গরুর হাটে এক দিন...
কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান শহীদুজ্জামান সেলিম বড় হয়েছি যাত্রাবাড়ীতে। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় কোরবানির ঈদে স্বভাবতই আমার ওপর বেশকিছু দায়িত্ব বর্তায়—গরু কেনা, এর দেখভাল করা ইত্যাদি।
ছেলেবেলায় এই কাজগুলো আমি খুব আগ্রহের সঙ্গেই করতাম।
যাত্রাবাড়ী ও পুরান ঢাকা গায়ে-গায়ে লাগোয়া। তাই আমাদের বেড়ে ওঠার মধ্যে পুরান ঢাকার একটা আবহ ছিল। আর পুরান ঢাকার ঈদ মানে তো নানা রঙের বাহার। কোরবানি ঈদে সেই রং যেন আরও খোলতাই হয়ে উঠত।
মনে পড়ে, বর্ণময় ঈদের গায়ে আরও হরেক রং লাগতে শুরু করত কোরবানির পশু কেনার মধ্য দিয়ে। বেশির ভাগ সময় গরুই কিনতাম আমরা। বিশেষ করে গরু কেনার দুই-তিন দিন আগ থেকে গরু কিনতে যাব, গরু কিনতে যাব বলে আমার ছোট্ট মনে যে রব উঠত, না কেনা পর্যন্ত তা আর থামত না।
সাধারণত ডেমরা বা নারায়ণগঞ্জের হাট থেকে গরু কিনতাম আমরা; আব্বা, আমি এবং এক রাখাল—সব মিলিয়ে আমরা তিনজন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একসময় পছন্দসই গরু মিলত। তারপর আমার হাতে সেই গরুর দড়ি বুঝিয়ে দিয়ে আব্বা আগেভাগেই চলতেন বাড়ির পথে। নারায়ণগঞ্জ থেকে যাত্রাবাড়ী। দীর্ঘ পথ হেঁটে কোরবানির গরু নিয়ে ফিরছি আমি। এই স্মৃতি আজও মনে পড়ে।
তবে গরু কেনাকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিগতভাবে আমার তেমন মজার কোনো স্মৃতি না থাকলেও, একটি মজার ঘটনার সাক্ষী আমি।
আজ থেকে প্রায় সাত-আট বছর আগের কথা। সেবার কোরবানির ঈদে আমার দুই ভগ্নিপতি হুমায়ুন পাঠান ও সারবি গরু কিনতে যাবেন। এ নিয়ে তাঁদের উৎসাহের শেষ নেই। নির্দিষ্ট দিনে আরমানিটোলার হাট থেকে গরু কিনে সহি-সালামতে তাঁরা বাড়ি ফিরে এলেন। তাঁদের চোখে-মুখে তখন এমন খুশির ঝিলিক, যেন মনে হচ্ছে, দুই বীর রাজ্য জয় করে ফিরেছেন।
এর মধ্যে হঠাৎ বীরত্বে কালিমা লেপন—ঘটল অঘটন। দড়ি ছিঁড়ে গরু দিল ছুট। তৎক্ষণাৎ আমার বীর ভগ্নিপতিদ্বয়ও ছুটলেন। গরু দৌড়ায়, পিছু পিছু দৌড়ান তাঁরাও।
দিনের আলো ফুরিয়ে একসময় রাত নামল। এদিকে যাত্রাবাড়ীর সীমানা পেরিয়ে গরুটি তখন ঢুকে পড়েছে পাশের এলাকায়। অগত্যা তাই গরুর পিছু পিছু তাঁরাও চষে বেড়াচ্ছেন পাশের পুরান ঢাকার অলিগলি। অবস্থা এমন, ‘কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান।’ অবশেষে যখন গরুর নাগাল পাওয়া গেল, তখন প্রায় ভোর হয়-হয়। ইতিমধ্যে গরু ও আমার দুই ভগ্নিপতি—উভয়ের নাকাল অবস্থা।
শেষ রাতের দিকে চরম ক্লান্তি নিয়ে গরুর দড়ি হাতে ফিরে এলেন দুই বীর। তবে সেদিন এই দুই বীরের কীর্তি দেখে খুবই মজা পেয়েছিলাম। হয়তো আনমনেই বলেছিলাম, ‘আহা বেচারা!’ প্রতি কোরবানির ঈদে এই স্মৃতি মনে এলে অজান্তেই হাসি পায় আমার।
যেন সত্যিই ‘গরু’ হয়ে গেছি!
