খোলা চোখে- তিন দেশের তালেবান by হাসান ফেরদৌস
তারা তিন দেশের তালেবান: পাকিস্তান, আমেরিকা আর বাংলাদেশের। ভিন্ন ভিন্ন দেশের হলে কী হবে, কাজকর্মে তারা সবাই এক। পাকিস্তানি তালেবের নাম আমরা জানি না, তবে তিনি যে প্রকৃত তালেবান সদস্য, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
খোদ তালেবানের সদর দপ্তর থেকে রীতিমতো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়েছে, সে যা করেছে বেশ করেছে, আরও করবে। কাজের কাজ যা করেছে, তা হলো, মালালা ইউসুফজাই নামের ১৪ বছরের এক কিশোরীর মাথায় দিনে-দুপুরে গুলি করেছে। ঘটনা ঘটেছে পাকিস্তানের সোয়াতে। তালেবানি সন্ত্রাসের কারণে পাকিস্তানে অসংখ্য মেয়ের স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। মেয়েদের শিক্ষার অধিকার দাবি করার জন্য মালালা অনেক আগে থেকেই তালেবানের রোষের শিকার। চিঠিপত্র এসেছে, মুখে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মালালা ভীত হয়নি। স্কুলে সে যাবেই, তালেবানরা যত হুমকিই দিক না কেন—এই ছিল তার প্রতিজ্ঞা, রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। এতটুকু ফুটফুটে মেয়ে, আর তার চ্যালেঞ্জের ভয়ে অস্থির পুরো তালেবান নামের বিশাল নেটওয়ার্ক। আমেরিকার পেন্টাগন তাদের ভয়ে কাঁপে। পাকিস্তানের সেনা সদর দপ্তর তাদের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য বিমানবহর ও সাঁজোয়া বাহিনী নামায়। এমন প্রবল প্রতাপশালী যে তালেবান, তারা কিনা ভীতসন্ত্রস্ত ১৪ বছরের এক বাচ্চা মেয়ের কাছে! তালেবানের এক মুখপাত্র গর্ব করে বলেছে, শুধু মালালাকে মারার জন্য আলাদাভাবে দুজন তালেবকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। মস্ত পুঙ্গবই বটে তারা!
তালেবানের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মালালা মেয়ে বা তার বয়স অল্প, সেটা কোনো ব্যাপার নয়। সে যা করছিল, তা ইসলাম ধর্মের জন্য ক্ষতিকর। এমন অপরাধের জন্য পুরুষ বা নারী, তা যে বয়সেরই হোক, তাকে খুন করা মহা পুণ্যের কাজ। করাচির ডন পত্রিকায় একজন তালেবান মুখপাত্রের কথা ছাপা হয়েছে। সেই মহা পুঙ্গব যুক্তি দেখিয়েছেন, ‘যদি কেউ ভেবে থাকে যে শিক্ষার কথা বলার জন্য মালালাকে “টার্গেট” করা হয়েছিল, তা হলে সম্পূর্ণ ভুল করা হবে। মালালাকে নিশানা করা হয়েছিল কারণ সে “সেকুলারিজম” ও তথাকথিত “এনলাইটেড এডুকেশন”-এর পক্ষে যুক্তি দেখাচ্ছিল।’
মালালা জীবন-মৃত্যু নিয়ে লড়েছে। খুব কাছ থেকে তার মাথায় গুলি করা হয়েছিল। সেই গুলি মাথায় না লেগে ঘাড়ে লাগে, অস্ত্রোপচারের পর তা বের করা গেছে, কিন্তু মেয়েটি এখনো বিপদ কাটিয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি সুস্থ অবস্থায় সে ফিরতে পারবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
