অর্থ মন্ত্রণালয়-বাংলাদেশ ব্যাংক বিরোধ!

আবারও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে কথা বললেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিপক্বতা ও হলমার্ক কেলেঙ্কারির জন্য প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা নিয়েও আবার প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি, তিনি যে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও শাসনক্ষমতা দেওয়ার বিপক্ষে, তা-ও জানালেন।


অর্থমন্ত্রী গতকাল বুধবার এসব কথা বলেছেন। আর এর মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে চলতে থাকা বিরোধ আরও একবার স্পষ্ট হলো। স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির মতো ঘটনায় আগে থেকেই খানিকটা বিরোধ ছিল। এরপর হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে একাধিকবার প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সফররত একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমালোচনা করেছিলেন।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সাধারণ সভা শেষে দেশে ফিরে গতকাল অর্থমন্ত্রী কথা বলেছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো অতটা পরিপক্ব কোনো সংস্থা হয়ে উঠতে পারেনি যে এর ওপর সবকিছুই ছেড়ে দেওয়া যাবে।’ আইএমএফ তাদের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পেতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়ার শর্ত দিয়েছে। এ বিষয়েই অর্থমন্ত্রী এ কথা বলেছেন।
অর্থমন্ত্রী যা যা বললেন: গতকাল এ এম এ মুহিত বলেন, হলমার্কের ঘটনাই প্রমাণ করে যে দায়িত্ব পালনে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো পরিপক্ব হয়ে উঠতে পারেনি। এটা স্বীকার করতেই হবে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালে হলমার্কের ঘটনা জানতে পেরেছে। তখন তারা (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) বলেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের পরিচালকেরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ দিচ্ছেন। বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে আমি তিনটি বৈঠক করেছি। কিন্তু ২০১১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুই করেনি। ২০১২ সালে হঠাৎ তারা জেগে উঠে বলল, এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছে। ২০১০ থেকে ২০১২—এত দিন তারা কী করেছে?’ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্দেশে এই প্রশ্ন রাখেন মুহিত।
সমঝোতা চেয়েছিল মন্ত্রণালয়: এদিকে নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হলমার্কের সঙ্গে সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংককে নিয়ে একটা সমঝোতা চেয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। এই প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া অর্থের দায়দায়িত্ব হলমার্ককে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিয়ে ১৫-২০ বছরের জন্য তা পুনঃতফসিলের প্রচেষ্টা ছিল। এ নিয়ে এক দফা বৈঠকও হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে সম্মত ছিল না। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৌশল করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের চাপ অন্যত্র সরিয়ে দিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে পাঠিয়ে দেয় হলমার্ক কেলেঙ্কারির তথ্য-উপাত্ত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ এক পরিদর্শনে হলমার্ক কেলেঙ্কারির তথ্য-উপাত্ত উদ্ঘাটনের পর তা পাঠায় সোনালী ব্যাংকে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক চিঠিতে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (ভূতপূর্ব ঢাকা শেরাটন হোটেল) শাখার ব্যবস্থাপক ও উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এ কে এম আজিজুর রহমান এবং সহকারী মহাব্যবস্থাপক সাইফুল হাসানকে অনতিবিলম্বে অব্যাহতি দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে নির্দেশ দেয়।
এসব বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আলোচনা হয়। পরে সোনালী ব্যাংক রূপসী বাংলা শাখার ব্যবস্থাপক ও উপমহাব্যবস্থাপককে শাখা থেকে প্রত্যাহার করে দুজনকেই দিলকুশায় জিএম অফিসে রেখে রূপসী বাংলা শাখায় গুরুতর অনিয়ম করে যে ঋণ দেওয়া হয়েছে, তা আদায়ের কাজে নিযুক্ত করে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে ক্ষুব্ধ হয়। সোনালী ব্যাংক এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানায়, টাকা আদায় তারা করে ফেলতে পারবে। সে জন্যই কৌশল হিসেবে ওই দুজনকে বরখাস্ত না করে তাঁদের দিয়েই টাকা আদায় করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক তা মানেনি। কেননা, অতীতে এভাবে টাকা আদায়ের কৌশল কাজে লাগেনি। তা ছাড়া, পুনঃতফসিল করা হলে যত বছরে টাকা ফেরত আসবে, তত বছরে মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে টাকার মূল্যমান অনেক কমে যাবে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক আবারও চিঠি দিয়ে ওই দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে তাদের জানাতে নির্দেশ দেয়। কোনো উপায় না পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশ কার্যকর করে সোনালী ব্যাংক।
যোগাযোগ করা হলে গত সোমবার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদ্য সাবেক সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, হলমার্কের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য একটি সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেটি আর পরে হয়নি। শেষ পর্যন্ত মামলার পথেই যাওয়া হলো। তিনি বলেন, ‘এগুলো তো জনগণের আমানতের টাকা। টাকা আদায় কীভাবে করা যায়, সেটাই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত ছিল।’