জাহিদ হাসান
একবার কোরবানির হাটে গরু কিনতে গিয়ে নিজেই যেন ‘গরু’ বনে গিয়েছিলাম।
ঘটনাটি দুই-তিন বছর আগের। সেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ঢাকায় ঈদ করব। তাই কোরবানির দিন কয়েক আগে ছেলেমেয়ে পূর্ণ ও পুষ্পিতাকে নিয়ে মহা উৎসাহে গেলাম মোহাম্মদপুরের গরুর হাটে। পছন্দ করে দরদাম করে গরু কিনব, এমন ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে গেল সেখানে পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই।
সবাই গরু দেখে জটলা করবে কি, আমায় দেখে মুহূর্তেই জড়ো হতে শুরু করল আমার চারপাশে! সবার হাতে হাতে মুঠোফোন, ফলে পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার মওকা কেউ কি ছাড়তে চায়? অন্যদিকে, আমার ছেলেমেয়েকে আদর করল কেউ কেউ। কেউ আবার আরেক ধাপ এগিয়ে বলল, ‘জাহিদ ভাই, মৌ আপা এল না কেন? তাকে নিয়ে এলেই পারতেন।’
একসময় দেখি, গরুর হাটে গরুর পাশে তেমন লোকজন নেই। সব ভিড় তখন আমাকে ঘিরে। সে সময় মনে হচ্ছিল, যেন সত্যিই আমি ‘গরু’ হয়ে গেছি!
কিছু মানুষ হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছে!
সজল
কোরবানির ঈদ মানে নানা স্মৃতি, নানা রকম আয়োজন। কেন যেন ঈদ এলে ছোটবেলার স্মৃতিগুলোই ফিরে আসে বারবার। শৈশবে কী যে উত্তেজনা ছিল কোরবানির গরু নিয়ে। গরুর দেখভাল করার দায়িত্ব যেন আর কারও নয়, আমার একার। আমাদের পরিবারটি বেশ বড়। তাই ঈদও হতো জম্পেশ।
সাত-আট বছর আগে একবার আমাদের ওপর দায়িত্ব পড়ল গরু কেনার। আমরা মানে আমি ও আমার চাচাতো ভাইয়েরা। তখন আমাদের তারুণ্যের প্রথম প্রহর।
গরু কিনতে যাব, মনে আমাদের খুশি আর ধরে না। অনেক ভেবেচিন্তে হাজারীবাগের গরুর হাটে গেলাম। রাত তখন ১২টার মতো বাজে। আলো-ঝলমলে পরিবেশে মানুষ ও কোরবানির পশু—সবই একাকার। মধ্যরাতেও মানুষের ভিড় কমেনি।
এদিকে লোকে লোকারণ্য অবস্থা দেখে সে সময় বেশ ভড়কে গেছি আমরা। ভাবছি, কী করব? এমন সময় দেখি, বেশ স্বাস্থ্যবান অনেকটা ষাঁড়ের মতো একটি গরু কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরছে একজন। আমাদের চোখ সে মুহূর্তে ওই লোকসহ ষাঁড়মার্কা গরুটির দিকে। খাড়া শিংয়ের মাথায় কী চমৎকার মালা প্যাঁচানো! এর মধ্যে অকস্মাৎ দেখলাম, কিছু মানুষ হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছে!