দ্বিতীয় তালেবান আমেরিকার। আসলে মিসর থেকে আসা এক কপ্টিক খ্রিষ্টান। লোকজন ভাড়া করে সে এক ফিল্ম বানিয়েছে, যার উদ্দেশ্য ইসলামের মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো। খুবই নিম্নমানের, কুরুচিসম্পন্ন ফিল্ম। যেসব লোক দিয়ে অভিনয় করানো হয়েছে, তারা জানত না আসলে এ রকম একটা ফিল্ম বানানো হবে। ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায়, অথচ নিজের সঠিক নামটি পর্যন্ত লুকিয়ে রেখেছিল লোকটি। ইউটিউবে আরবি অনুবাদে সেই ফিল্মের সামান্য কয়েক মিনিটের একটা ট্রেইলার ছাড়া হয়েছিল, তার না আছে মাথা, না আছে মুণ্ডু। তাই নিয়ে দেশ-বিদেশে মহা হুলুস্থুল। লিবিয়ায় আমেরিকান রাষ্ট্রদূতসহ কম করে হলেও ৫০ জন মানুষ ইতিমধ্যে হতাহত হয়েছে। সেই লোক এখন জেলে। ফিল্ম বানানোর জন্য নয়; জালিয়াতি, মিথ্যা পরিচয় ও অভিবাসন আইন ভঙ্গের অভিযোগে। এদিকে আবার তার পক্ষ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন ফ্লোরিডার এক পাদ্রি। ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পোড়ানোর আয়োজন করে বিস্তর নাম কুড়িয়েছেন তিনি। তাঁর সেসব কাণ্ড-কারখানার প্রতিবাদে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে যে হানাহানির ঘটন ঘটে, তাতে ডজন খানেক মানুষ হতাহত হয়েছে। কিন্তু তার পরও সেই লোকের টিকিটিও ছোঁয়া যায়নি, কারণ আমেরিকায় মত প্রকাশের অধিকার শাসনতান্ত্রিকভাবে স্বীকৃত। এমনকি সেই অধিকার প্রকাশের কারণে যদি খুনখারাবির মতো ঘটনা ঘটে, তবুও!
তৃতীয় তালেবান আমাদের বাংলাদেশের। মুক্তাদির নামে ছাত্রশিবিরের এক কর্মী উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ ছাত্রের ফেসবুক একাউন্টে ট্যাগ করা পবিত্র কোরআনের অবমাননাকর একটি ছবির প্রিন্ট-আউট নিয়ে রামু শহরে উত্তেজনা ও ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দেয়। আর তাই নিয়ে মানুষ—শুধু জামায়াতই নয়, অন্যান্য দলের সমর্থকেরাও আছেন—এমন আহত বোধ করেন যে ডজন খানেক বৌদ্ধমন্দির পুড়িয়ে মনের জ্বালা মিটিয়েছেন। শুনেছি, পুলিশ বাবাজিরাও দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব তাণ্ডব দেখেছেন। নিজেরা যে কত বড় ধার্মিক, তা প্রমাণ করতে হবে তো! এদের বড় ভাইয়েরাই ১৯৭১-এ ধর্মরক্ষার নামে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল। ভাবা হয়েছিল, স্বাধীনতার পর গত চার দশকে ধর্মের সেই সব ভূতকে বোতলে ঢোকানো গেছে। সে কথা যে কত বড় ভুল, রামু ও কক্সবাজারের হানাহানি থেকে তা প্রমাণিত হলো।
তিন দেশের ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা, কিন্তু তাদের মধ্যে এক সুনিশ্চিত যোগসূত্র রয়েছে। তিন দেশেই ধর্মের নামে যা করা হলো, ভদ্র ভাষায় তাকে বলা যায় ধর্মান্ধতা। পাকিস্তানি তালেবান যুবকটি ভেবেছে, মালালাকে খুন করার চেষ্টা করে সে এক মস্ত কাজ করেছে, নিজ ধর্মকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছে। আমেরিকার সেই চলচ্চিত্র নির্মাতা ও তার সেঙাত ধর্মযাজক ভেবেছেন যে অন্য ধর্মকে অবমাননা করলে নিজের ধর্ম খুব মহান বলে প্রমাণিত হয়। আর বাংলাদেশের ছাত্রটি ভেবেছে, বৌদ্ধদের ধর্মমন্দিরে আক্রমণ করে বিশেষ পুণ্যের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা মন্দ কী!
