কারবারিদের কাছে বিক্রি করে দেন। ব্যাঙ বিক্রি করে প্রতিদিন তাঁর আয় হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। সপ্তাহের দুই দিন তিনি আবার ব্যাঙ বিক্রি না করে শিকার করা ব্যাঙ দিয়ে মাছ ধরেন। ‘দুই দিন আমি বড়শি বাই। চিরিঙ্গি বিলের মাছ খুব টেস্ট। আপনি সেই মাছের স্বাদ একবার নিলে আজীবন মনে রাখবেন।’ বললেন নিরঞ্জন বিশ্বাস। তিনি বলে চলেন, ‘এই বিলে সব ধরনের মাছ আছে। তবে ব্যাঙ দিয়ে ধরা হয় বড় বোয়াল মাছ। বড়শিতে বোয়াল ছাড়া আরও ধরা পড়ে শোল, গজার, কালবাউশ মাছ। ব্যাঙ শিকারে খুব মজা পাই, সঙ্গে মাছ শিকার খুব আনন্দদায়ক। ব্যাঙের জন্য ঘোরাঘুরি করাই আমার কাজ।’ বলে তিনি আমাদের থেকে আলাদা হয়ে অন্য পথে তাঁর গন্তব্যে চললেন। একটু দূরে চলে গেলে মনে হয় তিনি কেমন আছেন জানা হলো না। এবার চিৎকার করে জানতে চাই, ‘ভাই, কেমন কাটছে জীবন?’
নিরঞ্জন বিশ্বাস সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ‘ব্যাঙ বা মাছ যা-ই ধরি না কেন, বড়শি বাইতে খারাপ লাগে না। বড়শি নিয়া খুব ভালা আছি!’
বি. দ্র. নিরঞ্জন বিশ্বাসের সঙ্গে সিলেটের স্থানীয় ভাষায় কথা হচ্ছিল। আমি তাঁর মুখের ভাষা লেখায় বসিয়ে দিতে পারলাম না বলে দুঃখ প্রকাশ করছি।
ফারুখ আহমেদ
farukh.ahmed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.