ব্যাপার কী? ষাঁড়ের মতো ওই গরুটি হঠাৎ রেগেমেগে মালিকের হাত থেকে ছুটে ঝাঁপিয়ে পড়েছে হাটের মানুষের ওপর। তাই সবার এমন হুড়মুড় অবস্থা। সংবাদপত্রের ভাষায় ‘ভীতসন্ত্রস্ত’ অবস্থা।
ওদিকে এক পলকের মধ্যে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় আমরা ভয় পেয়েছি বটে, তবে আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ, তখন সাইজে ছোট ছিলাম বলে লোকজনের ভিড়ভাট্টা ঠেলে বিভিন্ন কোনাকাঞ্চি ডিঙিয়ে নিরাপদ স্থানে যেতে পেরেছিলাম আমরা।
ভাইভাগার মিলে এ ঘটনায় সে সময় বেশ মজা লুটেছিলাম। তবে ওই মজাই সার, ওই রাতে আর কোরবানির গরু কেনা হয়নি আমাদের।
অনুলিখিত
যাত্রাবাড়ী ও পুরান ঢাকা গায়ে-গায়ে লাগোয়া। তাই আমাদের বেড়ে ওঠার মধ্যে পুরান ঢাকার একটা আবহ ছিল। আর পুরান ঢাকার ঈদ মানে তো নানা রঙের বাহার। কোরবানি ঈদে সেই রং যেন আরও খোলতাই হয়ে উঠত।
মনে পড়ে, বর্ণময় ঈদের গায়ে আরও হরেক রং লাগতে শুরু করত কোরবানির পশু কেনার মধ্য দিয়ে। বেশির ভাগ সময় গরুই কিনতাম আমরা। বিশেষ করে গরু কেনার দুই-তিন দিন আগ থেকে গরু কিনতে যাব, গরু কিনতে যাব বলে আমার ছোট্ট মনে যে রব উঠত, না কেনা পর্যন্ত তা আর থামত না।
সাধারণত ডেমরা বা নারায়ণগঞ্জের হাট থেকে গরু কিনতাম আমরা; আব্বা, আমি এবং এক রাখাল—সব মিলিয়ে আমরা তিনজন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একসময় পছন্দসই গরু মিলত। তারপর আমার হাতে সেই গরুর দড়ি বুঝিয়ে দিয়ে আব্বা আগেভাগেই চলতেন বাড়ির পথে। নারায়ণগঞ্জ থেকে যাত্রাবাড়ী। দীর্ঘ পথ হেঁটে কোরবানির গরু নিয়ে ফিরছি আমি। এই স্মৃতি আজও মনে পড়ে।
তবে গরু কেনাকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিগতভাবে আমার তেমন মজার কোনো স্মৃতি না থাকলেও, একটি মজার ঘটনার সাক্ষী আমি।
আজ থেকে প্রায় সাত-আট বছর আগের কথা। সেবার কোরবানির ঈদে আমার দুই ভগ্নিপতি হুমায়ুন পাঠান ও সারবি গরু কিনতে যাবেন। এ নিয়ে তাঁদের উৎসাহের শেষ নেই। নির্দিষ্ট দিনে আরমানিটোলার হাট থেকে গরু কিনে সহি-সালামতে তাঁরা বাড়ি ফিরে এলেন। তাঁদের চোখে-মুখে তখন এমন খুশির ঝিলিক, যেন মনে হচ্ছে, দুই বীর রাজ্য জয় করে ফিরেছেন।
এর মধ্যে হঠাৎ বীরত্বে কালিমা লেপন—ঘটল অঘটন। দড়ি ছিঁড়ে গরু দিল ছুট। তৎক্ষণাৎ আমার বীর ভগ্নিপতিদ্বয়ও ছুটলেন। গরু দৌড়ায়, পিছু পিছু দৌড়ান তাঁরাও।
দিনের আলো ফুরিয়ে একসময় রাত নামল। এদিকে যাত্রাবাড়ীর সীমানা পেরিয়ে গরুটি তখন ঢুকে পড়েছে পাশের এলাকায়। অগত্যা তাই গরুর পিছু পিছু তাঁরাও চষে বেড়াচ্ছেন পাশের পুরান ঢাকার অলিগলি। অবস্থা এমন, ‘কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান।’ অবশেষে যখন গরুর নাগাল পাওয়া গেল, তখন প্রায় ভোর হয়-হয়। ইতিমধ্যে গরু ও আমার দুই ভগ্নিপতি—উভয়ের নাকাল অবস্থা।
শেষ রাতের দিকে চরম ক্লান্তি নিয়ে গরুর দড়ি হাতে ফিরে এলেন দুই বীর। তবে সেদিন এই দুই বীরের কীর্তি দেখে খুবই মজা পেয়েছিলাম। হয়তো আনমনেই বলেছিলাম, ‘আহা বেচারা!’ প্রতি কোরবানির ঈদে এই স্মৃতি মনে এলে অজান্তেই হাসি পায় আমার।
যেন সত্যিই ‘গরু’ হয়ে গেছি!