বাংলাদেশের যুবকটির মতো এক কাণ্ড করে মস্ত নাম কিনেছেন এক পাকিস্তানি মোল্লা। রিমশা নামের ১৪ বছরের এক মানসিক প্রতিবন্ধীকে গত মাসে সে দেশের ‘ধর্মীয় অবমাননা’ আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযোগ, ইসলামাবাদের মেহেরাবাদ মহল্লায় মেয়েটি কুড়ানো কাগজপত্র পোড়ানোর সময় পবিত্র কোরআনের কয়েকটি পাতাও পুড়িয়ে ফেলেছে। পরে জানা গেল, মেয়েটি নয়, হাফিজ মোহাম্মদ চিশতি নামের এক মোল্লা কোরআনের দগ্ধ কাগজ অন্যান্য পোড়া কাগজের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। তাঁর দুই সহকারী বিচারকের সামনে সাক্ষী দেওয়ার সময় জানিয়েছেন, মোল্লা চিশতিকে এমন কাজ করতে তাঁরা নিষেধ করেছিলেন। জবাবে তিনি উল্টো সবক দিয়ে বলেন, ‘খ্রিষ্টানদের দেশ থেকে তাড়ানোর এটাই একমাত্র পথ।’
বলাই বাহুল্য, এসব দুষ্কর্মের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম বা খ্রিষ্টধর্মে ভিন্নমত বা ভিন্ন ধর্মাচারের জন্য হত্যা করতে হবে বা অন্য ধর্মের নামে কুৎসা রটাতে হবে, এমন কোনো নির্দেশ নেই। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের দেশ থেকে তাড়াতে হবে, সে কথাই বা কোথায় বলা আছে? এই দুই ধর্মের মূলে রয়েছে শান্তি ও প্রেমের বাণী। বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলামের অনুসারী। তাদের বিশ্বাসের ভিত কি এতই ঠুনকো যে নাবালিকা হত্যার চেষ্টা চালাতে হবে, অন্যের ধর্মকে কলুষিত করতে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিতে হবে?
এতসব কাণ্ডের পর আঁধারে আলোর মতো এক চিলতে ঝিলিক নজরে এসেছে। তালেবানি কাণ্ডের বিরুদ্ধে এই তিন দেশের প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছে। পাকিস্তানে শিশু-কিশোরেরা রাস্তায় নেমে এসেছে, তাদের বুকে ব্যানার: আমরা সবাই মালালা। সরকারের মন্ত্রী বাহাদুররাও রাস্তায় নেমেছেন, এমনকি জামায়াতি মোল্লারাও। আমেরিকায় শুধু পত্রপত্রিকায় এই ইসলামের বিরুদ্ধে ফিল্মটি নিয়ে প্রতিবাদ ও সমালোচনা হয়েছে তা নয়, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে একাত্মতা প্রকাশ করে মিছিল করেছে, আন্তধর্ম সমাবেশ হয়েছে। রামুর ঘটনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশেও প্রতিবাদ হয়েছে সর্বস্তরে। শুধু ছাত্র-বুদ্ধিজীবীরা নন, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও প্রতিবাদ এসেছে। কিন্তু তারা নিজেরাই যেখানে সেই ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তাদের সবার হাতেই যখন বিষ্ঠা, যত বক্তৃতা-বিবৃতিই তারা দিক না কেন, তাতে বিশ্বাস হবে না। কিন্তু আশার কথা হলো, দেশের সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে মিলিত হয়েছে। বেসরকারিভাবে তদন্তের উদ্যোগ ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের তরফ থেকে নেওয়া হয়েছে। দেশের প্রতিটি প্রধান দলকেই তারা বিচারের কাঠগড়ায় তুলেছে।
ফলে রামুর ঘটনায় আহত ও উদ্বিগ্ন হয়েছি বটে, কিন্তু সঙ্গে আশান্বিতও হয়েছি।