পর্ষদ নিয়ে বিরোধ: গত সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ভাগে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে সরকারের নিয়োগ করা পরিচালকদের দু-একজন বাদে প্রায় সবার মেয়াদ শেষ হয়ে আসে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে এসব পরিচালকের মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়।
সোনালী ব্যাংকের গোটা পর্ষদ পুনর্নিয়োগ হতে পারে, এমন আভাস পেয়েই ২৬ আগস্ট অর্থমন্ত্রীকে একটি চিঠি দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬(৬) ধারা মেনে চিঠিটি দেওয়া হয়। এ বিষয়ে শফিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘সবাইকে না, কোনো কোনো পরিচালককে পুনর্নিয়োগের চিন্তা করা হয়েছিল। এর মধ্যে কয়েকজনকে পুনর্নিয়োগ দেওয়াও হয়েছে।’ পরিচালকদের ব্যাংকের ঋণ-প্রক্রিয়ার সবকিছু জানার কথা নয় বলে মনে করেন তিনি।
আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলমার্ক কেলেঙ্কারির বিষয়ে বলেছিল, ‘সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের সংঘবিধি অনুযায়ী যাবতীয় ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড দেখভালসহ (ওভারসাইট) ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্ব পরিচালনা পর্ষদের; তাই সংঘটিত অনিয়মাদির সামগ্রিক দায়দায়িত্ব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ওপরই বর্তায়। এ ক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়নি।’
এই চিঠি পাওয়ার পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২৮ আগস্ট গণমাধ্যমের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছিলেন, এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব নয়। অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে বিরোধের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়।
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য ও ২০১০-এর প্রতিবেদন: সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখায় ২০১০ সালের পরিদর্শনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখতে পায়, হলমার্ক গ্রুপের পক্ষে তিনটি কোম্পানির অনুকূলে ৪৮ লাখ ৯৩ হাজার মার্কিন ডলার ঋণপত্রের বিপরীতে সীমাতিরিক্ত প্রাক্-জাহাজীকরণ ঋণ দেওয়া হয়েছে। প্রাক্-জাহাজীকরণ ঋণসীমা হলো রপ্তানিমূল্যের (এফওবি) ১০ শতাংশ। কিন্তু হলমার্কের একটা কোম্পানিকে দেওয়া হয় ১৮ শতাংশ আর অন্য দুই কোম্পানিকে দেওয়া হয় ১২ শতাংশ হারে।
২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক যখন রূপসী বাংলা শাখায় পরিদর্শনকাজ চালায়, তখন এই শাখার আমানতের পরিমাণ ছিল ৬৯৩ কোটি টাকা। এর বিপরীতে শাখার ঋণ বিতরণ করা ছিল মাত্র ৪৫ কোটি টাকা। বাকি টাকার মধ্যে ৬০০ কোটি টাকা প্রধান কার্যালয়ে বিনিয়োগ করে রূপসী বাংলা শাখা। ফলে শাখাটির আমানত ভিত্তি অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোনালী ব্যাংককে কিছু নির্দেশনা দিয়ে তা পালন করতে বলে। এর জবাবে ২০১০ সালের ১৩ অক্টোবর সোনালী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়ে জানায়, ঋণ আদায় করে সীমার মধ্যে আনা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে সীমাতিরিক্ত সুবিধা যেন আর না দেওয়া হয়, সে বিষয়ে ব্যাংক সতর্ক থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ব্যাংক খাতের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ হয় এমন শাখাগুলোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রতিবছর সাধারণ পরিদর্শন করা হয়। বাকি সব শাখা পরিদর্শন শেষ করা যায় প্রতি চার বছরে। রূপসী বাংলা শাখার ঋণ বিতরণ আগে এতই কম ছিল যে সাধারণ পরিদর্শনের আওতায় এই শাখায় আসতে চার বছর লাগত। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক একটি অভিযোগ পাওয়ায় সেই অভিযোগের বিষয় খতিয়ে দেখতেই বিশেষ পরিদর্শনকাজ চালিয়ে হলমার্ক কেলেঙ্কারির তথ্য চিহ্নিত করে।
আইএমএফ প্রসঙ্গ: অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিয়েছে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা নিয়েও। অর্থমন্ত্রী গতকাল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘পুঁজিবাজারে ব্যাংকের সার্বিক বিনিয়োগসীমা ২৫ শতাংশে আটকে রাখতে বলেছে আইএমএফ। আমরা বলেছি এটা ৪০ শতাংশ করতে। বর্তমানে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারে, সে তুলনায় ২৫ শতাংশ অনেক কম হয়ে যায়। এই হার এমনকি ৪৫ শতাংশ পর্যন্তও করা যায়। তবে পর্যায়ক্রমে তা ৩০ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে।’
আইএমএফের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিনিয়োগসীমা ২৫ শতাংশ রাখার পক্ষে।
বিরোধসহ সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ কথা বলতে চাননি। তবে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দক্ষ জনবল আকৃষ্ট করতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্যও স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো প্রয়োজন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা মন্তব্য করেন। যদিও স্বতন্ত্র বেতনকাঠামোর একটি প্রস্তাব তিন বছর ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে। আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের মূল কাজ ছেড়ে জনতুষ্টির চেষ্টায় নানা কাজে যুক্ত হয়েছে। এ কারণে তদারকি দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.