জাহিদ হাসান
একবার কোরবানির হাটে গরু কিনতে গিয়ে নিজেই যেন ‘গরু’ বনে গিয়েছিলাম।
ঘটনাটি দুই-তিন বছর আগের। সেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ঢাকায় ঈদ করব। তাই কোরবানির দিন কয়েক আগে ছেলেমেয়ে পূর্ণ ও পুষ্পিতাকে নিয়ে মহা উৎসাহে গেলাম মোহাম্মদপুরের গরুর হাটে। পছন্দ করে দরদাম করে গরু কিনব, এমন ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে গেল সেখানে পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই।
সবাই গরু দেখে জটলা করবে কি, আমায় দেখে মুহূর্তেই জড়ো হতে শুরু করল আমার চারপাশে! সবার হাতে হাতে মুঠোফোন, ফলে পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার মওকা কেউ কি ছাড়তে চায়? অন্যদিকে, আমার ছেলেমেয়েকে আদর করল কেউ কেউ। কেউ আবার আরেক ধাপ এগিয়ে বলল, ‘জাহিদ ভাই, মৌ আপা এল না কেন? তাকে নিয়ে এলেই পারতেন।’
একসময় দেখি, গরুর হাটে গরুর পাশে তেমন লোকজন নেই। সব ভিড় তখন আমাকে ঘিরে। সে সময় মনে হচ্ছিল, যেন সত্যিই আমি ‘গরু’ হয়ে গেছি!
কিছু মানুষ হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছে!
সজল
কোরবানির ঈদ মানে নানা স্মৃতি, নানা রকম আয়োজন। কেন যেন ঈদ এলে ছোটবেলার স্মৃতিগুলোই ফিরে আসে বারবার। শৈশবে কী যে উত্তেজনা ছিল কোরবানির গরু নিয়ে। গরুর দেখভাল করার দায়িত্ব যেন আর কারও নয়, আমার একার। আমাদের পরিবারটি বেশ বড়। তাই ঈদও হতো জম্পেশ।
সাত-আট বছর আগে একবার আমাদের ওপর দায়িত্ব পড়ল গরু কেনার। আমরা মানে আমি ও আমার চাচাতো ভাইয়েরা। তখন আমাদের তারুণ্যের প্রথম প্রহর।
গরু কিনতে যাব, মনে আমাদের খুশি আর ধরে না। অনেক ভেবেচিন্তে হাজারীবাগের গরুর হাটে গেলাম। রাত তখন ১২টার মতো বাজে। আলো-ঝলমলে পরিবেশে মানুষ ও কোরবানির পশু—সবই একাকার। মধ্যরাতেও মানুষের ভিড় কমেনি।
এদিকে লোকে লোকারণ্য অবস্থা দেখে সে সময় বেশ ভড়কে গেছি আমরা। ভাবছি, কী করব? এমন সময় দেখি, বেশ স্বাস্থ্যবান অনেকটা ষাঁড়ের মতো একটি গরু কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরছে একজন। আমাদের চোখ সে মুহূর্তে ওই লোকসহ ষাঁড়মার্কা গরুটির দিকে। খাড়া শিংয়ের মাথায় কী চমৎকার মালা প্যাঁচানো! এর মধ্যে অকস্মাৎ দেখলাম, কিছু মানুষ হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছে!
ব্যাপার কী? ষাঁড়ের মতো ওই গরুটি হঠাৎ রেগেমেগে মালিকের হাত থেকে ছুটে ঝাঁপিয়ে পড়েছে হাটের মানুষের ওপর। তাই সবার এমন হুড়মুড় অবস্থা। সংবাদপত্রের ভাষায় ‘ভীতসন্ত্রস্ত’ অবস্থা।
ওদিকে এক পলকের মধ্যে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় আমরা ভয় পেয়েছি বটে, তবে আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ, তখন সাইজে ছোট ছিলাম বলে লোকজনের ভিড়ভাট্টা ঠেলে বিভিন্ন কোনাকাঞ্চি ডিঙিয়ে নিরাপদ স্থানে যেতে পেরেছিলাম আমরা।
ভাইভাগার মিলে এ ঘটনায় সে সময় বেশ মজা লুটেছিলাম। তবে ওই মজাই সার, ওই রাতে আর কোরবানির গরু কেনা হয়নি আমাদের।
অনুলিখিত
No comments