প্রবাসে, এই নিউইয়র্কেও একাধিক সংহতি সমাবেশ হয়েছে। তার একটির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিল প্রবাসী চিত্রকর গোষ্ঠী। তাদের সঙ্গে যোগ দেন নাট্যকর্মী, সাংবাদিক, ছাত্র, কর্মজীবী। সেই সমাবেশে সবার চোখে আমি শুধু ক্রোধ দেখেছি, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দেখেছি এক গভীর বেদনাবোধ। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন আমাদের ছিল। সেই স্বপ্নকে হত্যার চেষ্টা চলছে। সেই চেষ্টা যেকোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে। জ্যাকসন হাইটসের বাঙালিপাড়ায় মোমবাতি নিয়ে হাতে হাত ধরে যারা সড়ক প্রদক্ষিণ করে, তাদের চোখে সেই শপথের প্রত্যয় দেখেছি।
এর আগেও আমরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নাগরিক প্রতিবাদের ঘটনা দেখেছি। কিন্তু সেই প্রতিবাদ কখনো আন্দোলনে পরিণত হয়নি। কারণ অসাম্প্রদায়িকতাকে আমাদের জাতীয় নীতিবোধের অবিভাজ্য অংশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি। অন্য অনেক কিছুর মতো এই প্রশ্নেও আমরা নেতৃত্বের জন্য মুখ চেয়ে তাকিয়ে থেকেছি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে। তার ফলে আমরা নিজেরা রাজনৈতিক ঘুঁটিতে পরিণত হয়েছি, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কোনো বর্ম তৈরি করতে পারিনি। (তুলনার জন্য ঘাতক-দালালদের বিচারের প্রশ্নটি বিবেচনা করুন। এখানেও সেই একই ঘটনা।)
সাম্প্রদায়িকতাকে যদি ঠেকাতে হয়, সরকার বা রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ভর করার পুরোনো ঐতিহ্য থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। রাজনৈতিক দল মাত্রই সবার আগে নিজেদের ফায়দা খোঁজে। তাদের সবার জন্য ধর্ম একটি রাজনৈতিক তাস মাত্র, তাকে যখন যেমন প্রয়োজন, সেভাবে তারা ব্যবহার করেছে। রামুর ঘটনায় দেখুন, সরকারি ও বিরোধী দল—সবাই একবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। না, ইসলাম রক্ষা তাদের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য ধর্মের কথা বলে যদি কিছু রাজনৈক ফায়দা আদায় করা যায়।
ধর্মের এই রাজনৈতিক ব্যবহার যদি আমরা বন্ধ করতে চাই, তা হলে সবার আগে সেই বন্ধের দাবিটি তুলতে হবে। যে তালেবানদের কথা ওপরে উল্লেখ করেছি, তারা তো আমাদের ভেতরেই বাস করে। তাদের কেউ কেউ সামাজিকভাবে সম্মানিত, সুপ্রতিষ্ঠিত। অপরাধী অথবা অপরাধীর দোসর জেনেও এই ভীরু ও কাপুরুষদের গালিচা বিছিয়ে সংবর্ধনা দিই, অনুষ্ঠানের সভাপতি করি, ভোটের সময় ঝান্ডা হাতে মিছিল করি। আর নয়, এখন সময় এসেছে আমাদের প্রত্যাখ্যানের আওয়াজ উঁচু গলায় ঘোষণা করার।
প্রত্যাখ্যানের আগুন এবার ছড়িয়ে পড়ুক।
নিউইয়র্ক, ১৫ অক্টোবর ২০১২
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
তালেবানের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মালালা মেয়ে বা তার বয়স অল্প, সেটা কোনো ব্যাপার নয়। সে যা করছিল, তা ইসলাম ধর্মের জন্য ক্ষতিকর। এমন অপরাধের জন্য পুরুষ বা নারী, তা যে বয়সেরই হোক, তাকে খুন করা মহা পুণ্যের কাজ। করাচির ডন পত্রিকায় একজন তালেবান মুখপাত্রের কথা ছাপা হয়েছে। সেই মহা পুঙ্গব যুক্তি দেখিয়েছেন, ‘যদি কেউ ভেবে থাকে যে শিক্ষার কথা বলার জন্য মালালাকে “টার্গেট” করা হয়েছিল, তা হলে সম্পূর্ণ ভুল করা হবে। মালালাকে নিশানা করা হয়েছিল কারণ সে “সেকুলারিজম” ও তথাকথিত “এনলাইটেড এডুকেশন”-এর পক্ষে যুক্তি দেখাচ্ছিল।’
মালালা জীবন-মৃত্যু নিয়ে লড়েছে। খুব কাছ থেকে তার মাথায় গুলি করা হয়েছিল। সেই গুলি মাথায় না লেগে ঘাড়ে লাগে, অস্ত্রোপচারের পর তা বের করা গেছে, কিন্তু মেয়েটি এখনো বিপদ কাটিয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি সুস্থ অবস্থায় সে ফিরতে পারবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
দ্বিতীয় তালেবান আমেরিকার। আসলে মিসর থেকে আসা এক কপ্টিক খ্রিষ্টান। লোকজন ভাড়া করে সে এক ফিল্ম বানিয়েছে, যার উদ্দেশ্য ইসলামের মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো। খুবই নিম্নমানের, কুরুচিসম্পন্ন ফিল্ম। যেসব লোক দিয়ে অভিনয় করানো হয়েছে, তারা জানত না আসলে এ রকম একটা ফিল্ম বানানো হবে। ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায়, অথচ নিজের সঠিক নামটি পর্যন্ত লুকিয়ে রেখেছিল লোকটি। ইউটিউবে আরবি অনুবাদে সেই ফিল্মের সামান্য কয়েক মিনিটের একটা ট্রেইলার ছাড়া হয়েছিল, তার না আছে মাথা, না আছে মুণ্ডু। তাই নিয়ে দেশ-বিদেশে মহা হুলুস্থুল। লিবিয়ায় আমেরিকান রাষ্ট্রদূতসহ কম করে হলেও ৫০ জন মানুষ ইতিমধ্যে হতাহত হয়েছে। সেই লোক এখন জেলে। ফিল্ম বানানোর জন্য নয়; জালিয়াতি, মিথ্যা পরিচয় ও অভিবাসন আইন ভঙ্গের অভিযোগে। এদিকে আবার তার পক্ষ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন ফ্লোরিডার এক পাদ্রি। ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পোড়ানোর আয়োজন করে বিস্তর নাম কুড়িয়েছেন তিনি। তাঁর সেসব কাণ্ড-কারখানার প্রতিবাদে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে যে হানাহানির ঘটন ঘটে, তাতে ডজন খানেক মানুষ হতাহত হয়েছে। কিন্তু তার পরও সেই লোকের টিকিটিও ছোঁয়া যায়নি, কারণ আমেরিকায় মত প্রকাশের অধিকার শাসনতান্ত্রিকভাবে স্বীকৃত। এমনকি সেই অধিকার প্রকাশের কারণে যদি খুনখারাবির মতো ঘটনা ঘটে, তবুও!
তৃতীয় তালেবান আমাদের বাংলাদেশের। মুক্তাদির নামে ছাত্রশিবিরের এক কর্মী উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ ছাত্রের ফেসবুক একাউন্টে ট্যাগ করা পবিত্র কোরআনের অবমাননাকর একটি ছবির প্রিন্ট-আউট নিয়ে রামু শহরে উত্তেজনা ও ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দেয়। আর তাই নিয়ে মানুষ—শুধু জামায়াতই নয়, অন্যান্য দলের সমর্থকেরাও আছেন—এমন আহত বোধ করেন যে ডজন খানেক বৌদ্ধমন্দির পুড়িয়ে মনের জ্বালা মিটিয়েছেন। শুনেছি, পুলিশ বাবাজিরাও দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব তাণ্ডব দেখেছেন। নিজেরা যে কত বড় ধার্মিক, তা প্রমাণ করতে হবে তো! এদের বড় ভাইয়েরাই ১৯৭১-এ ধর্মরক্ষার নামে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল। ভাবা হয়েছিল, স্বাধীনতার পর গত চার দশকে ধর্মের সেই সব ভূতকে বোতলে ঢোকানো গেছে। সে কথা যে কত বড় ভুল, রামু ও কক্সবাজারের হানাহানি থেকে তা প্রমাণিত হলো।
তিন দেশের ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা, কিন্তু তাদের মধ্যে এক সুনিশ্চিত যোগসূত্র রয়েছে। তিন দেশেই ধর্মের নামে যা করা হলো, ভদ্র ভাষায় তাকে বলা যায় ধর্মান্ধতা। পাকিস্তানি তালেবান যুবকটি ভেবেছে, মালালাকে খুন করার চেষ্টা করে সে এক মস্ত কাজ করেছে, নিজ ধর্মকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছে। আমেরিকার সেই চলচ্চিত্র নির্মাতা ও তার সেঙাত ধর্মযাজক ভেবেছেন যে অন্য ধর্মকে অবমাননা করলে নিজের ধর্ম খুব মহান বলে প্রমাণিত হয়। আর বাংলাদেশের ছাত্রটি ভেবেছে, বৌদ্ধদের ধর্মমন্দিরে আক্রমণ করে বিশেষ পুণ্যের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা মন্দ কী!
বাংলাদেশের যুবকটির মতো এক কাণ্ড করে মস্ত নাম কিনেছেন এক পাকিস্তানি মোল্লা। রিমশা নামের ১৪ বছরের এক মানসিক প্রতিবন্ধীকে গত মাসে সে দেশের ‘ধর্মীয় অবমাননা’ আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযোগ, ইসলামাবাদের মেহেরাবাদ মহল্লায় মেয়েটি কুড়ানো কাগজপত্র পোড়ানোর সময় পবিত্র কোরআনের কয়েকটি পাতাও পুড়িয়ে ফেলেছে। পরে জানা গেল, মেয়েটি নয়, হাফিজ মোহাম্মদ চিশতি নামের এক মোল্লা কোরআনের দগ্ধ কাগজ অন্যান্য পোড়া কাগজের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। তাঁর দুই সহকারী বিচারকের সামনে সাক্ষী দেওয়ার সময় জানিয়েছেন, মোল্লা চিশতিকে এমন কাজ করতে তাঁরা নিষেধ করেছিলেন। জবাবে তিনি উল্টো সবক দিয়ে বলেন, ‘খ্রিষ্টানদের দেশ থেকে তাড়ানোর এটাই একমাত্র পথ।’
বলাই বাহুল্য, এসব দুষ্কর্মের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম বা খ্রিষ্টধর্মে ভিন্নমত বা ভিন্ন ধর্মাচারের জন্য হত্যা করতে হবে বা অন্য ধর্মের নামে কুৎসা রটাতে হবে, এমন কোনো নির্দেশ নেই। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের দেশ থেকে তাড়াতে হবে, সে কথাই বা কোথায় বলা আছে? এই দুই ধর্মের মূলে রয়েছে শান্তি ও প্রেমের বাণী। বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলামের অনুসারী। তাদের বিশ্বাসের ভিত কি এতই ঠুনকো যে নাবালিকা হত্যার চেষ্টা চালাতে হবে, অন্যের ধর্মকে কলুষিত করতে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিতে হবে?
এতসব কাণ্ডের পর আঁধারে আলোর মতো এক চিলতে ঝিলিক নজরে এসেছে। তালেবানি কাণ্ডের বিরুদ্ধে এই তিন দেশের প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছে। পাকিস্তানে শিশু-কিশোরেরা রাস্তায় নেমে এসেছে, তাদের বুকে ব্যানার: আমরা সবাই মালালা। সরকারের মন্ত্রী বাহাদুররাও রাস্তায় নেমেছেন, এমনকি জামায়াতি মোল্লারাও। আমেরিকায় শুধু পত্রপত্রিকায় এই ইসলামের বিরুদ্ধে ফিল্মটি নিয়ে প্রতিবাদ ও সমালোচনা হয়েছে তা নয়, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে একাত্মতা প্রকাশ করে মিছিল করেছে, আন্তধর্ম সমাবেশ হয়েছে। রামুর ঘটনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশেও প্রতিবাদ হয়েছে সর্বস্তরে। শুধু ছাত্র-বুদ্ধিজীবীরা নন, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও প্রতিবাদ এসেছে। কিন্তু তারা নিজেরাই যেখানে সেই ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তাদের সবার হাতেই যখন বিষ্ঠা, যত বক্তৃতা-বিবৃতিই তারা দিক না কেন, তাতে বিশ্বাস হবে না। কিন্তু আশার কথা হলো, দেশের সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে মিলিত হয়েছে। বেসরকারিভাবে তদন্তের উদ্যোগ ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের তরফ থেকে নেওয়া হয়েছে। দেশের প্রতিটি প্রধান দলকেই তারা বিচারের কাঠগড়ায় তুলেছে।
ফলে রামুর ঘটনায় আহত ও উদ্বিগ্ন হয়েছি বটে, কিন্তু সঙ্গে আশান্বিতও হয়েছি।
প্রবাসে, এই নিউইয়র্কেও একাধিক সংহতি সমাবেশ হয়েছে। তার একটির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিল প্রবাসী চিত্রকর গোষ্ঠী। তাদের সঙ্গে যোগ দেন নাট্যকর্মী, সাংবাদিক, ছাত্র, কর্মজীবী। সেই সমাবেশে সবার চোখে আমি শুধু ক্রোধ দেখেছি, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দেখেছি এক গভীর বেদনাবোধ। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন আমাদের ছিল। সেই স্বপ্নকে হত্যার চেষ্টা চলছে। সেই চেষ্টা যেকোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে। জ্যাকসন হাইটসের বাঙালিপাড়ায় মোমবাতি নিয়ে হাতে হাত ধরে যারা সড়ক প্রদক্ষিণ করে, তাদের চোখে সেই শপথের প্রত্যয় দেখেছি।
এর আগেও আমরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নাগরিক প্রতিবাদের ঘটনা দেখেছি। কিন্তু সেই প্রতিবাদ কখনো আন্দোলনে পরিণত হয়নি। কারণ অসাম্প্রদায়িকতাকে আমাদের জাতীয় নীতিবোধের অবিভাজ্য অংশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি। অন্য অনেক কিছুর মতো এই প্রশ্নেও আমরা নেতৃত্বের জন্য মুখ চেয়ে তাকিয়ে থেকেছি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে। তার ফলে আমরা নিজেরা রাজনৈতিক ঘুঁটিতে পরিণত হয়েছি, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কোনো বর্ম তৈরি করতে পারিনি। (তুলনার জন্য ঘাতক-দালালদের বিচারের প্রশ্নটি বিবেচনা করুন। এখানেও সেই একই ঘটনা।)
সাম্প্রদায়িকতাকে যদি ঠেকাতে হয়, সরকার বা রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ভর করার পুরোনো ঐতিহ্য থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। রাজনৈতিক দল মাত্রই সবার আগে নিজেদের ফায়দা খোঁজে। তাদের সবার জন্য ধর্ম একটি রাজনৈতিক তাস মাত্র, তাকে যখন যেমন প্রয়োজন, সেভাবে তারা ব্যবহার করেছে। রামুর ঘটনায় দেখুন, সরকারি ও বিরোধী দল—সবাই একবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। না, ইসলাম রক্ষা তাদের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য ধর্মের কথা বলে যদি কিছু রাজনৈক ফায়দা আদায় করা যায়।
ধর্মের এই রাজনৈতিক ব্যবহার যদি আমরা বন্ধ করতে চাই, তা হলে সবার আগে সেই বন্ধের দাবিটি তুলতে হবে। যে তালেবানদের কথা ওপরে উল্লেখ করেছি, তারা তো আমাদের ভেতরেই বাস করে। তাদের কেউ কেউ সামাজিকভাবে সম্মানিত, সুপ্রতিষ্ঠিত। অপরাধী অথবা অপরাধীর দোসর জেনেও এই ভীরু ও কাপুরুষদের গালিচা বিছিয়ে সংবর্ধনা দিই, অনুষ্ঠানের সভাপতি করি, ভোটের সময় ঝান্ডা হাতে মিছিল করি। আর নয়, এখন সময় এসেছে আমাদের প্রত্যাখ্যানের আওয়াজ উঁচু গলায় ঘোষণা করার।
প্রত্যাখ্যানের আগুন এবার ছড়িয়ে পড়ুক।
নিউইয়র্ক, ১৫ অক্টোবর ২০১২
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments